[দিনগুলি মোর]

তুমি অন্য কারো ছন্দে বেঁধো গান

শেয়ার
তুমি অন্য কারো ছন্দে বেঁধো গান
অলংকরণ : তানভীর মালেক

হেমন্তের বিষণ্ন সন্ধ্যা। বাইরে মৃদু্ হাওয়া বইছে। লেখার অভ্যাস ছিল আমার। যখন যা মনে হতো, লিখে ফেলতাম।

তারপর অনেক দিন পেরিয়ে গেল। কাগজ-কলম পড়ে রইল। আমার আর লেখা হলো না। কিন্তু আজকের সন্ধ্যাটা বড় অদ্ভুত! গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই মনে পড়ল সে মানুষটার কথা, যে মানুষটা এক আকাশ যন্ত্রণা দিয়ে নির্দ্বিধায় রাত যাপন করছে তার প্রিয়জনের সঙ্গে।
আকাশের দিকে তাকাতেই মনে হয়, আকাশ তো একটাই! এক আকাশের নিচে বেঁচে আছি, দুজন দুই প্রান্তে। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। নিজের মানুষ অন্যের হয়ে যাওয়াটাই হয়তো দীর্ঘশ্বাসের কারণ।

শুনতে পাচ্ছ, তোমাকে বলছি!

অন্যের হাতে হাত রাখার আগে একবার তো আমার হাতটা শক্তভাবে ধরতে পারতে।

বলতে পারতে, ‘আমি আমার জীবন গুছিয়ে নিতে চলেছি, তুমিও গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করো।’ আমাদের তো দেখা হয়েছিল, দীর্ঘদিন নীরব থাকার পর আবার কথাও হয়েছিল। একটা সুন্দর বিকেল কেটেছিল। শীতের পড়ন্ত বিকেল। তোমার সঙ্গে রিকশায় বসা, আমার ছবি তুলে দেওয়া, আমার দিকে আড়চোখে তাকানো, মুচকি হাসি।
সেদিনও তো বলতে পারতে। বলোনি। আমি বোকার মতো ভেবে বসলাম, তুমি হয়তো আজও আমাকেই ভালোবাসো। ভুল ছিলাম! যে সম্পর্ক একবার ভেঙে যায়, তাকে দ্বিতীয়বার জীবনে উঁকি মারতে দেওয়াটা বড় ভুল। সে ভুলের মাসুল দিতে হলো আমাকেই। আচ্ছা, দ্বিতীয়বার কথা বলাটা নিছকই বন্ধুত্ব বজায় রাখতে চাওয়ার জন্যই ছিল, নাকি প্রতিশোধ নিতে আসা? একেবারে ভেঙে চুরমার করে দেওয়া।

যেদিন ফেসবুকে তোমার বিয়ের সংবাদ পেলাম মনে হলো, তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ। আচ্ছা তুমি কি জানো, তোমার বিবাহিত জীবনের রঙিন মুহূর্তগুলো সব আমার চোখে পড়ে? কখনো তোমাকে দেখে একবারও মনে হয়নি এর আগে তুমিও কাউকে ভালোবাসতে। কাউকে শাড়ি উপহার দিতে, কারো হাত ধরতে, কারো জন্য ছটফট করতে, কাউকে দেখার জন্য উতলা হয়ে থাকতে। প্রথম প্রেমের মতো অনুভূতি তোমার। বেশ তো আছ। বিশ্বাস করবে কি না জানি না, এটাই চাইতাম ঈশ্বরের কাছে। কিন্তু মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হয়, যখন দেখি আমার অস্তিত্বই নেই তোমার জীবনে। সেদিন চৈত্রের শেষ রাতটুকু বিছানায় ছটফট করেই কেটেছিল, চোখের জলে বালিশ ভিজেছিল। আজ অনেক দিন পেরিয়ে গেছে, বছরও পেরিয়ে যাবে এভাবে। কিন্তু সেই দগদগে ঘায়ের চিহ্নটা কোথাও না কোথাও রয়ে যাবে। যে শহরে নিজের মানুষ অন্যের হাত ধরে ঘুরে বেড়ায়, সে শহর আর যা-ই হোক কখনো সুখ দিতে পারে না।

অদিতি চক্রবর্ত্তী, চট্টগ্রাম

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

চা শ্রমিকদের একজন লিটন আছেন

    মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে পিছিয়ে পড়া চা শ্রমিকদের জন্য কাজ করেন লিটন গঞ্জু। সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও লাইবেরি প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী গঞ্জু সমাজসেবক ফোরামের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ, মাদক বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। লিখেছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
শেয়ার
চা শ্রমিকদের একজন লিটন আছেন
চা-শ্রমিকদের সচেতন করতে নিয়মিত উঠান বৈঠকের আয়োজন করেন লিটন। ছবি : সংগৃহীত

অভাব-অনটনে বেড়ে ওঠা লিটনের। ৯ সদস্যের পরিবার। তিনজন চা শ্রমিক। লিটনও চা বাগানে কাজ করেন।

চেয়েছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা হবেন। কিন্তু সেই স্বপ্নপূরণ হয়নি। অষ্টম শ্রেণির পর যে আর পড়তেই পারেননি লিটন। অভাবের কারণে তাকেও মা-বাবার সঙ্গে ছুটতে হয়েছে চা-বাগানে।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা-বাগান এলাকায় লিটনদের বাড়ি। চা শ্রমিকদের নিদারুণ মানবেতর জীবন লিটনকে ভাবায়। চাইতেন তাঁদের জন্য কিছু করতে। নিজের স্বপ্নপূরণ করতে না পারলেও তিনি চেয়েছেন চা শ্রমিকদের অন্য সন্তানদের স্বপ্নের মুকুল যেন ঝরে না যায়।

পাত্রখোলা চা-বাগান কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষ নিয়ে ২০২১ সালে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন লিটন। নাম পাত্রখোলা পাবলিক লাইব্রেরি। খোলা থাকে প্রতিদিন দুপুর ২টা পর্যন্ত। বই আছে হাজারখানেক। বিভিন্ন ব্যক্তি বই দিয়ে তাঁকে সহায়তা করেন।
আবার সামর্থ্য হলে পাঠকের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে নিজেই বই কিনে আনেন। লাইব্রেরিতে একসঙ্গে ১৫ জন বসে বই পড়তে পারে। চা শ্রমিক পরিবারের সবার জন্য উন্মূক্ত এই পাঠাগার।

অনেকের সহযোগিতায় চা-বাগানে শিক্ষার্থীদের মাঝে বাইসাইকেলও বিতরণ করেন লিটন। ছবি : সংগৃহীত

অনেকের সহযোগিতায় চা-বাগানে শিক্ষার্থীদের মাঝে বাইসাইকেলও বিতরণ করেন লিটন। ছবি : সংগৃহীত

কর্মক্ষম যাঁরা, তাঁরা যেন কাজ করে উপার্জন বাড়াতে পারেন সে জন্য স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় লিটন ব্যবস্থা করেছেন সেলাই প্রশিক্ষণের। ইতোমধ্যে প্রায় ৫০ জন চা-বাগানের নারী শ্রমিক সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অনেকেই এখন সেলাইয়ের কাজ করছেন। তাঁদের একজন যমুনা রাজবংশী। তিনি বলেন, ‘সেলাইয়ের কাজ শিখে অনেক উপকৃত হয়েছি। বাসায় বসে যা আয় করছি, তাতে দুবেলা ঠিকমতো খেতে পারছি।’

চা শ্রমিকদের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতার অভাব বরাবরই। মাসিকের সময় ন্যাপকিন ব্যবহারে তাঁরা অভ্যস্ত না। আবার রোগবালাই হলে তা পরিবারের অন্য সদস্যদের বলতেও চান না। ফলে একসময় তাঁদের শরীরে জটিল রোগ বাসা বাঁধে। জরায়ুর ক্যান্সার, মুখ ও ত্বকের ক্যান্সার ইত্যাদি জটিল রোগে আক্রান্ত হন তাঁরা। এই বিষয়গুলো লিটনের নজর এড়ায়নি। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে চা শ্রমিকদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য বিষয়ে ধারণা দেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে থাকেন বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার এই বিষয়ের অভিজ্ঞরাও। হাত ধোয়া, মাদক সেবনের অপকারিতা, স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের উপকারিতা—সবই বুঝিয়ে বলেন তাঁরা।

প্রতি মাসে একটি উঠান বৈঠক হয়। পাশাপাশি নারীদের মধ্যে অনেকের সহযোগিতায় স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণের ব্যবস্থা করেছেন লিটন। লিটন বললেন, ‘মুখে বললেই তো হবে না। ওরা গরিব। টাকা দিয়ে ন্যাপকিন কেনা ওদের জন্য কঠিন। তাই ওদের মাঝে কয়েক হাজার ন্যাপকিন বিতরণ করেছি। কিভাবে ঘরে বসে স্যানিটারি ন্যাপকিন বানাতে হয়, তাও শিখিয়ে দিয়েছি।’

এ ছাড়া শিক্ষাসামগ্রী বিতরণ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য সরাসরি বৃত্তি পেতে সহায়তা, বাইসাইকেলের ব্যবস্থা, জন্ম নিবন্ধন করতে সহযোগিতাসহ নানান ধরনের কাজ করেন তিনি। লিটনের সমাজ কল্যাণমূলক কাজগুলোতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সহযোগিতা করে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের চা-বাগানে আমন্ত্রণ জানিয়ে লিটন একাধিকবার কর্মশালার আয়োজন করেছেন। যাতে চা-বাগানের শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন দেখতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রস্তুতি নিতে পারে সহজেই। রীতিমতো মাইকিং করে ডেকে এলাকার মানুষকে জড়ো করে এই কর্মশালা করেছেন। এসব কর্মশালার সুফলও মিলছে। ইতোমধ্যে পাত্রখোলা চা-বাগানের দুটি মেয়ে এশিয়ান ইউনিভার্সিটিতে বৃত্তি নিয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। গত ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৫ ইয়ুথ নামে একটি সংগঠনের সহায়তায় শিশুদের জন্য স্কুল চালু করেছেন পাত্রখোলায়। স্কুলে ২০ জন ছাত্র-ছাত্রী আছে। চা জনগোষ্ঠী উন্নয়ন ফোরাম ও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী গঞ্জু সমাজসেবক ফোরাম নামে দুটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা লিটন। এর মধ্যে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী গঞ্জু সমাজসেবক ফোরাম সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেটভুক্ত হয় ২০১৯ সালে। নিজে প্রশিক্ষণও দেন। তিনি নিজে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এখন চা-বাগানের তরুণ-তরুণীদের হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালনের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন। এ পর্যন্ত শতাধিক মানুষ তার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছে বলে জানান।

ভবিষ্যতে একটি স্থায়ী ভবন নির্মাণ করতে চান, যেখানে লাইব্রেরির পাশাপাশি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং একটি মিলনায়তন থাকবে। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২২ সালে আরটিভি এসএমসি মনিমিক্স প্রেরণা পদক পেয়েছেন লিটন।

মন্তব্য
[ দিনগুলি মোর ]

দাম দিয়ে কিনি পচা কলা

শেয়ার
দাম দিয়ে কিনি পচা কলা
অলংকরণ : তানভীর মালেক

চেহারায় তাঁর রাজ্যের অভিমান। যতটুকু না অন্যদের ওপর, তার চেয়ে অনেকখানিই যেন নিজের ওপর। চার-চারটি ছেলের বাবা তিনি, কিন্তু একটি ছেলেকেও নিজ আদর্শে বড় করতে পারেননি। তাই বৃদ্ধ বাবার দেখাশোনার চেয়ে নেশায়ই বেশি আনন্দ পায় ছেলেরা।

বার্ধক্যের যে বয়সটায় শুয়ে-বসে আর ইবাদত-বন্দেগিতে কাটানোর কথা, সেই বয়সে নিজেকে জীবিকা সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত রাখতে হয় তাঁকে। ক্যাম্পাসের এমন এক জায়গায় তাঁর ছোট্ট দোকানটি, সাধারণ মানুষের চোখও সচরাচর পড়ে না সেখানে। যে কয়জন ছাত্র তাঁর দোকান থেকে কেনাকাটা করে, তা শুধু ভালোবাসা আর করুণা থেকেই।

প্রতিদিনের মতো সেদিনও কাঁপতে কাঁপতে দোকান খুলছিলেন।

দোকানের ঝাঁপ ঠিকমতো তুলতে পারছিলেন না। তাঁকে দোকানের ঝাঁপ উঁচু করতে সাহায্য করার সময় জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাকা, আপনি কি অসুস্থ?’ তিনি বললেন, ‘না।’

—‘তবে কাঁপছেন যে!’

—‘বুড়া হলে যা হয় আর কি।’

আর একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাকা, আপনার অনেক কষ্ট হয়, তাই না?’ এমন প্রশ্ন শুনে তাঁর মুখে দেখা গেল এক অদ্ভুত হাসি, সে হাসির মানে—কষ্ট হলেই বা কী করার আছে, বাবা?

তাঁর দোকানে সব মিলিয়ে পণ্য থাকত শ পাঁচেক টাকার।

এই পণ্য বেচে হয়তো ডাল-ভাত খেয়েই বাঁচতেন। খুব ইচ্ছা হতো বৃদ্ধ কাকাকে বড় ধরনের কোনো সাহায্য করতে, কিন্তু মানুষের অনেক সাধই সাধ্যের বাইরে রয়ে যায়। তবু প্রতিদিন কাকার দোকানে ক্রেতা হয়ে যেতাম। শুধু জিজ্ঞেস করতাম, ‘কাকা, কলার হালি কত?’ দাম জেনে টাকা দিয়ে প্রায় পচা কলাগুলো প্যাকেটে ভরে নিতাম। যতটুকু খাওয়া যেত খেতাম।
বাকিটা ফেলে দিতাম। চোখের ঝাপসা দৃষ্টিতে বৃদ্ধ কাকা হয়তো বুঝতেও পারতেন না, ক্রেতার অভাবে তাঁর দোকানের ঝুলিয়ে রাখা অনেক কলাই পেকে নিচে ঝরে পড়ে। আর তাঁর সন্তানের বয়সী এক ছেলে সেই পচা কলাগুলো কিনে নিয়ে যায়।

 

সায়েক আহমেদ সজীব

প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ

ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, যশোর

 

 

মন্তব্য

আলাউদ্দিনের ঘরে মেধার লালন

    পেশায় তিনি দিনমজুর। নিজে বেশিদূর পড়তে পারেননি, চেয়েছেন ছেলেমেয়েকে পড়াতে। তাঁর তিন ছেলে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাকিরাও পড়ছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। মো. আলাউদ্দিন মিয়ার গল্প বলছেন বিশ্বজিৎ পাল বাবু
শেয়ার
আলাউদ্দিনের ঘরে মেধার লালন

আয়েশা আক্তার ‘প্রেসিডেন্ট স্কাউটস পদক’ পাবে—এমন খবরে খুশি তার স্কুলের শিক্ষক ও সহপাঠীরা। পড়াশোনার পাশাপাশি স্কাউটসেও বেশ সক্রিয় আয়েশা। এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী, শ্রেণি রোল ৩। আয়েশার দিকে সবার দৃষ্টি অবশ্য অন্য কারণে।

নেহাত একজন দিনমজুরের মেয়ে আয়েশা। তাঁর মতো, তাঁর আট ভাই-বোনও পড়াশোনায় বেশ ভালো। শত অভাব-অনটনের মধ্যেও তাদের কেউ পড়াশোনা ছাড়েনি। দু-তিনজন কর্মক্ষম হলেও অনটন এখনো কেটে যায়নি।
একটি ল্যাপটপের জন্য আয়েশার এক ভাইয়ের পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার নয়নপুরে থাকে আয়েশারা। বাবা মো. আলাউদ্দিন মিয়া। দিনমজুর।

তবে শারীরিক অসুস্থতায় এখন তিনি খুব একটা কাজে যেতে পারেন না। আলাউদ্দিন মিয়া জানান, অতিরিক্ত বোঝা বহনের কারণে তাঁর পায়ে এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে। বাড়ির টুকটাক কাজ বাদে কিছু করতে পারেন না। ওষুধের খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হয়। খরচ কমাতে খাওয়াদাওয়ায় রাশ টেনেছেন।

আলাউদ্দিনের বড় ছেলে মাসুদ মিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত রসায়নে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে আহছানিয়া মিশন স্কুলে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। টিউশনিও করেন। বড় মেয়ে হাফেজা আক্তারকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে ইয়াকুব জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক। ইসমাইল মিয়া কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফরমেশন অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগে পড়ছেন। সুমন মিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে এইচএসসির ছাত্র। মেয়েদের মধ্যে মাহফুজা আক্তার ইতিহাসে স্নাতক। ফাহিমা কলেজে পড়ছে। আয়েশা আক্তার এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। সবার ছোটজন নাইমা আক্তার দশম শ্রেণির ছাত্রী।

দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরিতে কাজ করে ১১ জনের সংসার চালাতে বেশ হিমশিম খেতে হয় আলাউদ্দিন মিয়াকে। সম্পত্তি বলতে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া দুই শতক জায়গা। এখন এক ছেলে চাকরি করায় সংসারের ভার সামান্য কমেছে। তবে এখনো ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয়। তাঁর মেয়ে মাহফুজা বলেন, ‘বাবা আমাদের জন্য অনেক করেছেন। এখন আর পরিশ্রম করতে পারেন না। ভাই-বোনরা মিলে চেষ্টা করি সংসার ও নিজেদের পড়ার খরচ মেটাতে, বিশেষ করে বাবার ওষুধের টাকার জন্য একটা বাড়তি চিন্তা থাকে। খেয়ে না খেয়ে আমরা পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি।’

আলাউদ্দিনের স্ত্রী আফিয়া বলেন, ‘আমার ছেলেমেয়ে পড়াশোনায় ভালো। তারা নিজেরাই এখন নিজেদের পড়ার খরচ জোগায়। এক ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। পড়াশোনার জন্য তার ল্যাপটপ খুব জরুরি, কিন্তু টাকার অভাবে কিনে দিতে পারছি না।’ প্রতিবেশী খন্দকার শফিকুল আলম বলেন, ‘আলাউদ্দিনের পরিবারের সবাই মেধাবী, কিন্তু পরিবারটিতে অভাব-অনটন পিছু ছাড়ছে না। একাধিক সন্তান পড়ালেখা সম্পন্ন করে ভালো পেশায় যুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তাদের সংসার চলা মুশকিল।’

উলচাপাড়া মালেকা ছাহেব আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সেলিম হোসেন বলেন, ‘আলাউদ্দিনের পরিবারের সবাই আমাদের বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে ও করছে। এখন যে দুজন পড়ছে তারাও মেধাবী। এইচএসসি পরীক্ষার্থী আয়েশা স্কাউটস থেকে প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড পাবে। আমরা পড়াশোনায় ওদের সাহায্য করার চেষ্টা করি।’

কথোপকথনের আলাউদ্দিন মিয়া কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমি তো অচল হয়ে গেছি। শরীরটা ভালো থাকলে কাজ করে প্রতিদিন পাঁচ-ছয় শ টাকা পেতাম। এখন আর একদম চলতে পারি না। ছেলেটা (ইসমাইল মিয়া) কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইসিটিতে পড়ছে। ওকে একটা ল্যাপটপ কিনে দিতে পারলে খুব ভালো হতো।’

 

মন্তব্য

অথচ ফুটবলই ছাড়তে চেয়েছিলেন আল আমিন

    বিদেশিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘরোয়া ফুটবলে নিয়মিত গোল করে চলেছেন বাংলাদেশ পুলিশ এফসির আক্রমণভাগের খেলোয়াড় আল আমিন। লীগে ১০ ম্যাচে করেছেন সাত গোল। ফেডারেশন কাপেও জালের দেখা পেয়েছেন দুইবার। এতেই প্রথমবার গেলেন জাতীয় দলে। ২৫ মার্চ ভারতের বিপক্ষে এএফসি এশিয়ান কাপের বাছাই পর্বের ম্যাচে দলে আছেন তিনি। কিন্তু নীলফামারীর এই তরুণের পথচলা এত মসৃণ ছিল না। লিখেছেন রানা শেখ
শেয়ার
অথচ ফুটবলই ছাড়তে চেয়েছিলেন আল আমিন
সব ভুলে সামনে তাকাতে চান আল আমিন। ছবি : মীর ফরিদ

বয়স তখনো ১৭ পেরোয়নি। সবে ঢাকার ফুটবলে নিজেকে মেলে ধরার পথের খোঁজ মিলেছে। ঠিক তখনই কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যায় কৈশোর পেরোনো আল আমিনের জীবনে। ২০২১-২২ মৌসুমে আরামবাগের ফিক্সিং কাণ্ডে জড়িয়ে যায় তরুণ আল আমিনের নাম।

শাস্তি পায় তার ক্লাব, শাস্তি জোটে তারও। পান এক বছরের নিষেধাজ্ঞা। এলোমেলো হয়ে যায় সাজানো স্বপ্নের বাগান। সেখান থেকে যেন কিছুতেই স্বাভাবিক জীবনে ফেরার দিশা পাচ্ছিলেন না।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে নীলফামারীর এই তরুণ নতুন পথের সন্ধান পেয়েছেন। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফুটবলে ফিরে এখন স্বপ্ন দেখাচ্ছেন বাংলাদেশকে।

নীলফামারী সদর উপজেলায় বসবাস আল আমিনের পরিবারের। বাবা আমিনুর রহমান চাইতেন ছেলে ফুটবলার হোক, কিন্তু মা আমিনা বেগমের স্বপ্ন ছিল ছেলেকে ক্রিকেটার বানাবেন।

ছেলে ভালোবাসে ফুটবল। মায়ের পছন্দ উপেক্ষা করে তাই ফুটবল নিয়েই মাঠে নেমে পড়তেন। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ ফুটবলে এবারের মৌসুমের অন্যতম সেরা আবিষ্কার এই আল আমিন। পুলিশ এফসির জার্সিতে অনবদ্য নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। বল পায়ে তাঁর ক্ষিপ্রতা, দক্ষতা ও প্রতিপক্ষের বক্সে ত্রাস ছড়িয়ে মন জয় করেছেন জাতীয় দলের কোচ হাভিয়ের কাবরেরার।
সেই সুবাদে আল আমিনের সামনে প্রথমবার সুযোগ এসেছে লাল-সবুজ জার্সি গায়ে চাপানোর। এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে এ মাসে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের স্কোয়াডে আছেন আল আমিন। ২১ বছরের এই তরুণের লক্ষ্য লম্বা সময় ধরে দেশের জার্সিতে খেলা, স্ট্রাইকার সংকট দূর করা। আল আমিনের ভাষ্য, ‘আমার লক্ষ্য জাতীয় দলে নিয়মিত হওয়া। যখনই সুযোগ পাব গোল করে দলকে সাহায্য করতে চাই।’

পুলিশের জার্সিতে লীগে ১০ ম্যাচে সাত গোলসহ ফেডারেশন কাপে আল আমিনের আছে আরো দুটি গোল। সব মিলিয়ে স্বপ্নের মতো সময় কাটাচ্ছেন তিনি। কিন্তু মৌসুম শুরুর আগে ভীষণ দুশ্চিন্তা পেয়ে বসেছিল তাঁকে। দল পাওয়া নিয়েও ছিল সংশয়।

দলবদলের নির্ধারিত সময়ের একদম শেষ দিনে ক্লাব পেয়েছেন। আল আমিন বলেন, ‘গত বছর শেখ জামালে থাকা অবস্থায়ই কয়েকটি ক্লাব থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেখ জামাল থেকে বলা হয়েছিল, তুমি নিয়মিত খেলতে পারবে। ক্লাবে এ জন্য থেকে যাই। কিন্তু এখন দলই থাকল না। এরপর আমি তো হতাশ। মন খারাপ হয়ে যায়। দল না পাওয়ার চিন্তায় একদিন তো ভাতই খাইনি। ঈসা ভাইকে (ঈসা ফয়সাল, জাতীয় দল ও পুলিশ এফসির লেফট ব্যাক) বললাম যে দল না পেলে তো ফুটবল খেলতে পারব না। এরপর পুলিশ ক্লাবের ম্যানেজারের (মাসুদ হোসেন) সঙ্গে কথা বলে সাইন করতে যাই।’

আক্রমণভাগের খেলোয়াড়কে সব সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়। প্রতিপক্ষের বক্সে দেখাতে হয় বিচক্ষণতা। ভয়ডরহীন মেজাজে সামনে এগোতে হয়। সব গুণই আছে আল আমিনের মধ্যে। তিনি বলেন, ‘পুলিশ দলে শুরুতে অনেক নার্ভাস ছিলাম। কোচ আমাকে নিয়ে আলাদা করে কাজ করেছেন। বুঝিয়েছেন মাথা ঠাণ্ডা রেখে কিভাবে ফিনিশিং করতে হবে। বল পেলে আমি তাড়াহুড়া করি না। আগে দেখি, আশপাশে বা সামনে কে আছে। শট নেওয়ার সুযোগ না থাকলে ব্যাকপাস দিই। দলের সবাই আমাকে নানাভাবে সাহায্য করেছে। অনুশীলনের প্রক্রিয়া মূল ম্যাচেও কাজে লাগিয়েছি।’

নীলফামারীতে জন্ম হলেও আল আমিনের শুরুটা যশোরের শামসুল হুদা ফুটবল একাডেমিতে। সেখান থেকেই ঢাকার ফুটবলে পা রাখা তাঁর। আল আমিন বলেন, ‘২০১৮ সালে যশোর শামসুল হুদা ফুটবল একাডেমিতে ভর্তি হই। পরের বছর প্রিমিয়ার লীগের দল আরামবাগে ছিলাম। বসুন্ধরা কিংস আমাকে অনূর্ধ্ব-১৮ দলে খেলার জন্য বলেছিল, কিন্তু যাওয়া হয়নি। একাডেমি থেকেই গত মৌসুমে আমাকে শেখ জামাল ক্লাবে পাঠানো হয়। কয়েকটি ম্যাচও খেলেছি। এবারও শেখ জামালে থাকার কথা ছিল, কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে তো নতুন দল খুঁজে নিতে হলো।’

পুলিশ এফসিতে গিয়ে নতুন শুরু পেয়েছেন আল আমিন। তবে বছর চারেক আগের সেই নিষেধাজ্ঞার ঘটনা এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় তাঁকে। ফিক্সিংয়ে জড়িত না থেকেও যে শাস্তি পেতে হয়েছিল আল আমিনকে! কঠিন সেই সময় প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমার আসলে কোনো দোষ ছিল না। এগুলো বুঝতামও না। তখন আমার বয়স ১৭ বছরের মতো। ওই এক বছর খুব কঠিন সময় গেছে। ফুটবল ছেড়ে দিতে হবে এমন চিন্তাও পেয়ে বসেছিল।’

আপাতত সব ভুলে সামনে তাকাচ্ছেন আল আমিন। এখন জাতীয় দলের হয়ে অসাধারণ কিছু করে দেখানোর অপেক্ষায় তিনি। তাহলেই উত্থান-পতনের জীবনে সঠিক দিশা খুঁজে পাবেন এই তরুণ।

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ