ঢাকা, রবিবার ০৬ এপ্রিল ২০২৫
২৩ চৈত্র ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৬

ঢাকা, রবিবার ০৬ এপ্রিল ২০২৫
২৩ চৈত্র ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৬
মতামত

শহরের শিশুদের 'শীত দেখানো' দরকার

আনিসুর বুলবুল
আনিসুর বুলবুল
শেয়ার
শহরের শিশুদের 'শীত দেখানো' দরকার
ছবি: কালের কণ্ঠ

শীতের সকালে শিশির ভেজা ঘাসের ওপর পা ফেলার অভিজ্ঞতা ঢাকার শিশুদের জন্য যেন এক দুর্লভ স্বপ্ন। ইট-কাঠ-পাথরের ব্যস্ত শহরে শীতের প্রকৃতিকে উপভোগ করার সুযোগ পাওয়া তো দূরের কথা, শীতের সকালে প্রকৃতির ছোঁয়া বুঝতে পারার সময়ও তাদের থাকে না। অথচ প্রকৃতির এই মৃদু শীত, কুয়াশায় মোড়ানো ভোর আর সূর্যোদয়ের সৌন্দর্য শিশুদের মানসিক বিকাশে এক গভীর প্রভাব রাখতে পারে। 

আজ সকালে কালের কণ্ঠে এমনই একটি মনোমুগ্ধকর সংবাদে চোখ আটকে গেল।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় শিশুদের নিয়ে আয়োজিত হয়েছিল এক ব্যতিক্রমী শীত-উপভোগের আয়োজন। হিমেল হাওয়ার ভোরে শিশুরা কুয়াশাচ্ছন্ন পথ ধরে প্রায় দুই কিলোমিটার হেঁটে গেল। পথে তারা কৃষকের বীজতলার পরিচর্যা দেখল আর শিশির ভেজা ধান গাছ ছুঁয়ে অনুভব করল প্রকৃতির নির্মল সৌন্দর্য। জমির আইলের কাঁদামাটি যেন তাদের কাছে তুচ্ছ মনে হলো।
শীতকে শুধু অনুভব করাই নয় বরং দেখার, ছোঁয়ার এবং উপভোগ করার এ অভিজ্ঞতা যেন এক নতুন মাত্রা এনে দিল।

সংবাদটি পড়ে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি। এমন আয়োজন ঢাকার শিশুদের জন্য করলে কেমন হবে, ভেবে দেখছি। ইট-পাথরের ব্যস্ত শহরে শীতের প্রকৃতি ছুঁয়ে দেখার সুযোগ শিশুদের খুব কমই হয়।

এই ব্যস্ত নগরীর শিশুদের প্রকৃতির এমন ছোঁয়া যদি উপহার দেওয়া যায়, তবে তা হবে তাদের জন্য এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতার বীজ বুনে দিতে এমন আয়োজন যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা সত্যিই ভাববার মতো বিষয়।

এক. আয়োজনের রূপরেখা

ভোর পাঁচটা থেকে আয়োজন শুরু হবে। একদল শিশু শহরের কোনো উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ থেকে পায়ে হেঁটে যাবে কাছাকাছি কোনো পার্ক বা প্রাকৃতিক খোলা জায়গায়। সকালবেলার হিমেল বাতাসে শিশুরা প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করবে।

সূর্যের প্রথম কিরণের আলোয় তাদের চোখে ফুটে উঠবে বিস্ময়। এরপর পবিত্র গ্রন্থ থেকে পাঠ এবং জাতীয় সংগীত পরিবেশনার মাধ্যমে দিনটি শুরু হবে।

দুই. প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা

এ আয়োজনের মূল আকর্ষণ হবে প্রকৃতির সঙ্গে শিশুদের সরাসরি মেলবন্ধন। জমির কাঁদামাটি ছুঁয়ে দেখার অভিজ্ঞতা কিংবা গাছের পাতায় জমে থাকা শিশিরের ছোঁয়া পাবে শিশুরা। তারা শিখবে, কীভাবে কৃষকেরা শীতের সকালে ফসল ফলানোর জন্য পরিশ্রম করেন। এসবের মাধ্যমে তাদের মনে কাজের প্রতি সম্মান ও কষ্টের মূল্যবোধ গড়ে উঠবে।

তিন. সৃজনশীল কর্মকাণ্ড

আয়োজনে থাকবে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, যেখানে শিশুরা শীতের প্রকৃতির চিত্র আঁকবে। থাকবে কবিতা আবৃত্তি, গান এবং শরীরচর্চার আয়োজন। শীতের মিষ্টি রোদে পিঠাভোজের ব্যবস্থা করা হবে, যা শিশুদের আরও বেশি আনন্দ দেবে। এ সময় তারা শিখবে আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী পিঠাপুলি সম্পর্কে।

চার. শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা

শিশুরা শুধু মজা করবে না, শিখবেও অনেক কিছু। প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা, কঠোর পরিশ্রমের মূল্যবোধ এবং শীতের প্রকৃতির সৌন্দর্য উপলব্ধির পাশাপাশি তারা শারীরিক কসরত ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে।

পাঁচ. অংশগ্রহণ কারা করবেন

আয়োজনে উপস্থিত থাকবেন শিক্ষক, প্রকৃতি বিশেষজ্ঞ এবং মনোবিজ্ঞানীরা। তারা শিশুদের বিভিন্ন বিষয়ে গাইড করবেন এবং প্রকৃতির সঙ্গে সংযুক্ত থাকার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করবেন। এ ধরনের আয়োজন শিশুদের চিন্তাশক্তি ও কল্পনাশক্তিকে জাগ্রত করবে এবং তাদের প্রথাগত শিক্ষার বাইরেও জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পাঠ শেখাবে। অভিভাবকরাও এ আয়োজনে অংশ নিতে পারবেন, যা শিশুদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ঠ করবে। পরিবারের সঙ্গে প্রকৃতির আনন্দ ভাগাভাগি করার মাধ্যমে শিশুরা শিখবে ভালোবাসা ও সহযোগিতা।

শেষ কথা

ঢাকার শিশুদের জন্য ‘শীত দেখানো’ এমন একটি আয়োজন যা তাদের কেবল আনন্দই দেবে না বরং প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের এক অনন্য সুযোগ তৈরি করবে। এ ধরনের উদ্যোগ শিশুদের মনে সৃজনশীলতা, দায়িত্ববোধ ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা তৈরি করবে। শীতকে একেবারে কাছে থেকে অনুভব করার এই অভিজ্ঞতা শিশুমনে গেঁথে থাকবে আজীবন।

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

দৃষ্টিপাত

সোশ্যাল মিডিয়ার বিকৃত রুচি— শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মনুষ্যত্বের অবক্ষয়

আনিসুর বুলবুল

আনিসুর বুলবুল

আনিসুর বুলবুল

আনিসুর বুলবুল

শেয়ার
সোশ্যাল মিডিয়ার বিকৃত রুচি— শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মনুষ্যত্বের অবক্ষয়
প্রতীকী ছবি

আজকের ডিজিটাল যুগে সোশ্যাল মিডিয়া শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি হয়ে উঠেছে অর্থোপার্জনের হাতিয়ার, সমাজের রুচির দর্পণ, এমনকি নৈতিকতার মাপকাঠি। কিন্তু এই প্ল্যাটফর্মের জনপ্রিয়তা যখন কেবল অশালীনতা, ভাঁড়ামি আর সস্তা সেন্সেশনের উপর নির্ভর করে, তখন তা সমাজের জন্য এক ভয়াবহ সংকটের ইঙ্গিত দেয়। একজন নারী যখন টাওয়েল বা নাইটি পরে নাচলে লাখো ভিউ পায়, আর একজন গুণী কবি বা জ্ঞানী ব্যক্তির কথায় মানুষ নাক সিঁটকায়, তখন বুঝতে হবে আমাদের সমাজের মূল্যবোধ কোথায় হোঁচট খাচ্ছে।

ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো আজ মনিটাইজেশনের লোভে মানুষের নৈতিকতা ও লজ্জাকে পণ্যে পরিণত করেছে।

দেবরকে আজ যা দিলাম!—এমন ক্যাপশনে কৌতূহল জাগিয়ে ভিডিও তৈরি করলে তা ভাইরাল হয়, কিন্তু সমাজসংস্কার, শিক্ষা বা শিল্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উপেক্ষিত থেকে যায়। এখানে কবিতার চেয়ে বক্ষ প্রদর্শন বেশি মূল্য পায়, জ্ঞানের চেয়ে খিস্তির কদর বেশি। যেন মানুষ এখন শুধু চায় উত্তেজনা, চায় অশ্লীলতার মাঝে হারিয়ে যেতে। এমনকি মাঝবয়সী নারীরাও আজ প্রেমের কবিতা পড়ার চেয়ে শারীরিক প্রদর্শনেই বেশি সাড়া পাচ্ছেন।

কমেডির নামে আজ যা চলছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই অশ্লীলতা ও খিস্তির মিশেল। পাবলিক হাসছে, কিন্তু সেই হাসির পেছনে লুকিয়ে আছে আমাদেরই রুচির দৈন্য। আমরা ভুলে যাচ্ছি যে, সমাজের উন্নতি ঘটে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও নৈতিকতার মাধ্যমে, নাইটি বা শারীরিক প্রদর্শনের মাধ্যমে নয়। যখন একজন মা-বোন স্কুলের পড়া ছেড়ে রিলস বানাতে উৎসাহিত হন শুধু টাকার লোভে, তখন আমাদের ভাবতে হবে—আমরা আসলে কোন ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছি?

মনিটাইজেশনের এই উন্মত্ততা আমাদের নতুন প্রজন্মকে কী শিক্ষা দিচ্ছে? তারা শিখছে যে, পড়াশোনা বা সততার চেয়ে সস্তা সেলিব্রিটি হওয়াটাই বড় সাফল্য।

তারা দেখছে, সমাজে সম্মান পেতে হলে বুকের খাঁজ দেখাতে হবে, দেবর-ভাসুর নিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ কন্টেন্ট বানাতে হবে। এভাবে কি আমরা একটি সুস্থ প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারব? নাকি আমাদের সন্তানদের হাতে তুলে দেব শুধু বিকৃত রুচি আর নৈতিক অধঃপতনের উত্তরাধিকার?

সময় এসেছে জেগে ওঠার। সোশ্যাল মিডিয়ার অপসংস্কৃতি রোধ করতে হবে। প্যারেন্টস, টিচার্স ও ইনফ্লুয়েন্সারদের এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, পেট চালানোর জন্য নৈতিকতা বিক্রি করা কখনই সমাধান নয়।

শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতি ফিরে যেতে হবে। নইলে একদিন আমাদের সন্তানরা প্রশ্ন করবে—আপনারা আমাদের জন্য কী রেখে গেলেন? নাইটি নাচ, নাকি জ্ঞানের আলো? উত্তর দিতে পারব কি?

মন্তব্য

মিডিয়া সংস্কারে কার স্বার্থে একচোখা সুপারিশ

মাহফুজ জুয়েল
মাহফুজ জুয়েল
শেয়ার
মিডিয়া সংস্কারে কার স্বার্থে একচোখা সুপারিশ

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে নতুন বাংলাদেশ গড়ার কামনায় রাষ্ট্র সংস্কারের প্রসঙ্গটি জোরালোভাবে সামনে আসে। সংস্কারের বাসনায় একে একে গঠন করা হয় সাতটি কমিশন। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, সংবিধান সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন।

এর মধ্যে ১৮ নভেম্বর ১১ সদস্যের গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার।

কমিশনের প্রধান করা হয় জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কামাল আহমেদকে। ২২ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। কমিশনের সদস্যদের অনেকেই নিজ নিজ কর্মগুণে স্বনামখ্যাত সুশীল এবং নিঃসন্দেহে জ্ঞানীগুণী। তাঁরা তুলনামূলক দ্রুততম সময়ে তথ্যসমুদ্র মন্থন করে ১৮০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন জাতিকে উপহার দিয়েছেন।
আমরা আশা করি, দেশ ও জাতির সার্বিক মঙ্গল বা ইতিবাচক পরিবর্তনের বাসনা থেকেই তাঁরা তাঁদের মূল্যবান সময় ও শ্রম ব্যয় করেছেন। কষ্ট করে পড়তে গেলেই তা ধরতে পারা যায়।

কমিশনের সুপারিশমালার শুরুতেই গণমাধ্যমের মালিকানার কথা বলা হয়েছে। একই কোম্পানি, গোষ্ঠী, ব্যক্তি, পরিবার বা উদ্যোক্তা যাতে একই সঙ্গে একাধিক মাধ্যমের মালিক হতে না পারে, সেজন্য বিশ্বের বহু দেশে ‘ক্রস-ওনার শিপ’ (টেলিভিশনের মালিক সংবাদপত্রের মালিক হতে পারেন না বা সংবাদপত্রের মালিক টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক হতে পারেন না) নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে কমিশন ‘ওয়ান হাউস, ওয়ান মিডিয়া’র সুপারিশ করেছে।

কমিশন মনে করে, বাংলাদেশেও অচিরেই এমন পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। ক্রস-ওনার শিপ নিষিদ্ধ করে অধ্যাদেশ করা যায়। যেসব ক্ষেত্রে এটি বিদ্যমান সেগুলোয় পরিবর্তন আনার নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়ে তাদের ব্যবসা পুনর্গঠনের লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়া প্রয়োজন। এগুলো নানা পদ্ধতিতে হতে পারে।

যেসব কোম্পানি, গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি, পরিবার একই সঙ্গে টেলিভিশন ও পত্রিকার মালিক, তারা যে কোনো একটি গণমাধ্যম রেখে অন্যগুলোর মালিকানা বিক্রির মাধ্যমে হস্তান্তর করে দিতে পারে। অথবা দুটি গণমাধ্যমের (টেলিভিশন ও পত্রিকা) সাংবাদিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একত্র করে আরও শক্তিশালী ও বড় আকারে একটি গণমাধ্যম (টেলিভিশন অথবা পত্রিকা) পরিচালনা করতে পারে।

কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, একক মালিকানায় একই ভাষায় একাধিক দৈনিক পত্রিকা বা একাধিক টেলিভিশন চ্যানেল প্রতিযোগিতার পরিবেশ নষ্ট করে। সেই সঙ্গে গণমাধ্যমের যে প্রভাবক ক্ষমতা, তা নিজস্বার্থে কেন্দ্রীভূত করে। সে কারণে এ ব্যবস্থার অবসান হওয়া দরকার। বিদ্যমান এ ব্যবস্থার দ্রুত সমাধান করতে হবে।

উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, একই সাবান একাধিক মোড়কে বাজারজাত করায় যেমন বাজারের প্রতিযোগিতা নষ্ট করে, একই মালিকানায় একই ভাষায় একাধিক দৈনিক পত্রিকাও গণমাধ্যমের প্রতিযোগিতা নষ্ট করে এবং পাঠক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টেলিভিশনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এজন্য ‘এক উদ্যোক্তার একটি গণমাধ্যম (ওয়ান হাউস, ওয়ান মিডিয়া)’ নীতি কার্যকর করাই গণমাধ্যমের কেন্দ্রীকরণ প্রতিরোধের সেরা উপায় বলে মনে করে কমিশন।

আর এ কথাগুলো পড়ার পরই অধমের চোখে খটকা লাগে। প্রতিবেদনটিও অনেকটাই বিশ্বাসযোগ্যতা ও পবিত্রতা হারায়। মুহূর্তেই ‘অনেক দুধের মধ্যে এক ফোঁটা গোমূত্র পড়ার’ চিত্রকল্পটাও ভেসে ওঠে। প্রতিবেদনটি পক্ষপাতদুষ্ট এক উদ্ভট যাচ্ছেতাই বালখিল্য বিষয়ে পরিণত হয়। বোঝা যায়, নেহাত দেশ ও জনগণ, গণমাধ্যম বা গণমাধ্যমকর্মীদের মঙ্গলাকাক্সক্ষা নয়, এখানেও গতানুগতিক অপরাজনীতি ও ঘৃণ্য গোষ্ঠীস্বার্থ কাজ করেছে। সেই ‘গোষ্ঠীস্বার্থ’ও আবার স্রেফ ‘ব্যবসায়িক বিদ্বেষতাড়িত’। হ্যাঁ, স্রেফ বিদ্বেষ আর প্রতিহিংসা থেকেই কমিশন এ আজগুবি ওয়ান হাউস, ওয়ান মিডিয়ার সুপারিশ করেছে এবং ক্রস-ওনার শিপের প্রসঙ্গ টেনেছে।

বিদ্বেষের তাড়নায় কখনোই সর্বজনীন ভালো কিছু হয় না। ফলে কমিশনের এ প্রতিবেদন গণমাধ্যমকে ইতিবাচক নতুন কিছু দেওয়া থাক দূরে, বরং আরও অস্থির ও অস্থিতিশীল করে তুলবে। অদৃশ্য অব্যক্ত অসংখ্য ক্ষত বয়ে চলা নাজুক গণমাধ্যমকর্মীদের জীবনে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ বা ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’ দেওয়ার প্রেসক্রিপশন দিয়েছে গণমাধ্যম কমিশন।

কোন প্রতিষ্ঠান কয়টা পত্রিকা বা টেলিভিশন চালু করতে পারবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করার কোনো বৈধ যুক্তি নেই। যার বৈধ টাকা আছে সে কেন পারবে না? কোনো একটি শিল্পগোষ্ঠীকে মাথায় রেখে এ সুপারিশ সামনে আনা হলে মূল উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন উঠবে এবং সেটাই স্বাভাবিক।

কেননা এর বিপরীত চিত্রটাই পৃথিবীতে সবল সচল। চোখের সামনেই এর অনেক উদাহরণ রয়েছে। আনন্দবাজার পত্রিকা গ্রুপের কথা ধরুন। তাদের অনেক পত্রিকা রয়েছে। ভারত সরকার কি এ ব্যাপারে কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে?

রয়েছেন মিডিয়া মুঘল রুপার্ট মার্ডক, তাঁর কোম্পানি নিউজ করপোরেশন। তিনি বিশ্বজুড়ে শত শত স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বহুমুখী প্রকাশনা ও সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানের মালিক। এ একই প্রতিষ্ঠানের অধীনে যুক্তরাজ্যে রয়েছে দ্য সান এবং দ্য টাইমস, অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছে দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, হেরাল্ড সান এবং দি অস্ট্রেলিয়ান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এবং নিউইয়র্ক পোস্ট। এ ছাড়া তিনি টেলিভিশন চ্যানেল স্কাই নিউজ অস্ট্রেলিয়া এবং ফক্স নিউজ (ফক্স করপোরেশনের মাধ্যমে), টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরিস ফক্স এবং নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ডের (বর্তমানে বিলুপ্ত) মালিকও ছিলেন।

আছেন জন কার্ল মেলোন। এ আমেরিকান মিডিয়া মুঘল, যিনি লিবার্টি মিডিয়ার চেয়ারম্যান। তিনি ‘কেবল কাউবয়’ নামেও পরিচিত। তিনি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ধরনের মিডিয়া, টেলিযোগাযোগ এবং বিনোদন প্রতিষ্ঠানের মালিক।

জন কার্ল মেলোন ১৯৯২ সালে ‘ফাইভ হানড্রেড চ্যানেল ইউনিভার্স’ ধারণাটি ব্যবহার করেন ভবিষ্যতের মিডিয়ার পরিবেশ-পরিস্থিতি বোঝানোর জন্য, যেখানে বিপুলসংখ্যক টিভি চ্যানেলের প্রয়োজনীয়তাকে তিনি ইঙ্গিত করেন। তাঁর ডিসকভারি কমিউনিকেশনস, যা এখন ডিসকভারি ইনকরপোরেটেড, এই এক প্রতিষ্ঠানের অধীনে রয়েছে ডিসকভারি চ্যানেল, টিএলসি (দ্য লার্নিং চ্যানেল), অ্যানিমেল প্ল্যানেট, এইচজিটিভি (হোম অ্যান্ড গার্ডেন টেলিভিশন), ফুড নেটওয়ার্ক, ওডব্লিউএন (অপরাহ উইনফ্রে নেটওয়ার্ক), ইউরোস্পোর্ট (ইউরোপীয় স্পোর্টস চ্যানেল নেটওয়ার্ক), কিউভিসি (গুণমান, মূল্য, সুবিধা; যা একটি হোম শপিং নেটওয়ার্ক যা সৌন্দর্য, ইলেকট্রনিক, ফ্যাশন এবং আরও অনেক কিছু বিপণন ও পণ্য সরবরাহ করে লাইভ শো সম্প্রচার করে। কিউভিসি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপানসহ একাধিক অঞ্চলে কাজ করে।)

লিবার্টি গ্লোবালের অধীনে রয়েছে ভার্জিন মিডিয়া, যা যুক্তরাজ্যের একটি প্রধান টেলিযোগাযোগ এবং মিডিয়া কোম্পানি, কেবল টেলিভিশন, ইন্টারনেট পরিষেবা এবং মোবাইল যোগাযোগ প্রদান করে। ইউপিসি, ইউনাইটেড প্যান-ইউরোপ কমিউনিকেশনস, রয়েছে টেলিনেট, যা বেলজিয়ামের একটি শীর্ষস্থানীয় টেলিযোগাযোগ প্রদানকারী, প্রাথমিকভাবে ইন্টারনেট, টেলিভিশন এবং টেলিফোন পরিষেবা প্রদানকারী।

লিবার্টি ল্যাটিন আমেরিকা, সিরিয়াসএক্সএম, ফর্মুলা ওয়ান, লাইভ নেশান, জিসিআই (জেনারেল কমিউনিকেশন, ইনকরপোরেটেড), লায়ন্সগেটসহ আরও অনেক মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম।

শুধু রুপার্ট মার্ডক বা জন কার্ল মেলোন নন, এ রকম এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অধীনে অনেক মিডিয়া থাকা প্রতিষ্ঠানের তালিকা অনেক দীর্ঘ। এর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজনের নাম আমরা উল্লেখ করছি, যাদের সব প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করলে এ লেখাটা প্রবন্ধ না হয়ে মহাভারত হয়ে যাবে। সে কারণে আমরা শুধু ব্যক্তি বা তার মূল প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করছি। আগ্রহী পাঠক চাইলে হাতের মুঠোয় পৃথিবীর সুবিধা নিয়ে এ মুহূর্তেই সেসব ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের আরও বিস্তারিত জানতে পারবেন।

ধরুন, সামনার রেডস্টোন, ভায়াকমসিবিএস, যা বর্তমানে প্যারামাউন্ট গ্লোবাল; টেড টার্নার, টার্নার ব্রডকাস্টিং সিস্টেম, টিবিএস ও সিএনএন; জেফ বেজোস, অ্যামাজন, দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের মালিক; ওয়াল্ট ডিজনি, দ্য ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি, ডিজনি মিডিয়া নেটওয়ার্ক; ডেভিড গেফেন, গেফেন রেকর্ডস, ড্রিমওয়ার্কস এসকেজি; মাইকেল ব্লুমবার্গ, ব্লুমবার্গ এলপি, ব্লুমবার্গ নিউজ; ল্যারি পেজ এবং সের্গেই ব্রিন, গুগল, বর্তমানে যা অ্যালফাবেট, ইউটিউব এবং গুগল নিউজসহ।

প্রতিবেশী দেশে রয়েছেন সুভাষ চন্দ্র, জি এন্টারটেইনমেন্ট এন্টারপ্রাইজেস, জিটিভি; কালানিথি মরন, সান গ্রুপ, সান টিভি নেটওয়ার্ক, রেডিও এবং চলচ্চিত্র; রাঘব বাহল, নেটওয়ার্ক১৮ গ্রুপ, সিএনবিসি-টিভি১৮, সিএনএন-নিউজ১৮-এর মতো মিডিয়া আউটলেট এবং অন্যান্য বিভিন্ন ডিজিটাল ও টেলিভিশন সম্পত্তির মালিক; ম. কে. আলাগিরি, দ্য হিন্দু গ্রুপ, ভারতের অন্যতম সম্মানিত ইংরেজি ভাষার সংবাদপত্র দ্য হিন্দু এবং অন্যান্য প্রকাশনার মালিকানার সঙ্গে জড়িত। সম্বিত পাত্র, টাইমস অব ইন্ডিয়া, বেনেট, কোলম্যান অ্যান্ড কোং, আগরওয়াল পরিবারের নেতৃত্বে টাইমস গ্রুপ ভারতের বৃহত্তম মিডিয়া গ্রুপগুলোর মধ্যে একটি, যারা টাইমস অব ইন্ডিয়ার মতো প্রধান সংবাদপত্র প্রকাশ করে এবং জুমের মতো টেলিভিশন নেটওয়ার্কের মালিক। রজত শর্মা, ইন্ডিয়া টিভি, হিন্দি ভাষার সংবাদ চ্যানেল ইন্ডিয়া টিভির প্রতিষ্ঠাতা এবং ভারতের মিডিয়া শিল্পের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। এন. আর. নারায়ণ মূর্তি, ইনফোসিস, যদিও প্রাথমিকভাবে একজন প্রযুক্তিসম্রাট, মূর্তির বিনিয়োগ মিডিয়া এবং বিনোদনেও বিস্তৃত। বিজয় মালিয়া, কিংফিশার, ইউবি গ্রুপ এবং মিডিয়া ভেঞ্চারস। কিংফিশার এয়ারলাইনসের জন্য পরিচিত, মালিয়ার কিংফিশার টিভি এবং অন্যান্য বিনোদন উদ্যোগসহ মিডিয়া কোম্পানিগুলোতেও অংশীদারি ছিল। শিব নাদার, এইচসিএল এবং মিডিয়া ইনভেস্টমেন্টস, এইচসিএলের প্রতিষ্ঠাতা। নীতা আম্বানি, রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ, নেটওয়ার্ক১৮, টিভি১৮, জিও প্ল্যাটফর্মের মালিক।

ডিজিটাল যুগে সংবাদমাধ্যম এমনিতেই কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়েছে। বিশ্বব্যাপী ছাপা পত্রিকা মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে। অনেক স্বনামখ্যাত বড় পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোনোটি বন্ধ হওয়ার পথে, কোনোটি রূপান্তরের মাধ্যমে টিকে থাকার চেষ্টা করছে।

তাই ওয়ান হাউস, ওয়ান মিডিয়া চিন্তার পেছনে জনহিতকর, গঠনমূলক বা ইতিবাচক কিছু নয়, বরং রয়েছে প্রতিহিংসাপরায়ণ কুচিন্তা ও কূটকৌশল। যাতে লাথি মারা হবে অসংখ্য মিডিয়াকর্মীর পেটে। তাতে বরং বেকারত্বের পাহাড় আরও উঁচু হবে, নানামুখী অসন্তোষ, সীমাহীন হতাশার আকাশ আরও মেঘকালো বা ভারী হবে।

মাহফুজ জুয়েল : কবি ও সাংবাদিক

মন্তব্য
ঐকমত্য কমিশন

জনপ্রশাসনের ১৮ সুপারিশ বাস্তবায়ন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা : প্রেক্ষিত আইসিটি সার্ভিস

মো. মনিরুজ্জামান
মো. মনিরুজ্জামান
শেয়ার
জনপ্রশাসনের ১৮ সুপারিশ বাস্তবায়ন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা : প্রেক্ষিত আইসিটি সার্ভিস

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার সফল অভ্যুত্থানের ফলে দেশের জনগণের মধ্যে মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আলোকে রাষ্ট্র সংস্কারের একটি সুদৃঢ় প্রত্যয় ও আকাঙ্খা সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাঠামোগত সংস্কারের লক্ষ্যে কমিশন গঠন করে। যার মধ্যে গত ৩ অক্টোবরে গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনও আছে। একটি ‘জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, নিরপেক্ষ ও দক্ষ জনপ্রশাসন’ ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যে দুই শতাধিক সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন দাখিল করেছে।

যা আমাদের সবার জানা। 

পত্রপত্রিকার বরাতে আমরা ইতোমধ্যে একথাও জেনেছি, গত ২০ মার্চ থেকে শুরু হওয়া ঐকমত্য কমিশনের সংলাপের আগেই নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কারে ১১১ দফা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সংস্কার প্রস্তাবের অন্য সুপারিশগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হবে বলেও আমরা গণমাধ্যমের কল্যাণে জেনেছি। 

২. একটি জাতীয় দৈনিকের গত ২০ মার্চের খবরে আমরা দেখলাম, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ১৮টি সুপারিশ এখনই বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে সরকার।

এর মধ্যে রয়েছে স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন, জাতীয় রাজস্ব  বোর্ড পুনর্গঠন, ডিজিটাল রূপান্তর ও ই-সেবা চালু, ভূমি রেজিস্ট্রেশন সংস্কার, উপজেলা পরিষদ শক্তিশালী করা, পদোন্নতি না দেওয়া সরকারি কর্মচারীর বেতন সুবিধা চালু, দুর্নীতি তদন্তে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন এবং চাকরিতে পুলিশ ভেরিফিকেশন সীমিতকরণসহ আরো কিছু সুপারিশ। আমরা এখন দেখি ডিজিটাল রুপান্তর ও ই-সেবা নিয়ে সংস্কার প্রস্তাবে আসলে কি বলা ছিল? গত ৫ ফেব্রুয়ারি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীসহ কমিশনের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে কমিশনের যে প্রতিবেদন জমা দেন সে প্রস্তাবের ‘নাগরিক পরিষেবা উন্নয়নে জনপ্রশাসন’ শিরোনামে পঞ্চম অধ্যায়ের ৫.১ এ নাগরিক অধিকার নিশ্চিতকরণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নাগরিক সম্পৃক্ততা, নাগরিকদের তথ্য অধিকার ও নাগরিক পরিষেবা সহজীকরণের লক্ষ্যে স্বল্প মেয়াদী (ছয় মাসে বাস্তবায়ন যোগ্য ) যে সুপারিশ করা হয়েছে তাতে ডিজিটাল রুপান্তর ও ই-সেবায় বলা আছে, ‘৫.১ ডিজিটাল রূপান্তর এবং ই-সেবা: জনসেবা ব্যবস্থার দক্ষতা বাড়াতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। একটি মূল কৌশল হতে পারে সরকারি সেবার ডিজিটাল রূপান্তর। সরকার একাধিক ই-গভর্নমেনট সেবা শক্তিশালী করতে পারে, যেমন- অনলাইন ট্যাক্স দাখিল, ডিজিটাল জমির রেকর্ড এবং ইলেকট্রনিক জন্ম নিবন্ধন, এনআইডি, পাসপোর্ট ইত্যাদি।
ই-সেবা সরকারি বা জনসেবার সময় ও খরচ হ্রাস করে দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারে। এছাড়া এটি দূরবর্তী বা অনগ্রসর এলাকায় নাগরিকদের জন্য সেবার অভিগম্যতা (Access) বাড়াতে পারে। ই-সেবা স্বচ্ছতা বাড়াতে পারে এবং নাগরিকদের সাথে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে পারে। একইসঙ্গে এটি খরচ সাশ্রয়ী এবং তথ্য ব্যবস্থাপনায় উন্নতি করতে পারে। ই-সেবার উন্নতির লক্ষ্যে ন্যাশনাল ই-সাভিস সিস্টেম (NESS) এবং মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনগুলোকে (Mobile Applications) শক্তিশালী করে আমলাতান্ত্রিক পক্রিয়া সহজতর করতে পারে।


অর্থাৎ, কমিশন সংস্কারের অংশ হিসেবে জনবান্ধব, নৈতিক, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক, দক্ষ এবং কার্যকরি জনপ্রশাসনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রযুক্তি নির্ভর একটি নতুন দেশ গড়ার জন্য যেটুক দরকার সে বিষয়ে সুপারিশ প্রদান করেছে। 


৩. সরকার ডিজিটাল রূপান্তর ও ই-সেবা চালুর যে উদ্যোগ নিয়েছেন বোধকরি সরকারের এই উদ্যোগ যেন আলোর মুখ দেখে সেজন্য সংস্কার কমিশন প্রকৃত ডিজিটাল রূপান্তর ও টেকসই ই-সেবা বাস্তবায়ন এবং জন আকাঙ্ক্ষা পূরণে একটি গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সংস্কার প্রতিবেদনেই তার রুপরেখা বাতলে দিয়েছেন।  ‘জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন’ এর প্রতিবেদনের সপ্তম অধ্যায়ের ৭.১ ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের কাঠামো ও প্রক্রিয়াগত সংস্কার’-এ ১৩ তম সার্ভিস হিসেবে কমিশন ‘বাংলাদেশ তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি সার্ভিস (Bangladesh ICT Service) বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে। দুর্নীতি প্রতিরোধ,রেমিট্যান্স আহরণ, সম্পদের সুষ্ঠু বন্টন ও ব্যবস্থাপনা এবং জনভোগান্তি হ্রাসে আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়ন বোধকরি সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কমিশনের সুপারিশে আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়ন একটি স্বল্প মেয়াদী অর্থাৎ ছয় মাসে বাস্তবায়নযোগ্য লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে চিহ্নিত করে ৭.৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘এমতাবস্থায় সরকারি দপ্তরের আইসিটি কর্মকর্তাদেরকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সার্ভিসে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য সুপারিশ করা হলো” অর্থাৎ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত পিএসসি’র সুপারিশপ্রাপ্ত আইসিটি কর্মকর্তাদের নিয়ে কমিশন আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়নে সুপারিশ করেছে।

কিন্তু, গত ২০ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিক মন্ত্রিপরিষদ সচিবের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, যে কাজগুলো রাজনৈতিক  দলের মতামত ছাড়াই অল্প সময়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। এ জন্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের প্রস্তুতির জন্য পাঠানো হয়েছে। আমরা খোঁজ নিয়ে যতদূর জেনেছি, আইসিটি ডিভিশনে প্রেরিত সুপারিশে আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়নের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত নেই। আমরা  জানিনা সরকার আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়নের বিষয়টি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন কীনা? যদি পাঠিয়ে থাকেন তো সেটা সরকারের কথা ও কাজের মিলের প্রতিফলন হিসেবে আমরা সরকারকে ধন্যবাদ দিতে চাই কিন্তু যদি না পাঠিয়ে থাকেন তাহলে বিষয়টা সরকারকে দ্বিতীয় বার ভাবতে হবে। কেননা ঐকমত্য কমিশন যেখানে জনমুখী জনপ্রশাসন,  স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন, নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন এবং কার্যকর জনপ্রশাসনের স্বপ্ন দেখছে সঙ্গে সঙ্গে সরকার যেখানে নাগরিকরা যাতে সহজে ও অবাধে চাহিদামতো সরকারি সেবা পেত পারে, সকল সেবায় সকল নাগরিকের যেন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা যায়, দুর্নীতি ও ভোগান্তিমুক্ত সেবা প্রদান যেখানে অঙ্গীকার, স্বচ্ছতা বাড়ানোর মাধ্যমে নাগরিকদের সঙ্গে সরকারের যেখানে বিশ্বাসযোগ্যতার সম্পর্ক স্থাপনের প্রশ্ন সেখানে প্রযুক্তির প্রয়োগ না ঘটিয়ে সেবা প্রদান অসম্ভব। আর প্রযুক্তি যেখানে সেবা গ্রহণ ও সেবা প্রদানের মূল হাতিয়ার সেখানে আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়ন না হওয়া আত্মঘাতির শামিল। 

৪. জনপ্রশাসন কমিশন কাজ শুরু করার পর থেকে প্রায় ৪৯টি সভায় মিলিত হয়ে কমিশনের প্রতিবেদন ও সুপারিশ প্রণয়ন করে। জনপ্রশাসন সংষ্কারের বিষয়ে লিখিত পরামর্শ আহ্বান করে ১৩টি রাজনৈতিক দলের সম্মানিত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশসহ অন্যান্য দলের লিখিত পরামর্শ গ্রহণ করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়। এমনকি ইতোমধ্যে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর  শুরু হওয়া সংলাপেও  প্রথম দল হিসেবে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) থেকে শুরু করে বিএনপি, এনসিপি কিংবা অন্য কোনো দল আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়নে দ্বিমত পোষণ করেছে বলে জানা যায়নি। কোনো রাজনৈতিক দল নাগরিক সেবা প্রদানের সাথে জড়িত আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়নে দ্বিমত করবে বলেও আশঙ্কা নেই  সুতরাং, আমরা মনে করি সরকার তার নির্বাহী আদেশেই আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়ন করতে পারে। কেননা এতে যেমন সরকারের কোনো আর্থিক সংশ্লেষ নেই তেমনই বিষয়টি চাকরি আইন দ্বারাও স্বতঃসিদ্ধ। সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ ( ২০১৮ সনের ৫৭ নং আইন )
প্রজাতন্ত্রের কর্মবিভাগ সৃজন ও পুনর্গঠন, একীকরণ, সংযুক্তকরণ এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মে কর্মচারীগণের নিয়োগ ও তাহাদের কর্মের শর্তাবলি নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ এবং এতৎসংক্রান্ত বিদ্যমান বিধানাবলি সংহতকরণকল্পে প্রণীত আইন এর দ্বিতীয় অধ্যায় প্রজাতন্ত্রের কর্ম এবং কর্মবিভাগ সৃজন ও পুনর্গঠন- এ বলা আছে, (১) সরকার, সরকারি গেজেটে আদেশ দ্বারা, প্রজাতন্ত্রের যে কোনো কর্ম বা কর্মবিভাগ সৃজন, সংযুক্তকরণ, একীকরণ বা বিলুপ্তকরণসহ অন্য যে কোনোভাবে পুনর্গঠন করিতে পারিবে।   

অর্থাৎ সরকার সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী স্বল্প মেয়াদী সুপারিশ “বাংলাদেশ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সার্ভিস (Bangladesh ICT Service) বাস্তবায়ন নির্বাহী আদেশের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করতে পারে। 

৫. প্রজাতন্ত্রের নাগরিকদের আইনগত অধিকার নিশ্চিত করে নাগরিক সেবা প্রদান করাকে লক্ষ্য ধরে জনপ্রশাসনের প্রধান কাজই যে নাগরিকদের সেবা প্রদান করা। সে কথা জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। কমিশন নাগরিক সেবা প্রদানের বিষয়টির উপর গুরুত্বারোপ করে ই-গভর্ন্যান্স কার্যকরভাবে প্রবর্তনের  পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন। সরকারের ডিজিটাল রূপান্তর এবং ই-সেবা কিংবা কমিশনের সুপারিশ ই-গভর্ন্যান্স কোনোটাই সঠিক ভাবে বাস্তবায়ন হবে না যদি না আমরা কমিশনের সুপারিশ বাংলাদেশ আইসিটি সার্ভিস দ্রুতই বাস্তবায়ন করতে পারি। কেননা প্রযুক্তি নির্ভর যেকোনো সেবা প্রদানের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পরবর্তী প্রতিটা পদক্ষেপে আইসিটি জনবল সম্পৃক্ত থাকে ফলে সেই আইসিটি জনবলের দীর্ঘদিনের দাবী, তাদের অস্তিত্ব-ই যদি আমরা আগে নিশ্চিত করতে না পারি সঙ্গত কারণেই গৃহীত সব পদক্ষেপ অতীতের পতিত সরকারের ন্যায় মুখ থুবড়ে পড়বে এবং সরকারের আইসিটি সেক্টর যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থাকবে। তাই  আমরা মনে করি, শত শত শহীদের রক্তের বিনিময়ে ফিরে পাওয়া এই মাটি ও মানুষের অধিকার নিশ্চিতে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের স্বল্প মেয়াদী সুপারিশ বাংলাদেশ আইসিটি সার্ভিস বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার তার ডিজিটাল রূপান্তর ও ই-সেবা চালুর সকল উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারে। তাতে একদিকে জনগণের ভোগান্তিমুক্ত আইসিটি ভিত্তিক সেবা পাওয়ার অধিকার যেমন সুনিশ্চিত হবে অন্যদিকে শহীদদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে ঘোষনা করা কাঠামোগত সংস্কারের অঙ্গীকারও পূরণ হবে আর তা যদি না করতে পারি আমরা তবে একথা নিশ্চিত যে আমরা যেভাবেই আত্মপক্ষ সমর্থন করিনা কেন সাঈদ-মুগ্ধরা আমাদের কখনো কোনোদিন ক্ষমা করবে না।        

যুগ্মসচিব, গভর্নমেন্ট আইসিটি অফিসার্স ফোরাম 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

তুলসীর পর টাইমসে ভর : বাংলাদেশকে  কলঙ্কিত করার অপচেষ্টায় নতুন হাইপ

মোস্তফা কামাল
মোস্তফা কামাল
শেয়ার
তুলসীর পর টাইমসে ভর : বাংলাদেশকে 
কলঙ্কিত করার অপচেষ্টায় নতুন হাইপ

ঐতিহ্যগতভাবেই বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বর্গভূমি। বিশ্বব্যাপী এর স্বীকৃতি মডারেট মুসলিম দেশ হিসেবে। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব ধর্মের মানুষ নিয়ে এ দেশের সমাজ-সংস্কৃতি। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে তাদের বসবাস।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সম্পদ ও সৌন্দর্যও। বাংলাদেশের সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা ও অন্যান্য শিল্প মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির বেশ প্রভাব ও ছোঁয়া। এর বিপরীতে দেশটিতে গণ্ডগোল পাকাতেও সময়ে সময়ে ইস্যু করা হয় সাম্প্রদায়িকতাকে।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা রাজনৈতিক।

আবার ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলে অঘটন ঘটিয়ে রাজনৈতিক মোড়ক দেওয়ার ঘটনাও রয়েছে। কখনো কখনো বড় রকমের ইস্যু আড়াল করতে সাম্প্রদায়িক গোলমাল বাধানোর কাণ্ডকীর্তি এ অঞ্চলে বেশ কয়বার হয়েছে। সেনা, পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে সাধারণ মানুষের সচেতনতায় সেই অপচেষ্টা মারও খেয়েছে। এর পরও থেমে নেই অপচেষ্টাটি।
সামান্য সুযোগ পেলেই খাবলে ধরার মতো লয়ে পড়ে মহলবিশেষ।
  
কিছুদিন আগে একটি মিশন চালানো হয়েছিল ভারত সফরে আসা মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ডের ওপর ভর করে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন ‘গভীর উদ্বিগ্ন’ বলে তার দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ মহলটি বেশ আশাবাদী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসনের  অবস্থান বদলে গেছে—এ মর্মে তাদের প্রচারণা তুঙ্গে নেওয়ার চেষ্টা বুমেরাং হয়ে যায় অল্প ক’দিনেই। ট্রাম্পের সেন্ট্রাল প্রশাসন থেকে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিতে।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় বর্তমান সরকারের ভূমিকার প্রশংসা করেছে।

ওই বাস্তবতায় সেই যাত্রায় ব্যর্থ হয়ে এখন তা হাইপ তোলার অপচেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের ঘাড়ে চড়ে। ‘বাংলাদেশ নতুন করে গড়ে উঠছে, ইসলামী কট্টরপন্থীরা সুযোগ খুঁজছে’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিকে পুঁজি করে আবার একটা নাড়া দেওয়ার আয়োজন যে কারোই বোধগম্য। বিভ্রান্তিকর ও একপক্ষীয়’ মন্তব্যশ্রায়ী তথ্য দিয়ে হাইপ তোলার এ প্রকল্পে বিশাল বিনিয়োগ। প্রতিবেদনটি প্রকারান্তরে একটি প্রবন্ধ। যার বর্ণনায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক গতিশীলতাকে অতিসরলীকৃতভাবে দেখানো হয়েছে। সেই সঙ্গে অস্বীকার করা হয়েছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অগ্রগতিকে। বাছাই করা কিছু ঘটনা তুলে ধরে সাজানো প্রবন্ধটিতে রক্ষণশীল আন্দোলনের কথা বলা হয়েছে। যেখানে বাংলাদেশের নারী উন্নয়নে ঈর্ষণীয় অগ্রগতি, সেখানে নারীদের দেখানো হয়েছে অনগ্রসর করে। এবারের ‘যুব উৎসব ২০২৫ এখানে উদাহরণ হিসেবে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। যেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ২৭ লাখ মেয়ে অংশ নিয়েছে। তিন হাজার খেলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছে নারীরা। এই বিশাল ইভেন্টে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, আদিবাসী তরুণী ও বিভিন্ন স্তরের নারীদের যুক্ত হওয়া বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রাণবন্ততা প্রমাণ করে। একটি মাত্র ফুটবল খেলা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়া মানে এই নয় যে, বাকি দুই হাজার ৯৯৯টি সফল আয়োজনের মূল্য নেই। টাইমস তা-ই বোঝানোর চেষ্টা করেছে। একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে সামনে এনে গোটা অগ্রগতিকে খাটো করে দেখানো মোটেই সাংবাদিকতা নয়। এটি চাতুরীর রাজনীতি।
 
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার ওপরে। টাইমসের প্রতিবেদনে এর সামান্যতম উল্লেখ নেই। বেশ গুছিয়ে আরেকটি ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস চরমপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেননি ‘মন্তব্যে’র মধ্য দিয়ে। যা কেবল অসত্য-বিভ্রান্তিকরই নয়, বরং এটি তার দীর্ঘদিনের নারী ক্ষমতায়নের কাজকে অস্বীকার করা। ড. ইউনূসের নারীর ক্ষমতায়নের অন্তপ্রাণ চেষ্টা বিশ্বব্যাপী একটি রোল মডেল। গ্রামীণ ব্যাংক ও তার ক্যারিয়ারজুড়ে তিনি নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার স্বীকৃতি তাকে নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছে। 

বাংলাদেশের নারীরা দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও ক্রীড়াঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের লিঙ্গ সমতা সূচকে ৭৩তম অবস্থানে বাংলাদেশ। নারী ফুটবল ও ক্রিকেটে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। ২০২২ সালে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতকে হারিয়ে ইতিহাস গড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকে ৪০% কর্মকর্তা নারী। পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে হাজারো নারী কাজ করছেন। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো একজন নারী মেজর জেনারেল নিয়োগ দিয়েছে। অথচ নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশে নারীদের স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে ধর্মীয় সহিংসতা হিসেবে চিত্রিত করার অপচেষ্টাও চালানো হয়েছে। শেখ হাসিনার বিদায়ের পর যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে তা মূলত রাজনৈতিক এবং এর অনেকগুলো ঘটনাকে ধর্মীয় সংঘাত হিসেবে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই জনসমর্থন পেতে ধর্মকে ব্যবহার করে, যা সমস্যাটিকে আরো জটিল করে তোলে। রাজনৈতিক অস্থিরতাকে ধর্মীয় নিপীড়ন বলে চালানোর মওকা খোঁজা হয়। টাইমসেও তা করা হয়েছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর পর দিন তিনেক বাংলাদেশ ছিল পুলিশহীন, কার্যত সরকারহীন। এ সময়টাতে সাম্প্রদায়িক গোলমালসহ সামাজিক গণ্ডগোল পাকানোর চেষ্টা চলে।

অবাক-বিস্ময়করভাবে ছাত্র-জনতা, আলেম-ওলামারা তখন নিজ থেকেই এগিয়ে আসে ঐক্যের আলোকবর্তিকা হয়ে। তারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় দাঁড়িয়ে গেছে কারো নির্দেশ ছাড়াই। পাহারা দিয়েছে মন্দিরসহ বিভিন্ন স্থাপনা। দায়বদ্ধতা ও ঐক্যের ওই বাতাবরণ অটুট থাকলে এখন ঐক্য ঐক্য করে মাথা পানি করতে হয় না। ৮ আগস্ট ক্ষমতা নেয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষাকে টপ প্রায়োরিটি হিসেবে নিয়েছে। এই লক্ষ্যে সেনা-জনতা এক কাতারে দাঁড়িয়েছে। যা বাংলাদেশে চরমপন্থার বিরুদ্ধে একটি লাল সংকেত। এর পরও দেশে চরমপন্থার উত্থানের গল্প সাংবাদিকতার অপমান।

কারো বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশ এখন এশিয়ার অন্যতম সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক শক্তি। বিগত কয়েক মাসে বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল হয়ে উঠেছে এবং রপ্তানি প্রবৃদ্ধি প্রায় ১২ শতাংশ বেড়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথে রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে তা বিশ্বের নবম বৃহত্তম ভোক্তা বাজার হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও বেশ আলোচিত। বিস্ময়করভাবে বাংলাদেশ বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের চোখ-চশমায় ঘুরছে। কেবল গত সপ্তাহে ড. ইউনূসের চীন সফরের সময় বাংলাদেশ ২.১ বিলিয়ন ডলারের ঋণ, বিনিয়োগ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে।

‘ইনভেস্টরস কনফারেন্সে ৫০টি দেশের দুই হাজার ৩০০ প্রতিনিধিসহ মেটা, উবার, স্যামসাং-এর মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা অংশ নেবেন। পরিবর্তন ও অগ্রগতির এমন এক সন্ধিক্ষণে নিউইয়র্ক টাইমস অবিচার করেছে বাংলাদেশের ওপর। হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ, তাদের ঘরবাড়ি দখল, জ্বালাও-পোড়াও, মাজারে আক্রমণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাধা, নারীদের পোশাক নিয়ে কটূক্তি কিংবা পোশাকের কারণে নারীদের হেনস্থা করার মতো কিছু ঘটনাকে রঙিন মোড়কে সামনে এনে বাংলাদেশে উগ্রবাদের উত্থানের কাহিনি প্রচারের এজেন্ডা নতুন আয়োজনে আরো জোরদার করা হয়েছে। উগ্রবাদ এখন বৈশ্বিক সমস্যা। এর জেরে গণতন্ত্র একটি নতুন চ্যালেঞ্জে।

বাংলাদেশ আইন প্রয়োগ, সামাজিক সংস্কার ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী কার্যক্রমের মাধ্যমে তা মোকাবেলায় আগেভাগেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেখানে বিচ্ছিন্ন  কিছু উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর বক্তব্য ও কার্যকলাপকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সাথে পরিচায়ক করা দুরভিসন্ধিমূলক। বাংলাদেশে মৌলবাদীরা নারী ফুটবল বন্ধ করে দিয়েছে মর্মে পুরনো রেকর্ডটি নতুন করে বাজিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস। প্রসঙ্গক্রমে বলতেই হয়, জয়পুর হাটে ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়াজক কমিটি বিনা টিকেটে ফুটবল আয়াজনের অনুমতি নিলেও শর্ত ভঙ্গ করে টিনের বেড়া দিয়ে টিকেটের ব্যবস্থা করে। এতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এছাড়া মাঠের পাশে অশ্লীল নৃত্যের কারণে স্থানীয় কিছু ধর্মপ্রাণ মানুষের সাথে ভুল-বোঝাবুঝির ঘটনা ঘটে। তবে মূলত টিকিট ব্যবস্থার অনিয়মের কারণে সেখানে বিশৃঙ্খলা ঘটে যা নিয়ে মিডিয়ায় ভুলভাবে তথ্য ছড়ানো হয়৷ সেদিনের ম্যাচটি পরিত্যক্ত হলেও ৭  দিন পরে ম্যাচটি কোনো রকম অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই অনুষ্ঠিত হয়। অভিযোগ করা হয়েছে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রী হয়রানির শিকার হন। তবে এটি একটি ব্যক্তিগত অপরাধ, ধর্মীয় কোনো বিষয় নয়। আর পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে। এই ঘটনাগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় উগ্রবাদের রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আরো দাবি করা হয়েছে, ইসলাম অবমাননার শাস্তি না দিলে মৌলবাদীরা নিজেরাই বিচার করবে। ২০১৩ সালে একটি ইসলামি দল হাইকোর্টে ধর্ম অবমাননার শাস্তি বাড়ানোর দাবি জানিয়ে রিট করেছিল, যা আদালত খারিজ করে দেয়। বর্তমানে সরকার এই ধরনের কোনো দাবি গ্রহণ করেনি। 

দাবি করা হয়েছে যে নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোর বিক্ষোভ বেড়েছে। সরকার হিজবুত তাহরিরের মতো সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছে। গত এক বছরে ২০০ জনের বেশি উগ্রপন্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর যে মিছিলের কথা বলা হচ্ছে, তা বিগত ফ্যাসিষ্ট আওয়ামী সরকার ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র এর একটি অপচেষ্টা, যা বর্তমান সরকার ব্যর্থ করে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, এটি মুসলিম উগ্রপন্থীরা ছিল না, বরং হিন্দু উগ্রপন্থী সংগঠন ইসকনই সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে প্রবল আন্দোলন পরিচালনা করেছিল। সরকার এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলি পরিস্থিতি মোকাবিলায় অত্যন্ত ধৈর্যশীলতা দেখিয়েছে। দাবি করা হয়েছে নতুন সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সরিয়ে বহুত্ববাদ আনা হচ্ছে। বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে বহুত্ববাদ আনার দাবির বিষয়টি ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র এবং বহুত্ববাদ নিয়ে আলোচনা করেছে, তবে ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিলের কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়নি।

বহুত্ববাদ একটি সামাজিক ধারণা, যা বিভিন্ন ধর্ম, মতাদর্শ ও সংস্কৃতির সহাবস্থান নিশ্চিত করে, কিন্তু এটি ধর্মনিরপেক্ষতার বিপরীত নয়। বরং ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি এটি রাষ্ট্রীয় নীতিকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে। অতএব, সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা সরিয়ে ফেলা হচ্ছে-এমন তথ্য অসত্য ও বিভ্রান্তিমূলক। বাংলাদেশ আফগানিস্তান-পাকিস্তানের মতো উগ্রবাদী হচ্ছে তথ্যও একটি রটনা। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় দেশগুলো বলছে, মডারেট মুসলিম কান্ট্রি। বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে স্থিতিশীল দেশগুলোর একটি।
এরপরও একের পর এক অভিযোগের তীর যখন ছোঁড়া হচ্ছে, সেইক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতার আবশ্যকতা রয়েছে।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলা ভিশন

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ