কোরআনের অসংখ্য মুজিজার মধ্যে অন্যতম একটি বিস্ময় লুকিয়ে রয়েছে দুটি শব্দের শিল্পসম্মত ব্যবহারে : ‘নাসাবা’ (স্থাপন করা) ও ‘আলক্বা’ (নিক্ষেপ করা)। যদিও এ দুটি শব্দ একসূত্রে গাঁথা, তবে তাদের অর্থ ও প্রয়োগের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য এক অনন্য সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। এই শব্দ দুটি বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়েছে পাহাড়ের সৃষ্টির রহস্য উন্মোচনের জন্য। কোরআনে বলা হয়েছে : ‘আর পাহাড়ের দিকে তাকাও, কিভাবে সেগুলো স্থাপন করা হয়েছে।
কোরআনের বর্ণনায় পাহাড়ের গঠন প্রক্রিয়া
আসআদ শাহীন

অন্য আরেক জায়গায় এসেছে : ‘তিনি পৃথিবীতে সুদৃঢ় পাহাড় স্থাপন করেছেন, যাতে পৃথিবী তোমাদের নিয়ে নড়ে না যায়।’ (সুরা : আন-নাহল, আয়াত : ১৫)
কোরআনের শব্দগুলোর গভীরতা ও আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে তার তুলনা করলে বোঝা যায়, প্রতিটি শব্দ কতটা পরিপূর্ণ অর্থবোধক ও প্রাসঙ্গিক। ভূতত্ত্বের আলোকে, পাহাড়সমূহ গঠন প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত—ভাঁজযুক্ত পাহাড়, বৃহৎ পাথুরে পাহাড় এবং আগ্নেয়গিরি পাহাড়।
এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয়, ভাঁজযুক্ত ও বৃহৎ পাথুরে পাহাড়ের সৃষ্টি ঘটে নাসাবা অর্থাৎ স্থাপন করা বা গেঁথে দেওয়ার মাধ্যমে।
এই আয়াতে সেই পর্বতমালার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যেগুলো টেকটোনিক প্লেটের (Plate tectonics) সংঘর্ষ কিংবা ফল্ট ব্লকগুলোর (Fault blocks) চলাচলের কারণে ক্রমেই উঁচু হয়। অর্থাৎ পৃথিবীর অভ্যন্তরে চলমান এই সংঘর্ষ যত দিন চলতে থাকবে, পাহাড় ততই উঁচু হতে থাকবে।
অন্যদিকে আগ্নেয়গিরি থেকে সৃষ্ট পর্বতের ক্ষেত্রে দেখা যায়, যখন কোনো আগ্নেয়গিরি অগ্ন্যুৎপাত করে, তখন ভূগর্ভ থেকে উদগিরণ হওয়া লাভা, ছাই ও অন্যান্য উপাদান ভূপৃষ্ঠে জমা হতে থাকে।
উইলিয়াম ক্যাম্পবেল তাঁর গবেষণায় আগ্নেয়গিরি থেকে সৃষ্ট পর্বতমালা সম্পর্কে লিখেছেন : আগ্নেয়গিরি থেকে সৃষ্ট পর্বতের আরেকটি ধরন হলো এমন—যেখানে ভূগর্ভ থেকে লাভা ও ছাই নির্গত হয় এবং এগুলো ভূপৃষ্ঠে জমা হতে হতে এক বিশাল পাহাড়ে পরিণত হয়। (The Quran and the Bible: In the Light of History and Science, p. 172)
কোরআনের পরিভাষাগুলো এমন সূক্ষ্ম গভীরতা ও নিখুঁতভাবে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রকাশ করে, যা মানুষের কল্পনার গণ্ডিকেও ছাড়িয়ে যায়। কোরআন অবতীর্ণের সময় এই জ্ঞান ছিল সম্পূর্ণ অজানা।
আরেকটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, যা কোরআন বহু আগেই প্রকাশ করেছে, তাহলো পাহাড়গুলোকে কখনো আওতাদ বা কীলকরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘আমি কি পৃথিবীকে শয্যারূপে তৈরি করিনি? এবং পাহাড়কে (ভূমিতে প্রোথিত) কীলকরূপে স্থাপন করিনি?’ (সুরা : আন-নাবা, আয়াত : ৬-৭)
কোরআনের আরেক স্থানে পাহাড়গুলোকে রাসিয়াহ বা সুদৃঢ়ভাবে স্থাপিত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন : ‘আর আমি এতে সুউচ্চ ও দৃঢ় পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং তোমাদের জন্য তৃষ্ণা নিবারণকারী সুপেয় পানি দিয়েছি।’ (সুরা : আল-মুরসালাত, আয়াত : ২৭)
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন : ‘তিনিই পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছেন এবং তাতে দৃঢ়ভাবে পাহাড় ও নদী সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা : আর-রাদ, আয়াত : ৩)
এই বর্ণনাগুলো পাহাড়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের দিকে ইঙ্গিত করে। উদাহরণস্বরূপ একটি জাহাজ যখন পানির ওপর ভাসে, তার ভারসাম্য রক্ষার জন্য নিচের অংশটি পানির গভীরে প্রোথিত থাকে। তদ্রূপ পাহাড়গুলোরও এমন ভিত্তি রয়েছে, যা মাটির গভীরে প্রোথিত হয়ে পৃথিবীকে ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতা প্রদান করে।
আধুনিক বিজ্ঞান আজ এমন এক অভাবনীয় তত্ত্ব উদঘাটন করেছে, যা কোরআনের বিস্ময়কর বর্ণনার সঙ্গে অভূতপূর্বভাবে মিলে যায়। পাহাড় শুধু ভূমির ভূদৃশ্যকে নান্দনিক করে তোলে না, বরং তা পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষায় একটি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। পাহাড়গুলো মাটির গভীরে এমনভাবে প্রোথিত, যেন সেগুলো শক্ত খুঁটির মতো পৃথিবীকে দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছে।
খ্যাতনামা ভূতত্ত্ববিদ সাইমন ল্যাম্ব তাঁর গবেষণায় লিখেছেন : এটি এমন এক বিস্ময়কর আবিষ্কার যে পাহাড়গুলো মাটির গভীরে শিকড়ের মতো প্রোথিত, ঊনবিংশ শতাব্দীর ভূতত্ত্বের অন্যতম বড় মাইলফলক ছিল।
(Violent Earth, p. 46) পাহাড়ের শিকড় সম্পর্কে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী জর্জ এরি আবিষ্কার করেন। তিনি লিখেছেন : পাহাড়ের শিকড় পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠে ভারসাম্য রক্ষা করতে সহায়তা করে। এর শিকড়গুলো ভূত্বকের গভীরে ম্যান্টলের (Mantle) স্তরে প্রবেশ করে এবং এর উচ্চতার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। এই প্রক্রিয়াকে ভূবিজ্ঞানীরা ‘আইসোস্ট্যাসি’ বলে অভিহিত করেছেন।
কোরআনে এই তত্ত্ব বা হাকিকত বহু শতাব্দী আগেই সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘আমি কি পৃথিবীকে শয্যারূপে তৈরি করিনি? এবং পাহাড়গুলোকে কীলকরূপে স্থাপন করিনি?’ (সুরা : আন-নাবা, আয়াত : ৬-৭)
এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো কোরআনের অলৌকিকতার উজ্জ্বল প্রমাণ, যা মানব মনে বিস্ময় জাগায় এবং আল্লাহর সৃষ্টির গভীরতার প্রতি এক অনন্য শ্রদ্ধার জন্ম দেয়। উল্লিখিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে কোরআন সম্পর্কে আলী (রা.)-এর উক্তি কতটা সত্য ও গভীর। তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা তাঁর পথকে তোমাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তাঁর সুস্পষ্ট বিধান এবং লুক্কায়িত প্রজ্ঞার মাধ্যমে তাঁর উপদেশগুলোকে সুস্পষ্ট করেছেন। তাঁর বিস্ময়কর বিষয় কখনো শেষ হবে না এবং তাঁর আশ্চর্যতাগুলো কখনো নিঃশেষ হবে না।’ (নাহজুল বালাগা, পৃষ্ঠা-২১২)
এই বাণীর মর্মার্থ আজ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের আলোতে আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কোরআনের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি উপমা এবং প্রতিটি ধারণা এক অপার রহস্য ও জ্ঞানের ভাণ্ডার, যা যুগে যুগে মানুষকে বিস্মিত করেছে এবং করবে। এর অভ্যন্তরীণ প্রজ্ঞা ও বাহ্যিক নির্দেশনা এমনভাবে একে অপরের সঙ্গে সংমিশ্রিত যে তা আল্লাহর ঐশী জ্ঞানের এক মহিমাময় প্রকাশ হয়ে মানুষের হৃদয়ে অনুপ্রেরণা জাগায়।
মোটকথা, এই অসাধারণ তত্ত্ব, যা আজকের বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে, তা কোরআনে বহু শতাব্দী আগে থেকেই সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে।
সম্পর্কিত খবর

যে আমলে জাহান্নামের আগুন নেভে
মো. আবদুল মজিদ মোল্লা

ঈমানের পর ফরজ নামাজই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল। আল্লাহ মুমিন নর-নারীর ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য সময় নির্ধারণ করেছেন। মুমিনের দায়িত্ব হলো যথাসময়ে ফরজ নামাজ আদায় করা।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নির্ধারিত সময়ে নামাজ আদায় করা মুমিনের অবশ্য কর্তব্য।
যথাসময়ে নামাজের গুরুত্ব
কোরআন-হাদিসে যথাসময়ে নামাজ আদায়ের বহু তাগিদ আছে। নিম্নে তার কয়েকটি তুলে ধরা হলো—
১. জাহান্নামের আগুন নেভে : যথাসময়ে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে জাহান্নামের আগুন নির্বাপিত হয়। আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর এমন একজন ফেরেশতা আছে যে প্রত্যেক নামাজের সময় ঘোষণা করে : হে মানব সন্তান! তোমরা তোমাদের সেই আগুনের প্রতি মনোযোগী হও, যা তোমরা (পাপের মাধ্যমে) প্রজ্বলিত করেছ। সুতরাং তা নির্বাপিত করো।
২. জান্নাতের প্রতিশ্রুতি : যথাসময়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করলে তার জন্য জান্নাতের প্রতিশ্রুতি আছে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন। যে ব্যক্তি তা যথাযথভাবে পালন করবে, আর অবহেলার কারণে এর কোনটি পরিত্যাগ করবে না, মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানোর অঙ্গীকার করেছেন। আর যে ব্যক্তি তা (যথাযথভাবে) আদায় করবে না, তার জন্য আল্লাহর কাছে কোনো প্রতিশ্রুতি নেই।
৩. আল্লাহর ক্ষমা লাভ : যথাসময়ে নামাজ আদায় করলে আল্লাহ বান্দাকে ক্ষমা করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মহান আল্লাহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন। যে ব্যক্তি উত্তমরূপে অজু করে নির্ধারিত সময়ে পূর্ণরূপে রুকু ও পরিপূর্ণ মনোযোগ সহকারে নামাজ আদায় করবে, তাকে ক্ষমা করার জন্য আল্লাহ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর যে ব্যক্তি এরূপ করবে না, তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো প্রতিশ্রুতি নেই।
৪. সর্বোত্তম আমল : উম্মু ফারওয়া (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সর্বোত্তম আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, নামাজের সময় ওয়াক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নামাজ আদায় করা। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪২৬)
৫. ফেরেশতাদের দোয়া লাভ : সময়মতো নামাজ আদায়ের জন্য যারা সময়ের আগেই মসজিদে উপস্থিত হয় এবং নামাজের জন্য অপেক্ষা করে, ফেরেশতারা তাদের জন্য দোয়া করেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমাদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি যে পর্যন্ত মসজিদে নামাজের প্রতীক্ষায় থাকে, সে যেন নামাজের মধ্যেই থাকে, আর যতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের কেউ মসজিদে থাকে ফেরেশতারা সে পর্যন্ত তার জন্য দোয়া করতে থাকেন—‘হে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন, হে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন।’ অজু ছুটে না যাওয়া পর্যন্ত তার জন্য দোয়া চলতে থাকে। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩৩০)
আল্লাহ সবাইকে যথাসময়ে নামাজ আদায়ের তাওফিক দিন। আমিন।

মুসলিমদের পারষ্পরিক সম্পর্ক রক্ষায় গুরুত্ব
মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা

বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত মুহাম্মদ (সা.) মুসলিম উম্মাহর সম্পর্ককে এক দেহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। যদি মুসলিমরা এক দেহের মতো হয় কিংবা এক গাঁথুনির মতো, যেখানে এক অংশ অন্য অংশকে শক্তি জোগায়, তাহলে তাদের মাঝে বিভেদ, বিচ্ছিন্নতা বা সম্পর্কচ্ছেদ থাকার কথা নয়; বরং তাদের মধ্যে হওয়া উচিত সম্পর্ক রক্ষা, পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি ও মিলমিশ আর পারস্পরিক ঐক্য আরো দৃঢ় হওয়া উচিত।
ইসলামের শত্রুদের হৃদয় যেসব কারণে প্রশান্ত হয় এবং চোখ শীতল হয়, তার অন্যতম হলো, মুসলিমদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা, পরস্পরের প্রতি বিরূপতা, পরস্পর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং একে অপরের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত হওয়া। এই বিভেদই তাদের বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত করে ফেলে, যার ফলে তাদের ঐক্য বিনষ্ট হয়, শক্তি দুর্বল হয় এবং শত্রুরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং পরস্পরের মধ্যকার অবস্থা সংশোধন করে নাও।’ (সুরা : আনফাল, আয়াত : ১)
আল্লাহর নির্দেশনা সরাসরি বিবাদে লিপ্ত মুসলিমদের প্রতি যে তোমরা আল্লাহকে ভয় করে তোমাদের জেদ, শত্রুতা, বিদ্বেষ থেকে বেরিয়ে এসে পরস্পরের সম্পর্ক ঠিক করে নাও। এটা আল্লাহর আদেশ।
আর বিবাদে লিপ্ত মুসলমানদের আশপাশের মুসলমানদের দায়িত্ব হলো, তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়া। আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ‘আর যদি মুমিনদের দুটি দল পরস্পর লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে, তবে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ৯)
অন্য আয়াতে তিনি আরো বলেন, ‘নিশ্চয়ই মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। অতএব, তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে আপস-মীমাংসা করে দাও এবং আল্লাহকে ভয় করো, আশা করা যায় তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হবে।
আমাদের প্রিয় নবীজি (সা.) তাঁর উম্মতদের ভ্রাতৃত্ব রক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, কোনো মুসলমানের জন্য তার অপর মুসলমান ভাইয়ের সঙ্গে তিন দিনের অধিক সম্পর্কচ্ছেদ করে থাকা উচিত নয়। আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ কোরো না, হিংসা কোরো না, একে অপরের বিরুদ্ধাচরণ কোরো না। তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা, ভাই ভাই হয়ে যাও। কোনো মুসলিমের জন্য তার ভাইকে তিন দিনের বেশি সময় উপেক্ষা করা হালাল নয়।
নবীজি (সা.) মুসলমানদের সম্পর্ক রক্ষাকে এতটাই গুরুত্ব দিতেন যে প্রয়োজনে দুজন মুসলিমের মধ্যে মীমাংসা করতে কিছু বাড়িয়ে বলারও অনুমতি দিয়েছেন। হুমাইদ ইবনে আব্দুর রহমান (রহ.) থেকে তাঁর মায়ের সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সে মিথ্যাবাদী নয়, যে দুজনের মধ্যে মীমাংসার জন্য কিছু কথা বাড়িয়ে বলে।
আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুসাদ্দাদ (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তি লোকদের মধ্যে মীমাংসার জন্য কিছু উত্তম কথা বলে এবং কিছু বাড়িয়ে বলে, সে মিথ্যুক নয়। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯২০)
শয়তান সব মুসলমানকে নামাজ থেকে বিরত রেখে তার অনুসরণ করাতে পারে না, তাই মুমিনদের বিভ্রান্ত করতে তার শেষ অস্ত্র হলো, তাদের মধ্যে শত্রুতা তৈরি করে দেওয়া, তাদের বিভক্ত করে দেওয়া।
জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (সা.)-কে বলতে শুনেছি, শয়তান হতাশ হয়ে গেছে যে নামাজি লোকেরা তাকে উপাসনা করবে না। তবে সে তাদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা লাগিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে নিরাশ হয়নি। (তিরমিজি, হাদিস : ১৯৩৭)
ইমাম নববী বলেন, হাদিসের অর্থ হলো শয়তান জানে, নামাজি মুসলিমরা তাকে উপাসনা করবে না, তাই সে মুসলিমদের মধ্যে ঝগড়া, হিংসা, যুদ্ধ এবং বিশৃঙ্খলা লাগাতে সচেষ্ট থাকে।
শয়তানের এই পদক্ষেপকে হালকাভাবে চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। এটা তার খুব সূক্ষ্ম ও শক্তিশালী একটি চাল। কারণ মুমিনরা যখন একে অপরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে, তখন তারা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়, কিছু বিশেষ সময় মহান আল্লাহ অগণিত বান্দাকে ক্ষমা করে দেন, কিন্তু পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী মুসলিম নামাজিরা সেই সাধারণ ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, সোমবার ও বৃহস্পতিবারে জান্নাতের দরজাগুলো খোলা হয়। তখন আল্লাহ প্রত্যেক বান্দাকে ক্ষমা করে দেন, যে আল্লাহর সঙ্গে কোনো কিছু শরিক করে না। তবে সেই ব্যক্তি ব্যতিক্রম, যার সঙ্গে তার ভাইয়ের শত্রুতা থাকে। তখন বলা হয়, এ দুজনকে সময় দাও, যতক্ষণ না তারা মীমাংসা করে। (মুসলিম, হাদিস : ৬৪৩৮)
এখানে পরস্পর সম্পর্কচ্ছেদকে শিরকের পর্যায়ে না বললেও একজন শিরককারীকে যেভাবে ক্ষমার আওতামুক্ত রাখা হয়, তেমনি পরস্পর বিদ্বেষপোষণকারীকেও ক্ষমার আওতামুক্ত রাখা হয়, যা সত্যিই ভেবে দেখার বিষয়। অন্য হাদিসে তো এক বছর পরস্পর সম্পর্কচ্ছেদকে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আবু খিরাশ আস-সুলামী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছেন, যে তার ভাইয়ের সঙ্গে এক বছর সম্পর্ক ছিন্ন রাখল সে যেন তাকে হত্যা করল। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯১৫)
অতএব, আমাদের সবার উচিত মহান আল্লাহকে ভয় করা এবং নিজেদের সব রাগ-ক্ষোভ থেকে বের হয়ে এসে পরস্পর সন্ধি করে নেওয়া। একটা মানুষ বাঁচেই কত দিন। সামান্য বিষয় নিয়ে পরস্পর বিদ্বেষ পোষণ করে আল্লাহর ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কোনো মানে হয় না। এ অবস্থায় যদি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে দুনিয়া থেকে চলে যেতে হয়, তবে সে ক্ষতি পোষানোর কোনো ব্যবস্থা থাকবে না। মহান আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুন। আমিন।

প্রশ্ন-উত্তর
ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে নামাজ পড়লে নামাজ হবে?
ইসলামী জীবন ডেস্ক

প্রশ্ন : ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে নামাজ পড়লে নামাজ হবে? যদি না হয় তাহলে যারা এসি রুমে নামাজ পড়ে, তাদের দরজা-জানালা সব বন্ধ থাকে, তাদের নামাজের বিধান কী? আমার কিছু বন্ধু বলেছে, বদ্ধ ঘরে নামাজ হয় না।
-আব্দুর রহমান, চট্টগ্রাম
উত্তর : দরজা-জানালা বন্ধ করে নামাজ পড়লে নামাজ শুদ্ধ হবে। তাই এসি রুমে নামাজ পড়তেও কোনো অসুবিধা নেই। যিনি বদ্ধ ঘরে নামাজ হয় না বলেছেন, তাঁর কথা ভুল।
সমাধান : ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশ, বসুন্ধরা, ঢাকা

পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার আমল
ইসলামী জীবন ডেস্ক

পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। পরীক্ষার মাধ্যমেই নিজেকে যাচাইয়ের সুযোগ পান একজন শিক্ষার্থী। একজন শিক্ষার্থীর মেধা ও মান যাচাইয়ের মানদণ্ড হচ্ছে এই পরীক্ষা।
ইসলাম ভালো ফলাফলের জন্য অলসতা ত্যাগ করে পরিশ্রম করতে উৎসাহিত করে।
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তির আমল তাকে পিছিয়ে দেয়, তার বংশ-পরিচয় তাকে কখনোই এগিয়ে দিতে পারে না।’ (সহিহ মুসলিম : ৭০২৮)
আল্লাহর ওপর ভরসা করার মানে এই নয় যে পড়ালেখা না করেই উত্তম ফলাফলের অপেক্ষায় থাকবে। আল্লাহ তাআলা দুনিয়াকে দারুল আসবাব তথা উপকরণের কেন্দ্রবিন্দু বানিয়েছেন। তাই পড়ালেখা করতে হবে।
পরীক্ষাকেন্দ্রে যাওয়ার আগে দুই রাকাত ‘সালাতুল হাজত’ পড়ে মহান আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করে পরীক্ষার উদ্দেশ্যে বের হওয়া যেতে পারে।
এটি পড়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো সুরা পড়া জরুরি নয়। বরং সাধারণভাবে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে নিজ প্রয়োজনগুলো মহান আল্লাহর কাছে পেশ করা ও তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করা।
তাড়াহুড়ার কারণে ভুল হয়। ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, তাড়াহুড়া শয়তানের অভ্যাস। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘কাজে ধীরস্থিরতা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আর তাড়াহুড়া করা শয়তানের পক্ষ থেকে।’ (সুনানে বায়হাকি : ২০৭৬৭)।
যেকোনো ভালো কাজই বিসমিল্লাহ বলে শুরু করতে হয়। তাই পরীক্ষার্থীরাও প্রশ্নপত্র গ্রহণ করার সময় এবং উত্তর লেখা শুরু করার সময় বিসমিল্লাহ বলবেন। সঙ্গে দরুদ শরিফও পাঠ করে নিতে পারেন। কারণ কোনো ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর ওপর একবার দরুদ পড়লে মহান আল্লাহ তার ওপর ১০ বার রহমত বর্ষণ করেন। বিসমিল্লাহ পড়ার ব্যাপারে হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, যেসব কাজ আল্লাহর নাম না নিয়ে শুরু করা হয়, সেগুলো বরকতশূন্য। কোনো বর্ণনায় আল্লাহর প্রশংসার কথাও বলা হয়েছে।
অনেক সময় দেখা যায়, ভালোভাবে মুখস্থ করে যাওয়া জিনিসও মনে পড়ে না। কেউ এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়লে নিম্নোক্ত দোয়া পড়তে পারেন।
উচ্চারণ : ‘রব্বিশরাহলি সদরি, ওয়া ইয়াসসিরলি আমরি, ওয়াহলুল উকদাতাম মিল্লিসানি, ইয়াফকহু কওলি।’
অর্থ : ‘সে বলল, হে আমার রব, আমার বুক প্রশস্ত করে দিন। এবং আমার কাজ সহজ করে দিন। আর আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দিন—যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।’ (সুরা ত্বহা : ২৫-২৮)
এই দোয়া মৌখিক পরীক্ষার সময় বেশি বেশি পড়া যেতে পারে।