<p style="text-align:justify">প্রায় পাঁচ দশক ধরে দারিদ্র্য বিমোচন, নারীদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিসহ দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে ক্ষুদ্রঋণ। গত বছরের জুন শেষে ক্ষুদ্রঋণের গ্রাহক ছিল ছয় কোটি ৬৮ লাখ ২০ হাজার। ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করা হয়েছে দুই লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা, যা সরকারের উন্নয়ন বাজেটের (এডিপি) চেয়ে বেশি। ক্ষুদ্রঋণ গ্রাহকের সঞ্চয় ছাড়িয়েছে ৯০ হাজার কোটি টাকা।</p> <p style="text-align:justify">জানা গেছে, ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামে ক্ষুদ্রঋণের সূত্রপাত হয়। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল মানুষ দরিদ্রদের জামানতবিহীন ঋণ দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করেন। গ্রামের ৪২ জন নারী ঋণ পেলেন, যথাসময়ে সুদ ও আসল ফেরত পাওয়া গেল। দরিদ্ররাও যে ঋণের যোগ্য ও যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করতে পারে, সে শিক্ষাই এর মধ্য দিয়ে নথিভুক্ত হলো।</p> <p style="text-align:justify">জোবরা গ্রামের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ক্রমান্বয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে লাগল গ্রামীণ ব্যাংকসহ অসংখ্য সংগঠনের হাত ধরে। সময়ের আবর্তে ক্ষুদ্রঋণ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ব্যাপ্তি পেয়েছে আন্তর্জাতিক পরিসরে। জাতিসংঘ ২০০৬ সালকে ইয়ার অব মাইক্রোফিন্যান্স পালন করে। ক্ষুদ্রঋণের বদৌলতে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়।</p> <p style="text-align:justify">ড. ইউনূস এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। ফলে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ক্ষুদ্রঋণের আরো প্রসার ঘটবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।</p> <p style="text-align:justify">ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে ৭৩১টি প্রতিষ্ঠান ২৫ হাজারের বেশি শাখার মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এমআরএ সনদপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান, গ্রামীণ ব্যাংক, সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও বিশেষ কর্মসূচি, সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করা হয়। ২০২২ সালের জুন মাস শেষে ক্ষুদ্রঋণের সব ধরনের গ্রাহক ছিল চার কোটি ৪৬ লাখ ৬০ হাজার, যা গত বছর চার কোটি ৫৩ লাখে উন্নীত হয়েছে।</p> <p style="text-align:justify">এই সময়ে ঋণ বিতরণ দুই লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে দুই লাখ ৮৬ হাজার ১৭৪ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। ফলে এক বছরের ব্যবধানে ঋণ বিতরণ বেড়েছে প্রায় ২৬ শতাংশ।</p> <p style="text-align:justify">এক বছরের ব্যবধানে এক-চতুর্থাংশ ঋণ বৃদ্ধি বেশ চমকই মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ ছাড়া দেশের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপির চেয়ে এখন ক্ষুদ্রঋণ বেশি পরিমাণে বিতরণ করা হচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত এডিপি ছিল দুই লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা ছিল দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা।</p> <p style="text-align:justify"><strong>গ্রামীণ ব্যাংকের হিস্যা কমেছে</strong></p> <p style="text-align:justify">২০০৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের সব ধরনের ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে ওই সময়ে ক্রমপুঞ্জীভূত ঋণের প্রায় ২৯ শতাংশই ছিল গ্রামীণ ব্যাংকের। আবার ২০০৬-০৭ অর্থবছরে যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল তার ৩০-৩১ শতাংশই ছিল গ্রামীণ ব্যাংকের। অন্যদিকে গত ২০২২ সালে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণে গ্রামীণ ব্যাংকের অবদান ছিল ৯.১৪ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে আরো কমে নেমে এসেছে ৮.৬৫ শতাংশে। ফলে যে প্রতিষ্ঠানটির হাত ধরে ক্ষুদ্রঋণের বিকাশ হয়েছিল সেই প্রতিষ্ঠানের অবদানই ক্রমহ্রাসমান।</p> <p style="text-align:justify">বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষুদ্রঋণের প্রতি সরকারের নীতি ও সার্বিক সহায়তা প্রদানে অবস্থান পরিবর্তনের কারণেই মাঝেমধ্যে এর সংকোচন হয়েছে। আর গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে। পাশাপাশি গত এক দশকে আর্থিক খাতে, বিশেষ করে ব্যাংকের মাধ্যমে ছোট উদ্যোক্তাদের অর্থ পাওয়া বেশ কঠিন হয়ে গেছে। ব্যাংকের অর্থ বিশেষ শ্রেণি ও মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়ে থাকে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ ঋণ পেতে নানা জটিলতায় ভোগে। এ জন্য মানুষ ক্ষুদ্রঋণমুখী হয়েছে।</p> <p style="text-align:justify">এ বিষয়ে জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশনের (জেসিএফ) নির্বাহী পরিচালক আজাদুল কবির আরজু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে বিভিন্নভাবে এই খাতে বরাদ্দ জটিলতা তৈরি হয়েছে। সহযোগী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকেও সহায়তা কমানো হয়েছে। এর সঙ্গে গ্রাহক পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার ও আস্থাহীনতা বাড়ানো হয়েছে। ফলে সার্বিকভাবে কোণঠাসা অবস্থায় থেকে আমাদের ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে। এগুলো দূর করতে পারলে দেশে উদ্যোক্তা তৈরি, নারীর ক্ষমতায়ন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কারিগর হবে ক্ষুদ্রঋণ খাত।’</p> <p style="text-align:justify">খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মাঝেমধ্যে ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন সহযোগিতা কমানো ছাড়াও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কঠোর তদারকি করা হয়েছে। তা ছাড়া সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে ড. ইউনূসকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির কারণেও জনগণের মধ্যে আস্থাহীনতার শঙ্কা তৈরি হয়। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষুদ্রঋণের বিকল্প বিভিন্ন উদ্যোগ, বিশেষ করে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক গঠন, ঋণ ও সঞ্চয়ভিত্তিক বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু ক্ষুদ্রঋণের বিকল্প হিসেবে সেগুলো কোনোটাই কার্যকর হতে পারেনি।</p>