আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ আল মামুন বিবিসিকে জানান, ৫ আগস্টের পর এক মাসের মতো পুলিশের অনুপস্থিতি অপরাধ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। এখন সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে টহল এবং পুলিশিং চলছে। ‘নিয়মিত পুলিশিংটা আমি আসার আগ পর্যন্ত বন্ধই ছিল। সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখে আমি জয়েন করার পর আস্তে আস্তে পুলিশিংটা দৃশ্যমান হয়েছে। এখন আমরা ফুল ফিল্ডওয়ার্কে আছি। আগে চারটা টহল বের হতো, এখন যানবাহন সংকটে দুইটা টহল বের হয়। একটা ভাড়া নেই, আরেকটা সরকারি গাড়ি আছে। থানার গাড়ি তো পুড়ায় দিছে অনেকগুলো,’ বলেন আল মামুন।
রাজধানী ঢাকার মধ্যে মোহাম্মদপুর এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির বিষয়টি সবচেয়ে আলোচিত হয়েছে। সেখানে বিহারি ক্যাম্পে খুনোখুনি, প্রকাশ্যে ছিনতাই, ডাকাতি, সশস্ত্র মহড়ার ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি উন্নতির জন্য মোহাম্মদপুরে বিশেষ অভিযান হয়েছে। জেনেভা ক্যাম্পসহ বিভিন্ন স্থান থেকে শতাধিক সন্দেহভাজনক আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে।
কিন্তু এখনো মানুষের আতঙ্ক কাটেনি বলেই জানান এলাকার একজন বাসিন্দা জেসমিন। তার ভাষায়, ‘এখন একটু পরিস্থিতি ভয়াবহ। কেমন যেন একটা আতঙ্কে আছি আমরা। আগে রাতে বারোটা একটায় মানুষ যাইতে পারছে বাইরে। এখন তো মানুষ ভয়ের চোটে বাইরায় না।’
স্কুলে সন্তানকে নিয়মিত আনা-নেওয়া করা একজন অভিভাবক বলেন, ‘আমি ২০১০ সালের পর থেকে ঢাকায় আছি। আমরা কখনো আমাদের এলাকার মধ্যে এমন নিউজ পাইনি। গণ্ডগোলের পর থেকে যখন এ রকম দেখতেছি, তখন আতঙ্ক তো থাকবেই ‘
‘চলন্ত রিকশা থেকে বয়স্ক একজনের কানের দুলটা ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। রক্ত ঝরছে। এটা দেখার পর থেকে আমার বাচ্চাকে আমি বাসা থেকে হিজাব পরায় নিয়ে আসি, স্কুলের কাছে এসে হিজাবটা খুলি।’
আরো পড়ুন
সেনাবাহিনীর নাম ব্যবহার করে প্রতারণা, অভিযোগ জানানোর আহ্বান
আইনশৃঙ্খলার অবনতির বিষয়টি অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তবে পরিচয় প্রকাশ করে মিডিয়ায় বক্তব্য দিতে অনিচ্ছুক অনেকে। একজন নারী বলেন, ‘সন্ধ্যার পরে বের হওয়াটা যেন খুব একটা সিরিয়াস ব্যাপার। মনে হয় যে তাড়াতাড়ি বাসায় ঢুইকা যাই।’ তার ভাষায়-গত কিছুদিনের ঘটনায় এখন আতঙ্ক কাজ করে।
‘আমরা তো স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। যে সরকারই আসুক, যেই আসুক, আমাদেরকে কেউ খাওয়াবে না পরাবে না। খাবারটা নিজেই আর্ন করে খেতে হবে। তাহলে আমাদের মূল চাওয়াটা হচ্ছে সেইফটিটা যেন সরকারের থেকে পাই।’
মোহাম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ আলী ইফতেখার হাসানের দাবি- বিশেষ অভিযানের পর এলাকার পরিস্থিতি অনেকটাই তার ভাষায় নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ‘গত আড়াই মাসে দুটো ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। আমরা দ্রুততম সময় ডাকাতির ঘটনায় আসামি গ্রেপ্তার করেছি। আমরা রহস্য উদঘাটন করেছি। কিছু আসামি পলাতক আছে। ঘটনা ঘটতে পারে, কিন্তু ঘটনার প্রতিকার পাচ্ছে কি না জনগণ, সেটাই হলো বিবেচ্য বিষয়। সেই হিসেবে আমরা বলতে পারি, আমরা সফলতার সাথে মোকাবেলা করছি চ্যালেঞ্জগুলো। চ্যালেঞ্জ থাকবেই।’
মোহাম্মদপুর থানাটি ৫ আগস্টে অগ্নিসংযোগ এবং ব্যাপক লুটপাটের শিকার হয়। এলাকার পরিস্থিতির কারণ নিয়ে হাসান বিবিসিকে বলেন,
‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটা শূন্যতা ছিল। সেই সুযোগে যারা পেশাদার অপরাধী, সেই লোকগুলো পুরোদমে তাদের অপরাধ বাড়িয়ে দিয়েছিল। পরিস্থিতি খারাপ হয়েছিল, এখন আল্লাহর রহমতে আবার পরিস্থিতি অনেকটা ভালো হয়েছে এবং ডে বাই ডে এটা ভালোই হবে- এটা আমি আশা করি।'
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে গত তিন মাসে গণপিটুনিতে খুন হয়েছেন অন্তত ৬৮ জন। এ সময় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৭৮টি। একই সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুরাও হামলার শিকার হয়েছেন।
পরিস্থিতি নিয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান জেড আই খান পান্না বিবিসিকে বলেন, ‘নরসিংদী কারাগার থেকে যে জঙ্গিরা বের হইছিল, সেটার ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নিছে। সেখান থেকে যে আর্মসগুলো যে লুট হইছিল, সেগুলো কতটা উদ্ধার হইছে। সেগুলো নিছিল কে? তারপরে রাতারাতি আমরা দেখলাম যে সাজাপ্রাপ্ত দীর্ঘদিন যাবৎ চিহ্নিত সন্ত্রাসী মুক্তি পাইছে কারাগার থেকে। কী গ্রাউন্ডে পাইলো না পাইলো কিছুই জানি না। এইগুলা তো হতাশা আনে।’ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সরকারের কতটা নিয়ন্ত্রণ আছে সে প্রশ্ন রাখেন মি খান।
‘আমি তো দেখি হোম মিনিস্টার (উপদেষ্টা) অনেক সময় শুনেও না শোনার ভান করেন, উত্তর দিতে চান না, এভয়েড করে যান। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণে নাই। পুলিশ অসহযোগিতা করতেছে, এতে কোনো সন্দেহ নাই। আনসার নন-কো-অপারেশন করবে, এতেও কোনো সন্দেহ নাই। খোঁজ নিয়ে দেখেন, সারা দেশের অবস্থা কী? চাঁদাবাজি চলছে সেই আগের মতো। ইজারাদারি প্রথা- আমার জায়গায় আপনি আসছেন, আপনার জায়গায় আমি আসছি- এই চলতেছে। হাট-বাজার দখল চলছে।’
আরো পড়ুন
বাংলা সংস্কৃতির এক অনন্য সম্পদ পালাগান
আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কোনো সাক্ষাৎকার দেননি। তবে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বিবিসিকে বলেন, আগামী তিন মাসের মধ্যে পরিস্থিতি উন্নতির লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার।
‘আমরা আশা করি যে ছয় মাসের একটা টাইমফ্রেমের মধ্যে আগামী তিন মাসের মধ্যে আমরা পুরোপুরি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারব। এবং পুলিশ পুরোপুরি ফাংশনাল হবে,’ বলেন আসিফ মাহমুদ।
তিনি জানান, সে লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় খোদা বক্সকে নিয়োগ করা হয়েছে। ‘আইনশৃঙ্খলা হচ্ছে প্রায়োরিটি ওয়ান। কারণ এটার সাথে মানুষের জীবনযাত্রা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষের নিরাপত্তা ওতপ্রোতভাবে জড়িত,’ বলেন আসিফ মাহমুদ।
সরকার জানাচ্ছে, নতুন করে পুলিশ ও আনসার নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আর জননিরাপত্তার স্বার্থে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সেনাবাহিনীকে মাঠে রাখার চিন্তা-ভাবনাও আছে অন্তর্বর্তী সরকারের।
‘২২ তারিখ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার আছে। আমরা চাই খুব দ্রুত সেনাবাহিনী তার যে নিয়মিত কার্যক্রম স্বাভাবিক কার্যক্রম সেটাতে ফিরে যাক। সরকার চায় তারা দ্রুত ফিরে যাক। তবে পুলিশ সম্পূর্ণভাবে রিভাইভ করা এবং আমাদের যে অভ্যন্তরীণ অন্য বাহিনীগুলো, যারা আইনশৃঙ্খলা দেখে থাকে, তাদের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পুরোপুরি কন্ট্রোলে আসার পরপরই সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যাবে,’ বলেন আসিফ মাহমুদ।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বুধবার সেনা সদর এক ব্রিফিং করে জানিয়েছে, সেনাবাহিনী দেশের সাত শতাধিক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। লুট হয়ে যাওয়া ছয় হাজার অস্ত্র, দুই লক্ষাধিক গুলি উদ্ধার করেছে এবং এতে সম্পৃক্ত আড়াই হাজার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে।
ব্রিফিংয়ে সেনা সদরের কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, পরিস্থিতি আরো উন্নতির জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করছে সেনাবাহিনী।
‘ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা পাওয়ার পরের যে স্ট্যাটিস্টিক, সেটাতে আগের তুলনায় অপরাধের নথিভুক্ত রেকর্ডের সংখ্যা কমেছে। তার মানে পরিস্থিতির অবনতি হয়নি। সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা সবাইকে সম্পৃক্ত করে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে এবং আমরা আশা করছি, ভবিষ্যতে সিচুয়েশন আরো ভালো হবে,’ বলেন কর্নেল খান।
সূত্র : বিবিসি বাংলা