ইসরায়েলি কম্পানি এনএসওর তৈরি করা স্পাইওয়্যার পেগাসাস দিয়ে ফোনে আড়ি পাতা হয়েছে বা হচ্ছে—এই তথ্য জানার পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ তাঁর মোবাইল ফোন ও ফোন নম্বর পাল্টে ফেলেছেন। পেগাসাসের হানা এবং সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনার জন্য ম্যাখোঁ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকও ডাকেন বলে রয়টার্স জানিয়েছে।
বিশ্বজুড়ে এ ধরনের সতর্কতা অনেকের। প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত বৃহস্পতিবার বলেছেন, ‘একটা ফোন রয়েছে, কিন্তু সেটা ট্যাপ করা।
কারো সঙ্গে কথা বলা যাচ্ছে না। জগৎ এভাবে চলতে পারে না। সুপার ইমার্জেন্সির থেকেও ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’ পাকিস্তান এই বিষয়ে জাতিসংঘের তদন্ত চেয়েছে।
এ ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে ইসরায়েল সরকার পেগাসাস স্পাইওয়্যার তদন্তের জন্য কমিশন গঠন করেছে। গত বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের পার্লামেন্টের ফরেন অ্যাফেয়ার্স ও ডিফেন্স কমিটির প্রধান এই ঘোষণা দেন।
আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলের একজন আইনপ্রণেতা র্যাম বেন বারাক, যিনি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাবেক উপপ্রধান, তিনি বলেছেন, ‘অভিযোগ তদন্ত করে দেখার জন্য একটি রিভিউ কমিশন গঠন করা হয়েছে। তদন্ত শেষ হওয়ার পর আমরা দেখব ওই স্পাইওয়্যারের বিষয়টির কোনো সংশোধনের প্রয়োজন আছে কি না?’
এদিকে এনএসওর প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও শালেভ হুলিও আর্মি রেডিওকে বলেছেন, ‘ঘটনার তদন্ত হলে তাঁরা খুশি হবেন।
তাহলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। এনএসওর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসরায়েলের পুরো সাইবার ইন্ডাস্ট্রির গায়ে কলঙ্ক লাগানো।’
মরক্কোর একটি গোয়েন্দা সংস্থা পেগাসাস স্পাইওয়্যার দিয়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের ফোনে আড়ি পাতার অভিযোগ খণ্ডাতে ওই তথ্য প্রকাশের জন্য প্যারিসভিত্তিক অলাভজনক সংবাদ সংস্থা ফরবিডেন স্টোরিজ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মরক্কোর একজন ফারাসি আইনজীবী এমন আভাস দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, পেগাসাসের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে ফরবিডেন স্টোরিজ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের অনুসন্ধানের ফল থেকে।
২০১৯ সালে এই তদন্ত শুরু হয়। এই দুই সংগঠন যাদের স্মার্টফোনে আড়ি পাতা হয়েছিল, তাদের তালিকা ব্রিটেনের গার্ডিয়ান, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট, ভারতের ‘দ্য ওয়্যার’সহ বিশ্বের ১০টি দেশের মোট ১৭টি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে শেয়ার করে। তারা সবাই মিলে এই অনুসন্ধানের নাম দিয়েছে ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’, যাতে ৮০ জনেরও বেশি সাংবাদিক যুক্ত ছিলেন। তাদের দাবি, পেগাসাস নামের স্পাইওয়্যার অ্যাপ যা সাধারণত জঙ্গি কার্যকলাপের ওপর নজরদারি চালাতে বা সামরিক গোয়েন্দাদের কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে, সেই অ্যাপ দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ওপর গোপন নজরদারি চলছিল। এর শিকার হয়েছেন মানবাধিকারকর্মী, রাজনীতিক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সদস্যরা। বিশ্বজুড়ে ৫০ হাজার ফোন হ্যাক করে সেগুলোতে নজরদারি চালানোর বিষয়টি ওই অনুসন্ধানে উঠে আসে। দ্য গার্ডিয়ান জানায়, যেসব ফোনে আড়ি পাতা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ফ্রান্সের ম্যাখোঁ ও পাকিস্তানের ইমরান খান ছাড়াও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসাও রয়েছেন। এ ছাড়া এতে আছে ৩৪টি দেশে কূটনীতিক, সামরিক প্রধান ও সিনিয়র রাজনীতিকদের মোবাইল ফোন নম্বর।
২০১৯ সালের অক্টোবরে ফেসবুকের মালিকানাধীন সংস্থা হোয়াটসঅ্যাপ জানায়, চারটি মহাদেশের প্রায় এক হাজার ৪০০ জনের মোবাইল পেগাসাসের মাধ্যমে হ্যাক করা হয়েছে। এর আগে পেগাসাস বিষয়টি আলোচনায় আসে ২০১৮ সালে। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে ইন্টারনেট ওয়াচডগ টরন্টোভিত্তিক ‘সিটিজেন ল্যাব’ প্রকাশ করে যে ইসরায়েলি কম্পানি এনএসও-এর স্পাইওয়্যার পেগাসাস ৪৫টি দেশে ব্যবহার হচ্ছে। দেশগুলো হচ্ছে আলজেরিয়া. বাহরাইন, বাংলাদেশ, ব্রাজিল, কানাডা, আইভরিকোস্ট, মিসর, ফ্রান্স, গ্রিস, ভারত, ইরাক, ইসরায়েল, জর্দান, কাজাখস্তান, কেনিয়া, কুয়েত, কিরগিজস্তান, লাটভিয়া, লেবানন, লিবিয়া, ম্যাক্সিকো, মরক্কো, নেদারল্যান্ডস, ওমান, পাকিস্তান, প্যালেস্টাইন, পোল্যান্ড, কাতার, রুয়ান্ডা, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইজারল্যান্ড, তাজিকিস্তান, থাইল্যান্ড, টোগো, তিউনিশিয়া তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, উগান্ডা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, উজবেকিস্তান, ইয়েমেন ও জাম্বিয়া। ওই বছর ৩০ আগস্ট তেলআবিব আদালতে পাঁচজন মেক্সিকান সাংবাদিক এবং মানবাধিকারকর্মী এই মর্মে মামলা করে যে এনএসও গ্রুপের সফটওয়্যারের মাধ্যমে তারা গোয়েন্দা নজরদারির শিকার। মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও ওই বছর আগস্টে ইসরায়েলি ওই কম্পানির বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনে যে ইসরায়েলি কম্পানির সফটওয়্যার তাদের একজন কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবহার হচ্ছে। সে সময়ও এনএসও বলে, তাদের ওই সফটওয়্যার অপরাধ ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে তদন্তের কাজে ব্যবহার হয়। এর অপব্যবহারের অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হবে।
এদিকে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য, ‘পেগাসাস’ ব্যবহার করে যাঁদের ওপর নজরদারি বা চেষ্টা হয়েছে তাঁদের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) রাজকুমারী লতিফা আল মাখতুমও ছিলেন। তিনি দেশটির শাসক শেখ মোহাম্মেদ বিন রশিদ আল মাখতুমের মেয়ে। নিজ দেশ ও পরিবার ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টার সময় তাঁর ওপর নজরদারি হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। পরিবারের ‘নির্যাতনের’ মুখে ২০১৮ সালের মার্চে নৌকায় করে সাগর পাড়ি দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন লতিফা। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হাতে তিনি ধরা পড়ে যান। তাঁকে আটক করে নিয়ে যান আমিরাতের সেনারা। ওই ঘটনা বিশ্বে আলোচনার জন্ম দেয়।
‘পেগাসাস’ ব্যবহার করে সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের ওপর নজরদারি চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছে সৌদি আরব। এ অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে উল্লেখ করেছে দেশটি। তবে এর আগে পেগাসাস ব্যবহার করে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগির ফোনে আড়ি পাতার বিষয়টি ফরেনসিক পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়। ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর জামাল খাসোগিকে হত্যা করা হয় তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি আরবের কনস্যুলেটের ভেতরে। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের বিরুদ্ধে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে ২০১৮ সালের তালিকায় পেগাসাস ব্যবহারকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নাম থাকলেও কোনো গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশির ফোনে এই স্পাইওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছে কি না, সে তথ্য গতকাল পর্যন্ত কোনো সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করেনি।