বিশ্বজুড়ে লুঙ্গির জ্ঞাতিগোষ্ঠী আর ব্যবহারকারীর সংখ্যাটি জানা থাকলে হয়তো কবি আসাদ চৌধুরী আফসোস করে লিখতেন না, ‘লুঙ্গি পরার পুরুষ কই?’ তাঁর ‘তবক দেওয়া পান’ কাব্যগ্রন্থের ‘ফুল ফুটেছে থোকা থোকা’ কবিতার লাইনগুলো ছিল এ রকম : ‘ফুল ফুটেছে থোকা থোকা তাঁতির পুতে বড়ই বোকা/ জোলার ছাওয়াল জোলারে লুঙ্গি গামছা ঝোলারে/ পান খাওয়ালি বিনা চুনে তবু তাঁতি লুঙ্গি বোনে, তাঁতির পুত গো করি মানা লুঙ্গি থুইয়া শাড়ি বানা/ দেশ ভইরাছে মাইয়া লোকে, শাড়ি বানা থাকবি সুখে/ সোনার দেশের মানুষরে কই, লুঙ্গি পরার পুরুষ কই?’
আরো পড়ুন
দক্ষিণ আমেরিকায় সমুদ্রবন্দর বানাল চীন
লুঙ্গির মতো এত রিলাক্সড পোশাক বিশ্বে দ্বিতীয়টি রয়েছে কি না তা বিশেষজ্ঞদেরও জানা নেই। এই সরল পোশাকের রয়েছে নানা গুণ, রয়েছে বহুমুখী ব্যবহার। ভারতীয় এক লোকগীতিতে লুঙ্গির প্রশস্তি গাওয়া হয়েছে এভাবে—‘যখন তুমি সাদা রঙের হও/ তখন তুমি সাধারণ পোশাক/ রংটা উজ্জ্বল হলেই তোমার উপযুক্ত জায়গা উৎসবে/ মাথায় বাঁধলেই তুমি পাগড়ি বনে যাও/ দাপুটে শীতে তুমিই তো আমার কম্বল/ বাতাস থাকলেই তুমি আমার নৌকার পাল/ গোসলের পর টাওয়েল/ গাছ থেকে পড়ন্ত আম ধরতে তুমিই আমার ফাঁদ/ কাছাড় মেরে ক্রিকেট খেলতেও আমার সমস্যা হয় না/ তুমি তো বিছানারই বিকল্প অথবা প্রয়োজনে শাল/ মাঝেমধ্যে হয়ে যাও থলে/ তোমার গুণে কার না মন গলে।’
দুই মিটার দৈর্ঘ্য নিয়েই সিলিন্ডার আকৃতির এ পরিধানটির নিজস্ব ভুবন।
আরো পড়ুন
পটিয়ায় চাচার হাতে ভাতিজা খুন
চেক হোক আর একরঙা হোক, একটি জবরদস্ত ফ্যাশন হওয়ার যাবতীয় সম্ভাবনা যে লুঙ্গির মধ্যে লুকিয়ে আছে, তা এখন ফ্যাশন ডিজাইনাররাও মানছেন। ওয়েস্টার্ন একাধিক ফ্যাশন ডিজাইনার বলেছেন, প্রাচ্যের পোশাক লুঙ্গির উপযোগিতা ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হলে বিশ্বে এই সরল পোশাকটির আবেদন অনেক গুণ বেড়ে যাবে; এমনকি লুঙ্গি বিপ্লবও হয়ে যেতে পারে। তামিল তারকা বিক্রম তাঁর মুভি ‘মাজা’তে লুঙ্গি পরে অভিনয় করেছেন। প্রসাদ বিধপা তো লুঙ্গিতেই সবচেয়ে বেশি স্বস্তি পান।
লুঙ্গির প্রশস্তি গেয়ে এই ফ্যাশনগুরু বলেছেন, ‘এটি একটি দুর্দান্ত ফ্যাশন স্টেটমেন্ট। লুঙ্গি হয়ে যেতে পারে দোপাট্টা অথবা পরিধানের একটি সক্রিয় অংশ। ডেনিম জিন্সের ওপর আমি স্বচ্ছন্দে লুঙ্গি পরি। সাবকন্টিনেন্টের আবহাওয়ার দিক থেকে একমাত্র লুঙ্গিই সবচেয়ে উপযোগী পোশাক।
’
আরো পড়ুন
রোনালদোর জোড়া গোলে শেষ আটে পর্তুগাল
লুঙ্গি অতি সাধারণ ও সরল পোশাক। এক বা দুই গিট্টু দিয়েই তা পরা যায়। বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মায়ানমারে লুঙ্গি অতিসাধারণ দৃশ্য। মায়ানমারে এটি জাতীয় পোশাক হিসেবেও স্বীকৃত। তবে লুঙ্গিকে তারা বলে লোঙ্গাই।
বিশ্বের নানা দেশে স্থানীয় ঐতিহ্য অনুসারে পুরুষ অথবা নারী-পুরুষ লুঙ্গি পরে। তবে বিশ্বের সব জায়গায় লুঙ্গি পরার আলাদা স্টাইল রয়েছে। লুঙ্গির ধরন ও ব্যাবহারিক দিকটি বিবেচনায় আনলে যেকোনো ফ্যাশনসচেতন ব্যক্তি এটা বলতে বাধ্য হবে, পশ্চিমা বিশ্ব অনেকটা লুঙ্গির আদলে কিল্ট নামের পোশাককে ফ্যাশনদুরস্ত বলে গর্ববোধ করে; সাউথ এশিয়ানরা তার চেয়েও ডাহা আধুনিক পোশাক বহু আগে থেকে পরিধান করছে। কারণ লুঙ্গি কটন বা সিল্কের এমন একটি টিউব, যাতে কোনো জিপার লাগে না। এটা গিট্টু দিয়ে কোমর থেকে নিমেষেই পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঢেকে দেওয়া যায়। এটা যেমন হাইজেনিক তেমনি দেহের উপযোগী। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে তাকালে লুঙ্গিকে যেকোনো বিবেচনায় একটি স্বাস্থ্যসম্মত অ্যাংকল-লেংথ স্কার্ট বলা যায়। বড় সাদাসিধা পোশাক, যার নেই কোনো ফাংশনাল চ্যালেঞ্জ।
আরো পড়ুন
উপদেষ্টা নির্বাচনে আঞ্চলিকতা নয়, দেশের কথা ভাবা হয়েছে
ফ্যাশনের দৃষ্টিতে তাকানো হয়নি বলেই লুঙ্গিকে এত দিন ফ্যাশনসচেতন পোশাক বলা হয়নি। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মানুষ অনায়াসে এই সর্বজনীন পোশাকে অতি স্বল্প সময়ে অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারে।
লুঙ্গি পরলে মানুষ কি মানুষের পর্যায় থেকে নিচে নেমে যায়? সামাজিক বলয়ে জিন্সের টাইট প্যান্ট না পরলে কি ব্যক্তির সেন্স অব পাওয়ার কমে যায়? প্রিন্স চার্লস ও সিন কনারি কিল্ট পরিধান করে অথবা ডেভিড বেকহাম ও ডেভিড বোয়ি সারং পরিধানের পরও যদি ব্যক্তিত্ব না হারান, তাহলে বাংলাদেশিরা লুঙ্গি পরলে কেন আত্মমর্যাদা হারাবে?
আরো পড়ুন
বিদ্যমান সভ্যতা আমাদের ব্যর্থ করেছে, নতুন বিশ্ব গড়তে হবে
সম্প্রতি লন্ডনের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট এক্সিবিশনে ব্রিটেনের পুরুষ সেলিব্রিটিরা নৈতিক, সামাজিক ও জেন্ডার কোডকে চ্যালেঞ্জ জানানোর পাশাপাশি পৌরুষত্বের ধারণাকে পুনঃ সংজ্ঞায়িত করার লক্ষ্যে অবলীলায় স্কার্ট পরে ক্যাটওয়াক করেছেন। আমাদের সমাজে পুরুষদের অতটা সাহসী না হলেও চলবে। শুধু মানসিকতা পাল্টালেই ঐতিহ্যবাহী লুঙ্গির জাত পুনরুদ্ধার হবে।
হালের পশ্চিমা ফ্যাশন ডিজাইনাররা এখন প্রাচীন কালচার থেকেই অনুপ্রেরণা খুঁজে নিতে চাইছেন। তাঁরা স্কটিশ কিল্টের পাশাপাশি এশিয়া, আফ্রিকার প্রাচীন পোশাক কালচারকে আধুনিকতার পরশ দিয়ে আপন করে নিতে চাইছেন। তাঁরা এটা মনে করছেন, বিশ্বজনীন কালচারগুলো নতুন রূপে আয়ত্ত করে নেওয়ার অর্থ হচ্ছে নিজের বর্তমান সমাজ-সভ্যতা যে গতিশীল ও প্রাণবন্ত, তা নতুন করে প্রমাণ করা। ঠিক এ কারণে এশিয়া, আফ্রিকা আর এশিয়ার সারং, ধুতি, লুঙ্গি, কাফটান, কামিজ, চায়নিজ জোব্বা আর জাপানিজ কিমোনো পশ্চিমি বিশ্বের ফ্যাশন ক্যাপিটালগুলোর জাঁকালো ক্যাটওয়াকে ক্রমবর্ধমান হারে জায়গা করে নিচ্ছে।
আরো পড়ুন
ঝিকরগাছায় পিয়াল হত্যা মামলার আসামি আমিরুল আটক
৭৮ বছর বয়সী সিরাজগঞ্জের সামান আলী সরকারের কথা মনে আছে? ২০২২ সালের ৩ আগস্ট সামান আলী মিরপুর স্টার সিনেপ্লেক্সে যান ‘পরাণ’ ছবি দেখতে। টিকিট পাননি, পরনে লুঙ্গি ছিল বলে। ঘটনাটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘লুঙ্গি বিপ্লবে’র জন্ম দেয়। সমালোচিত হয় স্টার সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ। অবশেষে ২৪ ঘণ্টার মাথায় ৪ আগস্ট সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ ও ‘পরাণ’ টিম খুঁজে নেয় সামান আলীকে। ব্যবস্থা নেয় তাঁকে লুঙ্গি পরে ছবি দেখানোর। ইতিহাস বলছে, বঙ্গবন্ধু বাড়িতে লুঙ্গি পরতেন, ভাসানী পরতেন সর্বত্র। এই পোশাকটির প্রেমে পড়েছিলেন সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাও। তিনি লুঙ্গি পরতেন, ফিরে যাওয়ার সময় বাংলাদেশ থেকে লুঙ্গি নিয়ে গিয়েছিলেন। লুঙ্গি পরে রিকশায় চালকের আসনে বসে তিনি ফটোসেশনও করেছিলেন।