পুলিশ বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ৫ আগস্টের পর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা গ্রেপ্তার হলেও সাবেক সিআইডি প্রধান এখনো গ্রেপ্তার হননি।
পাসপোর্ট বাতিল, বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও অবৈধ সম্পদ জব্দের আদেশ দেওয়া হয়নি। একটি বিশেষ মহল তাকে রক্ষার চেষ্টা করছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সিন্ডিকেট গড়ে ঘুষ বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, অনিয়ম-দুর্নীতি, সিআইডি সদর দপ্তরে নিজ বলয় তৈরি, আইনবহির্ভূত কার্যক্রম, স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) নিজের পৈতৃক সম্পদে পরিণত করেছিলেন সংস্থাটির সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া।
পুলিশের এই অতিরিক্ত আইজিপি সম্প্রতি বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন সিআইডির সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা।
এতদিন প্রভাব খাটিয়ে যাদের ক্ষমতা খর্ব করে রেখেছিলেন তিনি। ড. মোহাম্মাদ ইউনূসকে মামলার জালে জড়িয়ে নাজেহাল করার কারিগর তিনি। বাড়ি গোপালগঞ্জ হওয়ায় পুলিশের শীর্ষস্থানগুলোতে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রভাব খাটিয়ে।
সিআইডিতে প্রচলিত রয়েছে, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে জানিয়ে, সরকারি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাটিকে ‘মগের মুল্লুক’ বানিয়ে রাখতেন। ধরাকে সরাজ্ঞান করা মোহাম্মদ আলী মিয়া দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন।
দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা, বিরোধী মতের লোকজনকে জিম্মি করে ক্ষমতার চরম অপব্যবহার ছিল তার অবৈধ অর্থের উৎস।
অভিযোগ রয়েছে, মামলা রুজু, অভিযান, তদন্তের সিদ্ধান্ত থেকে নিষ্পত্তি পর্যন্ত আইনবহির্ভূতভাবে নিজস্ব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক সিআইডি প্রধান। তার অবৈধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ‘টুঁ’ শব্দ করারও সুযোগ ছিল না।
তার এই সিন্ডিকেটের ‘মিডল ম্যান’ ছিলেন সিআইডি সদর দপ্তরে বিশেষ পুলিশ সুপার (ঢাকা মেট্রো-পূর্ব) এ, কে, এম এমরান ভুঞা। দুই বছর সিআইডিপ্রধান থাকাকালে তিনি কোনো নিয়মনীতিকেই পরোয়া করেননি। পিছপা হননি বিগত সরকারের ‘প্রেসক্রিপ্টেড’ আজ্ঞা পালনে।
বিশেষ করে ওই সরকারের ‘অপছন্দ’ ব্যক্তিদের শায়েস্তা করতে নানা কূটকৌশলে সিআইডিকে ব্যবহার করতেন তিনি। তিনি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে নিয়মিত মাসোয়ারা দিতেন।
আর অবৈধ উপার্জনের অর্থ দিয়ে নিজের ক্ষমতা বলয় সবসময় টিকিয়ে রাখতেন। অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ আলী মিয়া নিজের সেই সিন্ডিকেটে কতিপয় অধস্তন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদেরও যুক্ত করেন। তাদের দিয়ে কয়েকশ ভুয়া অভিযোগ এনে তদন্ত করার নামে অন্তত কয়েক হাজার কোটি টাকা কামিয়েছেন।
দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে মোহাম্মদ আলী মিয়ার অবৈধ সম্পদের পাহাড়ের তথ্য পাওয়া গেছে। রাজধানীর আফতাবনগর, বাড্ডা, মিরপুর, পূর্বাচলসহ বিভিন্ন এলাকায় নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এসব জায়গায় প্লট, ফ্ল্যাটসহ নানা সম্পদ রয়েছে তার।
লন্ডনে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা, মালয়েশিয়া ও দুবাইতেও ব্যবসা রয়েছে। লন্ডনে এক বাংলাদেশির রিয়েল এস্টেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অংশীদার তিনি। মোহাম্মদ আলীর একমাত্র ছেলে আফনান লাবিব লন্ডন, মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ের ব্যবসা দেখভাল করেন।
তিনি মালয়েশিয়া, দুবাই ও লন্ডনে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার করেছেন। অনুসন্ধানে ঢাকায় মোহাম্মদ আলীর বেশকিছু দামি জমির তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রাজধানীর আফতাবনগর-সংলগ্ন আনন্দনগরে ১২.৩৭ শতক জমির একটি প্লট।
এটি বাড্ডা মৌজার ৪৪৩২৫ খতিয়ানের জমি। দাগ নম্বর ১৮১৩০। মিরপুর বাউনিয়া মৌজায় ৪০৭২৩ নম্বর খতিয়ানের ৩০ নম্বর দাগে ৮.২২ শতক জমি রয়েছে তার। পূর্বাচলে ৫ কাঠা ও কেরানীগঞ্জে ৫ কাঠার প্লট রয়েছে। এ ছাড়া বেনামে একাধিক ফ্ল্যাটও রয়েছে।
এদিকে, সাবেক সিআইডিপ্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়ার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। গত ১৩ মার্চ মোহাম্মদ আলী মিয়া ও তার দুর্নীতিতে সহায়তাকারী পাঁচ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়।
এই তালিকায় সিআইডির প্রশাসন শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার মিনহাজুল ইসলাম, বিশেষ পুলিশ সুপার (ঢাকা মহানগর পশ্চিম) এ কে এম ইমরান ভূঁইয়া, সাইবার ক্রাইমের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমা, পরিদর্শক মানব শাহাজাদা ও পরিদর্শক মনিরুজ্জামান রয়েছেন।
দায়িত্ব থাকার সময় গত দু’বছরে তার নির্দেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলায় মূল আসামিদের নাম বাদ দিয়ে চার্জশিট দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। যার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মামলাটি অন্যতম।
তা ছাড়া অনেক মামলায় তদন্তে নাম আসা আসামিদের বাদ দিয়ে চার্জশিট দেওয়া, সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও মামলায় আসামি করা, এমন অনেক অভিযোগ আছে মোহাম্মদ আলী মিয়ার বিরুদ্ধে। তার অনৈতিক নির্দেশনা মেনে যেসব কর্মকর্তা কাজ করতে রাজি হননি তাদের হয় বদলি অথবা ডেকে নিয়ে হেনস্তা করতেন।
অনুসন্ধান, তদন্ত, আসামি গ্রেপ্তার সবই মোহাম্মদ আলীর পছন্দ অনুযায়ী করতে হতো। ডিআইজি থেকে পরিদর্শক পর্যন্ত কারও কথা বলার ক্ষমতা ছিল না।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে ২০২৩ সালের শুরুর দিকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন মোহাম্মদ আলী।
ড. ইউনূসকে হয়রানি না করার জন্য কিছু কর্মকর্তা বাধা দিলে মোহাম্মদ আলী তাদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কথা জানান এবং সিআইডির মানিলন্ডারিং শাখায় ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালানোর চিঠি ইস্যু করেন।
গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৭ আগস্ট মোহাম্মদ আলী সিআইডি কার্যালয়ে এসে ড. ইউনূসের বিষয়ে অনুসন্ধানসংক্রান্ত সব কাগজপত্র নিয়ে যান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মামলায় প্রথম দিকে তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন বিসিএস ২৪ ব্যাচের পদোন্নতিবঞ্চিত পুলিশ কর্মকর্তা রায়হানুল ইসলাম। তিনি ওই মামলায় মোহাম্মদ আলীর কথামতো বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নাম বাদ দিয়ে চার্জশিট দিতে রাজি না হওয়ায় তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
অথচ গুরুত্বপূর্ণ ওই মামলায় সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রায়হানুল ইসলাম অনেক দূর তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যান। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় কার কী ভূমিকা ছিল সবকিছু তিনি বের করেন দীর্ঘ তদন্তে।
২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় জড়িত হিসেবে মামলার তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রভাবশালী ১৪ কর্মকর্তার নাম উঠে আসে সিআইডির তদন্তে।
মোহাম্মদ আলী মিয়ার অন্যতম সহযোগী ও ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ করতেন বিসিএস ২৭ ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তা ইমরান ভূইয়া।
এই কর্মকর্তা চট্টগ্রামের লোহাগড়ায় এএসপি হিসেবে কর্মরত থাকাকালে তার বিরুদ্ধে একটি বিদেশি রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করার অভিযোগ ওঠে। ওই অভিযোগে ইমরানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়।
নিজেকে ছাত্রলীগের নেতা পরিচয় দিয়ে এবং বিএনপিসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দমনে পারদর্শিতার খতিয়ান তুলে ধরে বিভাগীয় মামলা থেকে রেহাই পান তিনি। এরপর পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতিও বাগিয়ে নেন ইমরান।
সাবেক সিআইডিপ্রধান মোহাম্মদ আলীর সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য ছিলেন এই ইমরান। তাকে সিআইডিতে নিয়ে আসেন মোহাম্মদ আলী নিজে।
সিআইডির ফরেনসিক ইউনিটে পদায়ন করা হলেও তিনি আরও দুটি ইউনিটের দায়িত্ব পান মোহাম্মদ আলীর কৃপায়। মূলত ইমরান ভূইয়া ছিলেন মোহাম্মদ আলীর ঘুষের টাকার ক্যাশিয়ার।