<p>সিনেমাপ্রেমীদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষনীয় যে জনরা, সেটি হরর ফিকশন। মানুষ রোমান্টিক, ড্রামা ও থ্রিলারের পাশাপাশি হরর ফিকশনের প্রতিও প্রচণ্ড কৌতুহলী। পৃথিবীজুড়ে হরর ফিকশনের বেশ চাহিদা। পাশের দেশের বলিউডেও এই জনরার একের পর এক ছবি সফল হচ্ছে। ‘স্ত্রী ২’ ও ‘ভুল ভুলাইয়া ৩’ যার সর্বশেষ উদাহরণ। আমাদের দেশে এই জনরার কাজ হাতে গোনা। এই যেমন গত কয়েক বছরে ওয়েবে এসেছে ‘পেট কাটা ষ’, ‘আধুনিক বাংলা হোটেল’ কিংবা বড় পর্দায় ‘স্বপ্নের ঘর’, ‘জ্বীন’। বাংলায় হরর ফিকশন কম হয় কেন? এ নিয়ে বলেছেন এই জনরার তিন নির্মাতা নুহাশ হুমায়ূন, তানিম রহমান অংশু ও কাজী আসাদ। শুনেছেন হৃদয় সাহা।</p> <p><strong>হরর ফিকশনে গল্প অনেক শক্তিশালী হতে হয়</strong></p> <p>নুহাশ হুমায়ূন [‘পেট কাটা ষ’ ও ‘মশারি’ নির্মাতা]</p> <p>আমি যখন ‘পেট কাটা ষ’ ও ‘মশারি’ করি, এর আগে আমাদের দেশে হরর বা ভৌতিক গল্প সেভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। আমার ভয়টা ছিল, দর্শক কিভাবে গ্রহণ করে কিংবা এর প্রচারণাটা কিভাবে হবে। এর বাইরে অন্য কোনো চ্যালেঞ্জ ছিল না। ‘পেট কাটা ষ’ মুক্তির পর বাংলাদেশ তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গের দর্শকও খুব ভালোভাবে গ্রহণ করেছে, আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃতি পেয়েছে সিরিজটি। তারপর সংখ্যায় খুব বেশি না হলেও ওটিটিতে বিভিন্ন হরর ফিকশন হয়েছে। এই জনরায় গল্পের দিক থেকে অনেক শক্তিশালী থাকতে হয়, দর্শক যেন গল্পের মূল নির্যাসটা অনুভব করতে পারে। উদাহরণ দিয়ে বলি, ‘লোকে বলে’তে (‘পেট কাটা ষ’-এর একটি পর্ব) একেবারে শেষ দৃশ্যে টাক মাথায় একটি বাচ্চা ছেলে শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে—এটাই অনেকের কাছে সবচেয়ে ভৌতিক মনে হয়েছে। এই দৃশ্য নিয়ে বেশসংখ্যক দর্শক আমাকে তাদের এই অভিজ্ঞতার কথা বলেছে।</p> <p>অথচ এখানে কোনো ভিএফএক্সের কাজ নেই, কোনো ভৌতিক সাজসজ্জা নেই। কিন্তু দর্শক ভয় পেয়েছে, কারণ আগে ঘটে যাওয়া গল্প দর্শক অনুভব করতে পেরেছে। আমার বাবার [হুমায়ূন আহমেদ] নির্মাণে ‘অদেখা ভুবন’ [১৯৯৯] নামে যে টিভি সিরিজ ছিল, সেখানেও কারিগরি বা বাজেটের দিক থেকে ভালো কিছু ছিল না, কিন্তু গল্পের দিক থেকে বেশ শক্তিশালী। সিরিজের ‘মদিনা’ নাটকটির কথা বিশেষভাবে বলব।</p> <p>ভিএফএক্স বা উন্নত কারিগরি দিক প্রয়োজন এটা ঠিক, তবে আমরা যদি দর্শককে মানসিকভাবে ভয় দেখাতে না পারি, তাহলে উন্নত ভিএফএক্স দিয়ে ভয় ধরানো যাবে না। লক্ষ করলে দেখবেন, হরর গল্পে সমাজের কিছু অসংগতি দেখানো হয়, অসংগতিগুলোর সঙ্গেও দর্শকের সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। তাহলেই সেই গল্পের সঙ্গে দর্শক একাত্ম হবে। যেমন—‘মিষ্টি কিছু’তে (‘পেট কাটা ষ’-এর একটি পর্ব) সেটা দেখানো হয়েছিল। পাশাপাশি এও বলব, এখনকার দর্শককে মুগ্ধ করতে হলে কারিগরি দিকও বেশ উন্নতমানের হতে হবে।</p> <p>সেটা হরর ফিকশন বা থ্রিলার যেটাই হোক। কারণ দর্শক আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফরমের দারুণ দারুণ সিরিজ/সিনেমা দেখছে, বাংলাদেশেরগুলোও দেখছে। তাই তারা তুলনা করবে, এটাই স্বাভাবিক। বাংলায় বিভিন্ন প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন উপকথা থেকেও গল্পের রসদ নেওয়া যায়, এ ক্ষেত্রে গবেষণার  প্রয়োজন। সামনে ‘পেট কাটা ষ’-র দ্বিতীয় কিস্তি আসছে, চেষ্টা করছি যেন প্রথম কিস্তির চেয়েও বৈচিত্র্যময় হয়।</p> <p><strong>ভয়টা পুরোই মনস্তাত্ত্বিক</strong></p> <p>তানিম রহমান অংশু [‘আলো’ ও ‘স্বপ্নের ঘর’ নির্মাতা]</p> <p>বাংলাদেশে হরর ফিকশন আগে কখনোই তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। সাম্প্রতিককালে দেখছি এই জনরার সিনেমা, সিরিজ জনপ্রিয় হচ্ছে, আলোচনা হচ্ছে—এটা অবশ্যই ভালো খবর। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলি, ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে গাজী টিভিতে একটা হরর সিরিজ বানাই—‘দ্য ফাইট নাইট’। তখনো দর্শক এই জনরা খুব একটা দেখত না। তবে ধারণা পাল্টে যায় যখন ‘আলো’ নির্মাণ করি। ঈদের অজস্র কনটেন্টের ভিড়ে দর্শক নাটকটি বেশ পছন্দ করে। বুঝতে পারি, দর্শক নতুন কিছুর স্বাদ নিতে সব সময়ই আগ্রহী। এরপর তো চলচ্চিত্র ‘স্বপ্নের ঘর’ [২০১৮] নির্মাণ করি। হরর ফিকশন নির্মাণের সীমাবদ্ধতা একটাই, আমাদের চর্চার অভাব। এ ধরনের কাজ খুবই কম হয়, যার কারণে এই কাজের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত তাঁরা ঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারেন না। অথচ হরর ফিকশন তখনই ভালো হবে, যখন পুরো টিম একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করবে।</p> <p>আমাদের প্রস্থেটিক মেকআপ নিয়ে তেমন ধারণা নেই, অথচ ভূতের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বাজেট সমস্যা তো আছেই। তবে বিশ্বব্যাপী ভূতের সিনেমাগুলোর ধরন পাল্টেছে। এখন ভূতের আগমনের চেয়ে তার আগের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে দর্শক বেশি আগ্রহী থাকে, এখন ভয়টা পুরোই মনস্তাত্ত্বিক। আমাদের এমনিতেই পাণ্ডুলিপি লেখায় ঘাটতি আছে, হরর ফিকশনের ক্ষেত্রে সেই ঘাটতি আরো বেশি। এখন যে হরর ফিকশনগুলো হচ্ছে, তা অবশ্যই বিশ্বমানের নয়। আমাদের সেই সামর্থ্য এখনো গড়ে ওঠেনি। নিয়মিত এই জনরা নিয়ে  চর্চা হলে সীমাবদ্ধতাগুলো কেটে যাবে, আমরাও বুঝতে পারব ঠিক কোথায় কোথায় ঘাটতি রয়েছে।<br />  <br /> <strong>নিয়মিত চর্চা হলে সীমাবদ্ধতা কেটে যাবে</strong></p> <p>কাজী আসাদ [‘আধুনিক বাংলা হোটেল’ নির্মাতা]</p> <p>বাংলায় তো বটেই, ভারতীয় উপমহাদেশে হরর জনরা নিয়ে খুব বেশি কাজ হয়নি। ২০১০ সালের আগে বাংলাদেশে তেমন থ্রিলার বানানো হয়নি। গত এক যুগে এই জনরায় কাজ করতে করতে আমরা অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছি। কিন্তু হরর জনরা নিয়ে তেমন কাজ করা হয়ে ওঠেনি, যার কারণে আমাদের চর্চাটা সেভাবে হয়নি। নিয়মিত চর্চার সুযোগ হলে আমরা ধীরে ধীরে উন্নতি করতে পারতাম। কারিগরি দিক থেকে আমরা উন্নতি করেছি সত্য, তবে এই জনরায় আমাদের কারিগরি কুশলীদের অভিজ্ঞতা নেই, প্রস্থেটিক মেকআপ নিয়েও ধারণা কম। সেখানেও আমি বলব চর্চার কথা। এখন যেমন কিছু হরর ফিকশন হচ্ছে, আমরা দেখে দেখে বুঝতে পারি কোথায় ঘাটতি রয়েছে, পরেরবার সেটা কাটিয়ে উঠব। বাজেট, রিসোর্সের সীমাবদ্ধতা তো আমাদের আছেই। এই জনরায় আরো পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন, যাঁরা প্রযোজক তাঁদের আগ্রহ থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমি ভাগ্যবান, ‘আধুনিক বাংলা হোটেল’ করতে গিয়ে ভালো পৃষ্ঠপোষক পেয়েছি।</p>