<p>১৮ জুলাই ষাণ্মাষিক (জুলাই-ডিসেম্বর ২০২৪) মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম কার্যক্রম হলো দেশের মুদ্রা ব্যবস্থাপনা। মুদ্রা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ ও দেশের অভ্যন্তরে বিনিয়োগ (সরকারি, বেসরকারি) প্রভাবিত করা মুদ্রা ব্যবস্থাপনার মূল লক্ষ্য থাকে দেশের প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করা, প্রবৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত থাকে কর্মসংস্থান ও সামাজিক অর্থনীতি স্থিতিশীলতা অর্জন।</p> <p>সুদহার দ্বারা মুদ্রা সরবরাহ ও বিনিয়োগের পরিমাণ নির্ধারিত হয়ে থাকে। মুদ্রা সরবরাহের নিয়ামক নীতি সুদ হার। ঘোষিত মুদ্রানীতিতে নীতি সুদ হার ৮.৫ শতাংশ অপরিবর্তিত রয়েছে। সুদহার হচ্ছে, যে সুদে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ থেকে টাকা ধার নিয়ে থাকে। এই নীতি সুদ হার ছিল মে ২০২২-এ ৫ শতাংশ, জানুয়ারি ২০২৩-এ ৬ শতাংশ, জানুয়ারি ২০২৪-এ ৮ শতাংশ এবং মে ২০২৪-এ তা উন্নীত হয়েছে ৮.৫ শতাংশ। নতুন ঘোষিত মুদ্রানীতিতে নীতি সুদ হার আগামী ছয় মাসের জন্য অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে ৮.৫ শতাংশে। আইএমএফ ও কোনো কোনো অর্থনীতিবিদের পরামর্শ ছিল, নীতি সুদ হার বাড়ানো, যাতে ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধি পায় এবং এর মাধ্যমে বেসরকারি বিনিয়োগ উচ্চ সুদের কারণে স্তিমিত থাকে। এতে মোট চাহিদা বাজারে কমবে। বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণায় নীতি সুদ হার না বাড়িয়ে বাস্তবতাবোধের পরিচয় দিয়েছে। আইএমএফের পরামর্শ কিছুটা কেতাবি, আমাদের বাস্তবতাকে তারা বিবেচনায় নেয়নি। প্রথাগতভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। লক্ষণীয় যে ৫ শতাংশ নীতি সুদ হার ২০২২ থেকে মে ২০২৪ পর্যন্ত ৮.৫ শতাংশ করা হলেও মূল্যস্ফীতিতে তা কোনো প্রকার প্রভাব রাখেনি, জুলাই ২০২৩ থেকে মে ২০২৪ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির গড় ৯.২ শতাংশ থেকে বেড়ে মে ২০২৪-এ উন্নীত হয়েছে ৯.৭৩ শতাংশ। মানে নীতি সুদ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো যায়নি। বরং ব্যক্তি খাতে ঋণ না বাড়ায় বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল জুলাই ২০২৩-এ ৯.৮ শতাংশ, যা জুন ২০২৪-এও ছিল ৯.৮ শতাংশ।</p> <p><img alt="মূল্যস্ফীতি ও বিনিয়োধগে মুদ্রানীতির প্রভাব" height="288" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/07.July/22-07-2024/1.jpg" style="float:left" width="338" />নীতি সুদ হার বাড়িয়ে, মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে, সরকারি/বেসরকারি বিনিয়োগের লাগাম টেনে ধরে যদি বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি কমানো যেত, তাহলে বিগত দুই বছর মুদ্রাস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপর থাকত না। চাহিদা নিয়ন্ত্রণের এসব প্রথাগত অস্ত্র কার্যকর হতে পারে চাহিদা বৃদ্ধি জনিত মূল্যস্ফীতিতে (ডিমান্ড পুল ইনক্লেশন)। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথাগতভাবে এগিয়েছে। এই পত্রিকায়ই আমরা আগেও বলেছি, বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি দেশে চাহিদা বৃদ্ধি জনিত কারণে নয়। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে বাইরের মূল্যস্ফীতির কারণে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় একটি ছোট অর্থনীতির (মাথাপিছু প্রাপ্ত জমির ভিত্তিতে) দেশে প্রধান প্রধান ভোগ্য পণ্যসহ প্রায় সব শিল্প ও কৃষি বিষয়ক উৎপাদন উপকরণ আমদানি করতে হয়। শিল্প উৎপাদন যন্ত্রপাতি, তুলা, মধ্যবর্তী শিল্পপণ্য, বীজ, সার, কীটনাশক, মৎস্য ও পোলট্রি ফিড, ভিটামিন, ভ্যাকসিনেশন ৮০ থেকে ১০০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। উৎপাদন উপকরণগুলো বর্ধিত দামে এনে, আরো যুক্ত হয়েছে প্রায় ৩৮ শতাংশ টাকার মূল্যমান ধরে বেড়ে যায় প্রতিটি উপকরণের দাম। এসব বর্ধিত দামে উপকরণ এনে আমরা যখন শিল্পপণ্য বা কৃষিপণ্য উৎপাদন করি; যেমন—চাল, ডাল, শাক-সবজি, মাছ, ব্রয়লার, ডিম, প্রক্রিয়াজাত পণ্য, এসব কিছুর বিক্রয় দাম বেড়ে যায়। আমাদের মূল্যস্ফীতি পণ্যবাহিত হয়ে দেশে এসে উৎপাদন খরচ তাড়িত মূল্যস্ফীতির রূপ পায় (কস্টপুশ ইনক্লেশন)। কাজেই রপ্তানির প্রাধান্য আছে তেমন দেশে, মূল্যস্ফীতির দাওয়াই যা হবে (চাহিদা ব্যবস্থাপনা), আমদানিনির্ভর দেশে সেই একই দাওয়াই কাজ করবে না। এ ক্ষেত্রে পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ চেইন এবং বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর নীতিনির্ধারকদের মনোনিবেশ করতে হবে। খরচতাড়িত মূল্যস্ফীতি কমানোর গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো উৎপাদন খরচ কমানোর উপায় বের করা, সেই সঙ্গে প্রতি উৎপাদন ইউনিটে বাড়তি উৎপাদন করা। এর জন্য ব্যবস্থাপনা দক্ষতা বাড়াতে হবে, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে যেতে হবে, যা মূলত সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন গবেষণার জন্য ব্যয় বাড়াতে হবে। দক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। উৎপাদনে যারা জড়িত, ব্যবস্থাপনায় যারা জড়িত, সবার জন্যই মানসম্মত মৌলিক শিক্ষা ও কর্মকালীন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এটা নীতিনির্ধারক বা সরকারের দায়িত্ব। মানসম্পন্ন পণ্য ও দক্ষ/প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির দায়িত্ব দেশ পরিচালনা যাঁরা করেন তাঁদের। মোটকথা উৎপাদন খরচ তাড়িত মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কৃষিপণ্য হলে, কৃষি উৎপাদনের কয়েক মৌসুম লেগে যেতে পারে উৎপাদন বাড়াতে এবং পণ্য উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে শিল্পপণ্য হলেও কয়েকটি উৎপাদনচক্র হাতে নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। এই লক্ষ্যে সরকারকে নীতি সমর্থন ও কৌশল গ্রহণে উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করতে হবে (যেমন—আমদানি-রপ্তানি কর কমিয়ে, উৎপাদনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করে, বিরতিহীন পণ্য পরিবহন ইত্যাদি)। মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ৯.৮ শতাংশ বর্ণনা করা হয়েছে, যা বিগত ষাণ্মাসিকেও ওই একই ছিল। সরকারি ঋণের হার আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত ধরা হয়েছে ১৪.২ শতাংশ এবং জুন ২০২৫ পর্যন্ত তা আরো ১৭.৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। সরকারি ঋণ বৃদ্ধিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রাপ্তি কমে যায় কি না এমন শঙ্কা কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ প্রকাশ করেছেন। যেহেতু আমাদের মূল্যস্ফীতি অধিক চাহিদা তাড়িত নয়, সে জন্য অতি সংকোচনমূলক কৌশল পরিবহার করা যেতে পারে। আবারও বলব, বেশি মনোযোগ দিতে হবে সাপ্লাই সাইডে বা সরবরাহ চেইনে। পলিসি রেট বাড়ানো হয়নি চমৎকার, সেই সঙ্গে ব্যক্তি খাতের ঋণ সরবরাহ বাড়ানো যেত ১০-১১ শতাংশ পর্যন্ত। সরকারি ঋণ কোন খাতে ব্যবহৃত হবে তার ওপর নির্ভর করবে মূল্যস্তরে প্রভাব। আবর্তক ব্যয় বা অনুৎপাদনশীল খাতে বেশি ব্যয়িত হলে মূল্যস্ফীতি আরো স্ফীতি হতে প্রভাব রাখবে। চলতি বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, আর নিট বিদেশি ঋণ ৯০ হাজার ৭০০ টাকা, যা গত বছর বাজেটে ছিল এক লাখ দুই হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। যত দূর জানি, পাইপলাইনে আমাদের প্রতিশ্রুত বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিদেশি ঋণের সুদের হার কম, পরিশোধের সময় বেশি, আবার কখনো কখনো সুদের হার মওকুফ হয়ে যায়। ঋণ ব্যবহারে পরিকল্পনা ও জবাবদিহি বেশি। তাই সরকার দেশীয় ব্যাংক বা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে (টাকা ছাপিয়ে) ঋণ যতটা কম নেওয়া যায়, ততই মঙ্গল। দেশীয় ঋণের সুদের হার বেশি, পরিশোধের সময় কম। ‘ক্রাউডিং আউটের’ও ভয় থাকে না। মূলত যা বলতে চাই, ক্রমান্বয়ে আমাদের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি থেকে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টা শুরু করা যায়। সে জন্য সুদের হার, সেটা নীতি সুদ হার, ব্যাংকঋণের সুদের হার, ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার যাতে আর না বাড়ে সে কৌশল নেওয়ার কথা ভাবতে হবে। সাপ্লাই সাইড ব্যবহার করে মূল্যস্ফীতি কমাতে আগামী ছয় মাস থেকে এক বছর (উৎপাদনচক্র বিবেচনায়) লেগে যেতে পারে। বোরো উৎপাদন ভালো হয়েছে, বর্ষায়ও আমাদের শাক-সবজির উৎপাদন ভালো, আগামী আমন ফসল ভালো হলে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। এখন শিল্প উৎপাদন শ্লথ না হয় সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। তার পরেও বলব, আমাদের কিছুটা বাড়তি মূল্যস্ফীতি নিয়েই বসবাস করতে হবে, যেহেতু আমরা ৭-৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম। আমাদের সব স্তরের ভোক্তাদের দেড় যুগ ধরে আয় বাড়ার কারণে ভোগের চাহিদা বেড়েছে। কাজেই এখন গড় মূল্যস্ফীতিতে (৬ থেকে ৬.৫ শতাংশ) আর ফিরে যাওয়া হবে না। গত এক দশকের উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ে (গড়ে ৩০ শতাংশের ওপর) তুরস্ক মাথাপিছু আয় বাড়িয়েই চলেছে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নও হচ্ছে।</p> <p>সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি থেকে বেরিয়ে আসা এবং সুদের হার আর না বাড়ানোর পক্ষে বলছি এই কারণে যে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের দিকে বেশি মনোযোগী হতে হবে। লক্ষ্য থাকবে বাজেটে প্রবৃদ্ধির হার যা ধরা হয়েছে ৬.৭৫ শতাংশ, তা যেন আমরা অর্জন করতে পারি। এটা এই কারণে যে আমাদের বেকারত্ব, অর্ধবেকারত্ব, ছদ্মবেকারত্ব মিলিয়ে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ, যা কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর প্রাধান্যের এই দেশে অত্যধিক। মূল্যস্ফীতির চেয়েও বেকারত্বই এখন আমাদের প্রধান সমস্যা। সে কারণেই প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিকে আমাদের সর্বোচ্চ প্রয়াস অব্যাহত থাকবে। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসুযোগ সৃষ্টি হওয়ার সম্পর্ক সরাসরি।</p> <p>বাজারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমানো কিছুটা সময়সাপেক্ষ। তবে রপ্তানি খাত থেকে টাকার ৩৬ থেকে ৩৮ শতাংশ অবমূল্যায়নের কারণে রপ্তানি খাতে রাজস্ব আয়ে করপ্রাপ্তির উল্লম্ফন ঘটেছে। আমরা রপ্তানি ট্যারিফ যদি বর্তমান হারের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমিয়ে দিই, তাহলে রপ্তানি প্রতিযোগিতা বাড়বে, সেই সঙ্গে আমদানি ট্যারিফ ওই পরিমাণ কমালে আমদানি সব পণ্যের দাম কমে আসবে এবং মূল্যস্ফীতি কমায় সরাসরি ভূমিকা রাখবে। পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি একটি স্বীকৃত সত্য। চাঁদাবাজি কমালে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।</p> <p>বর্তমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ (মূল্যস্ফীতি, নিম্নপ্রবৃদ্ধি, ধীরগতির বেসরকারি বিনিয়োগ) মোকাবেলায় ঘোষিত মুদ্রানীতি অধিক কার্যকর ও ফলপ্রসূ করতে আমাদের যা করা প্রয়োজন, তা হচ্ছে—সুদের হার আর না বাড়ানো,  যাতে বেসরকারি বিনিয়োগ গতিশীলতা পায়। পাশাপাশি আমদানি-রপ্তানি ট্যারিফ কমানো, ক্রমান্বয়ে সরকারি উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া, উন্নয়ন প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়ন জরুরি বিবেচিত হওয়া উচিত।</p> <p> </p> <p>লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ, সাবেক সদস্য পরিকল্পনা কমিশন ও সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী</p>