ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১০ এপ্রিল ২০২৫
২৭ চৈত্র ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৬

ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১০ এপ্রিল ২০২৫
২৭ চৈত্র ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৬
শামসুর রাহমানের সাক্ষাৎকার

প্রত্যেক কবিই তার নিজের পথ নিজে খুঁজে নেয়

  • [২০০০ সালের গ্রীষ্মে পুরো একটি দুপুর কাটে কবি শামুসর রাহমানের বাড়িতে। এফডিসি থেকে একটি ইউনিট ভাড়া করে সেদিন তাঁর বাসায় যাই। উদ্দেশ্য ছিল ডকুমেন্টারি করার। সারা দিন চিত্রগ্রহণ, সাক্ষাৎকার ও প্রয়োজনীয় ফুটেজ নেওয়ার কাজ চলে। তবে নানা কারণে সেই ডকুমেন্টারিটি আর হয়ে ওঠেনি। তাই সেদিনের সেই আলাপচারিতার নির্বাচিত অংশ লিখিত আকারে কবির অসংখ্য গুণগ্রাহীর জন্য তুলে ধরা হলো। হাসানআল আব্দুল্লাহ]
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
প্রত্যেক কবিই তার নিজের পথ নিজে খুঁজে নেয়
ছবি : এস এম সাইফুল ইসলাম

হাসানআল আব্দুল্লাহ : রাহমান ভাই আপনার বাল্যকাল, শৈশব কেটেছে ঢাকায়। আপনার জন্ম বেড়ে ওঠা ঢাকায়। তখনকার ঢাকার অবস্থা ও সাহিত্যিক পরিমণ্ডল সম্পর্কে আমাদের একটু ধারণা দিন।

শামসুর রাহমান : সত্যি কথা বলতে কি, বাল্যকালে সাহিত্য কী তা জানতাম না এবং সাহিত্যিক পরিবেশ কী আছে ঢাকায় তা আমার জ্ঞানের অনেক বাইরে ছিল।

একটা সাহিত্যিক পরিবেশ যে থাকা দরকার তারও কোনো ধারণা ছিল না। আমি যখন ক্লাস নাইন-টেনে, রবীন্দ্রনাথের কিছু গল্প আমাদের পাঠ্য ছিল। এটা শুনতে খারাপ লাগবে যে রবীন্দ্রনাথ কে এবং কী আমি অতটা বুঝতেই পারিনি এবং আমার মনে ওই সব গল্প কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি। কিন্তু অনেক পরে, ম্যাট্রিক পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর...একদিন ঘুমিয়ে ছিলাম; রবীন্দ্রনাথের যে গল্পের বই পাঠ্য বই ছিল, সেটি বিছানার পাশে পড়ে ছিল, আমার ঘুম ভেঙে গেছে, বিকেলবেলায় বইটা তুলে পড়তে শুরু করলাম।
পড়তে পড়তে প্রতিটি গল্প আশ্চর্য একটি জগৎ আমার সামনে উন্মোচিত করল। ‘গল্পগুচ্ছ’ দ্বিতীয় খণ্ড। রবীন্দ্রনাথ কে ছিলেন আমি জানি না। কিন্তু সেদিন, বিকেলবেলায়, আমার এই প্রথম মনে হলো, একি মানুষের লেখা! এত সুন্দর, এত ভালো লেখা, এটা নিশ্চয়ই কোনো ফেরেশতা কিংবা দেবতার লেখা।
তারপর থেকেই সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক বাড়ল। মানে, সাহিত্য যে একটি ব্যাপার এটা আমার কাছে ধরা দিল।

হাসানআল : আপনি লেখালেখি শুরু করলেন কবে?

রাহমান : আরো পরে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেই লিখতে শুরু করলাম।

হাসানআল : বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আপনি যখন লেখালেখি শুরু করলেন,  আপনার কবিতা লেখার প্রথম দিকের কিছু কথা বলুন।

রাহমান : প্রথম দিকে যা লিখতে শুরু করলাম সেগুলো কতটা কবিতা আমি তা জানি না।

তবে লিখতাম আমার ভেতর থেকে। বানিয়ে লিখতে হবে, এই ব্যাপারটি আমার তখন ছিল না। কবিতার টেকনিকগুলো অনেক পরে আয়ত্ত করেছি। প্রথম দিকে মনে যা আসত আমি লিখতাম। একদিন একটি কবিতা লিখলাম, লিখে আমার এক বন্ধু শিল্পী হামিদুর রাহমানকে শোনালাম। সে-ও লিখত; কিন্তু আমি লেখা শুরু করার পর সে লেখা বন্ধ করে দিল। তখন সে ছবি আঁকার দিকে ঝুঁকে পড়ল। কারণ তখন সে যা লিখত আমার লেখার মতো হয়ে যেত। প্রতিচ্ছবি বলা যাক কিংবা অন্য কিছু হোক, কিন্তু অনেক বেশি আমারই লেখা মনে হতো। তখন সে নিজে থেকেই লেখা বাদ দিয়ে দিল।

হাসানআল : কোন পত্রিকায় আপনার প্রথম লেখা ছাপা হলো?

রাহমান : আমার প্রথম লেখা ছাপা হলো...‘সোনার বাংলা’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায়, যা বেরোতো ঢাকা থেকে। সেই পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন, আরো কেউ কেউ, যেমন—প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছেন। আমি ‘১৯৪৯’ বলে একটি কবিতা লিখেছিলাম। সেটি আমি হামিদকে শুনিয়েছিলাম। হামিদ বলল, তুমি ছাপতে দাও না কেন! কিন্তু আমার মনে হলো, আমার কবিতা কে ছাপবে! সে বলল তুমি দিয়েই দেখো না। ওর কথা অনুযায়ী আমি একদিন গেলাম ‘সোনার বাংলা’ অফিসে। সেখানে গিয়ে আমি দাঁড়ালাম। দোতলায়, দেখলাম একজন ভদ্রলোক বসে আছেন। ফতুয়া পরা। চেহারা খুব সুন্দর। বেশ ব্যক্তিত্বসুলভ। লম্বা চুল। একটু ভয়ই লাগল। তিনি বসে আছেন। আমি গিয়ে তাঁঁকে কবিতাটি দিলাম। একটু বেশ ভয় করেই দিলাম। তখন তিনিই সম্পাদনা করতেন। কবিতাটি নিয়ে দেখলেনও না। রেখে দিলেন। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ দেখলাম তিনি কবিতাটির দিকে তাকালেন। হাতে তুলে নিলেন। আমাকে কিছু বলছেন না। আমি দাঁড়িয়েই আছি। তিনি পড়া শুরু করেছেন! কিছুক্ষণ পড়ার পর... তিনি হাত দিয়ে ইশারা করলেন বসার জন্য। আমি একটু ভরসা পেলাম। পড়া শেষে কবিতাটি রেখে দিলেন এবং বললেন যে সামনের সপ্তাহে ছাপা হবে। ‘১৯৪৯’ নাম ছিল, অর্থাৎ ’৪৮-এর শেষের দিকে লেখা। তখন বিশ্বাস করতে পারলাম না যে আমার কবিতা ছাপা হবে। আমি আর ওখানে অপেক্ষা করলাম না, দৌড়ে, প্রায় দৌড়ে, দোতলা থেকে নামলাম। কী করে যে নামলাম তা জানি না। চলে এলাম। ছাপা হলো। কবিতা ছাপা হওয়ার পর হামিদ খুব খুশি হলো এবং আমাকে রিভারভিউ ক্যাফেতে নিয়ে চা, বিস্কুট, কেক ইত্যাদি খাওয়াল। তারপর আমি বাসায় এলাম। বাসায় এসে আমার কবিতা মাকে দেখালাম। বাবাকে দেখানোর সাহস আমার ছিল না। মাকে যখন দেখাচ্ছিলাম, তখন বাবা অন্য ঘর থেকে সেই ঘর দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন। তিনি বললেন, আমি এসব অনেক দেখেছি। সে পারবে এ রকম কবি হতে! তিনি একজন কবির নাম বললেন। এখন সেই কবির নাম মনে নেই। তেমন কোনো ইম্পর্টেন্ট কবিও না। আমি বললাম... আমি দাঁড়িয়ে বললাম, আমি যদি কবি হই, তাহলে তার থেকে বড় কবি হব। বাবা আমার দিকে চোখ বড় করে তাকালেন। এই বলেই আমি তাড়াতাড়ি দৌড়ে পাশের ঘরে চলে গেলাম। এইভাবে লেখা শুরু করলাম।

হাসানআল : রাহমান ভাই, কবিতার ভাব-ভাষা ও ছন্দ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আপনি প্রথম দিকে ছন্দ কিভাবে আয়ত্ত করলেন?

রাহমান : কবিতা পড়েই আমার ছন্দের দিকে ঝোঁক হলো। কেননা ছন্দ আমাকে নাড়া দিত। আমি তখন নতুন, ইনিভার্সিটিতে যেতাম। আমার বন্ধুত্ব হয় জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর সঙ্গে।  তাঁর হাতে একটা বই দেখলাম। নামটা আমার পছন্দ হয়েছে, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’।

হাসানআল : জীবনানন্দের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ পড়ে আপনি কবিতার প্রতি আরো বেশি ঝুঁকে গেলেন। কিন্তু ছন্দ, ছন্দের যে গ্রামার, এটা শেখার জন্য হয়তো কোনো বই পড়েছেন!

রাহমান : কবিতা থেকেই আমার ধারণা এসেছে। কিন্তু গ্রামার প্রথমে পড়েছি কোনো ছন্দের বই নয়, আগের বাংলা ব্যাকরণ বইয়ে, জানি না এখন আছে কি না, শেষের দিকে ছন্দ সম্পর্কে একটা অংশ থাকত। ও থেকে আমি কিছুটা শিখেছি। তারপর কবিতা পড়েও শিখেছি। ঠিক বোঝানো যায় না কিভাবে শেখা হয়েছে।

হাসানআল : আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’। এই নামটি কেন বেছে নিলেন?

রাহমান : কেন নিয়েছিলাম আজ আর মনে নেই। তবে যে কবিতাটি ছিল [নাম কবিতা] ওটার যে নায়ক, তার আত্মহত্যার টেনডেন্সি ছিল। সে মারা যাবে। মৃত্যুর আগে সে একটি গান গাইবে। গান গাইবে মানে তার মনের কথা বলবে, সেই অর্থে। গ্রিক একটি মিথলজির সঙ্গে যোগ করে আমি কবিতাটি লিখেছিলাম।

হাসানআল : আপনারা যখন কবিতা লেখা শুরু করেন, তখন আপনাদের সামনে রবীন্দ্রনাথের পরও তিরিশের দশক ছিল। তিরিশের এই আধুনিক কবিতার সঙ্গে, পঞ্চপাণ্ডব এবং আরো অন্যান্য কবি বাংলা কবিতায় যে আধুনিক স্বরটি নিয়ে এলেন, এই অধুনিকতার সঙ্গে বা তাঁদের বুনন সৌকর্যের সঙ্গে আপনারা পঞ্চাশের যাঁরা নক্ষত্র, তাঁদের কবিতার পার্থক্য কিভাবে নিরূপণ করবেন?

রাহমান : আসলে একটি সময় একজন কবিকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাঁর মন তো কাজ করেই; কিন্তু মনের ওপর সময়টা কাজ করে। তিরিশের কবিদের যে সময় এবং আমরা যাঁরা পরে, পঞ্চাশে লিখতে শুরু করলাম, তাঁদের চিন্তা ও মনন, আমাদের চিন্তা ও মনন একটু অন্য রকম হয়ে গেছে। তাঁদের প্রভাব আমাদের মধ্যে আছে। কিন্তু লেখার ভঙ্গি আমরা অনেকটা অন্য রকম করেছি। আমাদের সাবজেক্টও আলাদা হয়ে গেছে। যেমন—আমরা যে দেশে বাস করি এবং এখানকার রাজনীতি, এখানকার সামাজিক পরিবেশ ইত্যাদি আমাদের টাচ করেছে, আমরা সেটার মূল্যায়ন করেই কবিতা লিখেছি।

হাসানআল : আজকে উত্তরাধুনিক হাওয়া বইছে, পোস্ট-মডার্নিজমের হাওয়া বইছে সারা পৃথিবীতে এবং বাংলাদেশে এই মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে কিছু কবি ভিন্ন ধরনের কবিতা লিখছেন। আপনার কবিতা থেকে আলাদা। শহীদ কাদরীর কবিতা থেকে আলাদা। এঁদের কবিতা তো নিশ্চয়ই পড়েন। এই সময়ের কবিতা সম্পর্কে কিছু কি বলবেন?

রাহমান : সত্যি কথা বলতে কী, এই সময়ের কবিতা আমি বুঝি না। কিছু বলা অন্যায় হবে—কারণ না বুঝে কিছু বলাটা ঠিক নয়। যতটা পড়া উচিত, হয়তো অতটা আমি পড়িনি। এটা আমার ব্যর্থতা নিশ্চয়ই; কিন্তু আমার অনেক সময় খুব ধাঁধা লাগে। মনে হয়, সবাই না, বেশ কয়েকজন, ইচ্ছা করেই এমন কিছু লেখেন যেগুলোর অর্থ ঠিক আমার কাছে প্রতিভাত হয় না। হয়তো এটা আমারই দোষ। কিন্তু এ রকম মনে হয় আমার। ভাবতে খারাপ লাগে, আমি কেন বুঝতে পারছি না।

হাসানআল : ফিরে আসি আপনার কবিতায়। দ্বিতীয় কবিতার বইয়ের নাম ‘রৌদ্র করোটি’তে। এখানে ‘দুঃখ’ নামের অসাধারণ একটি কবিতা আছে। এই কবিতার অনুপ্রেরণাটি কী ছিল? 

রাহমান : এত পুরনো হয়ে গেছে ব্যাপারগুলো। তখন কিভাবে, কী জন্য, কী ভেবে লিখেছি এখন ঠিক বলতে পারব না। তবে আমার কাছে একটা জিনিস মনে হয়েছে যে একটা সময় আসে মানুষের জীবনে, যখন দুঃখটা বড় হয়ে দেখা দেয় এবং সব কিছুতেই সে দুঃখ অনুভব করে, সেটি বলতেই নানা ধরনের উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আমি কতটা সাকসেসফুল হয়েছি সেটা...

হাসানাআল : স্বাধীনতাযুদ্ধ আর বাংলা কবিতা, বাংলাদেশের কবিতা যদি বলি, তো আপনার কবিতায়, আমারও ধারণা, যেমন বেটোফেনের সিম্ফনি, কেউ কেউ বলেন যে এ রকম সিম্ফনি আর করা সম্ভব নয়, স্বাধীনতার ওপর আপনার কয়েকটি কবিতা, যেমন ‘স্বাধীনতা তুমি’, আমার মনে হয় যে বাংলায় এই বিষয়ে এর থেকে ভালো কবিতা লেখা সম্ভব নয়। যুদ্ধের সময়ে বা স্বাধীনতার ওপর লেখা আপনার কবিতাগুলোর অনুভূতি বা ওই সময়ের অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাই।

রাহমান : আমি কবিতা দুটি লিখেছিলাম গ্রামে। ঢাকা থেকে গ্রামে পালিয়ে গিয়েছিলাম। ঢাকায় খুব অত্যাচার হচ্ছিল। গুলি হচ্ছিল।  এপ্রিলের লাস্টের দিকে চলে যাই। গ্রামে প্রায় আড়াই মাস থাকি। তারপর রসদ ফুরিয়ে গেলে, আমরা বাধ্য হয়ে ফিরে এলাম। যা হোক, ওটা আরেকটা অধ্যায়। তখন একদিন দুপুরে, আমাদের যে পুকুর ওখানে, সেই পুকুরের কিনারে, চতুর্দিকে গাছ, সেই গাছতলায় বসেছিলাম। এমন সময় কিছু ছোট ছেলে-মেয়ে গোসল করছিল। বেশ হল্লা করে। কেমন যেন ওদের ওই স্নান ও উদ্দামতা আমার মনে একটি দাগ কাটল। তখন কবিতা লেখার মানসিকতা ছিল না, কিন্তু হঠাৎ একটা তাড়না বোধ করলাম। আমি তাড়াতাড়ি বাসায় ঢুকলাম। সঙ্গে তো কিছুই আনিনি, কলমও আনিনি, পেনসিলও আনিনি, খাতাও আনিনি। আমার চাচাতো ভাই, সে গ্রামের স্কুলেরই ছাত্র। ওটা প্রথমে আমার দাদা করেছিলেন। একেবারে নিম্ন শ্রেণির স্কুল ছিল ওটা। বাবা পরে হাই স্কুলে পরিণত করেন। আমার চাচাতো ভাই, ছোট। ক্লাস ফোর বা ফাইভে পড়ে। ওর কাছ থেকে আমি চেয়ে একটা খাতা ও পেনসিল নিলাম। বসলাম গিয়ে পুকুরপারে। বিশ্বাস করবে কি না জানি না, ২৫-৩০ মিনিটের মধ্যে আমি পরপর দুটি কবিতা লিখে ফেললাম। আগে ‘স্বাধীনতা তুমি’। দ্বিতীয় হলো ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’।

হাসানআল : আপনি তো সনেট লিখছেন অনেক দিন ধরে। ‘মাতাল ঋত্বিক’ আপনার একটি সনেটের বই। আমি নিজেও অনেক দিন ধরে সনেটের কাজ করছি। আমারও এ বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহ আছে। আপনার অন্যান্য কবিতার সঙ্গে সনেটের উৎকর্ষ বা প্রাপ্তি সম্পর্কে কিছু বলুন।

রাহমান : সার্থক সনেট লেখা খুব কঠিন। কেননা এটিকে একটি সংযমের মধ্যে রাখতে হয়। আরো বেশ কিছু জিনিস আছে, যেগুলোকে বাগ মানানো বেশ কঠিন। কঠিন ও জটিল বলেই অনেক সময় চ্যালেঞ্জ হিসেবে কবিরা গ্রহণ করেন বোধ হয়। আমিও সেই হিসেবে গ্রহণ করেছি এবং চেষ্টা করেছি সনেটকে মানুষের কাছে, পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার; আকর্ষণীয় করে তোলার।

হাসানআল : স্বাধীনতার এই তিরিশ বছর পরে আপনার কি মনে হয়, যে স্বপ্ন নিয়ে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছিলেন, প্রাণ দিয়েছিলেন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে?

রাহমান : যুদ্ধের ফল তো ভালো, কারণ আমরা নিজেদের স্বাধীন মনে করতে পারি। আমাদের মাথার ওপরে কেউ নেই—এ রকম মনে করতে পারি। কিন্তু কিছু কিছু লোক, কিছু কিছু দল, এটাকে পাকিস্তান বানাতে চায়, বানানোর জন্য তাদের উদ্যম লক্ষ করা যায়। তারা বলেও ওরকম। এতে মনে হয় যে আমরা যে লক্ষ্যে পৌঁছতে চেয়েছিলাম সেটা এখনো পারিনি। কিছুটা খামতি রয়ে গেছে। এবং এ খামতি দূর করার জন্য আমাদের আরো বেশি সচেতন হতে হবে, আরো বেশি সক্রিয় হতে হবে; নইলে আমাদের এই স্বাধীনতা জখমি হবে। আমি এটা মনে করি যে আমাদের সতর্ক হতে হবে। এই যে একটি প্রবণতা দেখা দিয়েছে, কিছুদিন ধরে কিছুকাল ধরে, এটা যাতে মাথা তুলতে না পারে সে জন্য সবাই একজোট হয়ে কাজ করা দরকার; নইলে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে।

হাসানআল : আমাদের শিল্প-সাহিত্যে কেমন প্রভাব পড়েছে মনে হয়? আপনার কবিতায় তো যথেষ্ট প্রভাব দেখি।

রাহমান : কারো কারো কবিতায় হয়েছে। আমারও কিছু কিছু হয়েছে। কিন্তু শুধু শিল্প-সাহিত্যে হলে চলবে না, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে, রাজনৈতিক জীবনে, এসবের মধ্যেও [স্বাধীনতার প্রভাব] থাকতে হবে। নইলে তো শুধু আমরা লিখে যাব কেউ পড়বে কি পড়বে না, তার কোনো প্রভাব পড়তেও পারে, না-ও পড়তে পারে। তাতে যেটা আমরা চাই সেটা হয়তো হবে না। আমরা হয়তো ব্যর্থ হবো। সুতরাং আমাদের আরো বেশি সতর্ক হয়ে ওই দিকটি নিয়ে কাজ করতে হবে।

হাসানআল : সবাই কবি নন, কেউ কেউ কবি। এই কেউ কেউ যাঁরা কবি তাঁদের কিন্তু বলে দেওয়া যায় না কী লিখবেন, কী ভাববেন। তাঁদের বুনন কেমন হবে। তার পরও বাংলা সাহিত্যে তরুণ কবি আসবে। প্রতিভাবান তরুণ কবি আসবে। আপনি কি এদের জন্য কিছু বলতে চান?

রাহমান : প্রত্যেক কবিই তার নিজের পথ নিজে খুঁজে নেয় এবং তাকে পরামর্শ দেওয়ার কিছু নেই। হ্যাঁ, সে যদি চায়, তাহলে হয়তো দেওয়া যেতে পারে। গায়ে পড়ে কিছু পরামর্শ দেওয়া বোধ হয় ঠিক হবে না। কেননা সে এমন একটি কাজ হয়তো করতে চায়, যাতে একজন প্রবীণ কবি কিংবা একজন বিখ্যাত কবি তাঁকে কিছু বলতে গেলে সেটা তাঁকে প্রভাবান্বিত করতে পারে। তাঁর আসল কাজ ক্ষতিগ্রস্তও হতে পারে। সুতরাং আমার মনে হয় প্রত্যেককে তাঁর মতো করে ছেড়ে দেওয়া উচিত।

হাসানআল : রাহমান ভাই, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ আমাদের সময় দেওয়ার জন্য।

রাহমান : তোমাকেও অশেষ ধন্যবাদ।

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

আদিচির নতুন বই

শেয়ার
আদিচির নতুন বই

এ মাসের ৪ তারিখে নাইজেরিয়ার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কথাসাহিত্যিক চিমামান্দা নগোজি আদিচির নতুন উপন্যাস ড্রিম কাউন্ট প্রকাশ করা হয়েছে পেঙ্গুইন র‌্যান্ডম হাউস থেকে । তাঁর আগের বই আমেরিকানাহ প্রকাশের এক যুগ পরে প্রকাশ করলেন ড্রিম কাউন্ট। বেশ দীর্ঘ সময় পরে প্রকাশ করার কারণে এবং যথারীতি তাঁর লেখার প্রতি পাঠকের টান থাকার কারণে ড্রিম কাউন্ট প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকদের নজর পড়েছে এই নতুন উপন্যাসের ওপর। আফ্রিকার সাহিত্যের পণ্ডিত পাঠক ডারিয়া টুনকা মনে করেন, এক যুগ পরে প্রকাশের কারণে পাঠক সমালোচকের প্রত্যাশা অনেক বড় হওয়ার কথা।

তিনি মনে করেন, পাঠকের চাহিদা পূরণ করার মতো যথেষ্ট সমৃদ্ধ উপন্যাস ড্রিম কাউন্ট। চরিত্রদের জীবনের ওপর বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলো ফেলা হয়েছে। নারী চরিত্ররা আবেগের দিক থেকে জোরালো, অনেক ক্ষেত্রে বিপদের সম্মুখে তারা দুর্বল; আবার কোনো কোনো পরিস্থিতিতে তারা প্রাপ্য সম্মানের অধিকারী। কোনো ক্ষেত্রে বিরূপ পরিস্থিতির শিকার তারা।
আদিচির লেখার মধ্যে তির্যক, ব্যঙ্গ এবং কঠিন রসাত্মক বিষয়াদি খুব সাধারণ বিষয়।  অন্যদিকে আফ্রিকান-আমেরিকান স্টাডিজের বর্ষীয়ান প্রফেসর এডমান্ড গর্ডন মনে করেন, যে ভয়াবহ যৌন নিপীড়নের বাস্তব ঘটনার ওপর লেখা হয়েছে সেটার মতো গাম্ভীর্য ড্রিম কাউন্ট উপন্যাসে ধরে রাখা হয়নি। তিনি মনে করেন, যে চারজন প্রধান নারী চরিত্র তৈরি করা হয়েছে তাদের তিনজনের সামাজিক স্তরের সঙ্গে খাপ খায় না নিপীড়িত নারীর চরিত্র। তার অস্তিত্বে অন্য তিনজনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন গর্ডন।
তাঁর মতে, উপন্যাসের শেষে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র কাদিয়াতু এবং তার মেয়ে বিন্তাকে যেভাবে আলোকিত পরিবেশে দেখানো হয়েছে তাতে উপন্যাসের ভাবগম্ভীর পরিবেশ খানিকটা নষ্ট হয়েছে। সমালোচকদের কথা যা-ই হোক আশা করা যায়, সময়ের সঙ্গে পাঠকের দৃষ্টি নিরপেক্ষ বিচারে গ্রহণ করবে আদিচির ড্রিম কাউন্ট

ফাহমিদা দ্যুতি

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য
বিশ্ব সাহিত্য

পেঙ্গুইন সাহিত্য পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশ

শেয়ার
পেঙ্গুইন সাহিত্য পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশ

পেঙ্গুইন র‌্যান্ডম হাউস অস্ট্রেলিয়া ২০২৫ সালের পেঙ্গুইন সাহিত্য পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশ করেছে। পেঙ্গুইন র‌্যান্ডম হাউসের অস্ট্রেলীয় শাখা সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া শুরু করে ২০১৭ সালে। এ পুরস্কারের উদ্দেশ্য হলো, কথাসাহিত্যের সম্ভাবনাময় লেখকদের খুঁজে বের করার মাধ্যমে নতুন এবং বৈচিত্র্যময় সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া। শুরু থেকে প্রতিবছরই অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে বিচিত্র বিষয়ের লেখা জমা পড়ে থাকে।

অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশ করার পর পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের বই বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে থেকে। এবারের তালিকায় রয়েছে এমা ক্ল্যান্সির থ্রিলারধর্মী উপন্যাস ব্যাড মেডসন, টিকে থাকার গল্পের ওপর তৈরি সিওভান ডারমোডির উপন্যাস সল্ট, মেরি কলুসির আধিভৌতিক বিষয়ের কাহিনি টাচ গ্রাস, র‌্যাচেল বাউম্যানের প্রত্যন্ত পরিবেশে সত্যের প্রকাশ প্রদর্শন করা উপন্যাস দ্য ফিয়ার অব এম্পটি স্পেসম সামারা লোয়ের পুরাণনির্ভর কাহিনি হয়ার দ্য লোটাস স্ট্যান্ডস এবং ডেনিস রাওয়ার্ডের প্রেম, বিরহ ও তাড়া করে ফেরা গোপন বিষয় নিয়ে লেখা উপন্যাস সো, দ্যা ওয়ার্ডস। এযাবৎ পেঙ্গুইন সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন ক্যাথরিন হাইন্ড, ইম্বি নিমি, সোফি ওভারেট, জেমস ম্যাকেঞ্জি ওয়াটসন, অ্যানেট হিগস, মিশেল সি-থো এবং ক্লো অ্যাডামস।  উল্লেখ্য, পেঙ্গুইন র‌্যান্ডম হাউস অস্ট্রেলিয়া ২০২৫-এর চূড়ান্ত পুরস্কার ষোষণা করবে জুন মাসের ১২ তারিখে।
বিজয়ী লেখক পাবেন ২০ হাজার ডলার।  

মন্তব্য
চীনের চিঠি

দক্ষিণের মেঘ : প্রাকৃতিক সৌন্দর্যঘেরা ক্যাম্পাস

    শান্তা মারিয়া
শেয়ার
দক্ষিণের মেঘ : প্রাকৃতিক সৌন্দর্যঘেরা ক্যাম্পাস

চারদিকে সবুজ পাহাড়। তার ছায়া পড়েছে লেকের জলে। সেখানে ভেসে বেড়াচ্ছে ব্ল্যাক সোয়ান বা কালো রাজহাঁস। চেরিফুলের শোভায় রঙিন হয়ে আছে চারপাশ।

এমনি সৌন্দর্যময় এক ক্যাম্পাসে আমার প্রতিদিন কাটে। এটি হলো চীনের ইয়ুননান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছ্যংকুং ক্যাম্পাস।

চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমের আরণ্যক প্রদেশ হলো ইয়ুননান। এর প্রাদেশিক রাজধানী কুনমিং শহর।

এই শহরের এক প্রান্তে বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে ছ্যংকুং জেলা। এখানে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।

এর আগে আমি এখানকারই ইয়ুননান মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার শিক্ষক হিসেবে বেশ কয়েক বছর চাকরি করেছি। করোনার সময় দেশে গিয়েছিলাম।

এখন আবার এসেছি ইয়ুননান বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার শিক্ষক হিসেবে।

চীনের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হলো ইয়ুননান বিশ্ববিদ্যালয়। কুনমিং শহরে এর দুটি ক্যাম্পাস রয়েছে। দুটি ক্যাম্পাসই পর্যটন স্থান হিসেবেও বিখ্যাত।

ইয়ুননান বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।

এর পুরনো ক্যাম্পাসটি শহরের প্রাণকেন্দ্রে সুইহু লেক বা গ্রিনলেকের কাছে অবস্থিত। বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে ইয়ুনতা নামে বেশি পরিচিত।

ইয়ুননান বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো ক্যাম্পাস বা তংলু ক্যাম্পাস এবং ছ্যংকুংয়ে অবস্থিত নতুন ক্যাম্পাস দুটোই পর্যটন স্থান হিসেবে জনপ্রিয়। তংলু ক্যাম্পাসে অনেকে আসেন এখানকার প্রাচীন গিংকোগাছগুলো দেখার জন্য। এখানে একটি দীর্ঘ হাঁটাপথ রয়েছে। শরৎকালে বা ফল সিজনে পুরো হাঁটাপথটি গিংকোগাছের সোনালি পাতায় অনন্য সুন্দর হয়ে ওঠে। এখানে ঝরাপাতার দৃশ্য আলোকচিত্রীদের দারুণভাবে আকর্ষণ করে। গ্রীষ্মকালে গিংকোগাছের সবুজ ছায়া এবং চেরি ও প্লাম ফুলের সৌন্দর্য দেখতে আসেন অনেকে।

তংলু ক্যাম্পাস একটি ছোট টিলার ওপর অবস্থিত। কাছেই বিখ্যাত গ্রিন লেক পার্ক। এখানে শীতকালে পরিযায়ী পাখিরা উড়ে আসে। সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসা পাখিরা তংলু ক্যাম্পাসেও আসে। পুরো ক্যাম্পাস এলাকার আয়তন চার লাখ ২৬ হাজার ৬৬৯ বর্গমিটার। এখানকার বিজ্ঞান ভবন, গ্রন্থাগার ভবন এবং শিক্ষা ভবন দৃষ্টিনন্দন নির্মাণশৈলীর জন্য বিখ্যাত।

তংলু ক্যাম্পাসে প্রচুর কাঠবিড়ালি রয়েছে। এখানে বাদামগাছে কাঠবিড়ালির বাসা আছে। শিক্ষার্থীরা কাঠবিড়ালিকে খাবার দেয়। কাঠবিড়ালির খেলা দেখতে এই ক্যাম্পাসে অনেকে আসেন।

ইয়ুননান বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস কুনমিংয়ের প্রান্তে বিশ্ববিদ্যালয় টাউন নামে পরিচিত ছ্যংকুং এলাকায় অবস্থিত। এই ক্যাম্পাসটি বিশাল বড়। এখানে পাহাড়, লেক, অরণ্য এবং গোলাপ ও ল্যাভেন্ডার ফুলের বাগান রয়েছে।

এখানে পাহাড়ের ওপর থেকে কুনমিংয়ের বিখ্যাত তিয়ানছি লেক এবং সিশান পাহাড়ের দৃশ্য দেখা যায়। ছ্যংকুং ক্যাম্পাসে জাকারান্দা, চেরি ও প্লাম ফুলের শোভা বিখ্যাত। এখানে ল্যাভেন্ডার ফুলের বড় বাগানের পাশে হাঁটাপথ পর্যটকদের কাছে খুব প্রিয়।

ইয়ুননান বিশ্ববিদ্যালয় চীনের অন্যতম সেরা তো বটেই, বিশ্ব র‌্যাংকিংয়েও জায়গা করে নিয়েছে। এখানে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণার জন্য বিশ্বমানের একাধিক গবেষণাগার রয়েছে। এখানকার গবেষক ও ছাত্র-শিক্ষকরা আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন টিমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণা করছেন।

কম্পিউটার সায়েন্সেও এই বিশ্ববিদ্যালযের সুনাম রয়েছে।

ইয়ুননান বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী রয়েছেন। এরা বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের বৃত্তিও দিয়ে থাকে।

এখানে এসে মনে হচ্ছে লেখাপড়ার পরিবেশ এমন না হলে কি চলে? এই শান্ত-স্নিগ্ধ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা পরিবেশে ছেলেমেয়েরা তাদের সবটুকু মন-প্রাণ দিয়ে বিদ্যাচর্চা করছেন। শিক্ষকরাও শিক্ষাদান ও গবেষণায় ব্যস্ত।

এখানে বাংলা বিভাগে ছাত্রছাত্রীদের যখন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা হয় তখন বাংলাদেশের কথা খুব মনে পড়ে। বিশেষ করে আমার আলমা ম্যাটার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের কথা। সেই সঙ্গে আরেক প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগরের কথাও। সংবাদমাধ্যমে দেখলাম জুলাই গণ-আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করায় অনেককে বহিষ্কার করা হয়েছে।

মনে পড়ল এই বিশ্ববিদ্যালয়েই ধর্ষণে সেঞ্চুরি করা ছাত্রলীগ নেতা মানিকের কথা। এমন ভয়াবহ জঘন্য অপরাধ করার পরও তার কি এমন শাস্তি হয়েছিল? সে তো দিব্যি কানাডায় বিন্দাস লাইফ কাটাচ্ছে।

অসুস্থ রাজনীতি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে দিয়েছে। শিক্ষকরা যখন দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে মেতে ওঠেন আর ক্ষমতায় যাবার খেলায় নিজেদের মহান পেশাকে কলুষিত করেন তখন আর কী-ইবা বলার থাকে। সেই সঙ্গে ছাত্ররাও নিজেদের জীবনকে ধ্বংস করে দলীয় রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হন।

আমি নব্বইয়ের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। সেসব আমার তারুণ্যের সোনালি গল্প। কিন্তু তখন ক্যাম্পাস রাজনীতির ভয়াবহ কুিসত দিকও চোখে পড়েছে। আমার অনেক বন্ধুর জীবন শেষ হয়ে গেছে দলীয় ক্যাডার হওয়ায়। অস্ত্রবাজিও ছিল পুরোদমে।

আমেরিকার ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণেরও সুযোগ হয়েছে আমার। সেখানেও দেখেছি শিক্ষার পরিবেশ কত সুন্দর।

ছাত্রছাত্রীরা রাজনীতি সচেতন অবশ্যই হবেন। অন্যায়ের প্রতিবাদও নিশ্চয়ই করবেন। কিন্তু দলীয় কুিসত রাজনীতির হাতিয়ার তাঁরা হবেন কেন? কেনই বা ক্যাম্পাসে চলবে অস্ত্রবাজি?

ফিরে আসি ইয়ুননান বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে। এখানে ছাত্রছাত্রীরা কত সুন্দর শান্তিময় জীবন কাটাচ্ছে। তার ভবিষ্যৎ জীবন গড়ার জন্য উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে। এরা ক্লাস, গবেষণাগার, লাইব্রেরিতে ব্যস্ত থাকে। পাশাপাশি ক্রীড়া ও সংস্কৃতিচর্চায়ও অনেক সময় কাটায়। আহা, আমার দেশের ছেলেমেয়েদের যদি এমন সুযোগ দেওয়া যেত।

ইয়ুন শব্দের অর্থ মেঘ। আর নান মানে দক্ষিণ। দক্ষিণের মেঘে ঢাকা এই সুন্দর স্থান থেকে বাংলাদেশের জন্য পাঠালাম অশেষ ভালোবাসা।

লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিক্ষক, ইয়ুননান বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

কাবুলিওয়ালার দ্বিতীয় অধ্যায়

    মহিবুল আলম
শেয়ার
কাবুলিওয়ালার দ্বিতীয় অধ্যায়
অঙ্কন : তানভীর মালেক

কাবুলিওয়ালা গল্পটা দিয়েই শুরু করি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাবুলিওয়ালা গল্পটার কথা আমরা কে না জানি? ছোটবেলায় বাবার বুকে শুয়ে এই গল্প কতবার শুনেছি! কাবুলিওয়ালার মিনিকে খোঁজা, কাবুলিওয়ালার চলে যাওয়ার শেষ দৃশ্যটা শুনে কতবার যে কেঁদে বুক ভাসিয়েছি! বাবা নাটকের লোক ছিলেন। নিজে নাটক লিখতেন। তাঁর নাটক তাঁদের অফিসের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মঞ্চস্থ হতো।

বাবা যখন এই কাবুলিওয়ালা গল্পটা বলতেন তখন একধরনের নাটুকে পরিবেশের সৃষ্টি হতো। বাবার গল্প বলার ঢঙটাই এমন ছিল, খোঁখী, তোমি সসুরবাড়ি কখুনু যাবে না...! বা সসুরাকে মারিতাম, কিন্তু কী করিব, হাত বাঁধা...।

দীর্ঘদিন ধরে বিদেশবিভুঁই আছি। আটাশ বছর তো হয়ে গেল।

সেই উনিশশো সাতানব্বই সালে দূরদেশে আসা সেই তরুণটির এখন মধ্যবয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। বয়স বাড়তে থাকলে যা হয়, মানুষ খুব স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠে। আমারও তা-ই হচ্ছে। কোনো গোধূলিলগ্নে পাহাড়ের ওপর বসে বা প্রশান্ত মহাসাগরের কোনো সৈকতে গা এলিয়া দিয়ে বাল্যকালের স্মৃতি নিয়ে বড্ড বেশি ভাবি।
কোনো মনোরম সবুজে, বিকেলের সূর্য ডোবার পূর্বলগ্নে বা সন্ধ্যায় পাখিদের নীড়ে ফেরা দেখে বুকটা অসম্ভব হাহাকার করে ওঠে। ফিরে যাই গ্রামে। ফিরে যাই আমাদের সেই ছোট্ট শহরে।

আসলে আমরা যেন এই পরবাসে একেকজন কাবুলিওয়ালা। স্মৃতি নিয়েই বেঁচে আছি।

কেউ কেউ তো এখানে সত্যিকারের কাবুলিওয়ালা হয়ে ওঠে। রহমত কাবুলিওয়ালার চেহারাটা স্পষ্টই ভর করে। আমাদের আজমল স্যার সে রকমই একজন কাবুলিওয়ালা ছিলেন।

আজমল স্যারের কাবুলিওয়ালা হয়ে ওঠার যে গল্প, সেটা বলার আগে তাঁর সম্বন্ধে বিস্তারিত কিছু বলি। তিনি ছিলেন বাংলাদেশে একটি স্বনামধন্য কলেজের রসায়নের সহকারী অধ্যাপক। ছাত্রজীবনেও তিনি ছিলেন খুবই মেধাবী। রসায়ন বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণি পেয়ে মাস্টার্স করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে সরাসরি একটা কলেজে প্রভাষকের চাকরি নেন। একটু দেরিতে অবশ্য বিয়ে করেন। একটা ছেলেসন্তান ছিল।

এমন ভালো ছাত্র হওয়ার পরও তিনি চাকরিজীবনে খুব একটা সফলতার মুখ দেখেননি। এর পেছনে একটাই কারণ ছিল, তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল ছিলেন। আজকালকার সমাজে নয়কে ছয় বা ছয়কে নয় করা, এর কিছুই বুঝতেন না। তাঁর সহকর্মী বন্ধুরা যখন তরতর করে ওপরে উঠে যাচ্ছিল, তখন তিনি সেই একই কলেজে সহকারী অধ্যাপক হয়ে পড়ে ছিলেন।

আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। সূর্য সেন হলের আবাসিক ছাত্র। আজমল স্যার মাঝেমধ্যে আমার ছাত্রাবাসে চলে আসতেন। কখনো একা, কখনো আমার বাবার সঙ্গে। তিনি আমার বাবার বন্ধু ছিলেন।

একদিন আজমল স্যার আমার ছাত্রাবাসে এসে বলেন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি নিউজিল্যান্ড যাব।

আমি অবাক হই। জিজ্ঞেস করি, কেন?

তিনি বলেন, হায়ার স্টাডি করতে।

হায়ার স্টাডি?

হ্যাঁ, হায়ার স্টাডি। কলেজে আমার কলিগরা বলেছে, বিদেশে হায়ার স্টাডি করে এলে এখানে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বা বড় কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি হবে। আর মানুষ তো বাইরে গিয়ে হায়ার স্টাডি করেই

আজমল স্যারের কথা ঠিক। এটা সত্য, মানুষ তো বাইরে হায়ার স্টাডি করতেই যায়। অনেকে হায়ার স্টাডি করে বিদেশেই সেটেল্ড হয়ে যায়। কিন্তু আজমল স্যার এই বয়সে যাবেন? তাঁর বয়স তো পঞ্চাশের ওপরে। তেপ্পান্ন-চুয়ান্ন বছর হবে। আমি তাই মুখ ফসকে বলে ফেলি, স্যার, এই বয়সে?

আজমল স্যার অবশ্য সেদিন বুদ্ধিমানের মতো কথা বলেন, লেখাপড়ার কোনো বয়স নেই। 

 

দুই.

আজমল স্যার উনিশশো পঁচানব্বই সালে নিউজিল্যান্ডে চলে যান। বিদেশ যাওয়ার পর তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। উনিশশো সাতানব্বই সালের জানুয়ারিতে আমি নিউজিল্যান্ডে এলে এর এক মাস পর হকসবে অঞ্চলের হেস্টিং শহরে ফেব্রুয়ারির এক সকালে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়। তাঁকে দেখে আমি চমকে উঠি। তাঁর এ কী হাল! চেহারা ভেঙে গেছে। চোখ দুটো বসে গেছে। বয়সটা বেড়ে গিয়ে মনে হচ্ছে ষাট হয়ে গেছে। অথচ তিনি দেখতে খুব ফরসা ও সুন্দর ছিলেন। যে কেউ তাঁকে দেখলে বলত, রাজপুরুষ। তিনি সত্যি রাজপুরুষ ছিলেন। একবার কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে বাংলা সিনেমের শুটিং দেখতে গেলে এক চলচ্চিত্র পরিচালক তো তাঁকে নায়ক বানানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। কিন্তু তাঁর অতিরিক্ত সহজ-সরল স্বভাবের জন্য তিনি জীবনে এক কলেজের শিক্ষক বাদে কিছুই হতে পারেননি। আর কলেজে শিক্ষকতা করতে গিয়ে খুব যে সুখে ছিলেন, তা নয়। সাদাসিধে হওয়ার জন্য পদে পদে কলিগ, প্রিন্সিপাল, এমনকি ছাত্রদের কাছে অপদস্থ হতেন।

আমি সেদিন আজমল স্যারের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে হেস্টিংস শহরের একিনা সাবার্বের উইলো পার্কের এক বেঞ্চিতে গিয়ে বসে জিজ্ঞেস করি, স্যার, আপনার কী হয়েছে?

আজমল স্যার সরল গলায় জিজ্ঞেস করেন, কেন, কিছু হয়েছে নাকি?

আপনার চেহারা কী বানিয়েছেন?

টেনশনে, অতিরিক্ত টেনশনে

কেন এত টেনশন?

আমি বিদেশ আসার আগে তুমি একদিন ঠিকই বলেছিলে, আমার এই বয়সে বিদেশে আসা ঠিক হয়নি। আমার জন্য বিদেশ না। এখন নিউজিল্যান্ডে কিছুই করতে পারছি না। ওদিকে বাংলাদেশের কলেজের চাকরিটাও যায় যায় অবস্থা।

খুলে বলেন তো। এই দুই বছর তো আপনার কোনো খবর পাইনি।

আজমল স্যার চেহারা একটু ভারী ও বিষণ্ন করে বলেন, তুমি তো জানো, আমি হ্যামিল্টনের ওয়াইকাটো বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের টাকায় টিউশন ফি দিয়ে ভর্তি হয়ে এসেছি। কোনো স্কলারশিপ নিয়ে নয়। বাংলাদেশে অনেকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ও নিজের জমিজমা বিক্রি করে আমার বাইশ হাজার ডলার টিউশন ফি জমা দিতে হয়েছে। এ ছাড়া এয়ার ফেয়ার আরো কত কী! কিন্তু নিউজিল্যান্ডে এসে তো অকূল দরিয়া নয়, রীতিমতো প্রশান্ত মহাসাগরে পড়ি। হ্যামিল্টন শহরে এমনিতেই ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টরা কোনো চাকরি পায় না। তার ওপর আমার বয়স অনেক বেশি।

আমি নড়েচড়ে বসে জিজ্ঞেস করি, তারপর?

তারপর আমার না খেয়ে থাকার মতো অবস্থা। ওখানকার কিছু বাঙালি আমাকে পরামর্শ দেয় তাওরাঙ্গা বা হেস্টিংস শহরে চলে আসতে। এখানে তো ফলের বাগানে প্রচুর কাজ

আপনি তাই করলেন?

আজমল স্যার মাথা ঝাঁকিয়ে বলেন, হ্যাঁ

আমি জিজ্ঞেস করি, তারপর?

আজমল স্যার বলেন, তারপর আর কি, আমি কিছুদিন তাওরাঙ্গা শহরে কাজ করে পরে হেস্টিংসে চলে আসি।

আপনার ওয়াইকাটো ইউনিভার্সিটিতে স্টাডি?

ওটা আর করা সম্ভব হয়নি। একে তো দেশে অনেকের কাছ থেকে ঋণ করে নিউজিল্যান্ডে এসেছি। ওরা চাপ দিচ্ছিল। তাই ওয়াইকাটো ইউনিভার্সিটি থেকে আমার টিউশন ফি তুলে ফেলেছি। তুলে দেশে আবার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি।

তাহলে এখন কী করবেন, দেশে চলে যাবেন?

হ্যাঁ, তাইতো করতে হবে। আমার ছেলেটার কথা খুব মনে পড়ে। এখানে মন টিকছে না। আমি তিন মাস হ্যামিল্টন শহরে বসে বসে খেয়েছি। বেশ ঋণ হয়ে গেছে। দেশে আরো কিছু ঋণ আছে। নিজেও কিছু টাকা না নিয়ে যাই কিভাবে?

আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বলি, তাইতো!

 

তিন.   

আজমল স্যারের আর দেশে যাওয়া হয়নি। দেশে কলেজের গভর্নিং বোর্ড তাঁর দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে তাঁকে চাকরি থেকে ইস্তফা দেয়। আধাসরকারি কলেজ। গভর্নিং বোর্ড এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। কলেজের চাকরিটা চলে যাওয়ার পর আজমল স্যার দেশে যাওয়ার চিন্তা বাদ দেন। এদিকে তাঁর নিউজিল্যান্ডে লিগেল স্টুডেন্ট ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। তিনি দ্বিধা ও দ্বন্দ্বে অনেকটা দেরি করে সঠিক কোনো গ্রাউন্ড তৈরি না করেই রাজনৈতিক আশ্রয় চান। যেহেতু তিনি স্টুডেন্ট ভিসা শেষ হওয়ার পর অবৈধ হয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন, তাই নিউজিল্যান্ড সরকার তাঁকে সোশ্যাল বেনিফিটও দেয়নি। ব্যাপারটা এমন হয়েছিল, তাঁর রাজনৈতিক আশ্রয়ের কেস যত দিন ইমিগ্রেশনে চলবে তত দিন তিনি থাকতে পারবেন, কিন্তু সরকারের কোনো সুযোগ-সুবিধা তিনি পাবেন না। 

আমি যখন তাওরাঙ্গা শহরের কাছে মাউন্ট মাঙ্গানুই শহরে মামার বাসায় থাকি, তখন আজমল স্যারকে মামার বাসায় নিয়ে আসি। পুরো এক বছর তিনি আমার সঙ্গে রুম শেয়ার করেন। স্যারের সঙ্গে কত সুখদুঃখের আলাপই না করতাম। স্যার আমার দ্বিগুণ বয়সী হলেও আমরা কেমন বন্ধু হয়ে উঠি। স্যার সারাক্ষণ শুধু ছেলের গল্পই করতেন। স্যারের ছেলের নাম ছিল আবরার হোসেন। আজমল হোসেন স্যার নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে রেখেছিলেন। স্যার যখন ছেলেকে বাংলাদেশে রেখে আসেন তখন আবরারের বয়স ছিল আট বছর। রুমে থাকলে স্যার সারাক্ষণ শুধু আট বছর বয়সী আবরারের একটি ছবির দিকেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন। কতবার তাঁকে ছেলের ছবির দিকে তাকিয়ে একা একা কাঁদতে দেখেছি!

আজমল স্যার একটা কথা প্রায়ই বলতেন, নিউজিল্যান্ডে এই অনিশ্চিত জীবন, এত লাঞ্ছনা-বঞ্চনা, এত কষ্ট সবই সহ্য করছি আমার এই ছেলেটার জন্য। আবরারের একটা গতি করে যেতে পারলে আমি মরে গিয়েও শান্তি পাব!

আজমল স্যারের সঙ্গে উইকএন্ডে বা কোনো বিকেলে হাঁটতে বের হলে আমি একটা ব্যাপারে খুব বিরক্ত হতাম। তিনি ফুটপাতে বা পার্কে আট বছর বয়সী কোনো ছেলে দেখলেই গায়ে পড়ে কথা বলতেন। ওদের কেউ কেউ কথা বলত। কেউ কেউ না বুঝে স্যারকে অবহেলা করে চলে যেত। একটা সময় দেখলাম, স্যার পকেটে চকোলেট, ললি বা ললিপপ নিয়ে হাঁটেন। আট বছর বয়সী কোনো ছেলে দেখলেই চকোলেট বা ললিপপ সাধাসাধি করেন। অনেকেই তাঁর দেওয়া ললিপপ বা চকোলেট নিত। অনেকে নো থ্যাংকস বলে চলে যেত। আমি স্যারকে সতর্কও করেছিলাম এটা না করতে। কিন্তু স্যার তো অতশত বোঝেন না।

আরেকটা ব্যাপার আমাকে অবাক করত, আজমল স্যারের মাথায় শুধু তাঁর ছেলের আট বছর বয়সটাই কাজ করত। ছেলের আট বছর বয়স থেকে তিনি বের হতে পারতেন না। আবরারের যে বয়স বাড়ছে, ওটা স্যারের মাথায়ই ছিল না। এর পেছনে আরেকটা কারণও ছিল। আবরারের আট বছর বয়সী ছবিটা। তখন অবশ্য ইন্টারনেটের তেমন যুগ ছিল না। সবার হাতে মোবাইলও ছিল না। আমি যে গল্পটা করছি সেটা উনিশশো সাতানব্বই-আটানব্বই সালের গল্প। 

 

চার.

উনিশশো আটানব্বই সালের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে আমি অকল্যান্ডে চলে যাই। আজমল স্যার মাউন্ট মাঙ্গানুই ছেড়ে আবার হেস্টিংস শহরে চলে যান। মাঝখানে কর্মব্যস্ততায় স্যারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। একদিন শুনি, আজমল স্যারকে হেস্টিংস পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। আমি খবরটা শুনে আঁতকে উঠি। হেস্টিংসে বন্ধুসম একজনকে ফোন করে জানতে পারি, স্যার বিকেলে পার্কে হাঁটতে গিয়ে আট বছরের এক ছেলের হাত ধরে টানাটানি করেছেন। এ জন্য ছেলেটা ভয় পেয়ে চিৎকার করে বাসায় গিয়ে তার মা-বাবাকে গিয়ে বলে। ছেলের মা-বাবা তৎক্ষণাৎ পুলিশ ডাকে। আজমল স্যার অ্যারেস্ট হন।

এদিকে নিউজিল্যান্ডের বাঙালি মহলে ছড়িয়ে পড়ে, ওয়ান এইট ইয়ার্স ওল্ড বয় হ্যাজ বিন সেক্সুয়ালি এসাল্টেড বাই আজমল হোসাইন...! হেস্টিংসের কমিউনিটি নিউজপেপারে মনে হয় এই সংবাদটি ছাপাও হয়। কিন্তু আমি তো জানি কী হয়েছে। আমি স্যারকে আগেও কয়েকবার সতর্ক করেছিলাম। তিনি সরল মনে যা-ই করুন, নিউজিল্যান্ডে ছেলেমেয়েদের এ ব্যাপারগুলো খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখে। পুলিশ সর্বোচ্চ পন্থা অবলম্বন করে।

আজমল স্যারের সেই ব্যাপারটা অবশ্য বেশিদূর গড়ায়নি। কোর্ট পর্যন্ত ওঠেনি। হেস্টিংস শহরে বসবাস করে আবু সাইদ ও আসাদ রহমান নামের দুই ভালো মনের মানুষ স্যারের হয়ে বেশ পরিশ্রম করে সেই ছেলেটার মা-বাবাকে অনেক বুঝিয়ে কেসটি কোর্ট পর্যন্ত তুলতে দেয়নি। তিন দিন পর আজমল স্যারকে হেস্টিংস পুলিশ স্টেশন থেকেই ছাড়িয়ে নিয়ে আসে।

তারপর আজমল স্যার আর হেস্টিংস শহরে বেশিদিন থাকেননি। তাওরাঙ্গা শহরের অদূরের ছোট্ট শহর টিপুকিতে চলে আসেন। আমিও তত দিনে অকল্যান্ড ছেড়ে হ্যামিল্টন শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করি।

একদিন স্যারকে হ্যামিল্টন থেকে টিপুকি শহরে দেখতে আসি। স্যার তখন বাঙালিদের থেকে একটু দূরে দূরে থাকেন। আদিবাসী মাউরিদের সঙ্গে এক বাসায় রুম শেয়ার করে থাকেন। স্যার আরো শুকিয়ে গেছেন। গাল-চোখ অরো বসে গেছে। খানিকটা কুঁজো হয়ে গেছেন। অথচ তাঁর বয়স তখন বড়জোর সাতান্ন কি আটান্ন  হবে।

সেদিন আজমল স্যারকে দেখে আমার এতই কষ্ট হয়েছিল যে আমি স্যারের শারীরিক অবস্থার বিষয়ে কিছুই জিজ্ঞেস করিনি। বিকেলে একটা কফিশপ থেকে দুই কাপ কফি নিয়ে আমরা টিপুকির একটা পার্ক ধরে হাঁটতে বের হই। পার্কে দেখি কিছু ছেলেমেয়ে খেলা করছে। ওদের মধ্যে আট বছর বয়সীও কেউ কেউ আছে।

স্যার ও আমি পার্কে পাশাপাশি হাঁটছিলাম। হঠাৎ স্যারকে দেখি তিনি পার্কের ছেলেমেয়েদের দেখে খানিকটা দূর দিয়ে ঘুরে যেতে চাচ্ছেন। তিনি কেমন যেন ভয় পাচ্ছেন। ভয় পেয়ে এদিক-ওদিকও তাকাচ্ছেন। আমি বুঝতে পারি, তিনি হেস্টিংসের সেই ঘটনার পর এই ব্যাপার নিয়ে ভয় পাচ্ছেন।

আমি স্যারের রুমে ফিরে অনিচ্ছা সত্ত্বেও জিজ্ঞেস করি, স্যার, হেস্টিংসে আসলে কী হয়েছিল?

আজমল স্যার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর কী ভেবে বলেন, হেস্টিংসের উইলোপার্ক। সেই পার্কটা তো তুমি চিনোই। তুমি যখন হেস্টিংসে ছিলে তোমাকে নিয়ে কয়েকবার হাঁটতে গিয়েছি। সেই পার্কে একটা আট বছরের ছেলে বাইক চালাচ্ছিল। আমি তাকে ডেকে চকোলেট দিতে যাই। সে কোনো কারণ ছাড়া চিৎকার দিতে শুরু করে। আমি তাকে তার হাত ধরে বোঝানোর চেষ্টা করি, এটা চকোলেট, অন্য কিছু না। ছেলেটা আরো চিৎকার- চেঁচামেচি করে বাইক নিয়ে চলে যায়। একটু পরে পুলিশ এসে পার্ক থেকে আমাকে ধরে নিয়ে যায়।

আমি বলি, আমি তো আগেই আপনাকে সতর্ক করেছিলাম। আপনার সরলতা সবাই বুঝবে না। কোনো আট বছরের ছেলেও না।

আজমল স্যার বেশ কিছুক্ষণ কোনো জবাব দেননি। তারপর নিজের ছেলের প্রসঙ্গ টানেন। আস্তে আস্তে সেদিনের সন্ধ্যাটা আরো ভারী হয়ে ওঠে। তিনি একসময় ছেলে আবরারের আট বছর বয়সের ছবিটা ব্যাগের একটা ডায়েরি থেকে বের করে দেখতে দেখতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন।

আমার চোখও তখন কেমন ভিজে আসে। আমার মনে হয়েছে স্যারকে কিছু বলি। কোনো সান্ত্বনা। কিন্তু এর কিছুই বলতে পারিনি। আমার বারবার মনে হয়েছিল, এই ছাপ্পান্ন-সাতান্ন বছরের সরল শিশুটাকে কে বোঝাবে যে এই পৃথিবী তাঁর নয়। তাঁর সেই আট বছরের ছেলে আবরার আর আট বছরের নেই।

সেদিন রাতে টিপুকি শহর থেকে হ্যামিল্টনে ফিরতে ফিরতে একটা কথাই মনে হয়েছিল, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই রহমত কাবুলিওয়ালাই শেষ কাবুলিওয়ালা নয়। পিতৃ হৃদয়ের সেই কাবুলিওয়ালাদের আজও প্রতিদিন পৃথিবীর প্রতিটি শহরেই দেখা যায়। শুধু একজন আজমল স্যার নন, শতজন। সহস্রজন বা তারও অধিক।

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ