ঢাকা, শনিবার ১২ এপ্রিল ২০২৫
২৯ চৈত্র ১৪৩১, ১২ শাওয়াল ১৪৪৬

ঢাকা, শনিবার ১২ এপ্রিল ২০২৫
২৯ চৈত্র ১৪৩১, ১২ শাওয়াল ১৪৪৬

মেহমানের সমাদরে জান্নাত মেলে

মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা
মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা
শেয়ার
মেহমানের সমাদরে জান্নাত মেলে
ছবি : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি

মেহমানের সমাদর করা মুমিনের ভূষণ। মুমিন মেহমানের আগমনে খুশি হয়। মেহমানকে সাদরে গ্রহণ করে। কেননা নবীজি (সা.) মেহমানকে সম্মান করার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন।

এখানে মেহমানের আপ্যায়নের গুরুত্ব ও আদব সম্পর্কে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।

মেহমান আপ্যায়নের গুরুত্ব : ইসলামে মেহমান আপ্যায়নের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি শুধু সামাজিকতা নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় করলে এক ধরনের ইবাদতও বটে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়, অতিথিকে সমাদর করে, আর ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।

(বুখারি, হাদিস : ৬০১৮)

এই হাদিসে মেহমানের সমাদরকে ঈমানের দাবি হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। যে ঈমান রাখে, তার উচিত মেহমানকে সম্মান করা। তার আগমনে বিরক্ত না হওয়া।

মেহমানের হক : প্রতিটি মুসলমানের ওপর তার কাছে আসা মেহমানের হক রয়েছে।

তাইতো নবীজি (সা.) আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.)-কে লাগাতার রোজা রাখতে নিরুৎসাহ করার সময় বলেন, কয়েক দিন রোজা পালন করো, আর কয়েক দিন ইফতার করো (রোজা ভঙ্গ করো)। তোমার ওপর তোমার শরীরের হক আছে। তোমার ওপর তোমার চোখের হক আছে, তোমার ওপর তোমার মেহমানের হক আছে, আর তোমার ওপর তোমার স্ত্রীরও হক আছে। নিশ্চয়ই তুমি তোমার আয়ু দীর্ঘ হওয়ার আশা করো। (বুখারি, হাদিস : ৬১৩৪)

আপ্যায়নের সময়সীমা : বাড়িতে কোনো মেহমান এলে মেজবানের দায়িত্ব তার মেহমানদারি করা, মেহমানের হক আদায় করা।

প্রশ্ন হলো, এর কি কোনো সময়সীমা আছে, নাকি মেহমান যত দিন ইচ্ছা থাকতে পারবে, মেজবান সামর্থ্য না থাকলেও তার মেহমানদারি করে যাবে? এর উত্তরও পবিত্র হাদিসেই রয়েছে।

 

আবু কারিম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, এক রাত মেহমানদারি করা প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য। যার আঙিনায় মেহমান নামে, এক দিন মেহমানদারি করা তার ওপর ঋণ পরিশোধের সমান। সে ইচ্ছা করলে তার ঋণ পরিশোধ করবে বা ত্যাগ করবে। (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৭৫০)

তবে তিন দিন পর্যন্ত মেহমানদারি করা সুন্নত। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আবু শুরাইহ খুযাঈ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মেহমানদারি তিন দিন এবং উত্তমরূপে মেহমানদারি এক দিন ও এক রাত। কোনো মুসলিম ব্যক্তির জন্য বৈধ নয় যে সে তার ভাইয়ের নিকট অবস্থান করে তাকে পাপে নিপতিত করবে। তখন সাহাবারা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! কিভাবে সে তাকে পাপে নিপতিত করবে? তিনি বললেন, সে (মেহমান) তার নিকট (এমন বেশি দিন) থাকবে, অথচ তার (মেজবানের) এমন সম্বল নেই, যা দ্বারা সে তার মেহমেনদারি করবে।

(মুসলিম, হাদিস : ৪৪০৬)

 

মেহমানদারির ফজিলত

সম্মানজনক জীবন লাভ : কিছু গুণ এমন আছে, যেগুলো কারো মধ্যে থাকলে মহান আল্লাহ তাকে সর্বাবস্থায় সাহায্য  করেন, সম্মানিত করেন। তিনি কোথাও তাঁকে অপমানিত হতে দেন না। যেমনখাদিজা (রা.) রাসুল (সা.)-কে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, আল্লাহর কসম! তিনি কখনো আপনাকে অপমানিত করবেন না। আল্লাহর কসম! আপনি স্বজনদের খোঁজখবর রাখেন, সত্য কথা বলেন, দুঃখীদের দুঃখ নিবারণ করেন, দরিদ্রদের বাঁচার ব্যবস্থা করেন, মেহমানের সেবা করেন এবং প্রকৃত দুর্দশাগ্রস্তদের সাহায্য করেন।

(মুসলিম, হাদিস : ২৯৩)

জান্নাতে প্রবেশের মাধ্যম : আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় সাধ্যমতো মেহমানের আপ্যায়ন করা জান্নাতে যাওয়ার মাধ্যম হতে পারে। হাদিস শরিফে জান্নাতে যাওয়ার যে আমলগুলো বাতলে দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো মানুষকে খাওয়ানো। নবীজি (সা.) মদিনায় পৌঁছে সর্বপ্রথম যে নসিহত করেছেন তা ছিল, হে মানুষ! তোমরা সালামের প্রসার ঘটাও, খাদ্য দান করো এবং মানুষ ঘুমিয়ে থাক অবস্থায় (তাহাজ্জুদ) নামাজ আদায় করো। তাহলে নিশ্চয়ই তোমরা সহিহ-সালামতে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (তিরমিজি, হাদিস : ২৪৮৫)

জান্নাতে প্রাসাদ লাভ : যেসব অভ্যাসে জান্নাতে বিশেষ প্রাসাদ পাওয়া যাবে, তার মধ্যে একটি কাজ হলো মেহমানদারি করা, মানুষকে খাওয়ানো। আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জান্নাতের মধ্যে একটি বালাখানা (প্রাসাদ) আছে। এর ভেতর থেকে বাইরের এবং বাইরে থেকে  ভেতরের দৃশ্য দেখা যায়। এক বেদুইন (গ্রাম্য লোক) দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! এই বালাখানা কোন ব্যক্তির জন্য? তিনি বলেন, যে লোক মানুষের সঙ্গে উত্তমভাবে কথা বলে, ক্ষুধার্তকে খাদ্য দেয়, সর্বদা রোজা পালন করে এবং মানুষ যখন রাতে ঘুমিয়ে থাকে, তখন আল্লাহ তাআলার উদ্দেশে নামাজ আদায় করে। (তিরমিজি, হাদিস : ১৯৮৪)

আল্লাহর সন্তুষ্টি : মেহমানদারির দ্বারা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া যায়। নবীজি (সা.)-এর যুগে এক আনসারি দম্পতি নিজেদের অভাব থাকা সত্ত্বেও মেহমানের সমাদর করেছিল। এতে মহান আল্লাহ এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে তিনি এ ব্যাপারে কোরআনে আয়াত নাজিল করেছেন।

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক লোক নবী (সা.)-এর খিদমতে এলো। তিনি (সা.) তাঁর স্ত্রীদের কাছে লোক পাঠালেন। তাঁরা জানালেন, আমাদের কাছে পানি ছাড়া কিছুই নেই। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, কে আছ যে এই ব্যক্তিকে মেহমান হিসেবে নিয়ে নিজের সঙ্গে খাওয়াতে পারো? তখন এক আনসারি সাহাবি [আবু ত্বলহা (রা.)] বললেন, আমি। এই বলে তিনি মেহমানকে নিয়ে গেলেন এবং স্ত্রীকে বললেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মেহমানকে সম্মান করো। স্ত্রী বললেন, বাচ্চাদের খাবার ছাড়া আমাদের ঘরে অন্য কিছুই নেই। আনসারি বললেন, তুমি আহার প্রস্তুত করো, বাতি জ্বালাও এবং বাচ্চারা খাবার চাইলে তাদের ঘুম পাড়িয়ে দাও। স্ত্রী বাতি জ্বালালেন, বাচ্চাদের ঘুম পাড়ালেন এবং সামান্য খাবার যা তৈরি ছিল তা উপস্থিত করলেন। বাতি ঠিক করার বাহানা করে তিনি উঠে গিয়ে বাতিটি নিভিয়ে দিলেন। তারপর স্বামী-স্ত্রী দুজনই অন্ধকারের মধ্যে আহার করার মতো শব্দ করতে লাগলেন এবং মেহমানকে বোঝাতে লাগলেন যে তাঁরাও খাচ্ছেন। উভয়েই সারা রাত অভুক্ত অবস্থায় কাটালেন। ভোরে যখন তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে গেলেন, তখন তিনি (সা.) বললেন, আল্লাহ তোমাদের গত রাতের কাণ্ড দেখে হেসে দিয়েছেন অথবা বলেছেন খুশি হয়েছেন এবং এই আয়াত নাজিল করেছেন—‘তারা অভাবগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের ওপর অন্যদের অগ্রগণ্য করে থাকে। আর যাদের অন্তরের কৃপণতা থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে, তারাই সফলতাপ্রাপ্ত।   [সুরা : হাশর, আয়াত : ৯] (বুখারি, হাদিস : ৩৭৯৮)

 

আদব ও নিয়ম-কানুন

মেহমানকে স্বাগত জানানো : আল্লাহর রাসুল (সা.) আগত মেহমানদের স্বাগত জানাতেন। তাদের আগমনে আনন্দ প্রকাশ করতেন। (বুখারি, হাদিস : ৬১৭৬)

আন্তরিকতা প্রদর্শন করা : মেজবানের উচিত নিজ হাতে তার মেহমানদের সেবা করা, আন্তরিকভাবে তাদের হাসিমুখে গ্রহণ করা, তাদের আগমনে খুশি হয় এমন কথা বলা, যা তাদের মনকে আকর্ষণ করে। আল্লাহ তাআলা ইবরাহিম (আ.)-এর মেহমানদারি প্রসঙ্গে বলেন, অতঃপর তিনি (খাবারটি) তাদের সামনে রেখে বললেন, তোমরা কি খাচ্ছ না?

(সুরা : জারিয়াহ, আয়াত : ২৭০)

অন্তত তিন দিন পর্যন্ত মেহমানদারি করা : তিন দিন পর্যন্ত মেহমানের আপ্যায়ন করা সুন্নত। (মুসলিম, হাদিস : ৪৪০৬)

অতিথির জন্য বাড়তি চাপ নেওয়া নিষেধ : রাসুল (সা.) মেহমানদারি করতে গিয়ে সাধ্যের বাইরে অহেতুক খরচ করে আপ্যায়নের কৃত্রিমতা প্রদর্শন করতে নিষেধ করেছেন। সালমান (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি তাঁর কাছে প্রবেশ করল (মেহমান হলো)। তখন তিনি (সালমান) যা তাঁর কাছে ছিল তা দিয়ে তার আপ্যায়ন করলেন। তারপর বললেন, যদি না রাসুল (সা.) আমাদের নিষেধ করতেন, (অথবা বলেছেন) যদি না আমাদের নিষেধ করা হতো যে আমাদের কেউ যেন তার সাথির জন্য কষ্ট স্বীকার না করে, তাহলে আমরা অবশ্যই তোমার জন্য কষ্ট স্বীকার করতাম (অর্থাৎ মেহমানদারিতে অহেতুক খরচ করতাম)।

(মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৩৭৭৪)

হাফেজ ইবন রজব (রহ.) জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম-এ বলেছেন, এটি এ বিষয়ে প্রমাণ যে মেহমানকে আতিথেয়তা দেওয়ার দায়িত্ব কেবল তখনই বাধ্যতামূলক, যখন কারো কাছে কিছু অতিরিক্ত থাকে। যদি তার কাছে অতিরিক্ত কিছু না থাকে, তাহলে তার ওপর কিছুই আবশ্যক নয়। আর কেউ যদি নিজেকে অগ্রাহ্য করে (অর্থাৎ নিজের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও) অন্যকে প্রাধান্য দেয়, যেমনসেই আনসারি সাহাবি করেছিলেন, যাঁর সম্পর্কে আল্লাহ নাজিল করেছেন—‘তাহলে সেটা উত্তম মর্যাদা ও ইহসানের স্তরে পড়ে, কিন্তু তা ফরজ নয়।

নিজ হাতে অতিথিদের আপ্যায়ন করা : সাহাবায়ে কেরাম মেহমানকে নিজ হাতে আপ্যায়ন করতেন। খাবার পরিবেশন করতেন। (বুখারি, হাদিস : ৫১৮৩)

খাবার পরিবেশনে বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রাধান্য দেওয়া : খাবার পরিবেশনের সময় তুলনামূলক বয়স্কদের প্রাধান্য দেওয়া, এরপর ডান দিক থেকে পরিবেশন করাও সুন্নত। কারণ রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন কোনো কওমকে পান করাতেন, তখন বলতেন, বড় থেকে শুরু করো। (মুসনাদে আবি ইয়ালা)

মেহমানকে এগিয়ে দেওয়া : বিদায়ের সময় মেহমানকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়াও মেহমানদারির গুরুত্বপূর্ণ আদব। (ফাতহুল বারি : ৯/৫২৮)

 

মেহমানের আদব

আবুল লায়স সমরকন্দী বলেন, মেহমানের ওপর চারটি বিষয় রয়েছে

প্রথমত, তাকে যেখানে বসানো হয়, সেখানেই বসবে।

দ্বিতীয়ত, মেজবান যা কিছু দেয়, তাতে সে সন্তুষ্ট থাকবে।

তৃতীয়ত, মেজবানের অনুমতি ছাড়া সে উঠবে না।

চতুর্থত, বিদায়ের সময় সে মেজবানের জন্য দোয়া করবে।

কোরআন-হাদিসে মেহমানের পালনীয় আরো কিছু আদব পাওয়া যায়

খাবার শেষ হলে সেখানে আর দেরি না করা।

(সুরা : আহজাব, আয়াত : ৫৩)

দাওয়াতের বাইরে অতিরিক্ত কোনো মেহমান সঙ্গে এলে মেজবানের অনুমতি নেওয়া। (বুখারি, হাদিস : ৫৪৩৪)

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

কোরআন থেকে শিক্ষা

    পব, ৭৪৫
শেয়ার
কোরআন থেকে শিক্ষা

আয়াতের অর্থ : ‘তারা বলে, এ কেমন রাসুল যে আহার করে, হাটে-বাজারে চলাফেরা করে; তাঁর কাছে কোনো ফেরেশতা কেন অবতীর্ণ করা হলো না, যে তাঁর সঙ্গে থাকত সতর্ককারীরূপে? অথবা তাঁকে ধন ভাণ্ডার দেওয়া হয় না কেন? ...দেখ, তারা তোমার কী উপমা দেয়! তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে, ফলে তারা পথ পাবে না। কত মহান তিনি, যিনি ইচ্ছা করলে তোমাকে দিতে পারেন এর চেয়ে উত্তম বস্তু—উদ্যানগুলো, যার নিম্নদেশে নদী-নালা প্রবাহিত এবং তিনি দিতে পারেন তোমাকে প্রাসাদগুলো!’

(সুরা : ফোরকান, আয়াত : ৭-১০)

আয়াতগুলোতে মহানবী (সা.)-এর ব্যাপারে অবিশ্বাসীদের আপত্তির উত্তর দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষা ও বিধান

১. আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়, মহানবী (সা.) মাটির তৈরি রক্ত-মাংসের মানুষ। মক্কার মুশরিকরা যা অসম্ভব মনে করত।

২. ধন-সম্পদ ও সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি ধর্মীয় নেতৃত্ব নির্বাচনের মানদণ্ড হতে পারে না। তার ভিত্তি হবে আল্লাহভীতি ও উত্তম গুণাবলি।

৩. ঈমান-ইসলামের ওপর চলা লোকদের নির্বোধ ও বোকা মনে করা অবিশ্বাসীদের পুরনো রীতি।

৪. আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও দ্বিনকে নিয়ে মন্দ উপমা দেওয়া, উপহাস করা কাফির-মুশরিকদের বৈশিষ্ট্য।

৫. মুমিন পার্থিব জীবনে সম্পদহীন থাকাকে দোষের মনে করে না। কেননা সে বিশ্বাস করে তার জন্য চিরস্থায়ী জান্নাত প্রস্তুত আছে।

(আত-তাহরির ওয়াত-তানভির : ১৮/৩২৬)

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

রাগ স্বাস্থ্য ও আমলকে ক্ষতিগ্রস্ত করে

মুফতি সাইফুল ইসলাম
মুফতি সাইফুল ইসলাম
শেয়ার
রাগ স্বাস্থ্য ও আমলকে ক্ষতিগ্রস্ত করে

মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। রক্ত, মাংস আর শিরা-উপশিরায় তৈরি এই মানবদেহ এমন সূক্ষ্মাতি-সূক্ষ্ম অনুভূতিবোধ দিয়ে তৈরি, যেখানে সামান্য কিছুতেই মানুষ খুশি হয়, রাগ হয়, সুখ অনুভব করে ও কষ্ট পায়। কাজেই এ কথা অবলীলায় বলা যায় যে রাগ মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। কিন্তু রাগ যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তখন তা নিজ শরীর বা পরকালীন

আমলনামা—সর্বত্রই বিপদের কারণ হিসেবে পরিগণিত হয়।

হাদিস শরিফে অনিয়ন্ত্রিত রাগকে শয়তানের প্রভাবের ফল হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। নবীজি (সা.) বলেছেন, রাগ হলো শয়তানি প্রভাবের ফল। শয়তানকে আগুন থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।

(আবু দাউদ, হাদিস : ৪৭৮৪)

শয়তানের প্রভাবে যখন মানুষ প্রভাবিত হয়, তখন তার মাধ্যমে এমন কাজ সংঘটিত হওয়া স্বাভাবিক, যা তার আমল ও জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

এ জন্যই হয়তো প্রিয় নবীজি (সা.) তাঁর উম্মতদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘রাগ কোরো না।’ আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত যে এক ব্যক্তি নবী (সা.)-এর কাছে এসে বলল, আপনি আমাকে অসিয়ত করুন। তিনি বললেন, তুমি রাগ কোরো না। লোকটি কয়েকবার তা বললেন, নবী (সা.) প্রতিবারই বললেন, রাগ কোরো না।
(বুখারি, হাদিস : ৬১১৬)

অপর এক হাদিসে এসেছে—‘প্রকৃত বীর সে নয়, যে কাউকে কুস্তিতে হারিয়ে দেয়; বরং সে-ই আসল বীর, যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে।’

(বুখারি, হাদিস : ৬১১৪)

অনিয়ন্ত্রিত রাগ মানুষকে শারীরিক অনেক ক্ষতির মধ্যে ফেলতে পারে, যা কখনো কখনো জীবনও হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

২০১৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণাপত্র নিশ্চিত করেছে যে ‘রাগ হূিপণ্ডের কার্যকারিতা ধ্বংস করে দেয় এবং রাগের পরের দুই ঘণ্টার মধ্যে মারাত্মক হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে আট গুণেরও বেশি বৃদ্ধি করে।’ সেখানে গবেষকরা বলছেন, একবার রেগে গেলে আপনার হূত্স্পন্দন দ্রুত হয়, রক্ত প্রবাহ বৃদ্ধি পায়, জমাট বাঁধা বৃদ্ধি পায়, রক্তনালি সংকুচিত হয় এবং রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। ফলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়।

সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিওফ্রে টফলার বলেছেন, ‘মানুষের প্রতি আমাদের বার্তা হলো তাদের সচেতন থাকা উচিত যে তীব্র রাগ বা উদ্বেগের বিস্ফোরণ করোনারি রোগের কারণ হতে পারে, তাই যেখানে সম্ভব প্রতিরোধমূলক কৌশলগুলো বিবেচনা করুন।’

ওই গবেষণাপত্রে বিজ্ঞানীরা রাগ না করার পরামর্শ দিয়েছেন। আর যদি রাগ এসেই যায়, তাহলে হার্ট অ্যাটাক থেকে বাঁচার জন্য রাগ নিয়ন্ত্রণে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পরামর্শ দিয়েছেন। যেমন—দাঁড়ানো থাকলে বসে যাওয়া, মুখে কিছু পানি ঢালা এবং রাগের কারণ ভুলে যাওয়ার জন্য রাগ নিয়ন্ত্রণে হাদিসের নির্দেশনাও একই রকম। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের কারো যদি দাঁড়ানো অবস্থায় রাগের উদ্রেক হয়, তাহলে সে যেন বসে পড়ে। এতে যদি তার রাগ দূর হয় তো ভালো, অন্যথায় সে যেন শুয়ে পড়ে।’

(আবু দাউদ, হাদিস : ৪৭৮২)

এসব হাদিসে এ কথার প্রমাণ বহন করে যে নবী (সা.) রাগকে যেকোনো উপায়ে হলেও দমন ও নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের নির্দেশনা দিয়ে গেছেন।

আমরা সামাজিক জীব হিসেবে সমাজের নানা আচারে বিচরণের ক্ষেত্রে রাগান্বিত হতেই পারি, মন্দ অনুভূতির সম্মুখীন হতেই পারি। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রাগকে নিয়ন্ত্রণ করা। সব চেয়ে উত্তম উপায় হচ্ছে প্রতিপক্ষকে ক্ষমা করে দেওয়া। যেমন—মহান আল্লাহ তাআলা সুরা শুরায় খাঁটি মুমিনের গুণাবলি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘যারা মহাপাপ ও অশ্লীল কাজ থেকে দূরে থাকে এবং ক্রোধান্বিত হলে ক্ষমা করে দেয়।’

(সুরা : শুরা, আয়াত : ৩৭)

মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে দুনিয়ার জীবনে সুস্থতা ও পরকালীন জীবনে মুক্তির জন্য হলেও নিজেদের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে খাঁটি মুমিনের দলভুক্ত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও মুহাদ্দিস

saifpas352@gmail.com

 

মন্তব্য

বিক্রয়কর্মী অতিরিক্ত মুনাফা নিতে পারবেন?

মুফতি আবদুল্লাহ নুর
মুফতি আবদুল্লাহ নুর
শেয়ার
বিক্রয়কর্মী অতিরিক্ত মুনাফা নিতে পারবেন?

বিক্রয়কর্মী কম্পানির নিযুক্ত ওয়াকিল বা প্রতিনিধি। প্রতিনিধির দায়িত্ব হলো তাঁকে যিনি নিযুক্ত করেছেন তাঁর নির্দেশনা অনুসারে কাজ করা। সুতরাং বিক্রয়কর্মীর জন্য কম্পানির নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে পণ্য বিক্রি করা বৈধ নয়। আর যদি কম্পানি পণ্য নির্ধারণ করে দিয়ে না থাকে, তবে বিক্রয়কর্মী অধিক মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে পারেন।

তবে উভয় অবস্থায় অতিরিক্ত মূল্য বা অর্থ কম্পানিই লাভ করবে। বিক্রয়কর্মীর জন্য তা গ্রহণ করা জায়েজ হবে না। কেননা বিক্রয়কর্মী মূলত কম্পানির পক্ষ থেকে বিক্রয় করেন এবং অর্জিত মুনাফার শতভাগ মালিকও কম্পানি।

উরওয়া (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করিম (সা.) তাঁকে তাঁর জন্য একটি ছাগল কিনতে এক দিনার দেন।

উরওয়া (রা.) এক দিনার দিয়ে তাঁর জন্য দুটি ছাগল কেনেন। তারপর একটি ছাগল এক দিনারে বিক্রি করে দেন এবং এক দিনার ও একটি ছাগল নিয়ে নবী (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর জন্য বরকতের দোয়া করেন। এরপর থেকে উরওয়া (রা.) মাটি কিনলে তাতে লাভবান হতেন।
(বুখারি, হাদিস : ৩৬৪৩)

এ ক্ষেত্রে উরওয়া (রা.) নবী (সা.)-এর নিযুক্ত ক্রয় প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি ক্রয়-বিক্রয়ে লাভ করতে পেরেছিলেন। লাভটা ছিল নবী (সা.)-এর জন্য। লাভ যদি উরওয়া (রা.)-এর জন্য হতো তাহলে নবী (সা.) তা গ্রহণ করতেন না।

যদি কম্পানি একটি মূল্য নির্ধারণ করে দিয়ে বলে আপনি বেশি দামে বিক্রি করলে লাভটা আপনার জন্য।

তখন অতিরিক্ত মুনাফার মালিক হবেন বিক্রয়কর্মী।

(আল মুগনি : ৭/৩৬১)

 

মন্তব্য

মানুষের গোটা জীবনই পরীক্ষাস্বরূপ

মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা
মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা
শেয়ার
মানুষের গোটা জীবনই পরীক্ষাস্বরূপ

সম্প্রতি দেশে শুরু হয়েছে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষা। পরীক্ষা ঘিরে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না। পরীক্ষার বহু আগে থেকেই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা দিন-রাত পরিশ্রম করে ভালো ফলের জন্য। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য।

মহান আল্লাহ সব পরীক্ষার্থীকে কৃতকার্য হয়ে দেশ-জাতি ও ইসলামের পক্ষে কাজ করার জন্য কবুল করুন।

এই পরীক্ষাগুলো মুমিনদের জীবন-পরীক্ষার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কারণ পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষই পরীক্ষার্থী। গোটা পৃথিবীটাই একটি পরীক্ষাগার।

মহান আল্লাহ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে বানিয়েছেন তাঁর বান্দাদের পরীক্ষা করার জন্য। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, তিনি (আল্লাহ) সেই সত্তা, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। আর তাঁর আরশ ছিল পানির ওপর, যেন তিনি যাচাই করতে পারেন, তোমাদের মধ্যে কে কর্মে শ্রেষ্ঠ...। (সুরা : হুদ, আয়াত : ৭)

অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ আরো বলেন, পৃথিবীতে যা কিছু আছে, আমি তা তার জন্য শোভা বানিয়েছি, যেন আমি পরীক্ষা করতে পারি মানুষের মধ্যে আমলে কে শ্রেষ্ঠ।

(সুরা : কাহফ, আয়াত : ৭)

পৃথিবীতে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য বহু নিয়ামত সৃষ্টি করেছেন। এই নিয়ামতগুলো ভোগ করার নিয়ম-কানুন দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি পরীক্ষা করছেন, কারা এগুলোর ভেতর থেকেও দুনিয়াপ্রীতি সংবরণ করে মহান আল্লাহর নির্দেশনা মোতাবেক জীবন পরিচালনা করে। আর কারা এগুলোর লোভে পড়ে আল্লাহর হুকুম থেকে দূরে সরে যায়।

পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ এই পরীক্ষার ব্যাপারে তাঁর উম্মতদের সাবধান করেছেন।

তিনি বলেছেন, হে মুমিনগণ, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদের আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন না করে। আর যারা এরূপ করে তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত। আর আমি তোমাদের যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করো, তোমাদের কারো মৃত্যু আসার আগে। কেন না তখন সে বলবে, হে আমার রব, যদি আপনি আমাকে আরো কিছুকাল পর্যন্ত অবকাশ দিতেন, তাহলে আমি দান-সদকা করতাম। আর সত্ লোকদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। আর আল্লাহ কখনো কোনো প্রাণকেই অবকাশ দেবেন না, যখন তার নির্ধারিত সময় এসে যাবে। আর তোমরা যা করো সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত। (সুরা : মুনাফিকুন, আয়াত : ৯-১১)

আমাদের নবীজি (সা.)-ও তাঁর উম্মতদের দুনিয়ার এই পরীক্ষা সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। একদিন তিনি তাঁর এক ভাষণে বলেছেন, নিশ্চয়ই দুনিয়া সবুজ-শ্যামল ও লোভনীয়। আল্লাহ তাআলা দুনিয়ায় তোমাদের খলিফা (প্রতিনিধি) বানিয়েছেন। তিনি দেখবেন যে তোমরা কেমন কাজ করো। সাবধান! দুনিয়া সম্পর্কে সতর্ক হও এবং নারীদের সম্পর্কেও সতর্ক হও। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪০০০)

এ জন্য প্রত্যেক মুমিনের উচিত দুনিয়ার চাকচিক্যের মোহে পড়ে তাদের আসল কাজ ভুলে না যাওয়া। পরকালের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া, যে কালের শুরু আছে শেষ নেই। ক্ষুদ্র এই জীবনকে সাজাতে গিয়ে অসীম জীবনের সফলতা থেকে বঞ্চিত না হওয়া। প্রত্যেক মানুষের জীবনই পরীক্ষাস্বরূপ। জন্ম থেকে মৃত্যুর এই মধ্যবর্তী সময়টা মানুষ কিভাবে কাটায় মহান আল্লাহ তা যাচাই করেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, তিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন, তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য। কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।

(সুরা : মুলক, আয়াত : ২)

দুনিয়ার পরীক্ষায় একবার অকৃতকার্য হলে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ আছে, কিন্তু এই পরীক্ষা একবারই হয়। দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই প্রত্যেক মুমিনের উচিত সময় থাকতে নিজেদের সব পাপ থেকে বিরত হয়ে আল্লাহর পথে ধাবিত হওয়া। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, প্রত্যেকের জন্যই একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে, সেদিকেই সে মুখ করে। কাজেই তোমরা সত্ কাজের দিকে ধাবমান হও। যেখানেই তোমরা অবস্থান করো, আল্লাহ তোমাদের সবাইকে একত্র করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব বস্তুর ওপর ক্ষমতাবান।

(সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৪৮)

মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে জীবন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমাদের সব পাপ ও উদাসীনতা ক্ষমা করুন। আমিন।

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ