অথচ হাইকোর্টের নির্দেশে ২০১৫ সালে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ২২টি মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন (ইজি বাইক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, নছিমন, করিমন, ভটভটি ইত্যাদি) নিষিদ্ধ করেছিল সরকার। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কোনো তোয়াক্কাই করা হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহাসড়কে তিন চাকার যান চলাচল বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। মহাসড়কে নির্দিষ্ট গতির নিচে কোনো যান চলতে দেওয়া উচিত নয় এবং বিকল্প সড়ক ব্যবহারের নির্দেশনা কার্যকর করতে হবে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জাতীয় মহাসড়কের চার হাজার কিলোমিটারে এক হাজার ৮০ স্পটে যানজট ও দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। মোড়ে মোড়ে ইজি বাইক বসে থাকে। এতে যানবাহনের গতি আটকে দেয়। হঠাৎ রাস্তার পাশে চলে এলে বাস বা দ্রুতগতির বড় গাড়ির চালকরা খেই হারিয়ে ফেলেন এবং দুর্ঘটনা ঘটে যায়।’
তিনি বলেন, ‘আগের চেয়ে পুলিশের তৎপরতা কিছু বেড়েছে। পুলিশ শতভাগ নজর দিলে তিন চাকার যানবাহন যদি মহাসড়কে উঠতে না পারে তবে দুর্ঘটনা কম হবে।’
ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তিন চাকার যানবাহন : ঈদুল ফিতরের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের মহাসড়কে বাড়ছে যানবাহনের চাপ। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অবৈধ নছিমন, টমটম আর ভটভটি। কিন্তু সে তুলনায় সড়কের প্রশস্ততা না বাড়ানোর কারণে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা।
জানা যায়, চলতি মার্চ মাসের ২৩ দিনে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কে অন্তত ১৭টি দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত হয় সাতজন, আহত হয় অন্তত অর্ধশত। একই অবস্থা পিরোজপুরেও। বেকুটিয়া সেতুর কারণে যান চলাচলে গতি বাড়ার কথা থাকলেও তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে করিমন, নছিমন, থ্রিহুইলার। প্রয়োজনের তুলনায় সড়কের প্রশস্ততা না থাকায় দুর্ঘটনা কমছে না। এ ছাড়া সর্ব দক্ষিণের জেলা পটুয়াখালী-কুয়াকাটা আঞ্চলিক মহাসড়কেও চলছে ব্যাটারিচালিত মাহিন্দ্রা, সিএনজি, অটোরিকশা, ইজি বাইকসহ বিভিন্ন ধরনের তিন চাকার যান।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় পর্যটন নগরী কুয়াকাটার সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার সড়ক পথে বাড়ছে পরিবহনের সংখ্যা। প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন বিলাসবহুল বাস। কিন্তু তিন চাকার ব্যাটারিচালিত যান মহাসড়কে চলার কারণে প্রতিদিন ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা।
ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে বাধাহীনভাবে চলছে তিন চাকার যানবাহন : ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন বাধাহীনভাবে চলাচল করছে। এ কারণে ব্যস্ততম এই মহাসড়কে বেড়েছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। ঝুঁকি কমাতে অটোরিকশার চলাচল বন্ধ করতে মামলাসহ নানা পদক্ষেপ নিলেও তা কাজে আসছে না। মহাসড়কে তিন চাকার রিকশা, অটোরিকশা, ভটভটি, নছিমন ও করিমন বন্ধে বিভিন্ন সময় একাধিকবার পরিবহন ধর্মঘটও করেছেন পরিবহন শ্রমিকরা। মহাসড়কটির রংপুরের পীরগঞ্জ থেকে নীলফামারীর সৈয়দপুর অংশে প্রায় ৮০ কিলোমিটারে অবাধে চলাচল করছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ভ্যান। প্রকাশ্যেই চলছে নছিমন, করিমন ও ভটভটি। মহাসড়কের সাদুল্লাপুরের ধাপেরহাট, পীরগঞ্জ বাজার, বড়দরগা, শঠিবাড়ী, মিঠাপুকুর, জায়গীরহাট, মডার্ন মোড়, দর্শনা, টার্মিনাল, মেডিক্যাল মোড়, সিও বাজার, হাজিরহাট, তারাগঞ্জসহ অর্ধশত এলাকায় স্ট্যান্ড করে তিন চাকার যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বাড়ছে অবৈধ গাড়ির দাপট : নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলছে তিন চাকার যানবাহন। শুধু যে চলছে তা নয়, মাঝেমধ্যে উল্টোপথে চলছে এসব যান। এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বেড়েছে অনুমোদনহীন ‘দরজা খোলা’ অবৈধ গাড়ির দাপট। দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়েই মহাসড়কের বিভিন্ন এলাকায় এসব গাড়িতে চলছে অবাধে যাত্রী পরিবহন। ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে এসব মিনি মাইক্রোবাস দরজা খোলা অবস্থায় মহাসড়কে দাপটের সঙ্গে চলাচল করছে। ফিটনেসবিহীন এসব দরজা খোলা মিনি মাইক্রোবাস মহাসড়কে বড় বড় যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলাচল করছে। সড়ক দুর্ঘটনার এটিও একটি কারণ।
মহাসড়কের মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার জামালদী, ততৈতলা পাখির মোড়, বালুয়াকান্দি, ভাটেরচর, ভাটেরচর নতুন রাস্তা, আনারপুরা, ভিটিকান্দি, আলীপুরা, ভবেরচর, বাউশিয়া, দড়ি বাউশিয়া, বাউশিয়া পাখির মোড় এলাকায় দুই দিক দিয়েই চলছে তিন চাকার যানবাহন। কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছেন না এসব যানের চালকরা। গত ২২ ডিসেম্বর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গজারিয়ার মধ্য বাউশিয়া এলাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাকে সাইড দিতে গিয়ে একটি মিনিবাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায়। এতে চার যাত্রী আহত হয়। এর আগে গত ১১ নভেম্বর মহাসড়কের গজারিয়ার আলীপুরায় বাসের ধাক্কায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার তিন যাত্রী গুরুতর আহত হয়।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে তিন চাকার যান : নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার নয়াডিঙ্গি বাসস্ট্যান্ড থেকে আরিচা পর্যন্ত প্রায় ৩৭ কিলোমিটার এলাকায় অবৈধভাবে তিন চাকার যানবাহন চলাচল করছে। এতে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। এ মহাসড়ক দিয়েই পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলা থেকে দূরপাল্লার গাড়ি চলাচল করে।
আর এসব গাড়ির সামনে দিয়ে অবাধে চলছে নিষিদ্ধ ঘোষিত তিন চাকার সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ভ্যান, লেগুনা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজি বাইক, মাহেন্দ্রা ও টমটম। এসব যানের অদক্ষ চালকদের বিপজ্জনক ওভারটেকিং ও বেপরোয়া গতির কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বিআরটিএ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এসব যানবাহন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। মহাসড়কে শুধু অনুমোদিত যানবাহন চলাচলের জন্য কড়া আইন প্রয়োগ করা জরুরি। তিন চাকার যানের চালকদের জন্য নির্ধারিত রুট তৈরি করলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকটাই কমতে পারে।’
হাইওয়ে পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. দেলোয়ার হোসেন মিঞা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঈদে শান্তিপূর্ণ যাত্রা নিশ্চিত করতে থ্রি-হুইলারগুলো যেন মহাসড়কে না ওঠে সে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমাদের সদস্যরা কাজ করছেন। কেননা, দ্রুতগতির গাড়ির মাঝে যদি তিন চাকার গাড়ি ঢুকে পড়ে তাহলে যানজট তৈরি হয়। এতে করে ভোগান্তি ও দুর্ঘটনার শঙ্কা বেশি থাকে। তাই তাদের (তিন চাকার যান) অনুরোধ করছি মহাসড়কে যেন না ওঠে।’
মোটরসাইকেলে যাতায়াতকারীদের উদ্দেশে হাইওয়ে পুলিশপ্রধান বলেন, ‘প্রতি ঈদে মোটরসাইকেলের যাত্রায়ও দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। অনেকে নারী-শিশু ও একাধিক ব্যাগসহ দ্রুতগতিতে ছোটেন। ফলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। তাই যাঁরা নাড়ির টানে বাড়ি যাবেন, তাঁদের উদ্দেশে বলছি, খেয়াল রাখতে হবে যেন অতি দ্রুতগতির কারণে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে। নির্দিষ্ট গতিতে যাবেন। একই সঙ্গে সার্ভিস রোড ব্যবহার করবেন।’
(প্রতিবেনটিতে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন)