কোরআন-হাদিসে চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে মৌলিক নির্দেশনা

মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ
মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ
শেয়ার
কোরআন-হাদিসে চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে মৌলিক নির্দেশনা

পবিত্র কোরআনে পৃথিবী, নভোমণ্ডল, দিন-রাতের বিবর্তন, মহাশূন্য, প্রাণী ও উদ্ভিদ জগৎ, মানবদেহ ইত্যাদি সম্পর্কে বহুবার চিন্তাশীল লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। বিজ্ঞানের নতুন কোনো আবিষ্কার কোরআনের কোনো বক্তব্য ভুল প্রমাণ করতে পারেনি। অনেক পণ্ডিত এ নিয়ে গবেষণা করেছেন। প্রসঙ্গত ফরাসি বিজ্ঞানী ড. মরিস বুকাইলির বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান গ্রন্থটির কথা বলা যায়।

জার্মান গবেষক ড. কার্ল অপিটযাই তাঁর সুবিখ্যাত ‘Die Medizin in Koran’  গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে কোরআনের ১১৪ সুরার মধ্যে ৯৭টি সুরার ৩৫৫ আয়াত চিকিৎসাবিজ্ঞানসংশ্লিষ্ট। তিনি এসব আয়াত নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। আয়াতগুলোকে তিনি তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। তা হলো

১. চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ের আয়াত

এতে আছে

ক. সৃষ্টি, ভ্রূণ, গর্ভধারণ, গর্ভাবস্থা, শিশু পরিচর্যা, আয়তকাল ইত্যাদির আলোচনা

খ. শরীর জ্ঞান (Anatomy),  শরীরবৃত্ত (Physiology)  : গ. নিদানশাস্ত্র  (Pathology)  নিদান (Etiology),  মননবিদ্যা (Psychology), মনমা নিদান (Psycho-Pathology) ঘ. সাধারণ চিকিৎসা ও বিশেষ চিকিৎসা।

ঙ. মৃত্যু ও পুনর্জীবন।

 

২. স্বাস্থ্যবিদ্যা

ক. ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি; পোশাক, বিশ্রাম, পুষ্টি, পানীয় ইত্যাদি।

খ. সমাজগত স্বাস্থ্যবিধি : ঘরবাড়ি, সংক্রামক ব্যাধি।

গ. আকস্মিক মহাদুর্ঘটনা, মহামারি।

৩. Gesundheitsgesetze তথা স্বাস্থ্যবিধান

ক. শারীরিক পুষ্টি বিধান; মদ, গোশত ইত্যাদি বিষয়ক।

খ. যৌন বিধি-বিধান, সুষ্ঠু ও অসুষ্ঠু যৌনক্রিয়া।

গ. আনুষ্ঠানিক বিধি-বিধান; ত্বকচ্ছেদ, রোজা, অজু, গোসল, পীড়া, ক্রান্তি, বিনোদন ইত্যাদি।

ঘ. সামাজিক বিধি বিধান; হত্যা, প্রতিশোধ, অভিভাবকত্ব।

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ছয়টি পূর্বশর্ত

১. বায়ুপরিচ্ছন্ন বায়ু স্বাস্থ্যের জন্য একান্ত প্রয়োজন;

২. খাদ্য ও পানীয়

৩. দৈহিক বিশ্রাম ও চলাফেরা

৪. ঘুম

৫. আবেগপূর্ণ বিশ্রাম ও চলাফেরা (গতিবিধি)

৬. নিঃসরণ ও ধারণ।

মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রধান কয়েকটি বিষয়

১. শারীরবৃত্ত

২. অঙ্গব্যবচ্ছেদবিদ্যা

৩. রোগ নির্ণয়বিদ্যা

৪. কারণবিদ্যা (ইলমুল আসবাব)

৫. রোগ লক্ষণবিদ্যা

৬. স্বাস্থ্যবিজ্ঞান (হিফজআল সিহাহ) (শাহ আবদুল হান্নান, তাওহীদ, বিজ্ঞান ও মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান, দৈনিক নয়াদিগন্ত, ২৫ আগস্ট ২০১৭, পৃষ্ঠা-৬)

হাদিসে চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে নির্দেশনা

চিকিৎসাবিজ্ঞানকে আল হাদিসে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রোগব্যাধি, রোগের চিকিৎসা, ওষুধ ও সুস্বাস্থ্য সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিসে বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে। মহানবী (সা.)-এর চিকিৎসা বিধান সম্পর্কে অনেক গ্রন্থ রচনা করা হয়েছে। হাদিসের শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থ সহিহুল বুখারিতে কিতাবুত তিব্ব বা মহানবীর চিকিৎসাবিজ্ঞান শীর্ষক বিশাল অধ্যায় আছে। এ হাদিসগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় বেশির ভাগই রোগ নিরাময়ের জন্যনিবারণের ব্যবস্থা খুবই কম। তা সত্ত্বেও চিকিৎসাবিজ্ঞানকে বিশ্বনবী (সা.) যে গুরুত্ব প্রদান করেছেন তার ফল সুদূরপ্রসারী হয়েছে। অধ্যাপক ব্রাউন (

Prof. Brown)  বলেছেন, নবী মুহাম্মদ (সা.) চিকিৎসাবিজ্ঞানকে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন। তাঁর ভাষ্য হলো—Prophet Muhammad is a traditions familiar to all muslims is said to have linked medicine in importance with theology বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর নির্দেশনা ছিল নিম্নরূপ

রোগ নিরাময় পদ্ধতি : রোগ নিরাময়ের ব্যবস্থা হিসেবে মহানবী (সা.) মোটামুটি পাঁচটি পদ্ধতি ব্যবহারের উল্লেখ করেছেন।

১. হাজামত বা রক্তমোক্ষণ পদ্ধতি

২. লোলুদ বা মুখ দিয়ে ওষুধ ব্যবহার

৩. সাউত বা নাক দিয়ে ওষুধ ব্যবহার

৪. মাসিঈ বা পেটের বিশোধনের জন্য ওষুধ ব্যবহার

৫. কাওয়াই তথ্য লোহা পুড়িয়ে ছ্যাঁকা দেওয়া।

 

আর ওষুধ হিসেবে তিনি ব্যবহার করেছেন১. মধু. ২. কালিজিরা, ৩. সামুদ্রিক কুস্তা বা বুড়, ৪. মেহেদি, ৫. খেজুর, ৬. জলপাই, ৭. কাঁকরোল, ৮. মক্কার সোনামুখী গাছ, ৯. মান্নাব্যাঙের ছাতার মতো এক প্রকার উদ্ভিদ, ১০. ঘৃতকুমারী (মুসব্বর), ১১. এস্টেমনী, ১২. মৌরী, ১৩. মাদুর পোড়া ছাই, ১৪. উটের দুধ প্রভৃতি।

সাধারণত জ্বর, মাথাধরা, চোখ ওঠা, কুষ্ঠ, পুরিসি ইত্যাদি রোগের ওষুধ হিসেবে উক্ত জিনিসগুলো ব্যবহৃত হয়েছে।

 

(সূত্র : ইসলামের ধর্মীয় নীতি ও প্রতিষ্ঠাসমূহ এবং সাহিত্য ও বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতি,

ড. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম)

 

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

কোরআন থেকে শিক্ষা

    পর্ব, ৭৪৬
শেয়ার
কোরআন থেকে শিক্ষা

আয়াতের অর্থ : ‘কিন্তু তারা কিয়ামতকে অস্বীকার করেছে এবং যে কিয়ামতকে অস্বীকার করে তার জন্য আমি প্রস্তুত রেখেছি জ্বলন্ত অগ্নি। দূর থেকে অগ্নি যখন তাদেরকে দেখবে তখন তারা শুনতে পাবে তার ক্রুদ্ধ গর্জন ও চিৎকার; আর তাদেরকে শৃঙ্খলিত অবস্থায় তার কোনো সংকীর্ণ স্থানে নিক্ষেপ করা হবে, তখন তারা তথায় ধ্বংস কামনা করবে। তাদেরকে বলা হবে, আজ তোমরা একবারের জন্য ধ্বংস কামনা কোরো না, বহুবার ধ্বংস হওয়ার কামনা করতে থাকো। ...সেথায় তারা যা চাইবে তাদের জন্য তাই থাকবে এবং তারা স্থায়ী হবে; এই প্রতিশ্রুতি পূরণ তোমার প্রতিপালকেরই দায়িত্ব।

’ (সুরা : ফোরকান, আয়াত : ১১-১৬)

আয়াতগুলোতে জাহান্নামের ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে।

শিক্ষা ও বিধান

১. কিয়ামতের বিশ্বাস ঈমানের অপরিহার্য অংশ। কিয়ামতে বিশ্বাস না করলে কেউ মুসলমান হতে পারে না।

২. কিয়ামতে অবিশ্বাসের শাস্তি জাহান্নাম।

প্রকৃতপক্ষে কিয়ামতে অবিশ্বাস মানুষকে অপরাধপ্রবণ করে তোলে।

৩. আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বিশ্বাস হলো, জাহান্নাম এখনো বিদ্যমান। আল্লাহ তা অনাদিকাল থেকে জাহান্নামিদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন।

৪. পৃথিবীতে মানুষের কাছে মৃত্যু যতটা অনাকাঙ্ক্ষিত, জাহান্নামে পাপীদের কাছে মৃত্যু ততটা কাঙ্ক্ষিত হবে।

৫. আল্লাহ অনুগ্রহপূর্বক বান্দাকে জান্নাত দানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। নতুবা আল্লাহর ওপর কোনো কিছু অপরিহার্য নয়। (বুরহানুল কুরআন : ২/৬০৭)

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

জাহেলি আরবে যেসব মূর্তির পূজা হতো

মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ
মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ
শেয়ার
জাহেলি আরবে যেসব মূর্তির পূজা হতো

লাত ও উজ্জা ছিল কুরাইশের দুই দেবতা। কুরাইশের লোকেরা ঘুমানোর আগে লাত ও উজ্জার পূজা করত।

(মুসনাদে আহমাদ, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-২২২)

এ দুটির নামে কসম খেতো। হজের সময় তারা মানাতকে ঘিরে তাওয়াফ করত।

(মুজামুল বুলদান, আল-উজ্জা ভুক্তি)

সুরা নুহের ভেতর যেসব মূর্তির কথা বলা হয়েছে আরবের বিভিন্ন গোত্র এগুলোর পূজা করত। ওয়াদ্দ ছিল দুমাতুল জান্দালে বনি কালবের দেবতা। সুওয়াআ ছিল হুজাইল গোত্রের দেবতা। মুরাদ ও বনি গাতফানের গোত্রগুলোর দেবতা ছিল ইয়াগুস

ইয়াউক পূজিত হতো হামদান গোত্রে। নাসর ছিল হিময়ারি জুল কালা গোত্রের উপাস্য। (সহিহ বুখারি, সংশ্লিষ্ট আয়াতের তাফসির) শামে পূজা করা হতো বায়াল-এর। (তাফসিরে বায়জাবি, সুরা সাফফাতের তাফসির)

মূর্তির নাম বিশ্লেষণ

লাত : আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) ও অন্যদের থেকে বর্ণিত হয়েছে যে লাত শব্দটি থেকে এটা নিষ্পন্ন, এর অর্থ হলো সংমিশ্রণ।

আরবে একজন লোক ছিল, লোকটি হজের মৌসুমে একটি পাথরের ওপর বসে থাকত এবং ছাতু গুলিয়ে গুলিয়ে হাজিদের মধ্যে বিতরণ করত। লোকটির মৃত্যুর পর মানুষ ওই পাথর পূজা শুরু করে দিল এবং এটির নাম রাখল লাত (মিশ্রণকারী)। (সহিহ বুখারি, তাফসির সুরা নাজম; ফাতহুল বারি)

আল-উজ্জা : আল-উজ্জা অর্থ হলো প্রতাপ, প্রতিপত্তি। এই শব্দের ইসমুত তাফজিল বা অগ্রাধিকার-বিশেষণ স্ত্রীলিঙ্গ হলো উজ্জা। অর্থাৎ মহাপরাক্রমশালী দেবী।

এতে বিস্ময়ের কিছু নেই যে উজ্জা কুরাইশ ও একই বংশীয় অন্যান্য গোত্রের যুদ্ধের দেবী ছিল। এ কারণেই হয়তো উহুদ যুদ্ধে মুসলমানরা পরাজিত হলে আবু সুফিয়ান পাহাড়ের ওপর থেকে চিৎকার করে বলেছিলেন : আমাদের রয়েছে উজ্জা, তোমাদের তো উজ্জা নেই। তখন নবী করিম (সা.) কর্তৃক উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-কে তার জবাব দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়, যেন তিনি এই কথা বলেন—‘আল্লাহ আমাদের অভিভাবক এবং তোমাদের কোনো অভিভাবক নেই।

(সহিহ বুখারি, গাজওয়াতু উহুদ)

মানাত : মানাত শব্দটি কয়েকটি মূল ধাতু থেকে নির্গত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। লিসানুল আরব প্রণেতা উল্লেখ করেছেন যে মানাত-এর তা স্ত্রীলিঙ্গবাচক। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, মানাত ভাগ্য ও মৃত্যুর দেবী ছিল।

ওয়াদ্দ : ওয়াদ্দ অর্থ অনুরাগ ও ভালোবাসা। এর বিপরীতে ছিল ঘৃণা ও শত্রুতার দেবী, তার নাম ছিল নিকরা। ওয়াদ্দ দেবতার কথা বিভিন্ন শিলালিপিতে পাওয়া যায়।

সুওয়াআ : আরবি ভাষা সুওয়াআ শব্দটির মূল ধাতু পাওয়া যায় না। যার অর্থ যুগ।

ইয়াউক : যার অর্থ রুখে দেওয়া। এই মূর্তির পূজা করত ইয়ামানবাসীরা। তাদের মধ্যে প্রতীক হিসেবে ভবিষ্যত্বাচক ক্রিয়াপদের ব্যাপকতা ছিল।

ইয়াগুস : ইয়াউকের পদ্ধতি অনুযায়ী ইয়াগুসও একটি প্রতীক। এর অর্থ হলো ফরিয়াদ করা। সুতরাং ইয়াগুসের অর্থ হলো যে ফরিয়াদ শোনে এবং ফরিয়াদের প্রতিকার করে।

নাসর : নাসর একটি পরিচিত পাখি শকুন। আকাশে শকুন আকৃতি ধারণকারী একগুচ্ছ নক্ষত্রকে নাসর (ভেগা) বলা হয়। ভেগা নক্ষত্র একটি দেবতা হিসেবে দীর্ঘকাল পর্যন্ত সেমেটিক জাতিগোষ্ঠীগুলোর পূজা লাভ করেছে। বাবেলের অন্যতম দেবতা ছিল নাসরুক। ইদানীংকালে বাবেলে এই দেবতার মূর্তি উদ্ঘাটিত হয়েছে।

বায়াল : বায়াল সম্পর্কে আগেই বলা হয়েছে যে এই দেবতা শামের উপাস্য ছিল। এ প্রসঙ্গেই এটির উল্লেখ কোরআন মাজিদে রয়েছে। বায়ালের শাব্দিক অর্থ শক্তি। রূপকার্থে নেতা ও সর্দারকেও বায়াল বলা হয়। একইভাবে স্বামী অর্থেও বায়াল শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কোরআন মাজিদে শব্দটি দ্বিতীয় অর্থে বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। আরবের একটি বিখ্যাত দেবতা ছিল হুবাল। হুবাল ছিল কুরাইশের সবচেয়ে বড় উপাস্য। হুবাল বায়ালেরই

বিকৃতরূপ।

আরবের মূর্তি ইউরোপে

বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে আরবের তাওহিদবাদীরাই প্রথমে ইউরোপীয় দেশগুলোতে একত্ববাদের আলো ছড়ান, একইভাবে আরবের জাহেলি যুগই ইউরোপের মূর্তিপূজাকালের শিক্ষক ছিল। আরব বণিকদের মাধ্যমে গ্রিসে, গ্রিস থেকে ইউরোপের অন্যান্য দেশে আরবের দেবদেবী ছড়িয়ে পড়ে। সেসব দেশের লোকেরা এসব মূর্তির সামনে সিজদাবনত হয়ে এগুলো উপাসনা করতে শুরু করে। কথিত আছে যে গ্রিক দেবী লেটো (জিউসের পত্নী খবঃড়) আরবের লাতেরই বিকৃতরূপ। একইভাবে হুবাল হার্মিস হয়েছে। হুবাল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা এসেছে মুজামুল বুলদান নামক গ্রন্থে। কিছু প্রাচ্যবিদ এ বিষয়ে পুস্তিকা রচনা করেছেন। (এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলাম,

খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩৮০)

মন্তব্য

নবীযুগের প্রখ্যাত কারি উবাই ইবনে কাব (রা.)

মাওলানা মুহিউদ্দীন হাতিয়ূভী
মাওলানা মুহিউদ্দীন হাতিয়ূভী
শেয়ার
নবীযুগের প্রখ্যাত কারি উবাই ইবনে কাব (রা.)

নবীজি (সা.)-এর বিশেষ প্রতিভাবান সাহাবিদের একজন সাইয়্যিদুল কুররা উবাই ইবনে কাব (রা.)। তাঁর নাম উবাই। উপনাম আবু মুনযির ও আবুত তুফাইল। প্রথমটি দিয়েছেন রাসুল (সা.) এবং দ্বিতীয়টি হজরত উমর (রা.)।

উপাধি সাইয়্যিদুল কুররা (প্রধান কারি)। বংশীয় দিক থেকে তিনি মদিনার বিখ্যাত খাজরাজ গোত্রের বনু নাজ্জার শাখার সন্তান। তাই তাঁকে নাজ্জারি বলা হয়। ইসলামী পরিচয়ে তাঁকে আনসারি বলা হয়।
বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী হিসেবে বদরি বলা হয়। ইলমে কিরাআতে অগাধ দক্ষতার কারণে সাইয়্যিদুল কুররামুকরি বলা হয়। প্রসিদ্ধ সাহাবি আবু তালহা আনসারি (রা.) তাঁর মামাতো ভাই। (সিয়ার আলামিন নুবালা : ১/৩৮৯-৩৯০, উসদুল গাবাহ : ১/৬১)

 

ইসলাম-পূর্ব জীবন ও ইসলাম গ্রহণ

হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে ইসলাম-পূর্ব জীবনে মদিনায় ইহুদিদের অন্যতম ধর্মগুরু গণ্য করা হতো।

প্রাচীন আসমানি কিতাবগুলোর জ্ঞানও ছিল তাঁর। সে যুগে পড়ালেখার তেমন পরিবেশ ছিল না। তা সত্ত্বেও তিনি লিখতে জানতেন। এ কারণে তিনি ইসলাম গ্রহণের পর রাসুল (সা.)-এর লেখালেখির দায়িত্ব পালনের সৌভাগ্য অর্জন করেন। (আল-আলাম : ১/৮২)

রাসুল (সা.) মদিনায় হিজরতের পূর্বে কোনো একসময় উবাই ইবনে কাব (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন।

মিনার আকাবার দ্বিতীয় (শেষ) শপথে অংশগ্রহণ করেন। তাতে মদিনায় হিজরতের পর রাসুল (সা.)-কে পূর্ণ সহায়তার দৃঢ় অঙ্গীকার করেন। তিনি বদর, উহুদ, খন্দকসহ সব যুদ্ধে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে অংশ নেন। (আল-আলাম : ১/৮২; সিয়ার আলামিন নুবালা : ১/৩৯০; আল-ইসাবাহ : ১/১৮১)

 

ওহি লেখার সৌভাগ্য

যাঁরা রাসুল (সা.)-এর ওহি লিখতেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.)। হজরত যায়েদ ইবনে সাবিত (রা.)-এর পূর্বে তিনিই ওহি লিখতেন। তিনি উপস্থিত না থাকলে রাসুল (সা.) হজরত যায়েদ (রা.)-কে ডেকে নিতেন। পরবর্তী সময়ে হজরত যায়েদ (রা.) বেশি লিখতেন।

(আল-ইস্তিআব : ১/৬৮)

 

ইলমি দক্ষতা

উবাই ইবনে কাব (রা.) ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদিতে ব্যস্ত না হয়ে মসজিদে নববীতে কোরআনের পাঠ-পঠন-পদ্ধতিসহ দ্বিনি ইলম অর্জনের পেছনে সময় দিতেন। এভাবে রাসুল (সা.)-এর সাহচর্যে থেকে ইলমে ওহির বিশাল ভাণ্ডার অর্জন করেন। একসময় তিনি ইলম ও আমলের সাজে সজ্জিত হয়ে মহান মর্যাদার অধিকারী হন। রাসুল (সা.)-এর যুগেই তিনি ফতোয়া দিতেন। দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.) তারাবির জামাত চালু করেন। ইমাম হিসেবে নিয়োগ দেন হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে।

(আল-আলাম : ১/৮২; সিয়ার আলামিন নুবালা : ১/৩৯৪; আবু দাউদ : ১/২০২)

ইমাম শাবি (রহ.) তাবেঈ মাসরূক (রহ.) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.)-এর পক্ষ থেকে অনুমোদনপ্রাপ্ত বিচারক ও ফতোয়া দাতা ছয়জনের একজন ছিলেন উবাই ইবনে কাব (রা.)।

(উসদুল গাবাহ : ১/৬২)

 

ইলমে কিরাআত ও উবাই ইবনে কাব (রা.)

রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায় তিনি কোরআনের একটি পূর্ণ সংকলন প্রস্তুত করেন এবং তা রাসুল (সা.)-এর সামনে পেশ করেন। এই সংকলনটি মাসহাবে উবাই নামে খ্যাত ছিল। কোরআনের বিভিন্ন পাঠ-পদ্ধতিতে ছিল তাঁর অসাধারণ দক্ষতা। তাঁর তিলাওয়াতে ছিল বিশেষ আকর্ষণ। রাসুল (সা.) মাঝেমধ্যে তাঁর থেকে কোরআন শুনতেন। আনাস (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.) উবাইকে বললেন, আল্লাহ আমাকে আদেশ করেছেন, তোমাকে কোরআন শোনাতে। হজরত উবাই বললেন, আল্লাহ কি আমার নাম উল্লেখ করেছেন? ইরশাদ করলেন, হ্যাঁ। এরপর বললেন, আমি রাব্বুল আলামিনের দরবারে আলোচিত হয়েছি? ইরশাদ করলেন, হ্যাঁ। তখন তাঁর দুই চোখ অশ্রুতে ভরে গেল। (বুখারি : ৭৪১, মুসলিম : ১/২৬৯,

সিয়ার আলামিন নুবালা : ১/৩৯৪)

হাদিস : উবাই ইবনে কাব (রা.) সূত্রে ১৬৪টি হাদিস বর্ণিত আছে। এর মধ্যে বুখারি-মুসলিম যৌথভাবে তিনটি এবং পৃথকভাবে বুখারি তিনটি ও মুসলিম সাতটি হাদিস বর্ণনা করেছেন।

ইন্তেকাল : উবাই ইবনে কাব (রা.) মদিনায় ইন্তেকাল করেন। (মুজামুস সাহাবা : ১/৩)

তবে কোন সনে, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। আবু নুআইম (রহ.) বলেন, এক মতে ২২ হিজরি উমর (রা.)-এর খিলাফতে, আবার এক মতে ৩০ হিজরি উসমান (রা.)-এর খিলাফতে। দ্বিতীয় মতই গ্রহণযোগ্য। (উসদুল গাবাহ : ১/৬৩ পৃ.; আল-ইসাবাহ : ১/১৮১-১৮২ পৃ.; আত-ত্বাবাকাতুল কুবরা : ৩/৩৮১ পৃ., ক্র.১৭৪; তাহজিবুল আসমা ওয়াল লুগাত : ১/১০৯-১১০ পৃ.)

লেখক : মুহাদ্দিস ও গবেষক

 

মন্তব্য

জান্নাতে আল্লাহর দিদার লাভের ৬ আমল

আসআদ শাহীন
আসআদ শাহীন
শেয়ার
জান্নাতে আল্লাহর দিদার লাভের ৬ আমল
ছবি : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি প্রতীকী চিত্র

আল্লাহ তাআলাকে নিজ চোখে দেখা মহা সৌভাগ্যের বিষয়, যা পরকালে মুমিনদের জন্য নির্ধারিত। জান্নাতের অফুরন্ত সুখ-সুবিধা ও অনাবিল আনন্দের মধ্যেও আল্লাহর দিদার হবে এমন এক পরম আনন্দ, যা জান্নাতবাসীরা অন্য সব আনন্দ ভুলে যাবে।

আসুন, জান্নাতে আল্লাহর দিদার লাভের কিছু আমল জেনে নিই

প্রথম আমল : ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করা

আল্লাহর দিদার লাভের প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো, একজন ব্যক্তি ইসলামের অনুসরণে থেকে মৃত্যুবরণ করবে। কারণ অবিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহর দিদার হারাম করা হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন, কখনো নয়! বস্তুত তারা সে দিন তাদের প্রতিপালকের দিদার (দর্শন) থেকে বঞ্চিত থাকবে।

(সুরা : আল মুতাফফিফীন, আয়াত : ১৫)

অর্থাৎ গুনাহ ও কুফরির জন্য তাদের কঠিন শাস্তি হলো, তারা কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার দিদার থেকে বঞ্চিত হবে। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে মুমিনরা কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলাকে দেখতে পাবে, আর কাফিররা এই মহান নিয়ামত থেকে বঞ্চিত থাকবে।

দ্বিতীয় আমল : আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করা

আল্লাহ তাআলার দিদার লাভের অন্যতম মাধ্যম হলোতাঁর কাছে এই মহান নিয়ামত লাভের জন্য আন্তরিকভাবে দোয়া করা।

আল্লাহ তাআলা দোয়া কবুলকারী, আর তাঁর বান্দাদের আন্তরিক দোয়া তিনি প্রত্যাখ্যান করেন না। কায়েস ইবনে উবাদা (রা.) বর্ণনা করেন যে রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি বিশেষ দোয়া পড়তেন, যাতে আল্লাহর দিদারের জন্য দোয়া করা হয়েছে। সেই দোয়াটি হলো—‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে (জান্নাতে) তোমার দিদার লাভ করতে চাই এবং ক্ষতিকর কষ্ট ও পথভ্রষ্টকারীর ফাসাদে পড়া ছাড়া তোমার সাক্ষাতের আশা-আকাঙ্ক্ষা করি। হে আল্লাহ! আমাদের ঈমানের বলে বলীয়ান করো আর হেদায়েতপ্রাপ্ত ও হেদায়েত প্রদর্শনকারী করো।
(সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ১৩০৫)

তৃতীয় আমল : ফজর ও আসরের নামাজের পাবন্দি করা

জান্নাতে আল্লাহ তাআলার দিদার লাভের অন্যতম মাধ্যম হলো সব নামাজের প্রতি যত্নবান হওয়া, বিশেষত ফজর ও আসরের নামাজ নিয়মিতভাবে আদায় করা। জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন : একদা আমরা নবী করিম (সা.)-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তিনি রাতে (পূর্ণিমার) চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ওই চাঁদকে তোমরা যেমন দেখছ, ঠিক তেমনি অচিরেই তোমাদের প্রতিপালককে তোমরা দেখতে পাবে। তাঁকে দেখতে তোমরা কোনো ভিড়ের সম্মুখীন হবে না। কাজেই সূর্য উদয়ের ও অস্ত যাওয়ার আগের নামাজ (শয়তানের প্রভাবমুক্ত হয়ে) আদায় করতে পারলে তোমরা তা-ই করবে।

(বুখারি, হাদিস : ৫৫৪)

চতুর্থ আমল : গুনাহ থেকে মুক্ত থাকা

জান্নাতে আল্লাহ তাআলার দিদার লাভের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলোসব ধরনের গুনাহ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। হজরত আবু জর গিফারি (রা.) বর্ণনা করেন যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণির লোকের সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না এবং তাদের পবিত্র করবেন না; বরং তাদের জন্য রয়েছে ভয়ানক শাস্তি। বর্ণনাকারী বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এ কথাটি তিনবার পাঠ করলেন। আবু জর (রা.) বলে উঠলেন, তারা ধ্বংস হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে। হে আল্লাহর রাসুল! এরা কারা? তিনি বলেন, যে লোক পায়ের গোছার নিচে কাপড় ঝুলিয়ে চলে, কোনো কিছু দান করে খোঁটা দেয় এবং মিথ্যা শপথ করে পণ্যদ্রব্য বিক্রি করে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৯৪)

পঞ্চম আমল : আল্লাহ তাআলার সাক্ষাৎ ও দিদারের আকাঙ্ক্ষা

জান্নাতে আল্লাহ তাআলার দিদার লাভের অন্যতম মাধ্যম হলোআল্লাহ তাআলার সঙ্গে সাক্ষাতের প্রবল আকাঙ্ক্ষা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ পছন্দ করে, আল্লাহও তার সাক্ষাৎ পছন্দ করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ পছন্দ করে না, আল্লাহও তার সাক্ষাৎ পছন্দ করেন না। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৫০৭)

ষষ্ঠ আমল : ইহসান করা

জান্নাতে আল্লাহ তাআলার দিদার লাভের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো ইহসান বা সৎকর্ম করা।

ইহসানের অর্থ হলো, সৃষ্টিজীবের প্রতি যেকোনো ভালো কাজ করা এবং কল্যাণমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখা। এটি এমন একটি গুণ, যা মানুষের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ সুগম করে। ইমাম জুরজানি (রহ.) ইহসানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, ইহসান হলো সেই কাজ, যা দুনিয়াতে প্রশংসিত হয় এবং পরকালে প্রতিদান ও সওয়াবের কারণ হয়। (আল-তারিফাত, পৃষ্ঠা-৯১)

আল্লাহ তাআলা আমাদের উপরিউক্ত আমল পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ