হাজং বাংলাদেশের সমতল অঞ্চলের একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। বৃহত্তর ময়মনসিংহের মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশসংলগ্ন সমতল ভূমিতে এদের বসবাস। এর মধ্যে কিছুসংখ্যক হাজং জনগোষ্ঠীর বসবাস শেরপুরের ঝিনাইগাতী, সুনামগঞ্জের মধ্যনগর এবং নেত্রকোনার কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চলের সমতল ভূমিতে। বর্তমানে বাংলাদেশে হাজংদের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার।
এ জনগোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। রয়েছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে টংক আন্দোলনসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা গৌরবময় সংগ্রামী ইতিহাস।
হাজং ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী নিজেদের মধ্যেই এ ভাষা ব্যবহার করে। হাজং ভাষার নিজস্ব কোনো বর্ণমালাও নেই।
হাজংরা ভাষার লিখিত রূপ দিতে অসমীয়া বর্ণমালা ব্যবহার করে থাকে। তবে বাংলাদেশে বসবাসকারী হাজংদের প্রধান ভাষা বাংলা। হাজং ছেলেমেয়েরা বাংলা ভাষাতেই বিদ্যালয়ে পাঠ গ্রহণ করে এবং অন্য সমাজের লোকজনের সঙ্গে হাজংরা বাংলা ভাষাই ব্যবহার করে।
অন্যদিকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত না হওয়া, চর্চা আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে হাজং ভাষা।
বর্ণমালাহীন এ ভাষা টিকিয়ে রাখতে সাহসী লড়াইয়ে নেমেছেন অন্তর হাজং (২৯) নামের এক যুবক। তিনি ২০১৯ সাল থেকে গ্রামে গ্রামে গিয়ে হাজং ভাষা শিক্ষাচর্চা শুরু করেন। নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও শেরপুর জেলার হাজং অধ্যুষিত ১০১টি গ্রামের কখনো বাড়ির উঠানে, কখনো গাছতলায়, কখনো মন্দিরে, যখন যেখানে সুবিধা পেয়েছেন সেখানেই শিশু থেকে সব বয়সীদের হাজং ভাষা চর্চা করানোর কাজ করেন। ফলে নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও কিছুটা হলেও মাতৃভাষা শেখাতে পারছেন হাজং শিশু-কিশোরদের। হাজং ভাষায় নিজস্ব বর্ণমালা না থাকায় বয়োবৃদ্ধদের কাছ থেকে কথ্য ভাষার রূপ সংগ্রহ করেই হাজং ভাষা রক্ষার অসম লড়াই করে যাচ্ছেন তিনি।
অন্তর হাজং নেত্রকোর দুর্গাপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী খুজিগড়া গ্রামের বাসিন্দা। তাঁর বাবা রহিন্দ্র হাজং ও মা হিন্দুবালা হাজং পেশায় দিনমজুর। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার ছোট অন্তর। ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনা বিভাগে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন বছরখানেক আগে। টিউশনির আয় দিয়ে হাজং ভাষা রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। অসহায়, দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদেরও সাধ্যমতো সহায়তা করে থাকেন।
অন্তর ১৪ ফেব্রুয়ারি পাশের দুর্গাপুর উপজেলা থেকে ৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলার ঘিলগড়া গ্রামে আসেন। সেখানে হাজং সম্প্রদায়ের শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সী ৩০-৩২ জনকে হাজং ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন। সেখানে ছন্দ ও গল্পের ছলে কেউ হাজং ভাষার গান করেছেন, কেউবা কবিতা পড়েছেন, কেউ আবার মাতৃভাষার গুরুত্ব তুলে ধরেন।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, ‘অন্তর হাজং নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষায় যে কাজ করছেন তা অবশ্যই ভালো কাজ। তিনি যদি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তাঁকে এই মহৎ কর্মে প্রয়োজনীয় সহায়তা করা হবে।’
