মদিনা সনদের তাৎপর্য ও ফলাফল

প্রকৌশলী মোহাম্মদ কামরুজ্জামান
প্রকৌশলী মোহাম্মদ কামরুজ্জামান
শেয়ার
মদিনা সনদের তাৎপর্য ও ফলাফল
ছবি : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি

মদিনাবাসীরা যে আশায় মুহাম্মদ (সা.)-কে মদিনায় আসার আমন্ত্রণ জানায়, হিজরত করার পর তা পূরণ করার জন্য তিনি সচেষ্ট হন। এ লক্ষ্যে তিনি মদিনার পৌত্তলিক ও ইহুদি নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ৪৭টি ধারা সংবলিত একটি সনদ প্রণয়ন করেন। তদানুসারে মদিনায় বসবাসরত ইহুদি, পৌত্তলিক ও মুসলমানদের মধ্য এই সনদ স্বাক্ষরিত হয়। এটি ইতিহাস বিখ্যাত ‘মদিনা সনদ’ (Charter of Medina) নামে পরিচিত।

এ সনদের প্রধান ধারাগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
১. মদিনা সনদে স্বাক্ষরকারী ইহুদি, পৌত্তলিক ও মুসলমান সম্প্রদায় একটি সাধারণ জাতি গঠন করবে।
২. চুক্তিতে (মদিনা সনদে) স্বাক্ষরকারী কোনো সম্প্রদায় বাইরের শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে সবাই মিলিত শক্তি দিয়ে সে আক্রমণ প্রতিহত করবে।
৩. সব সম্প্রদায় স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে, কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
৪. দুর্বল ও অসহায়কে রক্ষা ও সাহায্য করতে হবে।

৫. স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে মতানৈক্য ও বিরোধ দেখা দিলে হজরত মুহাম্মদ (সা.) তা মীমাংসা করে দেবেন।
৬. কেউ কুরাইশদের সঙ্গে কোনো প্রকার সন্ধি স্থাপন করতে পারবে না কিংবা মদিনাবাসীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে কুরাইশদের সাহায্য করতে পারবে না।
৭. স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে তা ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, এর জন্য অপরাধীর সম্প্রদায়কে দায়ী করা যাবে না।
৮. সর্বপ্রকার পাপ ও অপরাধকে ঘৃণা করতে হবে।
কোনোভাবেই পাপী ও অপরাধী ব্যক্তিকে রেহাই দেওয়া যাবে না।
৯. মদিনা শহরকে পবিত্র বলিয়া ঘোষণা করা হলো। এখন থেকে এখানে রক্তপাত ও হত্যা নিষিদ্ধ করা হলো।
১০. মুহাম্মদ (সা.)-এর বিনা অনুমতিতে মদিনাবাসীরা কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে না।
১১. মুহাম্মদ (সা.) নবগঠিত এই প্রজাতন্ত্রের সভাপতি (রাষ্ট্রপ্রধান) হবেন এবং পদাধিকার বলে তিনি সর্বোচ্চ বিচারালয়ের (Court of Appeal) সর্বময় কর্তা হবেন।

১২. ইহুদিদের মিত্ররাও সমান নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা ভোগ করবে।
১৩. বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার নিজ নিজ যুদ্ধের ব্যয়ভার স্বাক্ষরকারী প্রত্যেক সম্প্রদায় বহন করবে।
১৪. সনদের শর্ত (ধারা) ভঙ্গকারীর ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষিত হবে।
৬২৪ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে প্রণীত এই মদিনা সনদ পৃথিবীর সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান। রাষ্ট্র গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনায় জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সবার প্রতি কল্যাণজনক এমন সর্বজনীন সনদ এর আগে আর কখনো প্রণীত হয়নি। মুহাম্মদ (সা.)-এর উদ্যোগে এই সনদের মাধ্যমে মদিনার পৌত্তলিক ও ইহুদিরা মুসলমানদের সঙ্গে একত্র হয়ে মদিনাভিত্তিক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এই সনদের মাধ্যমে মদিনার সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সমর্থনে তথা মদিনার জনসাধারণের সমর্থনে মুহাম্মদ (সা.) এ রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাচিত হন। তিনি নির্বাচিত হওয়ার সময় মদিনায় মুসলমানদের সংখ্যা পৌত্তলিকদের চেয়ে অনেক কম ছিল; এমনকি ইহুদিদের চেয়েও। তদুপরি মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মদিনায় বহিরাগত। এ অবস্থায় মদিনায় আগমনের মাত্র দেড় বছরের মধ্যে মুহাম্মদ (সা.)-এর মদিনাবাসীদের সমর্থনে নবগঠিত মদিনাভিত্তিক রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাচিত হওয়া এবং সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সর্বময় কর্তা হওয়া হচ্ছে ইতিহাসের নজিরবিহীন এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। এ ছাড়া সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলিম ও অতি সংখ্যাগরিষ্ঠ অমুসলিমদের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে মুহাম্মদ (সা.)-এর রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হওয়াটা হচ্ছে তিনি যে বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ তারই বহিঃপ্রকাশ।
যে মানবীয় মহত্ত্বের ভিত্তিতে মদিনার অমুসলমানরা মুহাম্মদ (সা.)-কে সমর্থন করে মদিনাভিত্তিক রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত করেন, সেই মানবীয় মহত্ত্বের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিখ্যাত ফরাসি মনীষী আলফ্রেড দ্য ল্যামার্টিন মুহাম্মদ (সা.)-এর বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতুলনীয় অবদানে ও সাফল্যে মুগ্ধ হয়ে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর Histoire de la Turquie (History of Turks / তুর্কি জাতির ইতিহাস) বইতে লেখেন, ‘Philosopher, orator, apostle, legislator, worrior, conqueror of ideas, restorer of rational dogmas, of a cult without images; the founder of twenty terrestrial empires and one of spiritual empire, that is Muhammad, As regards all standards by which human greatness may be measured, we may well ask, is there any man greater than he?’ (দার্শনিক, বক্তা, ধর্মপ্রবর্তক, আইন প্রণেতা, যোদ্ধা, মতবাদ বিজয়ী, যুক্তিসিদ্ধ ধর্মমত ও প্রতিমাবিহীন উপাসনা পদ্ধতির পুনঃসংস্থাপক, ২০টি পার্থিব সাম্রাজ্যের এবং একটি আধ্যাত্মিক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন মুহাম্মদ। যে সব মানদণ্ড দ্বারা মানবীয় মহত্ত্ব মাপা হয়ে থাকে সেগুলো দ্বারা বিবেচনা করে আমরা সহজেই জিজ্ঞাসা করতে পারি তাঁর চেয়ে মহান কোনো ব্যক্তি আছে কি?)

মদিনা সনদ প্রণয়নের ফলাফল
মদিনা সনদের ফলে মদিনায় গৃহযুদ্ধ ও অন্তর্দ্বন্দ্বের স্থলে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা বিধান হয়। এই সনদ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে মদিনায় বসবাসকারী সব অধিবাসীকে সমানাধিকার প্রদান করে। এটা মদিনার মুসলমান ও অমুলমানদের মধ্যে সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সম্পর্কে পরে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। মুহাম্মদ (সা.)-এর উদ্যোগে মদিনার পৌত্তলিক, ইহুদি ও মুসলমানদের মধ্যে স্বাক্ষরিত বিশ্ববিখ্যাত মদিনা সনদ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে স্যার উইলিয়াম মুর তাঁর রচিত ‘The life of Muhammad’ বইতে বলেন, ‘It (Charter) reveals the Man in his real greatness-a master-mind, not only of his own age, but of all ages.Ó-W.Muir, The Life of Muhammad. [এটি (সনদ) মানুষটির সত্যিকার মহত্ত্ব ও অসাধারণ মননশীলতা, যা শুধু তৎকালীন যুগের জন্য নয়, বরং সর্বযুগের জন্য শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করে।]
মূলত ইসলামী গণতন্ত্রের অন্যতম প্রতিচ্ছবি হচ্ছে মদিনা সনদ। এই মদিনা সনদ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ইতিহাসবিদ প্রফেসর ড. এ কে এম ইয়াকুব হোসাইন তাঁর ‘ইসলামের ইতিহাস’ বইতে বলেছেন, ‘আরবে এই সনদের (মদিনা সনদ) দ্বারা সর্বপ্রথম ইসলামী গণতন্ত্রের বীজ বপন করা হলো।’ (পৃষ্ঠা : ২২৫)
অর্থাৎ এই রাষ্ট্র হচ্ছে ইসলামী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

কোরআন থেকে শিক্ষা

    পর্ব, ৭৪৬
শেয়ার
কোরআন থেকে শিক্ষা

আয়াতের অর্থ : ‘কিন্তু তারা কিয়ামতকে অস্বীকার করেছে এবং যে কিয়ামতকে অস্বীকার করে তার জন্য আমি প্রস্তুত রেখেছি জ্বলন্ত অগ্নি। দূর থেকে অগ্নি যখন তাদেরকে দেখবে তখন তারা শুনতে পাবে তার ক্রুদ্ধ গর্জন ও চিৎকার; আর তাদেরকে শৃঙ্খলিত অবস্থায় তার কোনো সংকীর্ণ স্থানে নিক্ষেপ করা হবে, তখন তারা তথায় ধ্বংস কামনা করবে। তাদেরকে বলা হবে, আজ তোমরা একবারের জন্য ধ্বংস কামনা কোরো না, বহুবার ধ্বংস হওয়ার কামনা করতে থাকো। ...সেথায় তারা যা চাইবে তাদের জন্য তাই থাকবে এবং তারা স্থায়ী হবে; এই প্রতিশ্রুতি পূরণ তোমার প্রতিপালকেরই দায়িত্ব।

’ (সুরা : ফোরকান, আয়াত : ১১-১৬)

আয়াতগুলোতে জাহান্নামের ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে।

শিক্ষা ও বিধান

১. কিয়ামতের বিশ্বাস ঈমানের অপরিহার্য অংশ। কিয়ামতে বিশ্বাস না করলে কেউ মুসলমান হতে পারে না।

২. কিয়ামতে অবিশ্বাসের শাস্তি জাহান্নাম।

প্রকৃতপক্ষে কিয়ামতে অবিশ্বাস মানুষকে অপরাধপ্রবণ করে তোলে।

৩. আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বিশ্বাস হলো, জাহান্নাম এখনো বিদ্যমান। আল্লাহ তা অনাদিকাল থেকে জাহান্নামিদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন।

৪. পৃথিবীতে মানুষের কাছে মৃত্যু যতটা অনাকাঙ্ক্ষিত, জাহান্নামে পাপীদের কাছে মৃত্যু ততটা কাঙ্ক্ষিত হবে।

৫. আল্লাহ অনুগ্রহপূর্বক বান্দাকে জান্নাত দানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। নতুবা আল্লাহর ওপর কোনো কিছু অপরিহার্য নয়। (বুরহানুল কুরআন : ২/৬০৭)

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

জাহেলি আরবে যেসব মূর্তির পূজা হতো

মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ
মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ
শেয়ার
জাহেলি আরবে যেসব মূর্তির পূজা হতো

লাত ও উজ্জা ছিল কুরাইশের দুই দেবতা। কুরাইশের লোকেরা ঘুমানোর আগে লাত ও উজ্জার পূজা করত।

(মুসনাদে আহমাদ, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-২২২)

এ দুটির নামে কসম খেতো। হজের সময় তারা মানাতকে ঘিরে তাওয়াফ করত।

(মুজামুল বুলদান, আল-উজ্জা ভুক্তি)

সুরা নুহের ভেতর যেসব মূর্তির কথা বলা হয়েছে আরবের বিভিন্ন গোত্র এগুলোর পূজা করত। ওয়াদ্দ ছিল দুমাতুল জান্দালে বনি কালবের দেবতা। সুওয়াআ ছিল হুজাইল গোত্রের দেবতা। মুরাদ ও বনি গাতফানের গোত্রগুলোর দেবতা ছিল ইয়াগুস

ইয়াউক পূজিত হতো হামদান গোত্রে। নাসর ছিল হিময়ারি জুল কালা গোত্রের উপাস্য। (সহিহ বুখারি, সংশ্লিষ্ট আয়াতের তাফসির) শামে পূজা করা হতো বায়াল-এর। (তাফসিরে বায়জাবি, সুরা সাফফাতের তাফসির)

মূর্তির নাম বিশ্লেষণ

লাত : আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) ও অন্যদের থেকে বর্ণিত হয়েছে যে লাত শব্দটি থেকে এটা নিষ্পন্ন, এর অর্থ হলো সংমিশ্রণ।

আরবে একজন লোক ছিল, লোকটি হজের মৌসুমে একটি পাথরের ওপর বসে থাকত এবং ছাতু গুলিয়ে গুলিয়ে হাজিদের মধ্যে বিতরণ করত। লোকটির মৃত্যুর পর মানুষ ওই পাথর পূজা শুরু করে দিল এবং এটির নাম রাখল লাত (মিশ্রণকারী)। (সহিহ বুখারি, তাফসির সুরা নাজম; ফাতহুল বারি)

আল-উজ্জা : আল-উজ্জা অর্থ হলো প্রতাপ, প্রতিপত্তি। এই শব্দের ইসমুত তাফজিল বা অগ্রাধিকার-বিশেষণ স্ত্রীলিঙ্গ হলো উজ্জা। অর্থাৎ মহাপরাক্রমশালী দেবী।

এতে বিস্ময়ের কিছু নেই যে উজ্জা কুরাইশ ও একই বংশীয় অন্যান্য গোত্রের যুদ্ধের দেবী ছিল। এ কারণেই হয়তো উহুদ যুদ্ধে মুসলমানরা পরাজিত হলে আবু সুফিয়ান পাহাড়ের ওপর থেকে চিৎকার করে বলেছিলেন : আমাদের রয়েছে উজ্জা, তোমাদের তো উজ্জা নেই। তখন নবী করিম (সা.) কর্তৃক উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-কে তার জবাব দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়, যেন তিনি এই কথা বলেন—‘আল্লাহ আমাদের অভিভাবক এবং তোমাদের কোনো অভিভাবক নেই।

(সহিহ বুখারি, গাজওয়াতু উহুদ)

মানাত : মানাত শব্দটি কয়েকটি মূল ধাতু থেকে নির্গত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। লিসানুল আরব প্রণেতা উল্লেখ করেছেন যে মানাত-এর তা স্ত্রীলিঙ্গবাচক। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, মানাত ভাগ্য ও মৃত্যুর দেবী ছিল।

ওয়াদ্দ : ওয়াদ্দ অর্থ অনুরাগ ও ভালোবাসা। এর বিপরীতে ছিল ঘৃণা ও শত্রুতার দেবী, তার নাম ছিল নিকরা। ওয়াদ্দ দেবতার কথা বিভিন্ন শিলালিপিতে পাওয়া যায়।

সুওয়াআ : আরবি ভাষা সুওয়াআ শব্দটির মূল ধাতু পাওয়া যায় না। যার অর্থ যুগ।

ইয়াউক : যার অর্থ রুখে দেওয়া। এই মূর্তির পূজা করত ইয়ামানবাসীরা। তাদের মধ্যে প্রতীক হিসেবে ভবিষ্যত্বাচক ক্রিয়াপদের ব্যাপকতা ছিল।

ইয়াগুস : ইয়াউকের পদ্ধতি অনুযায়ী ইয়াগুসও একটি প্রতীক। এর অর্থ হলো ফরিয়াদ করা। সুতরাং ইয়াগুসের অর্থ হলো যে ফরিয়াদ শোনে এবং ফরিয়াদের প্রতিকার করে।

নাসর : নাসর একটি পরিচিত পাখি শকুন। আকাশে শকুন আকৃতি ধারণকারী একগুচ্ছ নক্ষত্রকে নাসর (ভেগা) বলা হয়। ভেগা নক্ষত্র একটি দেবতা হিসেবে দীর্ঘকাল পর্যন্ত সেমেটিক জাতিগোষ্ঠীগুলোর পূজা লাভ করেছে। বাবেলের অন্যতম দেবতা ছিল নাসরুক। ইদানীংকালে বাবেলে এই দেবতার মূর্তি উদ্ঘাটিত হয়েছে।

বায়াল : বায়াল সম্পর্কে আগেই বলা হয়েছে যে এই দেবতা শামের উপাস্য ছিল। এ প্রসঙ্গেই এটির উল্লেখ কোরআন মাজিদে রয়েছে। বায়ালের শাব্দিক অর্থ শক্তি। রূপকার্থে নেতা ও সর্দারকেও বায়াল বলা হয়। একইভাবে স্বামী অর্থেও বায়াল শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কোরআন মাজিদে শব্দটি দ্বিতীয় অর্থে বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। আরবের একটি বিখ্যাত দেবতা ছিল হুবাল। হুবাল ছিল কুরাইশের সবচেয়ে বড় উপাস্য। হুবাল বায়ালেরই

বিকৃতরূপ।

আরবের মূর্তি ইউরোপে

বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে আরবের তাওহিদবাদীরাই প্রথমে ইউরোপীয় দেশগুলোতে একত্ববাদের আলো ছড়ান, একইভাবে আরবের জাহেলি যুগই ইউরোপের মূর্তিপূজাকালের শিক্ষক ছিল। আরব বণিকদের মাধ্যমে গ্রিসে, গ্রিস থেকে ইউরোপের অন্যান্য দেশে আরবের দেবদেবী ছড়িয়ে পড়ে। সেসব দেশের লোকেরা এসব মূর্তির সামনে সিজদাবনত হয়ে এগুলো উপাসনা করতে শুরু করে। কথিত আছে যে গ্রিক দেবী লেটো (জিউসের পত্নী খবঃড়) আরবের লাতেরই বিকৃতরূপ। একইভাবে হুবাল হার্মিস হয়েছে। হুবাল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা এসেছে মুজামুল বুলদান নামক গ্রন্থে। কিছু প্রাচ্যবিদ এ বিষয়ে পুস্তিকা রচনা করেছেন। (এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলাম,

খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩৮০)

মন্তব্য

নবীযুগের প্রখ্যাত কারি উবাই ইবনে কাব (রা.)

মাওলানা মুহিউদ্দীন হাতিয়ূভী
মাওলানা মুহিউদ্দীন হাতিয়ূভী
শেয়ার
নবীযুগের প্রখ্যাত কারি উবাই ইবনে কাব (রা.)

নবীজি (সা.)-এর বিশেষ প্রতিভাবান সাহাবিদের একজন সাইয়্যিদুল কুররা উবাই ইবনে কাব (রা.)। তাঁর নাম উবাই। উপনাম আবু মুনযির ও আবুত তুফাইল। প্রথমটি দিয়েছেন রাসুল (সা.) এবং দ্বিতীয়টি হজরত উমর (রা.)।

উপাধি সাইয়্যিদুল কুররা (প্রধান কারি)। বংশীয় দিক থেকে তিনি মদিনার বিখ্যাত খাজরাজ গোত্রের বনু নাজ্জার শাখার সন্তান। তাই তাঁকে নাজ্জারি বলা হয়। ইসলামী পরিচয়ে তাঁকে আনসারি বলা হয়।
বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী হিসেবে বদরি বলা হয়। ইলমে কিরাআতে অগাধ দক্ষতার কারণে সাইয়্যিদুল কুররামুকরি বলা হয়। প্রসিদ্ধ সাহাবি আবু তালহা আনসারি (রা.) তাঁর মামাতো ভাই। (সিয়ার আলামিন নুবালা : ১/৩৮৯-৩৯০, উসদুল গাবাহ : ১/৬১)

 

ইসলাম-পূর্ব জীবন ও ইসলাম গ্রহণ

হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে ইসলাম-পূর্ব জীবনে মদিনায় ইহুদিদের অন্যতম ধর্মগুরু গণ্য করা হতো।

প্রাচীন আসমানি কিতাবগুলোর জ্ঞানও ছিল তাঁর। সে যুগে পড়ালেখার তেমন পরিবেশ ছিল না। তা সত্ত্বেও তিনি লিখতে জানতেন। এ কারণে তিনি ইসলাম গ্রহণের পর রাসুল (সা.)-এর লেখালেখির দায়িত্ব পালনের সৌভাগ্য অর্জন করেন। (আল-আলাম : ১/৮২)

রাসুল (সা.) মদিনায় হিজরতের পূর্বে কোনো একসময় উবাই ইবনে কাব (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন।

মিনার আকাবার দ্বিতীয় (শেষ) শপথে অংশগ্রহণ করেন। তাতে মদিনায় হিজরতের পর রাসুল (সা.)-কে পূর্ণ সহায়তার দৃঢ় অঙ্গীকার করেন। তিনি বদর, উহুদ, খন্দকসহ সব যুদ্ধে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে অংশ নেন। (আল-আলাম : ১/৮২; সিয়ার আলামিন নুবালা : ১/৩৯০; আল-ইসাবাহ : ১/১৮১)

 

ওহি লেখার সৌভাগ্য

যাঁরা রাসুল (সা.)-এর ওহি লিখতেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.)। হজরত যায়েদ ইবনে সাবিত (রা.)-এর পূর্বে তিনিই ওহি লিখতেন। তিনি উপস্থিত না থাকলে রাসুল (সা.) হজরত যায়েদ (রা.)-কে ডেকে নিতেন। পরবর্তী সময়ে হজরত যায়েদ (রা.) বেশি লিখতেন।

(আল-ইস্তিআব : ১/৬৮)

 

ইলমি দক্ষতা

উবাই ইবনে কাব (রা.) ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদিতে ব্যস্ত না হয়ে মসজিদে নববীতে কোরআনের পাঠ-পঠন-পদ্ধতিসহ দ্বিনি ইলম অর্জনের পেছনে সময় দিতেন। এভাবে রাসুল (সা.)-এর সাহচর্যে থেকে ইলমে ওহির বিশাল ভাণ্ডার অর্জন করেন। একসময় তিনি ইলম ও আমলের সাজে সজ্জিত হয়ে মহান মর্যাদার অধিকারী হন। রাসুল (সা.)-এর যুগেই তিনি ফতোয়া দিতেন। দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.) তারাবির জামাত চালু করেন। ইমাম হিসেবে নিয়োগ দেন হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে।

(আল-আলাম : ১/৮২; সিয়ার আলামিন নুবালা : ১/৩৯৪; আবু দাউদ : ১/২০২)

ইমাম শাবি (রহ.) তাবেঈ মাসরূক (রহ.) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.)-এর পক্ষ থেকে অনুমোদনপ্রাপ্ত বিচারক ও ফতোয়া দাতা ছয়জনের একজন ছিলেন উবাই ইবনে কাব (রা.)।

(উসদুল গাবাহ : ১/৬২)

 

ইলমে কিরাআত ও উবাই ইবনে কাব (রা.)

রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায় তিনি কোরআনের একটি পূর্ণ সংকলন প্রস্তুত করেন এবং তা রাসুল (সা.)-এর সামনে পেশ করেন। এই সংকলনটি মাসহাবে উবাই নামে খ্যাত ছিল। কোরআনের বিভিন্ন পাঠ-পদ্ধতিতে ছিল তাঁর অসাধারণ দক্ষতা। তাঁর তিলাওয়াতে ছিল বিশেষ আকর্ষণ। রাসুল (সা.) মাঝেমধ্যে তাঁর থেকে কোরআন শুনতেন। আনাস (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.) উবাইকে বললেন, আল্লাহ আমাকে আদেশ করেছেন, তোমাকে কোরআন শোনাতে। হজরত উবাই বললেন, আল্লাহ কি আমার নাম উল্লেখ করেছেন? ইরশাদ করলেন, হ্যাঁ। এরপর বললেন, আমি রাব্বুল আলামিনের দরবারে আলোচিত হয়েছি? ইরশাদ করলেন, হ্যাঁ। তখন তাঁর দুই চোখ অশ্রুতে ভরে গেল। (বুখারি : ৭৪১, মুসলিম : ১/২৬৯,

সিয়ার আলামিন নুবালা : ১/৩৯৪)

হাদিস : উবাই ইবনে কাব (রা.) সূত্রে ১৬৪টি হাদিস বর্ণিত আছে। এর মধ্যে বুখারি-মুসলিম যৌথভাবে তিনটি এবং পৃথকভাবে বুখারি তিনটি ও মুসলিম সাতটি হাদিস বর্ণনা করেছেন।

ইন্তেকাল : উবাই ইবনে কাব (রা.) মদিনায় ইন্তেকাল করেন। (মুজামুস সাহাবা : ১/৩)

তবে কোন সনে, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। আবু নুআইম (রহ.) বলেন, এক মতে ২২ হিজরি উমর (রা.)-এর খিলাফতে, আবার এক মতে ৩০ হিজরি উসমান (রা.)-এর খিলাফতে। দ্বিতীয় মতই গ্রহণযোগ্য। (উসদুল গাবাহ : ১/৬৩ পৃ.; আল-ইসাবাহ : ১/১৮১-১৮২ পৃ.; আত-ত্বাবাকাতুল কুবরা : ৩/৩৮১ পৃ., ক্র.১৭৪; তাহজিবুল আসমা ওয়াল লুগাত : ১/১০৯-১১০ পৃ.)

লেখক : মুহাদ্দিস ও গবেষক

 

মন্তব্য

জান্নাতে আল্লাহর দিদার লাভের ৬ আমল

আসআদ শাহীন
আসআদ শাহীন
শেয়ার
জান্নাতে আল্লাহর দিদার লাভের ৬ আমল
ছবি : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি প্রতীকী চিত্র

আল্লাহ তাআলাকে নিজ চোখে দেখা মহা সৌভাগ্যের বিষয়, যা পরকালে মুমিনদের জন্য নির্ধারিত। জান্নাতের অফুরন্ত সুখ-সুবিধা ও অনাবিল আনন্দের মধ্যেও আল্লাহর দিদার হবে এমন এক পরম আনন্দ, যা জান্নাতবাসীরা অন্য সব আনন্দ ভুলে যাবে।

আসুন, জান্নাতে আল্লাহর দিদার লাভের কিছু আমল জেনে নিই

প্রথম আমল : ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করা

আল্লাহর দিদার লাভের প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো, একজন ব্যক্তি ইসলামের অনুসরণে থেকে মৃত্যুবরণ করবে। কারণ অবিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহর দিদার হারাম করা হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন, কখনো নয়! বস্তুত তারা সে দিন তাদের প্রতিপালকের দিদার (দর্শন) থেকে বঞ্চিত থাকবে।

(সুরা : আল মুতাফফিফীন, আয়াত : ১৫)

অর্থাৎ গুনাহ ও কুফরির জন্য তাদের কঠিন শাস্তি হলো, তারা কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার দিদার থেকে বঞ্চিত হবে। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে মুমিনরা কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলাকে দেখতে পাবে, আর কাফিররা এই মহান নিয়ামত থেকে বঞ্চিত থাকবে।

দ্বিতীয় আমল : আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করা

আল্লাহ তাআলার দিদার লাভের অন্যতম মাধ্যম হলোতাঁর কাছে এই মহান নিয়ামত লাভের জন্য আন্তরিকভাবে দোয়া করা।

আল্লাহ তাআলা দোয়া কবুলকারী, আর তাঁর বান্দাদের আন্তরিক দোয়া তিনি প্রত্যাখ্যান করেন না। কায়েস ইবনে উবাদা (রা.) বর্ণনা করেন যে রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি বিশেষ দোয়া পড়তেন, যাতে আল্লাহর দিদারের জন্য দোয়া করা হয়েছে। সেই দোয়াটি হলো—‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে (জান্নাতে) তোমার দিদার লাভ করতে চাই এবং ক্ষতিকর কষ্ট ও পথভ্রষ্টকারীর ফাসাদে পড়া ছাড়া তোমার সাক্ষাতের আশা-আকাঙ্ক্ষা করি। হে আল্লাহ! আমাদের ঈমানের বলে বলীয়ান করো আর হেদায়েতপ্রাপ্ত ও হেদায়েত প্রদর্শনকারী করো।
(সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ১৩০৫)

তৃতীয় আমল : ফজর ও আসরের নামাজের পাবন্দি করা

জান্নাতে আল্লাহ তাআলার দিদার লাভের অন্যতম মাধ্যম হলো সব নামাজের প্রতি যত্নবান হওয়া, বিশেষত ফজর ও আসরের নামাজ নিয়মিতভাবে আদায় করা। জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন : একদা আমরা নবী করিম (সা.)-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তিনি রাতে (পূর্ণিমার) চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ওই চাঁদকে তোমরা যেমন দেখছ, ঠিক তেমনি অচিরেই তোমাদের প্রতিপালককে তোমরা দেখতে পাবে। তাঁকে দেখতে তোমরা কোনো ভিড়ের সম্মুখীন হবে না। কাজেই সূর্য উদয়ের ও অস্ত যাওয়ার আগের নামাজ (শয়তানের প্রভাবমুক্ত হয়ে) আদায় করতে পারলে তোমরা তা-ই করবে।

(বুখারি, হাদিস : ৫৫৪)

চতুর্থ আমল : গুনাহ থেকে মুক্ত থাকা

জান্নাতে আল্লাহ তাআলার দিদার লাভের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলোসব ধরনের গুনাহ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। হজরত আবু জর গিফারি (রা.) বর্ণনা করেন যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণির লোকের সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না এবং তাদের পবিত্র করবেন না; বরং তাদের জন্য রয়েছে ভয়ানক শাস্তি। বর্ণনাকারী বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এ কথাটি তিনবার পাঠ করলেন। আবু জর (রা.) বলে উঠলেন, তারা ধ্বংস হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে। হে আল্লাহর রাসুল! এরা কারা? তিনি বলেন, যে লোক পায়ের গোছার নিচে কাপড় ঝুলিয়ে চলে, কোনো কিছু দান করে খোঁটা দেয় এবং মিথ্যা শপথ করে পণ্যদ্রব্য বিক্রি করে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৯৪)

পঞ্চম আমল : আল্লাহ তাআলার সাক্ষাৎ ও দিদারের আকাঙ্ক্ষা

জান্নাতে আল্লাহ তাআলার দিদার লাভের অন্যতম মাধ্যম হলোআল্লাহ তাআলার সঙ্গে সাক্ষাতের প্রবল আকাঙ্ক্ষা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ পছন্দ করে, আল্লাহও তার সাক্ষাৎ পছন্দ করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ পছন্দ করে না, আল্লাহও তার সাক্ষাৎ পছন্দ করেন না। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৫০৭)

ষষ্ঠ আমল : ইহসান করা

জান্নাতে আল্লাহ তাআলার দিদার লাভের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো ইহসান বা সৎকর্ম করা।

ইহসানের অর্থ হলো, সৃষ্টিজীবের প্রতি যেকোনো ভালো কাজ করা এবং কল্যাণমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখা। এটি এমন একটি গুণ, যা মানুষের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ সুগম করে। ইমাম জুরজানি (রহ.) ইহসানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, ইহসান হলো সেই কাজ, যা দুনিয়াতে প্রশংসিত হয় এবং পরকালে প্রতিদান ও সওয়াবের কারণ হয়। (আল-তারিফাত, পৃষ্ঠা-৯১)

আল্লাহ তাআলা আমাদের উপরিউক্ত আমল পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ