পবিত্র কোরআনে পৃথিবী, নভোমণ্ডল, দিন-রাতের বিবর্তন, মহাশূন্য, প্রাণী ও উদ্ভিদ জগৎ, মানবদেহ ইত্যাদি সম্পর্কে বহুবার চিন্তাশীল লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। বিজ্ঞানের নতুন কোনো আবিষ্কার কোরআনের কোনো বক্তব্য ভুল প্রমাণ করতে পারেনি। অনেক পণ্ডিত এ নিয়ে গবেষণা করেছেন। প্রসঙ্গত ফরাসি বিজ্ঞানী ড. মরিস বুকাইলির ‘বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান’ গ্রন্থটির কথা বলা যায়।
জার্মান গবেষক ড. কার্ল অপিটযাই তাঁর সুবিখ্যাত ‘Die Medizin in Koran’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে কোরআনের ১১৪ সুরার মধ্যে ৯৭টি সুরার ৩৫৫ আয়াত চিকিৎসাবিজ্ঞানসংশ্লিষ্ট। তিনি এসব আয়াত নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। আয়াতগুলোকে তিনি তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। তা হলো—
১. চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ের আয়াত
এতে আছে—
ক. সৃষ্টি, ভ্রূণ, গর্ভধারণ, গর্ভাবস্থা, শিশু পরিচর্যা, আয়তকাল ইত্যাদির আলোচনা
খ. শরীর জ্ঞান (Anatomy), শরীরবৃত্ত (Physiology) : গ. নিদানশাস্ত্র (Pathology) নিদান (Etiology), মননবিদ্যা (Psychology), মনমা নিদান (Psycho-Pathology) ঘ. সাধারণ চিকিৎসা ও বিশেষ চিকিৎসা।
ঙ. মৃত্যু ও পুনর্জীবন।
২. স্বাস্থ্যবিদ্যা
ক. ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি; পোশাক, বিশ্রাম, পুষ্টি, পানীয় ইত্যাদি।
খ. সমাজগত স্বাস্থ্যবিধি : ঘরবাড়ি, সংক্রামক ব্যাধি।
গ. আকস্মিক মহাদুর্ঘটনা, মহামারি।
৩. Gesundheitsgesetze তথা স্বাস্থ্যবিধান
ক. শারীরিক পুষ্টি বিধান; মদ, গোশত ইত্যাদি বিষয়ক।
খ. যৌন বিধি-বিধান, সুষ্ঠু ও অসুষ্ঠু যৌনক্রিয়া।
গ. আনুষ্ঠানিক বিধি-বিধান; ত্বকচ্ছেদ, রোজা, অজু, গোসল, পীড়া, ক্রান্তি, বিনোদন ইত্যাদি।
ঘ. সামাজিক বিধি বিধান; হত্যা, প্রতিশোধ, অভিভাবকত্ব।
স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ছয়টি পূর্বশর্ত
১. বায়ু—পরিচ্ছন্ন বায়ু স্বাস্থ্যের জন্য একান্ত প্রয়োজন;
২. খাদ্য ও পানীয়
৩. দৈহিক বিশ্রাম ও চলাফেরা
৪. ঘুম
৫. আবেগপূর্ণ বিশ্রাম ও চলাফেরা (গতিবিধি)
৬. নিঃসরণ ও ধারণ।
মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রধান কয়েকটি বিষয়
১. শারীরবৃত্ত
২. অঙ্গব্যবচ্ছেদবিদ্যা
৩. রোগ নির্ণয়বিদ্যা
৪. কারণবিদ্যা (ইলমুল আসবাব)
৫. রোগ লক্ষণবিদ্যা
৬. স্বাস্থ্যবিজ্ঞান (হিফজআল সিহাহ) (শাহ আবদুল হান্নান, তাওহীদ, বিজ্ঞান ও মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান, দৈনিক নয়াদিগন্ত, ২৫ আগস্ট ২০১৭, পৃষ্ঠা-৬)
হাদিসে চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে নির্দেশনা
চিকিৎসাবিজ্ঞানকে আল হাদিসে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রোগব্যাধি, রোগের চিকিৎসা, ওষুধ ও সুস্বাস্থ্য সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিসে বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে। মহানবী (সা.)-এর চিকিৎসা বিধান সম্পর্কে অনেক গ্রন্থ রচনা করা হয়েছে। হাদিসের শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থ ‘সহিহুল বুখারি’তে কিতাবুত তিব্ব বা মহানবীর চিকিৎসাবিজ্ঞান শীর্ষক বিশাল অধ্যায় আছে। এ হাদিসগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় বেশির ভাগই রোগ নিরাময়ের জন্য—নিবারণের ব্যবস্থা খুবই কম। তা সত্ত্বেও চিকিৎসাবিজ্ঞানকে বিশ্বনবী (সা.) যে গুরুত্ব প্রদান করেছেন তার ফল সুদূরপ্রসারী হয়েছে। অধ্যাপক ব্রাউন (
Prof. Brown) বলেছেন, নবী মুহাম্মদ (সা.) চিকিৎসাবিজ্ঞানকে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন। তাঁর ভাষ্য হলো—Prophet Muhammad is a traditions familiar to all muslims is said to have linked medicine in importance with theology বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর নির্দেশনা ছিল নিম্নরূপ—
রোগ নিরাময় পদ্ধতি : রোগ নিরাময়ের ব্যবস্থা হিসেবে মহানবী (সা.) মোটামুটি পাঁচটি পদ্ধতি ব্যবহারের উল্লেখ করেছেন।
১. হাজামত বা রক্তমোক্ষণ পদ্ধতি
২. লোলুদ বা মুখ দিয়ে ওষুধ ব্যবহার
৩. সাউত বা নাক দিয়ে ওষুধ ব্যবহার
৪. মাসিঈ বা পেটের বিশোধনের জন্য ওষুধ ব্যবহার
৫. কাওয়াই তথ্য লোহা পুড়িয়ে ছ্যাঁকা দেওয়া।
আর ওষুধ হিসেবে তিনি ব্যবহার করেছেন—১. মধু. ২. কালিজিরা, ৩. সামুদ্রিক কুস্তা বা বুড়, ৪. মেহেদি, ৫. খেজুর, ৬. জলপাই, ৭. কাঁকরোল, ৮. মক্কার সোনামুখী গাছ, ৯. মান্না—ব্যাঙের ছাতার মতো এক প্রকার উদ্ভিদ, ১০. ঘৃতকুমারী (মুসব্বর), ১১. এস্টেমনী, ১২. মৌরী, ১৩. মাদুর পোড়া ছাই, ১৪. উটের দুধ প্রভৃতি।
সাধারণত জ্বর, মাথাধরা, চোখ ওঠা, কুষ্ঠ, পুরিসি ইত্যাদি রোগের ওষুধ হিসেবে উক্ত জিনিসগুলো ব্যবহৃত হয়েছে।
(সূত্র : ইসলামের ধর্মীয় নীতি ও প্রতিষ্ঠাসমূহ এবং সাহিত্য ও বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতি,
ড. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম)