<p>এই লেখাটি যখন শুরু করেছি তখন সিএনএন, বিবিসি, আলজাজিরাসহ বিশ্বের বড় বড় মিডিয়ায় খবর প্রচারিত হচ্ছে, ইউক্রেন ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও ন্যাটো বাহিনীর মধ্যে যেকোনো সময় একটা মিলিটারি শোডাউনের ঘটনা ঘটতে পারে। সে রকম কিছু ঘটলে তা কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা এখনই বলা মুশকিল। আপাতদৃষ্টিতে সংকটের শুরু ২০১৪ সালে হলেও এর লিগ্যাসি ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পরপরই শুরু হয়। ওই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে ১৩টি রাজ্য স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, যার একটি ইউক্রেন। তখন পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোতে কমিউনিস্ট সরকারের পতন হয় এবং তার মধ্য দিয়ে ওয়ারশ সামরিক জোটেরও বিলুপ্তি ঘটে।</p> <p>সংগত কারণেই বিশ্বের অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সামরিক বিশেষজ্ঞের ধারণা হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও ওয়ারশ জোটের বিলুপ্তিতে ন্যাটো সামরিক জোট তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে এবং বিশ্ব বোধ হয় অস্ত্র প্রতিযোগিতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে চলেছে। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই বোঝা গেল সবার ধারণা ভুল। ন্যাটো সামরিক জোটের অবসান তো হলোই না, বরং উল্টো তার সম্প্রসারণ ঘটছে। অচিরেই সদ্য সাবেক ওয়ারশ সামরিক জোটের দেশগুলো ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত হয়। শুধু তা-ই নয়, সাবেক সোভিয়েতের অধীন বাল্টিক রাষ্ট্র লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া ন্যাটো জোটে যোগ দেয়। তাতে রাশিয়ার একসময়ের রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গ ন্যাটো বাহিনীর গোলন্দাজ কামানের নাকের ডগার মধ্যে চলে আসে। তখন ন্যাটো জোটের বিলুপ্তি ঘটলে অথবা সম্প্রসারণ না হলে কী হতো তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তবে আমার ধারণা, আমেরিকার স্টেট ডেপার্টমেন্ট, পেন্টাগন ও থিংকট্যাংকগুলো হয়তো তখনই আজকের চলমান এই ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণের চিত্রটিকে অনুমান করতে সক্ষম হয়।</p> <p><img alt="" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/ckfinder/innerfiles/images/Print Version Online/print /2022/01.January/20-01-2022/121/0.gif" style="float:left; height:273px; margin:12px; width:332px" />আমেরিকার স্ট্র্যাটেজিক থিংকট্যাংকগুলোর সক্ষমতা তুলনাহীন। রাশিয়া ও চীন আজকে একই অক্ষে। এমনটি যে হবে তা কিন্তু আশি বা নব্বই দশকেও বোঝা যায়নি। হয়তো আমেরিকার থিংকট্যাংকগুলো ঠিকই বুঝেছিল। বর্তমানে বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির তিনটি সরব অঞ্চল অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপ এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে ঘিরে মেরুকরণের আলাদা আলাদা বৃত্ত তৈরি হচ্ছে। সব ভৌগোলিক বৃত্তের মেরুকরণে বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্টতা একই রকম নয়। তাই সংক্ষেপে প্রতিটি ভিন্ন ভিন্নভাবে আলোচনা করতে হবে।</p> <p>প্রথমে এ সময়ে উত্তপ্ত পূর্ব ইউরোপ ফ্রন্টের কথা বলি। ইউক্রেনকে ঘিরে বর্তমান উত্তপ্ত পরিস্থিতির নবযাত্রা শুরু হয় ২০১৪ সালে, যে কথা কিছু আগে উল্লেখ করেছি। তখন রাশিয়াপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিস আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা থেকে উত্খাত হন এবং তাঁর জায়গায় আসেন আমেরিকানপন্থী বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। ন্যাটো বাহিনী পেটের মধ্যে ঢুকে যাওয়ার আশঙ্কায় ইউক্রেনের স্ট্র্যাটেজিক্যালি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ক্রিমিয়া দখল করে নেয় রাশিয়া। এত দিনে সেই দখলদারি পাকাপোক্ত হয়ে গেছে। শুধু তাতেই তখন ক্ষান্ত হয়নি রাশিয়া। ইউক্রেনের মধ্যে জাতিগতভাবে রাশিয়ান সংখ্যাগরিষ্ঠ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে পূর্ণ সামরিক সমর্থনের মাধ্যমে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়।</p> <p>তখন একটি কলামে আমি লিখেছিলাম এই সংকটের সহজ সমাধান নেই এবং ন্যাটো জোটের পূর্বমুখী সম্প্রসারণ প্রেসিডেন্ট পুতিন কিছুতেই আর মেনে নেবেন না। কিছুদিন আগে বেলারুশ এবং এই কয়েক দিন আগে কাজাখস্তানের রাশিয়ানপন্থী শাসকদ্বয়কে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য রাশিয়ার দৃশ্যমান ভূমিকায় আমার উপরোক্ত কথার যথার্থতা প্রমাণিত হয়। সম্প্রতি জেনেভায় অনুষ্ঠিত আলোচনায় রাশিয়া দাবি করেছে, সম্প্রসারণ বন্ধসহ পূর্ব ইউরোপ থেকে ন্যাটো জোটের সেনা সংখ্যা ও অস্ত্রের মোতায়েন হ্রাস করতে হবে। তবে ন্যাটো সেটা মেনে নেবে বলে মনে হয় না।</p> <p>ইরান, চীনসহ মধ্য এশিয়ার দেশগুলো সিএসটিও  (কালেক্টিভ সিকিউরিটি ট্রিয়েটি অর্গানাইজেন) এবং এসসিও (সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেন)-এর মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে রাশিয়ার সঙ্গে মুক্ত। এই অঞ্চলের মেরুকরণে তুরস্কের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য। বর্তমানে সেখানে ন্যাটোর সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। কিন্তু ভূমধ্যসাগরের সীমান্ত নিয়ে গ্রিসের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, সেই সূত্রে ফ্রান্স ও জার্মানির সঙ্গে চরম মতবিরোধ এবং ২০১৬ সালের জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টায় আমেরিকার হাত থাকার সন্দেহে তুরস্ক এখন রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে আছে।</p> <p>২০২০ সালে মধ্যপ্রাচ্যের মেরুকরণে বিশাল পরিবর্তন ঘটেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান ও মরক্কো সৌদি আরবের আশীর্বাদে এবং আমেরিকার পৌরহিত্যে ইসরায়েলকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাতে ফিলিস্তিনের জনগণের ন্যায়সংগত স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আরো সুদূরপরাহত হয়ে গেছে। বাংলাদেশের জনগণ একচেটিয়া ফিলিস্তিনের পক্ষে। অন্যদিকে সৌদি আরব, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশের বিশালসংখ্যক মানুষ কর্মরত, যাঁরা বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম সরবরাহকারী। জন-আকাঙ্ক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সব সময় একই দিকে অবস্থান করে না। তবে উভয়ের মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকা জরুরি।</p> <p>এখন আসি আমাদের জন্য সরাসরি গুরুত্বপূর্ণ এশিয়া অঞ্চলের কথায়। এখানে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক মেরুকরণের ভিন্ন ভিন্ন রূপ যেমন রয়েছে, তেমনি একটির সঙ্গে আরেকটির সংমিশ্রণও আছে। আঞ্চলিক, অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার সমীকরণটি আমাদের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়া বলতে মোটাদাগে আমরা সার্কভুক্ত দেশগুলোকেই ধরে নিই। সার্ক গঠিত হয় ১৯৮৫ সালে। আশা করা হয়েছিল অতীতের সব তিক্ততা ভুলে দক্ষিণ এশিয়া ঐক্যবদ্ধভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও আসিয়ান থেকেও অনেক বেশি ভাইব্র্যান্ট অর্থনৈতিক জোট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু তার কিছুই হয়নি।</p> <p>সার্ক এখন ভেন্টিলেশনে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এই ব্যর্থতার পেছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে। তবে পাকিস্তানের মোল্লা ও মিলিটারিতন্ত্রই মূলত এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী। ভারত এক নম্বর শত্রু রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় এই ঘোষিত নীতি থেকে পাকিস্তান সরে আসেনি। একাত্তরে গণহত্যা চালানোর অপরাধ, জাতীয় সম্পদের ন্যায্য হিস্যা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে পাকিস্তান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, আগ্রহও দেখায়নি। ফলে বাংলাদেশের জনগণের কাছে পাকিস্তানের গ্রহণযোগ্যতা শূন্য। উল্টো পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ভারত ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জঙ্গি সন্ত্রাসের সঙ্গে সরাসরি জড়িত, যার অকাট্য দালিলিক ও প্রকাশ্য প্রমাণ রয়েছে। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা সংকটের বিস্তৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশ যেভাবে সংকটে পড়েছে তার নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই।</p> <p>একাত্তরের সব কিছু কার্পেটের নিচে রেখে পাকিস্তানের একটি মহল এখন বাংলাদেশের প্রতি প্রীতি প্রদর্শনের চেষ্টায় আছে। কিন্তু তাতে চিড়া ভিজবে না, বাংলাদেশের মানুষ একাত্তরকে ভুলবে না; কখনো না। পাকিস্তান এখন একটি বিচ্ছিন্ন তলায়মান রাষ্ট্র। পাকিস্তানের জনগণকে বুঝতে হবে তারা মোল্লা ও মিলিটারির কবল থেকে মুক্ত হওয়া না পর্যন্ত তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। মধ্যযুগীয় চিন্তা ও উগ্রতন্ত্রে বিশ্বাসী তালেবান বাহিনী ২০২১ সালের মাঝামাঝিতে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করায় দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতার সম্ভাবনা আরো ক্ষীণতর হয়েছে এবং শান্তি ভঙ্গ ও জঙ্গি সন্ত্রাস বিস্তারের আশঙ্কা বৃদ্ধি পেয়েছে। উল্লেখ্য, তালেবান সরকারকে বিশ্বের কোনো রাষ্ট্র এখনো স্বীকৃতি দেয়নি। তালেবান নিয়ে পাকিস্তানের চরম উত্ফুল্লতা এখন আর দেখা যাচ্ছে না। আল-কায়েদা নেতা আইমান আল জাওয়াহিরির লেখা ‘নাইটস আন্ডার দ্য প্রফেটস ব্যানার’ গ্রন্থে বর্ণিত কৌশল অনুসারে বৃহৎ মুসলিম খেলাফত প্রতিষ্ঠার যাত্রায় পাকিস্তানই হবে তালেবান ও তাদের মিত্রদের পরবর্তী নিকটতম সহজ টার্গেট।</p> <p>সার্কের বহুমুখী প্রতিবন্ধকতার জন্য বিকল্প হিসেবে পূর্বমুখী সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত করার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার নেতারা ১৯৯৭ সালে গঠন করেন বিমসটেক, সেখানে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড যুক্ত হয়। তাতে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগ ও সহযোগিতার দ্বার উন্মোচিত হয়। এটিকে আরো শক্তিশালী করার জন্য গঠিত হয় বিসিআইএম, যেখানে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্ত হয় চীন। কলকাতা থেকে বাংলাদেশ, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মিয়ানমার হয়ে চীনের কুনমিং শহর পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন কানেক্টিভিটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে কলকাতা ও কুনমিংকে ঘোষণা করা হয় টুইন সিস্টার সিটি। টিটিই, অর্থাৎ ট্রেড ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড  এনার্জি ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সহযোগিতাকে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত ও প্রসারিত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। বিমসটেক এবং বিসিআইএমের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় বাংলাদেশ। মিয়ানমার হয়ে ওঠে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গেটওয়ে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে চীন ও ভারতের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ায় এবং মিয়ানমারের সামরিক শাসক কর্তৃক ২০১৭ সালে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ায় বিমসটেক এবং বিসিআইএম—দুটি সংস্থার কার্যক্রমে ভাটা পড়ে।</p> <p>২০১৫ সালে বাংলাদেশ, ভুটান, ইন্ডিয়া ও নেপাল নিয়ে গঠিত হয় উপ-আঞ্চলিক জোট বিবিআইএন। এর অনেকটা অগ্রগতি আছে। তবে প্রত্যাশিত অর্জন হয়নি। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে ঘিরে আমেরিকা ও চীনের দ্বন্দ্ব-প্রতিযোগিতার বিরূপ প্রভাব পড়ছে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর ওপর। নিরাপত্তা নিশ্চিত করে উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে বাংলাদেশকে এই জটিল, কঠিন ও পিচ্ছিল পথের মধ্য দিয়েই যেতে হবে। এই চলার পথে সফলতা অর্জনের জন্য আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক, উদার গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের ওপর বাংলাদেশকে অটল থাকা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।</p> <p> </p> <p>লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক</p> <p>sikder52@gmail.com</p>