<p>পাহাড়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের দারিদ্র পরিবারে জন্ম তার। তিন ভাই-বোন আর মা-বাবাকে নিয়ে সংসার স্মৃতি ত্রিপুরার। ছোটবেলা থেকেই সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা দেখেছেন তিনি। পড়ালেখা করানোর ইচ্ছা থাকলেও খরচ দিতে পারছিল না পরিবার। বাধ্য হয় প্রাথমিকের গণ্ডিতেই পড়াশোনা জন্য পরিবার ছেড়ে সুদূর কুষ্টিয়া মেহেরপুরের ভল্লবপুর খ্রিস্টান মিশনারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পাড়ি জমান স্মৃতি। </p> <p>হাল ছাড়েননি। সংগ্রাম করে বিনা বেতনে সেখানে থেকে মিশনারি স্কুল থেকে এসএসসিতে মানবিক বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন তিনি। পরে বাড়িতে এসে ভর্তি হন গুইমারা সরকারি কলেজে। অভাবের কারণে প্রাইভেট-কোচিং করতে পারেনি। এর পরও সদ্য প্রকাশিত এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে মানবিক বিভাগে জিপিএ-৫ পান তিনি। পড়াশোনা করে বড় কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। স্বপ্ন দেখাচ্ছেন পরিবারকেও। দারিদ্র্য ডিঙিয়ে সেই স্বপ্ন জয়ই প্রধান চ্যালেঞ্জ ওর।<br />  <br /> পরিবারের অভাব-অনটনের কারণে এই ফল অর্জন করতে গুইমারা উপজেলার বাইল্যাছড়ি  গ্রামের স্মৃতিকে নানা ত্যাগ আর কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। স্মৃতি ত্রিপুরা হতে চায় বিসিএস ক্যাডার। কিন্তু অভাব তাতে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই অবস্থায় পড়াশোনা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন স্মৃতি ও তার পরিবার। </p> <p>স্মৃতি ত্রিপুরার বাড়ি গুইমারা উপজেলার বাইল্যাছড়ি ১ নম্বর রাবার বাগান গ্রামে। তার পিতা রবিন্দ্র ত্রিপুরা একজন বৃদ্ধ দিনমজুর। মা স্বপ্না ত্রিপুরা গৃহিণী। কলেজ থেকে দূরবর্তী গ্রামে বসবাস হওয়ায় যাতায়তেও কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে তাকে।</p> <p>মা স্বপ্না ত্রিপুরা জানান, তার স্বামী একজন দিনমজুর। তিন ছেলে-মেয়ে তার। বড় ছেলে বিবাহিত, মেজো মেয়ে লেখাপড়া করে। স্মৃতি ছোট। ছোট বেলা থেকে সে মেধাবী ছিল। পরিবার তাকে সহযোগিতা করতে পারেনি। তবে এবার তিনি হাঁস-মোরগ ও গরু পালন করে কোনরকমে মেয়েকে সহযোগিতা করেছেন। এত কষ্টের মাঝেও সে এইচএসসিতে গুইমারা সরকারি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছেন। এই মেয়েটাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন মায়ের। ইউপি সদস্য একটা ভিজিডি কার্ড দিয়েছিলেন। এ দিয়ে কোনরকম সহযোগিতা হয়েছিল তার।</p> <p>তবে চেহারা এখনও মলিন স্মৃতির। জানান, এইচএসসিতে সফল হয়েছি। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে  কী করে ভর্তি হবো! আর কী করেইবা খরচ জুগিয়ে পড়াশোনা করবো। একজন বিসিএস ক্যাডার হওয়ার সাধ আছে। কিন্তু সেই সাধ্য তো আমার বা পরিবারের নেই। মনে হয় এ স্বপ্ন পূরণ হবে না। </p> <p>এদিকে, টিউশনিই ভরসা ছিল আশরাফুলের। চার বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছে। মা ছিলেন একমাত্র আশার আলো। তবে মায়ের আয়ে পড়াশোনার খরচ হচ্ছিল না। বাধ্য হয়ে টিউশনিতে নামেন তিনি। এভাবে নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই জোগাড় করে এইচএসসিতে গুইমারা সরকারি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছেন।</p> <p>আশরাফুলের বাড়ি মাটিরাংগা উপজেলার খেদাছড়া এলাকায়। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতেও বৃত্তি পেয়েছিলেন। তিনি খেদাছড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছিলেন।</p> <p>সংগ্রামী এই কিশোরের মা পেয়ারা বেগম বলেন, ছেলে কষ্ট করে এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করেছে। এতে খুশি হয়েছি ঠিকই, তবে দুশ্চিন্তা বেড়ে গেছে। সামনে পড়ার খরচ কিভাবে মিটবে, তা ভেবে পাচ্ছি না। তার বয়স যখন চার বছর তখন তার বাবা মারা যান। তিন ছেলে মেয়েকে আমি  এই পর্যায়ে আনতে অনেক কষ্ট করেছি। তবে তার কাকা, মামা, খালারা সহযেগিতা না করলে হয়তো কিছুই করতে পারতাম না।</p> <p>আশরাফুল বলেন, আমার এই সফলতার পেছনে রয়েছে সংগ্রাম। পিতাহীন পরিবারে আমরা তিন ভাই-বোন। বড়ভাই বর্তমানে সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে ১ম বর্ষে অধ্যয়নরত। ছোটবোন দশম শ্রেণিতে পড়ছে। বাবা যখন মারা যায়, তখন বড় ভাইয়ের বয়স ছয় বছর, আমার চার আর বোনের বয়স এক বছর ছিল। মা ছিলেন সাহসী। তিনি আমাদের  আগলে রেখে যুদ্ধ শুরু করেছেন। এসএসসিতেও খেদাছড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছি। এতে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। কলেজে পড়ার সময় দেড় বছর টিউশনি করেছি। </p> <p>গুইমারা কলেজের অধ্যক্ষ গুইমারা সরকারি কলেজ থেকে এবার দুজন শিক্ষার্থী এ প্লাস পেয়ে উর্ত্তীণ হয়েছে। যদিও আমাদের প্রত্যাশা আরো বেশি ছিল। তারা হলেন- স্মৃতি ত্রিপুরা, মানবিক এবং বিজ্ঞান বিভাগে মো. আশরাফুল ইসলাম। আশরাফুল ও স্মৃতি বিভিন্ন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে পড়াশোনা করেছে। আশরাফুল ছোট বেলায় বাবাকে হারায়, এতে তাদের পুরো পরিবার বেশ আর্থিক সংকটে পড়ে যায়। এই দুজন বিভিন্ন ইভেন্টে অংশগ্রহণ করে মেধার স্বাক্ষর রেখেছে। আমরা তাদের আরো সাফল্য কামনা করি।</p>