<p>চলতি সপ্তাহে উত্তর কোরিয়ার একটি অস্ত্র পরীক্ষা দুই কোরিয়ার মধ্যে নতুন করে বিবাদের জন্ম দিয়েছে। পিয়ংইয়ং বলেছে, তারা একাধিক সর্বাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র বা সূচালো মাথাসম্পন্ন ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে এবং সিউল তাদের এই দাবি মিথ্যা বলে অভিযোগ করেছে। এর কয়েক ঘণ্টা পর উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম তাদের এই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা ‘সফল’ হয়েছে বলে ব্যাপক গুণগান গাইতে থাকে। প্রমাণ হিসেবে বৃহস্পতিবার এসংক্রান্ত কিছু ছবিও প্রকাশ করে।</p> <p>দক্ষিণ কোরিয়া পিয়ংইয়ংয়ের এই দাবিকে ‘প্রতারণা ও অতিরঞ্জন’ বলে অভিহিত করেছে। উত্তর কোরিয়া যে আসলে ব্যর্থ হয়েছে তা ইঙ্গিত করে তারা তাদের নিজস্ব প্রমাণ প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে বিশ্লেষকরাও উত্তর কোরিয়ার দাবির সত্যতা সম্পর্কে অনিশ্চিত থাকার কথা জানিয়েছেন।</p> <p>আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও উত্তর কোরিয়া যে অস্ত্র কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে তারা অস্ত্র কতটা উন্নত করে তুলছে, নানা জটিলতার কারণে সেটা যাচাই করা সহজ নয়। উত্তর কোরিয়ার সর্বশেষ দাবি সত্য হলে, এটাই প্রমাণিত হবে যে তারা ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে।</p> <p>একাধিক যুদ্ধাস্ত্র ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ করা কঠিন এবং এই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে যে প্রযুক্তি দরকার সেটা অর্জন করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। বর্তমানে শুধু যুক্তরাষ্ট্র এবং সেই সংগে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীনেরও এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধের সক্ষমতা রয়েছে বলে জানা গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ষাটের দশকে এ ধরনের প্রযুক্তি তৈরি করেছে। পিয়ংইয়ং এখন ঘোষণা করছে, তারাও এমন সক্ষমতা অর্জনের কাছাকাছি পৌঁছেছে। উত্তর কোরিয়া শেষ পর্যন্ত এমআইআরভি সক্ষমতা অর্জন করতে পারে কিছু সময়ের জন্য—এমন সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।</p> <p>এমআইআরভি হলো আলাদাভাবে একাধিক লক্ষ্যে নিক্ষেপ করা যায় এমন পুনঃপ্রবেশকারী যান। এটি এমন এক প্রযুক্তি, যেখানে একটি ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে বেশ কয়েকটি যুদ্ধাস্ত্র যুক্ত থাকে, যা উৎক্ষেপণের পরে আলাদা হয়ে যায়। এরপর যুদ্ধাস্ত্রগুলো তাদের নিজস্ব রকেট দিয়ে চালিত হয়ে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। এই যুদ্ধাস্ত্রগুলো বিভিন্ন গতিতে, একাধিক দিকে ছিটকে যায় এবং একে অপরের থেকে কয়েক শ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে এগুলো আঘাত করতে সক্ষম। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে অস্ত্রটিকে বিশেষভাবে কার্যকর বলে বিবেচনা করা হয়।</p> <p>পিয়ংইয়ং বৃহস্পতিবার বলেছে, তারা ‘সফলভাবে প্রতিটি মোবাইল যুদ্ধাস্ত্রের আলাদা হওয়া এবং দিক নিয়ন্ত্রণের পরীক্ষা’ করেছে। একটি মধ্যমপাল্লার কঠিন জ্বালানি ব্যবহার করা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রে যে প্রথম পর্যায়ের ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয় এই অস্ত্রে সেটি ব্যবহার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এতে তিনটি যুদ্ধাস্ত্র এবং একটি ডিকয় স্থাপন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।</p> <p>এ ছাড়া নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং যুদ্ধাস্ত্রগুলো কতো দূর পর্যন্ত উড়েছে সেটা পরিমাপ করতে ক্ষেপণাস্ত্রটি ১৭০ থেকে ২০০ কিলোমিটার, অর্থাৎ ‘সংক্ষিপ্ত পরিসরে’ নিক্ষেপ করা হয়েছে বলে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে।</p> <p>উত্তর কোরিয়া দাবি করেছে, প্রতিটি যুদ্ধাস্ত্র তাদের লক্ষ্যবস্তুতে ‘সঠিকভাবে’ আঘাত হেনেছে। অন্যদিকে এই অস্ত্রে যে ডিকয় স্থাপন করা হয়েছে সেটাও অ্যান্টিএয়ার রাডার সফলভাবে শনাক্ত করতে পেরেছে।</p> <p>এই পরীক্ষাটি উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র বাহিনীকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে ‘বেশ তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মনে করা হয়। এর মাধ্যমে উত্তর কোরিয়া ‘এমআইআরভি সক্ষমতা’ অর্জন করতে পেরেছে, যা তাদের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য ছিল বলে ধারণা করা হয়।</p> <p>দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক বাহিনী অবশ্য এই দাবিগুলোকে খণ্ডন করে বলেছে, ‘ফ্লাইটটি স্বাভাবিক ছিল না’ এবং অস্ত্রটি উড়ন্ত থাকার মাঝখানেই বিস্ফোরিত হয়েছে। তারা এসংক্রান্ত একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে, যেখানে এই অস্ত্র পরীক্ষার কিছু ছবি পাওয়া যায়। তাদের দাবি, ভিডিওর শুরুর দিকে এমন একটি ফ্লাইট দেখা গেছে, যা কিছুটা অস্থিতিশীল ছিল এবং পরে সেটা মধ্য আকাশেই বিস্ফোরিত হয়।</p> <p>দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা প্রচুর পরিমাণে ধ্বংসাবশেষ শনাক্ত করেছেন। একটি সফল পরীক্ষা চালানোর পর যে পরিমাণ ধ্বংসাবশেষ পাওয়ার কথা তার চাইতেও বেশি পরিমাণ ধ্বংসাবশেষ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন তারা। তারা আরো বলেছেন, উত্তর কোরিয়ার ছবিগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র থেকে যুদ্ধাস্ত্র ও ডিকয় আলাদা হওয়ার ছবি দেখানো হয়েছে।</p> <p>আসলে সেগুলো মার্চ মাসে চালানো একটি আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার ছবি বলে দাবি দক্ষিণ কোরিয়ার। দেশটির বার্তা সংস্থা ইয়োনহাপ বিশ্লেষকদের বরাতে জানিয়েছে, পরীক্ষাটি যে রেঞ্জে বা পরিসরে চালানো হয়েছে, সেটি সাধারণত আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষায় দেখা যায়। তাদের ধারণা, ক্ষেপণাস্ত্রটির দিক নির্দেশনার অভাব রয়েছে এবং এর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায়ও সমস্যা থাকতে পারে।</p> <p>অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন, পরীক্ষার কিছু অংশ সফল হয়েছে। যদিও অনেক কিছু এখনো জানা যায়নি। আসান ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজের গবেষক ইয়াং উক বিবিসিকে বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন, যুদ্ধাস্ত্রগুলো আকাশে উড়েছে এবং সেগুলো আলাদা হওয়ার কাজ ঠিকঠাক মতো হয়েছে। তবে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধাস্ত্রগুলো তাদের লক্ষ্যে পৌঁছেছে কি না উত্তর কোরিয়া এসংক্রান্ত প্রমাণ প্রকাশ করেনি। তাই আমরা বলতে পারি না যে তারা এখানে সফল হয়েছে।’</p> <p>এ ছাড়া জাপানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ক্ষেপণাস্ত্রটি সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার উচ্চতায় উড়েছে। এর অর্থ হলো এটি বাইরের মহাকাশে প্রবেশ করেনি বরং পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভেতরেই অবস্থান করেছে।</p> <p>ডঃ ইয়াং বলেন, এর মানে হলো ‘যুদ্ধাস্ত্রগুলো উচ্চতাপ ও চাপ সহনীয় কি না সেটা পরীক্ষা করা হয়নি। কোনো বস্তু একবার মহাকাশে ওঠার পর বায়ুমণ্ডলের দিকে পুনরায় নেমে আসার সময় এই তাপ বা চাপ সহ্য করতে হয়, তাই আমরা এই ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষমতা জানতে পারিনি।’</p> <p>সীমান্তে বসবাসকারী দক্ষিণ কোরীয়রা এই অস্ত্র পরীক্ষাটি দেখেছেন এবং এক বেসামরিক পর্যবেক্ষক এই অস্ত্র পরীক্ষার একটি ভিডিও ধারণ করেছেন, যা পরে দক্ষিণ কোরিয়ার গণমাধ্যম প্রকাশ করে। ওই ভিডিওতে আকাশে একটি দৃশ্যমান কনট্রেইল অর্থাৎ ওই ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের পর যেদিক বরাবর যায় সেদিকে একটি সাদা রেখা রেখে যায়, সেই রেখা দেখা গেছে।</p> <p>উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র বিশেষজ্ঞ ও মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সাবেক কর্মকর্তা ভ্যান ভ্যান ডিয়েপেন বলেছেন, ‘ভিডিওটি দেখে মনে হচ্ছে না সেখানে বড় কোনো বিস্ফোরণ হয়েছে বা ক্ষেপণাস্ত্রটি পরীক্ষার ক্ষেত্রে বিপর্যয়করভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।’</p> <p>উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম যে ছবিগুলো প্রকাশ করেছে সেখানে কনট্রেইল বা সাদা লাইনগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে দেখা গেছে। তিনি আরো বলেন, ‘তবে এসব দেখে এটা বলা যাবে না, এতে কোনো সূক্ষ্ম ব্যর্থতা ছিল না।’ যুদ্ধাস্ত্রগুলো ছাড়ার পর সেগুলো সফলভাবে নিজেদের মতো উড়েছে কি না এর কোনো স্বাধীন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।</p> <p>পরীক্ষা সফল হয়েছে কি না সে বিষয়ে প্রকৃত সত্য যাই হোক না কেন, এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট, তা হলো, উত্তর কোরিয়া হয়তো কিছুটা সাফল্য অর্জন করে থাকতে পারে। পর্যবেক্ষকরা জানিয়েছেন, পিয়ংইয়ং এই ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ থেকে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত তথ্য পাবে, এভাবে তারা তাদের এমআইআরভি সক্ষমতা অর্জনে নিজেদের এক ধাপ এগিয়ে রাখবে।</p> <p>ভ্যান ডিয়েপেন জানিয়েছেন, উত্তর কোরিয়া সরকার ২০২১ সালে প্রকাশ্যে এই লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। এমআইআরভি ক্ষেপণাস্ত্রের ‘উৎপাদনশীলতা’ বিবেচনা করে একে পুরস্কৃত করা হবে বলে। বিশেষ করে এমন পরিস্থিতিতে যেখানে শত্রুপক্ষ প্রথম আঘাত হানার পর উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র অস্ত্রাগার ক্ষয়প্রাপ্ত হতে পারে। এই সপ্তাহের পরীক্ষা সফল হলেও এই ধরনের অস্ত্রের বিকাশ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে তা যথেষ্ট হবে না বলে তিনি মনে করেন। তবে তিনি ধারণা করেন, উত্তর কোরিয়া সেই লক্ষ্য অর্জন থেকে ‘অন্তত কয়েক বছর দূরে’ রয়েছে।</p> <p>এই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা এমন সময়ে চালানো হয়েছে, যার কয়েক দিন পরই উত্তর কোরিয়ার পূর্ব নির্ধারিত পূর্ণাঙ্গ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে উত্তর কোরিয়ার কর্মকর্তারা বছরের প্রথম ছয় মাসে তারা কেমন কাজ করেছেন তা পর্যালোচনা করতে জড়ো হয়ে থাকেন। তাই এমন বৈঠকের ঠিক আগ মুহূর্তে এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা কাকতালীয় নাও হতে পারে।</p> <p>অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের মতে, উত্তর কোরিয়ার সামরিক বাহিনী তাদের সাফল্য প্রদর্শনের লক্ষ্যে জেনে বুঝে বৈঠকের আগেই ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করে থাকতে পারে। তবে এই অস্ত্র পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তর কোরিয়া ক্রমাগত প্রতিরোধ করে যাওয়ার একটি বার্তা দিতে পারে। সেই সঙ্গে শত্রুদের কাছে দেশটির ক্ষমতার একটি সংকেতও পাঠাতে পারে।</p> <p>উত্তর কোরিয়ার সর্বশেষ এই অস্ত্র পরীক্ষার প্রতিক্রিয়ায় ওয়াশিংটন সামান্য কিছু বলেছে। তারা এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে একটি সংক্ষিপ্ত যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেছে। তবে ভ্যান ডিয়েপেন বলেছেন, মার্কিন সরকার, যাদের কাছে উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র পরীক্ষার বিষয়টি বিশ্লেষণ করার সবচেয়ে ভালো উপায় রয়েছে, তারা এ বিষয়ে আলোকপাত করতে পারে, বরং সেটাই করা উচিত হবে। তিনি আরো বলেন, ‘অন্যথায় উত্তর কোরিয়া বিনা মূল্যে তাদের সফলতা প্রচারে জয় পেয়ে যাবে।’</p>