ইতিকাফ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আত্মশুদ্ধি, ইবাদতের প্রতি একাগ্রতা ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। ইতিকাফ সুপ্রাচীন ইবাদত হওয়ায় যুগে যুগে এর আমল হয়েছে। ইতিকাফ করার জন্য মসজিদকে পবিত্র রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ইতিকাফ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আত্মশুদ্ধি, ইবাদতের প্রতি একাগ্রতা ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। ইতিকাফ সুপ্রাচীন ইবাদত হওয়ায় যুগে যুগে এর আমল হয়েছে। ইতিকাফ করার জন্য মসজিদকে পবিত্র রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
(সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১২৫)
ইতিকাফসংক্রান্ত জরুরি কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হলো—
ইতিকাফের শর্ত
ইতিকাফের প্রধান শর্ত তিনটি—
এক. ইতিকাফের নিয়ত করতে হবে।
দুই. এমন মসজিদে ইতিকাফ হতে হবে, যেখানে নামাজের জামাত হয়—জুমার জামাত হোক বা না হোক। তিন. মহিলাদের ক্ষেত্রে হায়েজ-নেফাস থেকে পবিত্র হতে হবে।
(আহকামে জিন্দেগী, পৃষ্ঠা-২৫৭)
ইতিকাফের প্রকার
ইতিকাফ তিন প্রকার—এক. ওয়াজিব। এটা হলো মান্নতের ইতিকাফ। মান্নতের ইতিকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। সুন্নত ইতিকাফ ফাসেদ হয়ে গেলেও তার কাজা আদায় করা ওয়াজিব।
দুই. সুন্নাতে মুয়াক্কাদা কিফায়া। এটা হলো রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ দশক ইতিকাফ করতেন। তাঁর ওফাত পর্যন্ত এই নিয়মই ছিল। এরপর তাঁর সহধর্মিণীরাও (সে দিনগুলোতে) ইতিকাফ করতেন।
রমজানের ২০ তারিখ সূর্যাস্তের আগে থেকে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা পর্যন্ত ইতিকাফের সময়। বড় গ্রাম বা শহরের প্রতিটি মহল্লা এবং ছোট গ্রামের পূর্ণ বসতিতে কেউ কেউ ইতিকাফ করলে সবাই দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে। আর কেউই না করলে সবাই সুন্নত তরকের জন্য দায়ী হবে।
তিন. মুস্তাহাব বা নফল ইতিকাফ। এই ইতিকাফের জন্য কোন দিন বা সময়ের পরিমাপ নেই এবং রোজাও শর্ত নয়। অল্প সল্প সময়ের জন্যও তা হতে পারে।
মহিলাদের ইতিকাফের স্থান
পুরুষদের মতো মহিলাদের জন্যও রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ সুন্নত। এ জন্য বাড়িতে মহিলাদের নিজের ঘরে আগে থেকে নামাজের জন্য নির্ধারিত জায়গা থাকলে সেখানে অথবা জায়গা নির্ধারিত করে সেখানে ইতিকাফ করা সর্বোত্তম। এটাই নিরাপদ এবং সওয়াব অর্জনের মাধ্যমে। তবে কোনো মহিলা যদি মসজিদে পূর্ণ পর্দার সঙ্গে ইতিকাফ করে তাহলে তা মাকরুহের সঙ্গে আদায় হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একাধিক স্ত্রী মসজিদে ইতিকাফ করতে চাওয়ায় তিনি তখন ইতিকাফ করেননি। পরে কাজা আদায় করেছেন। এখান থেকে বোঝা যায়, ইতিকাফের বিধানটি মূলত পুরুষদের জন্য মসজিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত, নারীদের জন্য নয়।
(বুখারি, হাদিস : ১৯০৫)
ইতিকাফ ভাঙার কারণ
ইতিকাফ পালনের জন্য কিছু নিয়ম ও শর্ত আছে। এগুলো মেনে চলা আবশ্যক। যদি কেউ শর্তভঙ্গকারী কোনো কাজ করে তাহলে তার ইতিকাফ ভেঙে যাবে।
এক. স্ত্রী সহবাস করলে ইতিকাফ ফাসেদ হয়ে যায়। চাই বীর্যপাত হোক বা না হোক, ইচ্ছাকৃত হোক বা ভুলে হোক। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, আর তোমরা মসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায় তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ো না। এগুলো আল্লাহর সীমারেখা। কাজেই এগুলোর নিকটবর্তী হয়ো না। (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৮৭)
দুই. ইতিকাফের স্থান থেকে শরিয়তসম্মত প্রয়োজন বা স্বাভাবিক প্রয়োজন ছাড়া বের হলে ইতিকাফ ফাসেদ হয়ে যায়। শরিয়তসম্মত প্রয়োজন হলে বাইরে যাওয়া যায়। যেমন—ফরজ গোসলের জন্য বের হওয়া ইত্যাদি। আর স্বাভাবিক প্রয়োজনেও বের হওয়া যায়। যেমন—পেশাব-পায়খানার জন্য বের হওয়া, খাদ্য-খাবার এনে দেওয়ার লোক না থাকলে খাওয়ার জন্য বের হওয়া ইত্যাদি। যে কাজের জন্য বাইরে যাওয়া হবে সে কাজ সমাপ্ত করার পর সত্বর ফিরে আসতে হবে। বিনা প্রয়োজনে কারো সঙ্গে কথা বলবে না। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) মসজিদে থাকাবস্থায় আমার দিকে মাথা বাড়িয়ে দিতেন আর আমি তা আঁচড়িয়ে দিতাম এবং তিনি যখন ইতিকাফে থাকতেন, তখন (প্রাকৃতিক) প্রয়োজন ছাড়া ঘরে প্রবেশ করতেন না। (বুখারি, হাদিস : ১৯০২)
সম্পর্কিত খবর
আয়াতের অর্থ : ‘যারা কুফরি করে তাদের কাজ মরুভূমির মরীচিকাসদৃশ, পিপাসার্ত যাকে পানি মনে করে, কিন্তু সে তার কাছে উপস্থিত হলে দেখবে তা কিছু নয় এবং সে পাবে সেখানে আল্লাহকে, অতঃপর তিনি তার কর্মফল পূর্ণ মাত্রায় দেবেন। আল্লাহ হিসাব গ্রহণে তৎপর। অথবা তাদের কাজ গভীর সমুদ্রতলের অন্ধকারসদৃশ, যাকে আচ্ছন্ন করে তরঙ্গের ওপর তরঙ্গ, যার ঊর্ধ্বে মেঘপুঞ্জ, অন্ধকারপুঞ্জ স্তরের ওপর স্তর...।’
(সুরা : নুর, আয়াত : ৩৯-৪০)
আয়াতদ্বয়ে পরকালের ব্যাপারে অবিশ্বাসীদের অসারতা তুলে ধরা হয়েছে।
শিক্ষা ও বিধান
১. উপদেশ প্রদানে কোরআনের রীতি হলো সুসংবাদ ও হুঁশিয়ারি পাশাপাশি নিয়ে আসা। যেন মানুষের ভেতর আশা বা ভয় কোনোটাই প্রবল না হয়।
২. পরকালের ব্যাপারে অবিশ্বাসীদের প্রত্যাশা মিথ্যা ও মূল্যহীন। পরকালে তাদের কোনো প্রাপ্য নেই।
৩. অবিশ্বাসীদের ভালো কাজগুলো মরীচিকার মতো নিষ্ফল ও বিভ্রম মাত্র, যা দূর থেকে পানি মনে হলেও প্রকৃত পক্ষে পানি নয়। (আত-তাহরির ওয়াত তানভির : ৩৯-৪০)
৪. তিন জিনিসের অভাবে মানুষের আমল নিষ্ফল হয় : ক. ঈমান, খ. ইখলাস বা নিষ্ঠা, গ. শরিয়তের অনুসরণ।
৫. ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘তরঙ্গ আচ্ছন্ন করে’ বাক্য দ্বারা অবিশ্বাসীদের অন্তর, চোখ ও কানের ওপর বিরাজমান পর্দা উদ্দেশ্য।
(তাফসিরে ইবনে কাসির : ৮/১৩৪)
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন কারিম, তুহিব্বুল আফওয়া, ফা‘ফু আন্নি।
অনুবাদ : হে আল্লাহ! তুমি সম্মানিত ক্ষমাকারী, তুমি ক্ষমা করতেই পছন্দ করো। অতএব, আমাকে ক্ষমা করে দাও।
সূত্র : আয়েশা (রা.) বলেন, আমি একদিন আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! যদি আমি ‘লাইলাতুল কদর’ জানতে পারি তাহলে সে রাতে কী বলব? তখন তিনি তাঁকে এই দোয়া শিক্ষা দেন।
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত অন্য বর্ণনায় এসেছে,
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফা‘ফু আন্নি।
অনুবাদ : হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমা করতেই ভালোবাসো, অতএব, আমাকে ক্ষমা করে দাও। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৮৫০)
সুরা ফাতাহ
আলোচ্য সুরায় প্রধানত হুদাইবিয়ার সন্ধি সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। মক্কার কুরাইশদের সঙ্গে মুসলমানদের ঐতিহাসিক এই সন্ধি হয়েছিল। এরপর কাফিরদের জন্য জাহান্নামের এবং ঈমানদারদের জন্য জান্নাতের ওয়াদা করা হয়েছে। পরে বাইআতে রিদওয়ান সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।
আদেশ-নিষেধ-হিদায়াত
১. বিজয় আল্লাহর অনুগ্রহ। (আয়াত : ১-২)
২. আল্লাহর ব্যাপারে মন্দ ধারণা পোষণ কোরো না। (আয়াত : ৬)
৩. সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করো।
(আয়াত : ৯)
৪. দ্বিনের কাজে পিছিয়ে থেকো না। (আয়াত : ১১)
৫. আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করো।
(আয়াত : ১৭)
৬. মানুষকে মসজিদে যেতে বাধা দিয়ো না।
(আয়াত : ২৫)
৭. যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে মানুষকে রক্ষা করো।
৮. গোত্রীয় অহমিকা পরিহারযোগ্য। (আয়াত : ২৬)
৯. পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হও। (আয়াত : ২৯)
১০. সিজদার চিহ্ন মুমিনের গৌরব। (আয়াত : ২৯)
সুরা হুজুরাত
এ সুরায় মুসলমানদের আদব-কায়দা, শিষ্টাচার ও আচরণ শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সংবাদ যাচাই-বাছাই করেই গ্রহণ করতে হবে।
আদেশ-নিষেধ-হিদায়াত
১. দ্বিনের পথে অগ্রগামীরাই সিদ্ধান্ত নেবে।
(আয়াত : ১)
২. বড়দের সামনে উচ্চকণ্ঠ হয়ো না। (আয়াত : ২)
৩. সাহাবায়ে কিরাম (রা.) ক্ষমাপ্রাপ্ত। (আয়াত : ৩)
৪. প্রচারের আগে সংবাদ যাচাই করো। (আয়াত : ৬)
৫. মানুষের বিবাদ মিটিয়ে দাও। (আয়াত : ৯)
৬. কাউকে নিয়ে উপহাস কোরো না। (আয়াত : ১১)
৭. কাউকে মন্দ নামে ডেকো না। (আয়াত : ১১)
৮. খারাপ ধারণা ও গিবত থেকে বেঁচে থেকো।
(আয়াত : ১২)
৯. আল্লাহভীতি সম্মানের মাপকাঠি। (আয়াত : ১৩)
১০. মৌখিক দাবি ঈমান গ্রহণযোগ্য হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়। (আয়াত : ১৪)
সুরা কাফ
আলোচ্য সুরায় কাফিরদের ঈমানবিমুখতা সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। তাদের কথা খণ্ডন করা হয়েছে, যারা পুনরুত্থানে বিশ্বাস করে না। পরে সৃষ্টিজগতের বিভিন্ন বস্তুর কথা তুলে ধরে আল্লাহর কুদরতের প্রমাণ দেওয়া হয়েছে। অতীতের পাপীদের কিছু উদাহরণ আনা হয়েছে। যারা আল্লাহর আজাবকে ভয় করে, তাদের কোরআনের মাধ্যমে সতর্ক করার নির্দেশ দিয়ে সুরাটি শেষ করা হয়েছে।
আদেশ-নিষেধ-হিদায়াত
১. সত্য স্পষ্ট হওয়ার পর তা প্রত্যাখ্যান কোরো না। (আয়াত : ৫)
২. আল্লাহ মানুষের সন্নিকটে উপস্থিত। (আয়াত : ১৬)
৩. মানুষের সব কথাই লিপিবদ্ধ হয়। (আয়াত : ১৮)
৪. মৃত্যু অবধারিত। (আয়াত : ১৯)
৫. অতৃপ্তি জাহান্নামের বৈশিষ্ট্য। (আয়াত : ৩০)
৬. আল্লাহমুখী মানুষের জন্য জান্নাত। (আয়াত : ৩২)
৭. আল্লাহকে ভয় করো। (আয়াত : ৩৩-৩৪)
সুরা জারিয়াত
আলোচ্য সুরায় আল্লাহর ওয়াদা সত্য হওয়ার কিছু নজির তুলে ধরা হয়েছে। এখানে বিভিন্ন নবীর ঘটনা বর্ণনা করে দেখানো হয়েছে যে যুগে যুগে আল্লাহর আজাবের ওয়াদা সত্য হয়েছে। কিয়ামতের বর্ণনার মাধ্যমে সুরাটি শুরু হয়েছে। সুরার শেষের দিকে বলা হয়েছে, মানুষ ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে আল্লাহর পরিচয় লাভের জন্য, তাঁর ইবাদতের জন্য।
আদেশ-নিষেধ-হিদায়াত
১. মিথ্যাচারীরা আল্লাহর দরবারে অভিশপ্ত।
(আয়াত : ১০-১১)
২. তাহাজ্জুদ আল্লাহর প্রিয় আমল। (আয়াত : ১৭-১৮)
৩. ধনীর সম্পদে গরিবের অধিকার রয়েছে।
(আয়াত : ১৯)
৪. ‘সালাম’ দ্বারা পরস্পরকে অভিনন্দিত করো।
(আয়াত : ২৫)
৫. আল্লাহ বন্ধ্যা নারীকেও সন্তান দিতে পারেন।
(আয়াত : ২৯-৩০)
৬. অভিশপ্ত জাতিদের দেখে শিক্ষা নাও। (আয়াত : ৩৭)
৭. ক্ষমতার দম্ভে সত্যবিমুখ হয়ো না। (আয়াত : ৩৯)
৮. দ্বিন প্রচারকরা সমালোচনা উপেক্ষা করবে।
(আয়াত : ৫৪-৫৫)
সুরা তুর
আলোচ্য সুরায় বিভিন্ন বিষয়ের কসম খেয়ে সেই ওয়াদার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। পাশাপাশি মহানবী (সা.)-এর প্রতি দ্বীন প্রচারের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কাফিরদের অপপ্রচারে কান দিতে নিষেধ করা হয়েছে। মহানবী (সা.)-এর প্রতি ধৈর্যের উপদেশ দিয়ে সুরাটি শেষ হয়েছে।
আদেশ-নিষেধ-হিদায়াত
১. অর্থহীন কথা ও কাজ পরিহার করো।
(আয়াত : ১১-১২)
২. জাহান্নামিদের অপমানের সঙ্গে হাজির করা হবে। (আয়াত : ১৩-১৪)
৩. কোরআন সব সংশয়ের ঊর্ধ্বে। (আয়াত : ৩৩-৩৪)
গ্রন্থনা : মুফতি আতাউর রহমান