পঞ্চগড়ের করসিনার আক্তার (৩৪) নামে এক নারীকে আট বছর ধরে পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। মাথায় সমস্যা আছে এই অভিযোগেই তার এই শিকলবন্দি জীবন। বেঁধে রাখা শিকলে পায়ে ঘা হয়ে গেলেও মুক্তি মিলছে না তার। দরিদ্র পরিবারটি ভালো চিকিৎসা করাতে না পারায় দিন দিন আরো অসুস্থ্য হয়ে পড়ছে ওই নারী।
তার পাগলামির কারণে নিরুপায় হয়েই বেঁধে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানিয়েছে তার পরিবার।
পঞ্চগড় সদর উপজেলার সাতমেরা ইউনিয়নের হরেয়াপাড়া এলাকার কলিম উদ্দিনের বড় মেয়ে করসিনা আক্তার। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় তেঁতুলিয়া উপজেলার দেবনগর ইউনিয়নের মানিকডোবা গ্রামের নাজিম উদ্দিনের ছেলে আবুল হোসেনের সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর ভালোই চলছিল তার সংসার।
বিয়ের দুবছর পর করসিনার প্রথম ছেলে সন্তান জন্ম দেন। তার দুবছর পর এক মেয়ে সন্তান জন্ম দেন। ওই মেয়ে সন্তান প্রসব করার সময় মানুষিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন করসিনা। তাছাড়া তার স্বামী আবুল হোসেন বিভিন্ন কারণে তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করতো।
করসিনা বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসা না করিয়ে বাড়িতেই বেঁধে রাখতে শুরু করে তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন। এভাবেই স্বামীর সংসারে দুই বছর শেকলবন্দি হয়ে কাটে তার। পরে আবুল কৌশলে করসিনাকে তালক দিয়ে অন্যত্র বিয়ে করেন। তারপর থেকে বাবার বাড়িতে আশ্রয় হয় করসিনার। দরিদ্র বাবা মা তাদের সাধ্য মতো চিকিৎসা করান রংপুরসহ বিভিন্ন স্থানের বড় বড় ডাক্তারের চিকিৎসা করান।
তবে চিকিৎসার টাকা ফুড়িয়ে যায় অল্প কয়েকদিনেই। তারপর পাবনা মানসিক হাসপাতালে দুই মাস ভর্তি রাখেন। কিন্তু সেখানেও কোনো কাজ না হওয়ায় বাড়ি নিয়ে আসেন।
ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যান, লোকজনকে মারধর করেন, ভাঙচুর করেন বলে শিকলে বেঁধে রাখতে বাধ্য হয় বলে জানায় তার পরিবার। স্বামী ও বাবার বাড়ি মিলে ৮ বছর ধরে তার শিকলে বাঁধা জীবন। তার ছেলে হৃদয়ের বয়স এখন ১০ বছর আর মেয়ে আশামনির বয়স আট বছর।
আজ বুধবার দুপুরে কলিম উদ্দিনের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, করসিনার বাম পায়ে লোহার শিকল পরিয়ে ঘরে খুঁটিতে তালা দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। এর আগে ডান পায়ে শিকল ছিল। সেখানে ক্ষতের সৃষ্টি হলে বাম পায়ে শিকল দেওয়া হয়। বেশির ভাগ সময় ঘরের ভেতর কাটে তার। মাঝে মধ্যে বারান্দায় বের করা হয়। দেখলে তাকে স্বাভাবিক মানুষ বলেই মনে হবে। সুন্দর হাতের লেখায় নিজের ও পরিবারের লোকজনের নামও লিখতে পারেন। গুছিয়ে কথাও বলতে পারেন। তবে কিছুক্ষণ পরেই আবার অসংলগ্ন কথা বলতে শুরু করে। রাতে চেচামেচি করেন।
স্থানীয়রা জানান, বছরের পর বছর এভাবেই কাটছে তার দিন। ছেড়ে দিলেই লোকজনকে মারধর করেন এবং পালিয়ে যান।
করসিনার সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি বসতে বলেন। তারপর বলেন, আমি বলি যে আমাকে ছেড়ে দাও আমি গোসল করবো, বাড়ি যাবো। এখানে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু বাবা-মা আমাকে ছেড়ে দেয় না। তারপর কথাবার্তা অসংলগ্ন হয়ে আসে।
করসিনার মা আলিমা খাতুন বলেন, শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা ছাড়া কোনো উপায় নেই। নিজের মেয়েকে এভাবে রাখতে খুব খারাপ লাগেও, কিছু করার নেই। সুযোগ পেলেই ও পালিয়ে যায়। কোথায় চলে যায় কোনো ঠিক নেই। টাকার অভাবে ভালো করে চিকিৎসা করাতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে চিকিৎসা করালে মেয়েটা ভালো হয়ে যাবে।
বাবা কলিম উদ্দিন বলেন, বিয়ের আগে মেয়েটি আমার ভালোই ছিল। বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই তার স্বামী নানা রকম নির্যাতন শুরু করে। স্বামীর নির্যাতনের কারণে মেয়ে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। আমরা তার স্বামীকে মেয়ের চিকিৎসার জন্য খরচও দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে কোনো কথা শোনেনি। পাগল বলে আমার মেয়েকে সে তালাক দিয়ে দেয়।
প্রতিবেশি সকিনা বেগম বলেন, স্বামীর অবহেলা এবং সন্তানদের ভালবাসা নেই বলে করসিনার অসুস্থতা দিনদিন বাড়ছে। চিকিৎসার সাথে পারিবারিক সহানুভূতি পেলে সে সুস্থ্য হয়ে উঠতে পারে। তার চিকিৎসার জন্য সহায়তা প্রয়োজন।
সাতমেরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান বলেন, তার চিকিৎসার জন্য তার নামে ভিজিডি কার্ড দেওয়া হয়। বিষয়টি জেলা প্রশাসককেও অবহিত করেছি। জেলা প্রশাসক চিকিৎসা সহায়তার জন্য একটা ব্যবস্থা নিবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।