জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা

সব সময় মনে রাখতে হবে, আমরা কিন্তু যুদ্ধাবস্থায় আছি

কালের কণ্ঠ ডেস্ক
কালের কণ্ঠ ডেস্ক
শেয়ার
সব সময় মনে রাখতে হবে, আমরা কিন্তু যুদ্ধাবস্থায় আছি
ড. মুহাম্মদ ইউনূস

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দেশবাসীকে আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম পর্ব সফলভাবে সমাপ্ত হয়েছে। প্রথম পর্বের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে অভ্যুত্থানের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হলো। সব সময় মনে রাখতে হবে, আমরা কিন্তু যুদ্ধাবস্থায় আছি। গুজব হলো এই জুলাই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে পরাজিত শক্তির মস্ত বড় হাতিয়ার।

গুজব দেখলেই সূত্রের সন্ধান করতে থাকবেন। বহু অভিজ্ঞ সমরবিশারদ এই গুজবের পেছনে দিনরাত কাজ করছেন, সীমাহীন অর্থ এর পেছনে নিয়োজিত আছে। এর মূল লক্ষ্য জুলাই অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করা। আমরা তাকে ব্যর্থ হতে দেব না।

মহান স্বাধীনতা দিবস ও পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানিয়ে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার সময় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। একই সঙ্গে চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত হাজারো শহীদ ও আহত, যাঁরা বৈষম্য, শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের প্রতি সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ সালাম জানান।

পবিত্র রমজানের সিয়াম সাধনা উপলক্ষে দেশবাসীকে তিনি আন্তরিক মোবারকবাদ এবং পবিত্র ঈদুল ফিতরের অগ্রিম শুভেচ্ছা জানান।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমাদের সামগ্রিক ঐক্য পলাতক শক্তির গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে। তারা এই ঐক্য ভাঙতে চায়। তাদের অভিনব কৌশল আপনি টেরই পাবেন না। আপনি বুঝতেই পারছেন নাকখন তাদের খেলায় আপনি পুতুল হয়ে গেছেন। তিনি বলেন, আমাদের সচেতনতা এবং সামগ্রিক ঐক্য দিয়েই এই গুজবকে রুখতে হবে।

পলাতক অপশক্তির ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দিতে হবে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দলের মতামত নেওয়ার কাজ এখন চলমান। কমিশনের লক্ষ্য হচ্ছে যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে, সেগুলো চিহ্নিত করা এবং তার একটা তালিকা প্রস্তুত করা। এই তালিকাই হবে জুলাই চার্টার বা জুলাই সনদ। তিনি বলেন, আমাদের দায়িত্ব জাতির সামনে পুরো প্রক্রিয়া স্বচ্ছভাবে তুলে ধরা এবং প্রক্রিয়া শেষে নির্বাচনের আয়োজন করা।

ড. ইউনূস বলেন, নির্বাচনের ব্যাপারে আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি, এ বছর ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। আমরা চাই, আগামী নির্বাচনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক। এ জন্য নির্বাচন কমিশন সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় নির্বাচনের জন্য তৈরি হতে শুরু করবে বলে আশা করছি।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরেছে, ক্রমান্বয়ে অর্থনীতির অন্য সূচকগুলো ইতিবাচক ধারায় ফিরতে শুরু করছে। এ সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি। ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ৯.৩২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে, যা ২২ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ রেকর্ড গড়েছে; প্রায় ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে আড়াই বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। রেমিট্যান্স-যোদ্ধারা যেন ভোগান্তির শিকার না হন, দূতাবাস যেন ঠিকমতো কাজ করে, এটি নিশ্চিত করার জন্য আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।

ড. ইউনূস বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শীর্ষস্থানীয় বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করে যাচ্ছে। তারা বাংলাদেশের বর্তমান ব্যবস্থায় বিনিয়োগের বিষয়ে খুবই আগ্রহী। আশা করছি, দ্রুততম সময়ে দেশে নতুন নতুন বিদেশি বিনিয়োগ আপনারা দেখতে পাবেন।

তিনি বলেন, সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশে রপ্তানি ১৩ শতাংশ বেড়েছে। জানুয়ারিতে ৭ শতাংশ কনটেইনার হ্যান্ডলিং বেড়েছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আগামী মাসে ঢাকায় চার দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন করছে, বিশ্বখ্যাত অনেক বিনিয়োগকারী এতে অংশ নেবেন।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আগামীকাল চার দিনের সফরে আমি চীন যাচ্ছি। প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের সঙ্গে আমার বৈঠক হবে। চীনের বড় বড় ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সিইওদের সঙ্গেও বৈঠক করব। তিনি বলেন, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ চায়নিজ সোলার প্যানেল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লংজি বাংলাদেশে কারখানা স্থাপনের আগ্রহ জানিয়েছে। আমরা তাদের সঙ্গে কাজ করছি। এ ছাড়া প্রযুক্তিগত সহায়তা, মেডিক্যাল সহায়তা, স্বল্প মূল্যে চিকিৎসাসহ অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা হবে। এই সফরের মধ্য দিয়ে আমাদের দুই দেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হবে।

ড. ইউনূস বলেন, আপনারা শুনেছেন, আমি স্টারলিংকের প্রতিষ্ঠাতা এবং বিশ্বের শীর্ষ ধনকুবের স্পেসএক্স ও টেসলার মালিক ইলন মাস্কের সঙ্গে ফোনে আলাপ করে বাংলাদেশে স্টারলিংকের কার্যক্রম শুরু করার আহ্বান জানিয়েছি। সে অনুসারে কম্পানির প্রতিনিধিরা এখন বাংলাদেশে তাঁদের কার্যক্রম শুরুর আয়োজন করছেন। তাঁদের সঙ্গে তিন মাসের মধ্যে বাণিজ্যিক চুক্তি চূড়ান্ত করার কাজ চলছে।

তিনি বলেন, স্টারলিংকের মাধ্যমে স্বল্প মূল্যে উচ্চগতির ইন্টারনেট বাংলাদেশের ডিজিটাল জগতে একটি বিপ্লব আনবে। স্টারলিংক সেবা চালু হলে দেশের প্রতিটি গ্রাম, দ্বীপাঞ্চল, দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল অতি উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবার আওতায় চলে আসবে।

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ চান জামায়াতের আমির

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ চান জামায়াতের আমির
শফিকুর রহমান

ষড়যন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে সরকারকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। দেশবাসীকে পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা জানিয়ে গতকাল শুক্রবার এক বিবৃতিতে তিনি এ আহ্বান জানান।

জামায়াতের আমির বলেন, এক মাস পবিত্র সিয়াম সাধনার পরে আনন্দের বার্তা নিয়ে পবিত্র ঈদুল ফিতর আমাদের দুয়ারে সমাগত। জাতি এমন এক মুহূর্তে পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন করতে যাচ্ছে, যখন দেশ ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীনতা অর্জন করেছে।

দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের জগদ্দল পাথরের ন্যায় চেপে বসা জালিমের হাত থেকে মুক্ত হয়ে দেশের মানুষ মুক্ত পরিবেশে শ্বাস নিতে পারছে। দেশের মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছে এবং শান্তিতে-স্বস্তিতে চলাফেরা করতে পারছে।

জামায়াতের আমির আরো বলেন, যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে জাতি শান্তি-স্বস্তির দেশ পেয়েছে এবং কথা বলার সুযোগ পেয়েছে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের শহীদ হিসেবে কবুল করুন। আর যারা পঙ্গুত্ববরণ করেছেন ও আহত হয়েছেন আমরা তাঁদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি।

জামায়াতের আমির বলেন, দেশ থেকে ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচার পালিয়ে গেলেও তারা বিদেশে বসে এবং দেশে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা তাদের দোসরদের দিয়ে দেশে নানাভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেই যাচ্ছে। দেশে যাতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হতে পারে, সে জন্য নানাভাবে বিতর্ক এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। এ অবস্থার অবসান ঘটিয়ে সরকারকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। 

ডা. শফিকুর রহমান বলেন, মানুষের মধ্যে আল্লাহর ভয় তথা তাকওয়ার গুণাবলি সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে আল্লাহর বিধান মেনে চলার দীর্ঘ প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের মাঝে আগমন করছে পবিত্র ঈদুল ফিতর।

মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর পবিত্র ঈদুল ফিতর মুসলমানদের জীবনে শান্তি ও আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। পবিত্র ঈদুল ফিতর ধনী-গরিব সব শ্রেণির মুসলমানের মধ্যে নিবিড় ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করে। 

তিনি বলেন, পবিত্র ঈদের এই দিনে আমরা সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে মানুষে মানুষে দয়া, সৌভ্রাতৃত্ব, সাম্য, ঐক্য ও ভালোবাসার এক মহা সেতুবন্ধ তৈরি করি। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে একটি হিংসা ও বিদ্বেষমুক্ত সমাজ গঠনে তৎপর হই এবং সমাজের অবহেলিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসি এবং একে অপরের সুখানন্দ ও দুঃখ-কষ্ট ভাগ করে নিই।

জামায়াতের আমির সবার সুখ-শান্তি, সমৃদ্ধি, সুস্বাস্থ্য ও নিরাপদ জীবন কামনা করেন।

 

মন্তব্য

আমরা এখন পর্যন্ত গণতন্ত্র ফিরে পাইনি : ফখরুল

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি
ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি
শেয়ার
আমরা এখন পর্যন্ত গণতন্ত্র ফিরে পাইনি : ফখরুল
মির্জা ফখরুল

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা মুক্ত হতে পেরেছি। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত গণতন্ত্র ফিরে পাইনি এবং আমরা নির্বাচন পাইনি। নির্বাচন পেতে হলে আমাদের মধ্যে ঐক্যকে আরো অটুট রাখতে হবে।

গতকাল শুক্রবার বিকেলে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রুহিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে রুহিয়া থানা স্বেচ্ছাসেবক দল আয়োজিত ইফতার মাহফিলে ভার্চুয়ালি বক্তব্যে মির্জা ফখরুল এসব কথা বলেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ফখরুল বলেন, আমাদের জনগণের কাছে যেতে হবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।

এ সময় আরো বক্তব্য দেন বিএনপির রংপুর বিভাগীয় পর্যবেক্ষণ টিমের সহসভাপতি মফিদুল আলম খান, কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-আইনবিষয়ক সম্পাদক জাকির হোসেন, ঠাকুরগাঁও স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক মাসুদুল ইসলাম, সদস্যসচিব কামরুজ্জামান প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রুহিয়া থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি মোহাম্মদ বেলাল হোসেন এবং সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক জিল্লুুর রহমান।

 

 

মন্তব্য
অন্য জীবন

মোহনের সেই বিভীষিকার রাত

পিন্টু রঞ্জন অর্ক
পিন্টু রঞ্জন অর্ক
শেয়ার
মোহনের সেই বিভীষিকার রাত
জগন্নাথ হলে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও গণসমাধির সামনে মোহন রায়। ছবি : কালের কণ্ঠ

তখনো সূর্যের আলো ফোটেনি। দূর থেকে আসছে কান্নার শব্দ। এ যেন স্বজন হারানোর বেদনা। জগন্নাথ হলের গণসমাধির দিক থেকে আসছে কান্নার আওয়াজ।

কাছে গিয়ে দেখা গেল, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও গণসমাধির নিচে ঘাসের ওপর বসে কাঁদছেন এক ভদ্রলোক। পরনে নীল ফুলহাতা শার্ট, কালো প্যান্ট। একবার হাত দিয়ে গণসমাধি ছুঁয়ে দেখছেন, আরেকবার সবুজ ঘাস। চোখের জল যেন কিছুতেই বাঁধ মানছে না।
মিনিট দুয়েক পর পিঠে হাত দিলাম—‘দাদা কাঁদছেন কেন?

পেছন ফিরে তাকালেন। শার্টের হাতায় চোখ মুছে বললেন, ভাই, আজ ২৫ মার্চ। দিনটা এলে নিজেকে কিছুতেই স্থির রাখতে পারি না। একাত্তরের এই দিনে এই সবুজ চত্বর রাঙা হয়েছিল আমার স্বজনদের রক্তে।

কত যে লাশ টেনেছিলাম!

বলতে বলতে গলা ধরে আসে তাঁর। শুধু যে স্বজন বা পরিচিতদের হারিয়েছেন তা নয়, সেদিন নিজেও মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলেন।

নাম তাঁর মোহন রায়। পেশায় মালি। এখন ঢাকার বাংলামোটরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন।

থাকেন আজিমপুর। বয়স সত্তরের ঘরে। কিন্তু দেখলে বোঝার উপায় নেই। এই বয়সেও নিয়মিত সাইকেল চালিয়ে যাতায়াত করেন।

২৫ মার্চ জগন্নাথ হল ও তত্সংলগ্ন এলাকায় গণহত্যার শিকার লাশগুলো জগন্নাথ হলের মাঠে জড়ো করার পর সবার সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন মোহন। পায়ে গুলি লাগলেও বেঁচে যান। জীবন-মৃত্যুর সংকটময় সময়ে মানবতার ডাকে সহযোদ্ধাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন।

স্কুলে যাওয়া হয়নি : মোহনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। অভাব মোহনদের সংসারে বারো মাসের গল্প। স্কুলে ভর্তি হতে পারেননি। তবে নাম-ঠিকানা লিখতে পারেন। তাঁর বাবা বাসু রাজভর ফজলুল হক হলের মালি ছিলেন। মোহন ঢাকা ক্লাবে টেনিস বয় হিসেবে কাজ করেছেন কয়েক বছর। সেই সুবাদে কাজ চালানোর মতো উর্দু বলতে পারতেন। পরে চাকরি পেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে।

সেদিন জ্বর ছিল তাঁর : জগন্নাথ হলে রবীন্দ্রভবনের পেছনের পূর্ব পাশটায় ছিল মোহনদের বাসা। একাত্তরে তিনি ২০ বছরের তরুণ। ঢাকার রাজপথ উত্তপ্ত। মোহনরা টের পাচ্ছিলেন বড় কিছু একটা ঘটতে চলেছে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণও শুনেছিলেন রেসকোর্স ময়দানে বসে। ২৫ মার্চ দুপুর থেকেই জ্বর ছিল তাঁর। শরীরটাও ছিল ক্লান্ত। সন্ধ্যার একটু পর ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুম ভাঙে গোলাগুলির শব্দে। উঠে দেখেন লাল আলো এবং ধোঁয়া। হলের পাশের মেইন রোডে পাক সেনাদের অনেক গাড়ি। হলের ভেতরে দলে দলে সেনারা প্রবেশ করছে। অনবরত গুলির আওয়াজ। বাড়ির সবাই মিলে চৌকির নিচে আশ্রয় নিলেন। আক্রমণটা শুরু হলো রাত ১২টার দিকে। চারদিকে শুধু বাঁচাও-বাঁচাও শব্দ। হানাদারদের একটা গাড়ি তাঁদের বাসার সামনে রাখল। আর্মিরা দরজা খুলতে বলল। বাসু রাজভর উঠে দরজা খুলে দিলেন। ওরা সবাইকে বের হতে বলল। মোহন উর্দুতে বলেছিলেন, হাম লোক কৈ কাছর নেই হ্যায়, হাম লোককা উপর ক্যা জুলুমছে আয়া। ওরা বলল, তুম লোক উর্দুমে বাত চিতকে বাতায়া সামাজ মে নেহি তো হাম মেজর সাব কো বোলায়া।

জি সি দেব পড়ে ছিলেন মেঝেতে : মোহন মাঠে এসে দেখেন, টিনশেডের ছাত্রাবাস, সোনালি ব্যাংক জ্বলছে। মেজরের সামনে থেকে সেনারা মোহনদের ডেকে নিয়ে গেল লাশ টানার জন্য। বাংলা এবং উর্দু বলতে পারে যারাদুটো দলে ভাগ করল তাদের। দুই গ্রুপ সৈন্য ভার নিল কাজ করানোর। বাংলাভাষী গ্রুপ কাজ শুরু করল হলের ভেতর, আর অন্য গ্রুপকে নিয়ে গেল শিববাড়ীর দিকে।

মোহন বলেন, আমরা সামনে, পেছনে সেনারা। রাইফেল তাক করাযেন পালাতে না পারি। বুধিরাম, মিস্ত্রি, জহরলালসহ আমার সঙ্গে আরো পাঁচজন ছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব। থাকতেন শিববাড়ীসংলগ্ন শিক্ষক কোয়ার্টারে। মোহনরা গিয়ে দেখেন ঘরের দরজা বন্ধ। পাক সেনারা লাথি মেরে ভাঙল। মোহন বলেন, ঘরের ভেতরে আর কেউ ছিল না। বাইরে থেকে জানালা দিয়ে দেব বাবুকে ওরা গুলি করেছে। ঘরে ঢুকে দেখি, দেববাবু মেঝেতে পড়ে আছেন। আমরা তাঁর লাশ টেনে নিয়ে বর্তমান জগন্নাথ হল শহীদ মিনারের কাছে রাখি। রক্তমাখা ভারী শরীর। আনার সময় তাঁর পরনের ধুতিটা খুলে গিয়েছিল। তখন লাশটা মাটিতে রেখে ধুতিটা ঠিক করে দিচ্ছিলাম। এর মধ্যেই ঘাড়ে রাইফেলের বাঁট দিয়ে মারল এক পাক সেনা। গালিও দিল—‘তুম ইয়ে লাশকো কিউ রাখতা হ্যায়, এক সাথমে টেনে চল।

মধুদা তখনো বেঁচে ছিলেন : চারদিক থেকে লাশ টেনে আনা হচ্ছে। মৃত ভেবে মধুদার লাশ আনতে যখন তাঁর বাসায় গেলেন, তখনো তিনি জীবিত ছিলেন বলে জানালেন মোহন। বললেন, আহত লোকটাকে নিয়ে আসতে হলো সেনাদের হুকুমে। তাঁর দেহটা রাখলাম মাঠে লাশের স্তূপে। রাখার পর গুলি করল সেনারা। গুলি করেই ক্ষান্ত হয়নি, বুট দিয়ে মুখটা থেঁতলে দিল।

জগন্নাথ হল থেকে যেসব লাশ টেনেছিলেনততক্ষণে সবার শরীর শক্ত হয়ে গেছে। উত্তরবাড়ি থেকে, পুকুর পার থেকেও বহু ছাত্রের লাশ এনেছেন। যেসব ছাত্রের সঙ্গে ফুটবল খেলেছেন তাঁদের অনেকের লাশও টানতে হয়েছে।

লাশ টানতে টানতে প্রায় ভোর হয়ে গেল। পরে উর্দু জানা সবাইকে নেওয়া হলো মেজরের কাছে। এদের মধ্যে মোহনের এক স্বজনও ছিলেন। তিনি উর্দুতে পাক সেনাদের সঙ্গে বাতচিত করলেন। অন্যদের কাতর প্রার্থনা। কিন্তু মন গলল না।

মরার মতো পড়ে রইলেন : যারা লাশ টেনেছে, সবাইকে নিয়ে আসা হলো হলের শহীদ মিনারের সামনে। কাঁদতে কাঁদতে প্রাণভিক্ষা চাইছিলেন সবাই। কিন্তু তাঁদের লাইন ধরে দাঁড়াতে বলা হলো। মোহন ছিলেন একেবারে প্রথমে। উর্দুতে নিজেকে বিহারি বলে পরিচয় দিয়ে প্রাণভিক্ষা চাইলেন তিনি। মেজর বলল, ওর লুঙ্গি উঁচিয়ে দেখ। একজন সৈনিক সজোরে মোহনের গালে থাপ্পড় মারল। ঘুরে কয়েকজনের পেছনে চলে গেলেন তিনি। এরপর লাইনে দাঁড় করানো লোকগুলোকে গুলি করলে গুলিবিদ্ধ লোকগুলো পড়ল মোহনের ওপর। রক্তে গা ভেসে গেল।

মোহন বলেন, ওরা মনে করল আমিও মারা গেছি। তবে কিছু সময় পর আমার পা নড়ে উঠলে পায়ে গুলি করল। গুলি খেয়েও মাটি কামড়ে পড়ে থাকলাম। একটা গুলি ডান পায়ের ঊরুতে এবং অপরটা বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচে লাগে।

অনেকক্ষণ গুলির শব্দ না পেয়ে মোহন চোখ খুলে দেখলেন, পাক সেনাদের দেখা যাচ্ছে না। তাঁর শরীর থেকে রক্ত ঝরছে, পা ফুলে গেছে। কাছেই দেখলেন বুধিরামকে। বোনাই (দুলাইভাই) বলে ডাক দিলেন। পেটে গুলি লেগেছে তাঁর। খুব কষ্টে পেট চেপে ধরে রেখেছেন। বুধিরামের খুব রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তাঁকে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি।

আবার হলে ফেরা : স্বাধীন দেশে আবার হলে ফেরেন মোহন। আবার শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাগানে ফুল ফোটানো। একসময় বিয়েও করেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি তিন ছেলে ও এক মেয়ের জনক। ২০১০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন।

২৫ মার্চের সেই বিভীষিকা আর ভুলতে পারেননি। পায়ে এখনো গুলির ক্ষত রয়ে গেছে। সাইকেল চালালে ব্যথামুক্ত থাকেন। হাঁটতে গেলে এখনো ব্যথা পান বলে জানালেন মোহন।

 

 

মন্তব্য

বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ চেয়ে প্রস্তাবনা পাস অস্ট্রেলিয়ার সংসদে

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ চেয়ে প্রস্তাবনা পাস অস্ট্রেলিয়ার সংসদে

বাংলাদেশে দ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সংসদে প্রস্তাবনা পাস হয়েছে। দেশটির তিনটি রাজনৈতিক দললেবার, লিবারেল ও গ্রিন পার্টির সংসদ সদস্যরা এই বিল প্রস্তাব করেন, যা সংসদে পাস হয়।

গত বুধবার বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দেশটির সংসদের অধিবেশনে এই আহ্বান জানানো হয়। বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ কমিউনিটির প্রেসিডেন্ট মো. রাশেদুল হক এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

অস্ট্রেলিয়ার সংসদ সদস্যরা বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়ানো এবং নির্বাচনী সততা ও জবাবদিহির আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে শক্তিশালী দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে রূপান্তর; জরুরি ভিত্তিতে নির্বাচনী রোডম্যাপ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার সংসদ সদস্যরা।

সংসদে লিখিত বক্তব্য দেন এনএসডব্লিউয়ের সদস্য এবিগেইল বয়েড। তিনি বলেন, এই হাউস উল্লেখ করে যেক. ২৬ মার্চ ২০২৫ হচ্ছে বাংলাদেশের ৫৫তম স্বাধীনতা দিবস, যা বাংলাদেশের একটি স্বাধীন, সার্বভৌম জাতি হিসেবে ৫৫ বছর পূর্তি এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার দিনটিকে স্মরণ করে; খ. বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস জাতীয় সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, মুক্তি, ন্যায়বিচার, ঐক্য, সাম্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুষ্ঠু ভবিষ্যতের জন্য সংগ্রামে বাংলাদেশি জনগণের শক্তি ও স্থিতিস্থাপকতা উদযাপন করে; গ. ২৩ মার্চ বাংলাদেশ কমিউনিটি কাউন্সিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের জন্য লাকেম্বা লাইব্রেরি হলে দোয়া ও ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে।

অনুষ্ঠানে অনেক সম্প্রদায়ের সদস্য এবং অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন, যাঁরা স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের জন্য একত্র হয়েছিলেন, যা বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশি-অস্ট্রেলীয় সম্প্রদায়সহ বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশি জনগণের জন্য একটি চিরন্তন গর্বের; ঘ. সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সাবেক শাসনব্যবস্থার পতনের পর বাংলাদেশের জনগণ গুরুতর চ্যালেঞ্জ, দুর্নীতি, হুমকি এবং অস্থিতিশীলতার মুখোমুখি হচ্ছে। এই সংকটময় সময়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন এবং পদ্ধতিগতভাবে দুর্নীতি ভেঙে ফেলা, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ওপর জনসাধারণের আস্থা পুনরুদ্ধার, মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ীদের জবাবদিহি করার নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। এই সংসদ গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশি জনগণের চলমান লড়াইয়ের সঙ্গে তার সংহতি নিশ্চিত করে।

এবিগেইল বয়েড আরো বলেন, এই সংসদ অস্ট্রেলিয়ান সরকারকে বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়ানোর এবং নির্বাচনী সততা, জবাবদিহি ও শক্তিশালী দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রূপান্তর এবং নির্বাচনী রোডম্যাপ জরুরি ভিত্তিতে প্রণয়নের জন্য আহ্বান জানাচ্ছে।

 

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ