কিশোর সংশোধন কেন্দ্রের নাম পরিবর্তন করে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র করার এক যুগ পরও দৃশ্যত কোনো উন্নয়ন ঘটেনি। অভিযোগ রয়েছে, উন্নয়ন তো দূরের কথা, শিশুদের সংশোধনে সাধারণ যেসব উপাদান ও সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা, সেসবের কিছুই নেই এসব কেন্দ্রে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নামের পরিবর্তন করা হলেও প্রতিষ্ঠানগুলোর মানের কোনো তারতম্য হয়নি। উন্নয়ন কেন্দ্রে যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকতে হয়, সেসবের কিছুই নেই এসব প্রতিষ্ঠানে।
শিশুদের আটক রাখা এবং জামিন বা মুক্তি দেওয়ার মতো স্বাভাবিক কার্যক্রম নিয়েই পরিচালিত হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। রয়েছে পর্যাপ্ত জনবলসংকট। মানসম্মত উন্নয়ন কেন্দ্র গড়ে তুলতে ‘কাউন্সেলর’ ছাড়াও কয়েকটি বিষয় অপরিহার্য। এসব উন্নয়ন কেন্দ্রে যেহেতু শিশুরা থাকে, সেখানে পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্স, বিনোদনের ব্যবস্থা, প্রাথমিক শিক্ষা ও বিভিন্ন ট্রেডে দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
‘শিশু (কিশোর/কিশোরী) উন্নয়ন কেন্দ্রের’ প্রধান শর্ত বা লক্ষ্যগুলোর প্রথমটি হলো কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে শিশুদের অপরাধপ্রবণ মানসিকতার পরিবর্তন করা। অথচ ২০১৩ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি ‘উন্নয়ন’ কেন্দ্র হিসেবে পরিচালিত হলেও জনবলকাঠামোতে এখন পর্যন্ত ‘কাউন্সেলর’ পদটি যুক্ত করা হয়নি।
দেশে বর্তমানে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীন তিনটি শিশু (কিশোর/কিশোরী) উন্নয়ন কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। এগুলো হলো গাজীপুরের টঙ্গীতে অবস্থিত শিশু (বালক) উন্নয়ন কেন্দ্র, গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে শিশু (বালিকা) উন্নয়ন কেন্দ্র এবং যশোর পুলেরহাটে শিশু (বালক) উন্নয়ন কেন্দ্র।
এসব প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের মধ্যেও কাউন্সেলিংসহ বাকি উপাদানগুলো বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে কেন্দ্র থেকে বের হওয়ার পর শিশুরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে কি না, তা পর্যবেক্ষণের কথাও বলা আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব লক্ষ্যের কোনোটিই পূরণ করতে পারছে না বিদ্যমান উন্নয়ন কেন্দ্রগুলো। প্রতিষ্ঠালগ্ন (১৯৭৮) থেকেই কেন্দ্রগুলোতে জনবলসংকট প্রকট। বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ পদ ফাঁকা।
বেশির ভাগ শিক্ষক পদে জনবল নেই। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষক না থাকায় তিনটি কেন্দ্রের ৯টি ট্রেড কোর্স বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।
টঙ্গীর উন্নয়ন কেন্দ্রে ৩০০ শিশুর ধারণক্ষমতা থাকলেও বেশির ভাগ সময় সেখানে পাঁচ শতাধিক শিশু গাদাগাদি করে থাকছে। কখনো তা বেড়ে তিন গুণে দাঁড়ায়। যশোর বালক শাখায় ১৫০ শিশুর ধারণক্ষমতা থাকলেও প্রায় দ্বিগুণ শিশু থাকছে। এসব শিশুর শারীরিক বিকাশের লক্ষ্যে পর্যাপ্ত ডাক্তার বা নার্স থাকা বাধ্যতামূলক হলেও জনবলকাঠামোতে এখনো এসব পদ যুক্ত হয়নি।
মানবাধিকারকর্মী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফৌজিয়া করিম ফিরোজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রধান শর্ত কাউন্সেলিং ব্যবস্থা থাকা। কাউন্সেলর না থাকলে একটি প্রতিষ্ঠানকে উন্নয়ন কেন্দ্র বলা যায় না। যে লক্ষ্য নিয়ে উন্নয়ন কেন্দ্র করা হয়েছে, আজও তা পূরণ হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘সরকারি এসব প্রতিষ্ঠান কিভাবে চলছে, তা সঠিকভাবে মনিটর করা হচ্ছে না। গত ১৫ থেকে ২০ বছর সরকারি খাতে কেউ স্বচ্ছতার ও জবাবদিহির মধ্যে ছিল না।’
সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য মতে, তিনটি কেন্দ্রে বর্তমানে মোট অনুমোদিত জনবল ১৪৩। বর্তমানে মাত্র ৮৩ জন কাজ করছেন, ৬০টি পদই ফাঁকা। গত ১২ মার্চ পর্যন্ত এসব উন্নয়ন কেন্দ্রে মোট শিশু ছিল ৮০০ জন। এদিন সারা দেশের বিভিন্ন কোর্ট ও কারাগার থেকে মোট ১২ শিশুকে কেন্দ্রে আনা হয়, জামিনে মুক্তি পায় ১৩ শিশু। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত এই তিনটি কেন্দ্র থেকে জামিন ও মুক্তি পেয়েছে ৬০ হাজার ৬২১ জন। সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) এবং কেন্দ্রগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সমির মল্লিক সংকটের বিষয়গুলোর কথা স্বীকার করেন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের একটি প্রকল্প থেকে কিছুসংখ্যক কাউন্সেলর উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোতে খণ্ডকালীন কাজ করছেন। তবে ওই প্রকল্প শেষ হলে কেন্দ্রগুলোর বড় চ্যালেঞ্জ দেখা দিতে পারে। প্রতি সপ্তাহে থোক বরাদ্দের মাধ্যমে কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসক নিয়ে আসা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের জনবলসংকট আছে, এ বিষয়টি অস্বীকার করা যাবে না। নানা সংকটের কারণে জামিনে যাওয়া শিশুদের তদারকির ব্যবস্থা এখনো গড়ে তুলতে পারিনি। তবে শিশুদের উন্নয়নে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।’