বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। এরই মধ্যে অনেক ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ে পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে দুর্বল ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ভালো ব্যাংকে জমা রাখছে মানুষ। ব্যাংকগুলো এখন আর বিশেষ ধার না পাওয়ায় অনেক আমানতকারীকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। অবশ্য দিনে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা উত্তোলনের সীমা করার কারণে এসব ব্যাংকের খারাপ অবস্থা বোঝা যাচ্ছে না। এ রকম অবস্থায় কোনো কোনো ব্যাংকের ভল্ট খালি হলেও অনেক ব্যাংকে টাকা রাখার জায়গা নেই। সীমান্ত ব্যাংকে বেশি টাকা জমা পড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিচ্ছে অনেক শাখা।
ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনযায়ী, বেশির ভাগ ব্যাংক এখন আমানত সংগ্রহের জন্য ১০ শতাংশের কাছাকাছি সুদহার অফার করছে। অর্থাৎ কোনো ব্যাংক যদি নতুন করে কোনো ঋণ বিতরণ নাও করে তার পরও বছর শেষে আমানত প্রবৃদ্ধি হবে ১০ শতাংশ। কারণ পূর্বের আমানতের সঙ্গে সুদ যুক্ত হয়ে মোট আমানত বাড়বে। ব্যাংকের ওপর আস্থা ফেরাতে কাজ করছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। দেওয়া হচ্ছে আকর্ষণীয় অফার।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদ দিচ্ছে চতুর্থ প্রজন্মের নতুন ব্যাংকগুলো। এসব ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে মিডল্যান্ড, মেঘনা, পদ্মা ব্যাংক, ইউনিয়ন, মধুমতি, এসবিএসি, প্রবাসী উদ্যোক্তাদের এনআরবি ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটিজেন ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। এ ব্যাংকগুলোয় সাধারণ সঞ্চয় রাখলে ২ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশ সুদ পাবেন গ্রাহক। মেয়াদি আমানতে মিলবে ৪ শতাংশ থেকে ১১ শতাংশ পর্যন্ত সুদ। চতুর্থ প্রজন্মের কিছু ব্যাংক মেয়াদি আমানতের ওপরে সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ থেকে ১৩ শতাংশ সুদ দিচ্ছে গ্রাহকদের।
বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদ দিচ্ছে এনআরবি ব্যাংক। তিন থেকে ছয় মাস সময়ের সুদ ৫ শতাংশ থেকে ১০.৫০ শতাংশ, ছয় মাস থেকে এক বছরের বেশি সময়ের জন্য ৬.৫০ শতাংশ থেকে ১০.৭৫ শতাংশ সুদ দিচ্ছে ব্যাংকটি। তিন বছরের বেশি সময়ের আমানতের সুদ মিলছে ১২ শতাংশ থেকে ১৩.৪৬ শতাংশ। সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক (এসএবিসি) তিন মাস থেকে তিন বছর বা তার বেশি সময়ের ফিক্সড ডিপোজিটে ৫ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে।
জানা গেছে, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন উপায়ে অর্জিত অর্থ নানা উপায়ে অনেকেই ঘরে রেখেছিলেন। তবে সরকার পরিবর্তনের পর তাদের বেশির ভাগই পলাতক। ঘরে টাকা রেখে তাদের কেউ কেউ এখন বিপদে আছেন। নিরাপদ বোধ না করায় বিভিন্ন উপায়ে তারা ভালো ব্যাংকে টাকা জমা রাখছেন। আবার সরকার পতনের পর থেকে বড় অঙ্কের নগদ টাকা তুলতে পারছে না মানুষ। এর কারণ, সরকার পতনের প্রথম সপ্তাহে দিনে সর্বোচ্চ এক লাখ, দ্বিতীয় সপ্তাহে দুই লাখ এবং তৃতীয় সপ্তাহে তিন লাখ টাকা নগদ উত্তোলনের সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। এ কারণে খারাপ অবস্থার ব্যাংক থেকে অনেকেই বড় অঙ্কের আমানত তুলতে পারছে না।
শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ উদ্দিন বলেন, ‘এখনো ব্যাংক খাতের অস্থিরতা কাটেনি। বিশেষ করে ইসলামী খাতের ব্যাংকগুলোর পর্ষদ পরিবর্তনের পর আমানতকারীরা আস্থাশীল ব্যাংকের দিকে স্থানান্তর হচ্ছিল। সেই সুবিধাটা পেয়েছে শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকও। তা ছাড়া উচ্চমূল্যস্ফীতির সময়ে জনগণ টাকা রাখলে লাভের পরিমাণ অত্যন্ত নগণ্য। সার্ভিস চার্জ এবং ব্যাংকের চার্জ দিয়ে আর কোনো লাভ থাকে না। আস্থা ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে যেকোনো একটি সমাধানে যাওয়া উচিত। দীর্ঘদিন থেকে শুনছি ব্যাংক ইকুইজিশন অ্যাক্ট এবং মার্জারের বিষয়ে আলোচনা চলছে। যেকোনো একটা সিদ্ধান্ত না এলে ব্যাংক খাতের অস্থিরতা নাও কমতে পারে। ব্যাংকে আমানত বৃদ্ধির বিষয়টি সব সময় সুখকরও নয়। কারণ আমানত নিয়ে বিনিয়োগের জায়গা থাকতে হবে। শুধু আমানত নিলেই চলবে না, তার খরচ বহন করতে হবে।’
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে গত ১০ বছর আগে থেকে বলে আসছি এস আলমের ব্যাংকে আপনারা টাকা রাখবেন না। কিন্তু আপনারা টাকা রেখেছেন। তারা ২ শতাংশ সুদ বেশি দিয়েছে, আপনারা সেখানেই টাকা রেখেছেন, এখন ধরা খেয়েছেন। এখন আমরা আপনাদের উদ্ধার করব; কিন্তু এখনই সেটি পারা যাবে না। আমরা ধাপে ধাপে করব; সে জন্য সময় দিতে হবে। আমরা ব্যাংক রেজল্যুশন অ্যাক্টের দিকে যাচ্ছি, কিছু ব্যাংক একীভূত করতে হবে। অনেক কিছু করা যাবে, করা হবে। এ বছরই হয়তো অনেক কিছু করা হবে। এতটুকু বলতে পারি, আপনারা টাকা পান আর বন্ড পান, কিছু একটা পাবেন।’
ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেইন বলেন, ‘বাংলাদেশে করপোরেট গভর্ন্যান্স, কমপ্লায়েন্স এবং মূল্যবোধভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের রোল মডেল হিসেবে ব্র্যাক ব্যাংক সব স্টেকহোল্ডারের কাছে স্বীকৃতি। এ জন্য গ্রাহকরা সব সময়ই ব্র্যাক ব্যাংকের ওপর আস্থা রাখেন। এ ছাড়া সব সময় গ্রাহকদের আস্থা ধরে রাখতে তাদের পরিবর্তনশীল চাহিদার কথা বিবেচনায় রেখে আমরা নতুন নতুন প্রডাক্ট ও প্রপোজিশন চালু করি। এ জন্য ব্র্যাক ব্যাংকের আমানত বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা গত বছরের আগস্টের তুলনায় অনেক ভালো পরিস্থিতিতে আছি। বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল হয়েছে এবং আমরা সঠিক পথে আছি। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে।’
তিনি বলেন, ‘ব্যাংকিং খাত সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক মিলে যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা প্রশংসার দাবিদার। বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে আমরা গ্রাহকদের আস্থা ফিরে আসতে দেখছি। এটি একটি ইতিবাচক দিক। তবে সার্বিক সংস্কার বাস্তবায়ন হলে আমাদের ব্যাংকিং খাত অনেক দূর এগিয়ে যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’