<p>বান্দরবানের লামা বনবিভাগের আওতাধীন তৈন রেঞ্জে শত কোটি টাকার কাট পাচারের অভিযোগ উঠেছে কাট-পাচারকরী ও সংশ্লিষ্ট সিনিয়র বন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। তাদের বাঁচাতে লোক দেখানো তদন্তের নামে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে তৈন রেঞ্জের রেঞ্জ-কর্মকর্তা জুলফিকার আলী খান ও তৈন সদর রেঞ্জ বিট কর্মকর্তা মেজাম্মেলকে।</p> <p>অনুসন্ধানে জানা যায়, বিগত সরকারের আমলে লামা বনবিভাগের অসংখ্য অনিয়মের রহস্যজনক এক কালো অধ্যায়ের বর্ণনা। বেশকিছু জোত পারমিটের নামের আড়ালে বছরের পর বছর চলছে অবৈধভাবে কাট পাচার। এসব কাট পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত বনবিভাগের কর্মকর্তারা। চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে কাট পাচার চলছে।</p> <p>স্থানীয় সূত্র জানায়, লামা বনবিভাগের আওতাধীন আলীকদম তৈন রেঞ্জের মোট রিজার্ভ পাঁচ হাজার একর বনাঞ্চল এখন অনেকটা গাছ শূন্য। পাচারকারী চক্রের মূল হোতা পার্শ্ববর্তী উপজেলা চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের কুতুবউদ্দিন সওদাগর বহু বছর ধরে এসব কাট পাচার করে আসছেন। লামা সদর রেঞ্জের রেঞ্জার আতা এলাহী ও সাময়িক বহিষ্কৃত তৈন রেঞ্জ কর্মকর্তা জুলফিকার আলি খানের সহযোগিতায় এবং লামা বনবিভাগের ডিএফও আরিফুল হক বেলালের মদদ থাকার কথা জানা গেছে। </p> <p>৮ এপ্রিল তৈন রেঞ্জের সৃজিত বাগানের গাছ চুরির ঘটনার তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত ডলুছড়ি রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা হাবিবুল্লাহকে আহ্বায়ক করে লামা সদর রেঞ্জার আতা এলাহী ও ডলুছড়ির সাবেক রেঞ্জার রেজাউল করিমকে বিষয়টির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটিকে। তদন্ত প্রতিবেদনে ১৮৭টি বন বিভাগের সৃজিত বাগানের গাছ চুরির অভিযোগ উঠে আসে তৈন রেঞ্জ কর্মকর্তা জুলফিকার আলি খানের বিরুদ্ধে। ডিসিসিএফ মাইনউদ্দিন খান ও চট্টগ্রান-সিএফ বিপুল কৃষ্ণ দাসের টিমের প্রতিবেদনে মোট চুরি হওয়া গাছের সংখ্যা ২১২টির মতো বলে দেখানো হয়। </p> <p>স্থানীয় কয়েকজন কাট ব্যবসায়ী বলেন, ৮০০-১০০০টি গাছের মোতা দেখা মিলবে। কিন্তু অধরা থেকে গেছে আরো লাখো গাছের মোতা যা দীর্ঘ বছর ধরে পাচার হয়ে আসছে।</p> <p>কাট ব্যবসায়ী ওমর ফরুক (বেছু) বলেন, লামা বনবিভাগের কাট চুরির অভিযুক্ত মূলহুতাদের বিরুদ্ধে এলিগেশনে সহযোগিতা করায় তার কলেজ পড়ুয়া ছেলে ও তার ওপর হামলা হয়েছিল। বেশ কয়েকবার হামলার শিকার হয়ে দীর্ঘদিন লামা সরকারি হাসপাতালেও ভর্তি ছিলেন। </p> <p>ডিএফও আরিফুল হক বেলালের সম্পৃক্ততা ও তার দায়ভার এড়ানোর জন্য চট্টগ্রামের ১৩টি ডিভিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান সিএফ বিপুল কৃষ্ণ দাসের দাপুটে অর্ডারে তদন্ত রফাদফা হয় তৈন রেঞ্জের জুলফিকার ও বিট কর্মকর্তা মোজাম্মেলকে সাময়িক বরখাস্ত করার মাধ্যমে। চুরি হওয়া কাট চকরিয়ার মগবাজার এলাকার কাউন্সিলর সালামের মিল থেকে জব্দ করেন ১০০ ঘনফুট। তদন্তে দেখানো হয়েছে ১৫০০ ঘনফুট। বাকী ৫০০ ঘনফুট কাট তদন্ত কর্মকর্তারা কয়েকজন জোত মালিক থেকে নেওয়া সেগুনের আগাছা দেখিয়ে সালাম কমিশনারের নামে বান্দরবান কোর্টে বন মামলা করা হয়। </p> <p>বন সংরক্ষক বিপুল কৃষ্ণ দাস চট্টগ্রাম বিভাগে দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকাকালীন সুফল প্রকল্প, বনায়ন প্রকল্প ও রাজস্ব খাতে কাগজে-কলমে কাজ ও হিসেব দেখিয়ে শত কোটি টাকা লোপাট করার অভিযোগ রয়েছে তার নামে। তৈন রেঞ্জের জুলফিকার আলীর সঙ্গে বন সংরক্ষক বিপুল কৃষ্ণ দাসের গভীর সম্পর্ক থাকাতে শত অপরাধ লামা বনবিভাগের ডিএফও আরিফুল হক বেলাল ও বহিষ্কৃত জুলফিকার আলী নির্দ্বিধায় সব অপকর্ম করতেন। বর্তমানে বিপুল কৃষ্ণ দাস পানিশমেন্ট পোস্টিং পেয়ে গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর বনবিভাগের ওয়্যারলেস ভবনে আছেন।</p> <p>লামার স্থানীয় (নাম জানাতে অনিচ্ছুক) এক কাট ব্যবসায়ী জানান, ডিএফও আরিফুল হক বেলালের অবৈধ কার্যকলাপ সমূহের যে সব ডকুমেন্ট তদন্ত করা প্রয়োজন। দৃশ্যমান প্রাকৃতিক সম্পদ লুট ও পরিবেশ ধ্বংস করেছে তার জন্য মাতামুহুরি ও তৈন রেঞ্জে হাতছানি দেওয়া কর্তনকৃত গাছের হাজার হাজার মোতাসমূহ। এ ছাড়া তিনি তার অবৈধ কাট পাচার ও অন্যান্য কার্যকলাপে যে সব কর্মচারীর প্রতি আস্থা রাখেন তাদের কাছ থেকে উচ্চ মানের উৎকোচ গ্রহণ করেন। তার কাজের সহায়তার জন্য কমিশন প্রদান করে থাকেন। একইভাবে তাদেরকে অন্যত্র বদলি হওয়া থেকে সুরক্ষা দিয়ে থাকেন তিনি। আর যাদেরকে তার অননুগত মনে করেন তাদের ওপর বদলির নিপীড়ন চালান।</p> <p>অনুসন্ধানে দেখা গেছে, লামা বনবিভাগের আওতাধীন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য জোতের পারমিট না থাকায় স্থানীয় কিছু অসাধু কাট পাচারকারী নাইক্ষ্যংছড়ির রিজার্ভ বন থেকে সেগুন কাট (মাদার ট্রি) চুরি করে কেটে একত্রে করার পর কৌশলে লামা বনবিভাগের ডিএফওয়ের নির্দেশে কাট গুলো জব্দ করে। আবার সেই কাটগুলো নাম-মাত্র নিলামে তুলে চকরিয়ার কাট চোরা-কারবারী কুতুবউদ্দিন সওদাগরের মাধ্যমে টিপি করে চালান করে দেয় চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে।</p> <p>কুতুবউদ্দিন সওদাগর নিজের নামের কোনো জোত পারমিট নেন না। তার নিজস্ব লোক দিয়ে জোত পারমিট করান বিভিন্ন নামে। লামার খোকন, কাট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সেলিম, আলীকদমে সৌকত, আহমদ, আমিন আরো বেশ কিছু লোকজন দিয়ে এসব জোত পারমিট করান কুতুবউদ্দিন সওদাগর, এই জোত পারমিটের আড়ালে চলে দীর্ঘ ২৫ বছর কাট পাচারের রমরমা ব্যবসা, কৌশলে নিজেকে আড়াল রেখে লামা বনবিভাগের কর্মকর্তাদের মোটা অঙ্কের আর্থিক সুবিধা দিয়ে এসব কর্মকাণ্ড চলছে নিয়মিতভাবে বছের পর বছর।</p> <p>পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও ইউএনডিপি-এর যৌথ অর্থায়নের ইউএসএআইডি-এর তত্ত্বাবধানে সেইভ ফরেস্ট- কনজারভ ওয়াটার শীর্ষক (এসআইডি- সিএইচটি) একটি প্রকল্প প্রদান করা হয়। যাতে বন সংরক্ষণ বন্যপ্রাণী শিকার প্রতিরোধ বিষয়ক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এই প্রকল্পের অধীনে মাতামুহুরি ও তৈন রিজার্ভে খরা মৌসুমে পানি সংরক্ষণের জন্য এবং বন্যপ্রাণীর অবাধ চলাফেরার উপযোগী পরিবেশ তৈরির জন্য শত কোটির অধিক বরাদ্দ দেওয়া হয়। </p> <p>প্রকল্পটির বাস্তবায়নের নামে ভুয়া বিল-ভাউচার দিয়ে বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে বাস্তবায়ন হয়েছে মর্মে মিথ্যা প্রাপ্তিস্বীকার দিয়ে উক্ত বরাদ্দকৃত অর্থ লোপাট করে নেন চক্রের সদস্যরা। যেখানে সরকার ও বিশ্বসংস্থা পরিবেশ রক্ষায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সেখানে সাবেক ডিএফও আরিফুল হক বেলাল বন উজাড় ও পরিবেশ ধ্বংসের মাধ্যমে অর্থ লোপাটে মগ্ন।</p> <p>লামা বনবিভাগের তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিএফও আরিফুল হক বেলাল ২০২১ সালে লামা বনবিভাগে আসার পর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অবৈধভাবে অর্জিত অর্থে ঢাকা ও খুলনাসহ বিভিন্ন জেলা শহরে শত কোটি টাকার মূল্যমানের অ্যাপার্টমেন্ট নিজের স্ত্রী-সন্তান ও নিকটতম আত্মীয়ের নাম-বেনামে জমি ক্রয় স্থাপনা নির্মাণ ও ব্যাংক ব্যালেন্স নান কৌশলে অর্থ গুচ্ছিত করণের ব্যবস্থা করে রাখেন। যা তৎকালীন প্রধান বন-সংরক্ষক উসমান গনিকেও হার মানাবেন।</p> <p>বেলালের নেপথ্যে থাকাকালীন লামা বনবিভাগের সদর রেঞ্জ কর্মকর্তা আতা এলাহীও গড়েছে সম্পদের পাহাড়। জোত পারমিটে অনুমোদন দেওয়া কাটের ডিপু থেকে অবৈধভাবে লাখো ঘনফুট কাট পাচার হয়েছে লামা সদর রেঞ্জার আতা এলাহীর সহযোগিতায় তথ্যসূত্রে খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া লাইনঝিরি গেইট ও ইয়াংছা গেইট দুইটি দিয়ে অনায়াসে পাচার হচ্ছে প্রতিদিন ২০-৩০  ট্রাক সেগুনসহ (মাদার ট্রি) বিভিন্ন জাতের সংরক্ষিত রিজার্ভের বন থেকে কর্তন করা কাটের (আন্ডার টেবিল মানি) মাধ্যমে।</p> <p>লামা বনবিভাগের সদ্য বদলি হয়ে যাওয়া এক কর্মকর্তা জানান, তিনি দীর্ঘ বছর লামা বনবিভাগে চাকরিরত থাকার কারণে বনবিভাগের লুটপাট ও সংরক্ষিত রিজার্ভ ধ্বংসের প্রতিবাদ করায় তাকে তাৎক্ষণিকভাবে বদলি করা হয়। কোনো ধরনের কারণ দর্শানো নোটিশ ছাড়াই বদলি করা হয়।</p> <p>বেলাল বদলির পরবর্তীতে লামা বনবিভাগের সদ্য নিযুক্ত ডিএফও মোস্তাফিজুর রহমান ও আগের ডিএফও-এর দেখানো পথে হাঁটছেন বলে স্থানীয় অনেকেই মন্তব্য করেছেন। জাতীয় তথ্য-অধিকার আইন মোতাবেক জোতের বিষয়ে তথ্য চাইলে সদর রেঞ্জার আতা এলাহী ও বর্তমান লামা বনবিভাগে নিয়োজিত ডিএফও তথ্য গোপন করে রাখেন।</p>