ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির এক আদালত প্রয়াত শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনের দুটি ‘আপত্তিকর’ চিত্রশিল্প বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। পাতিয়ালা হাউস কোর্টের ফার্স্টক্লাস জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এই নির্দেশ দিয়েছেন।
সম্প্রতি দায়ের করা এক অভিযোগে জানানো হয়, এম এফ হুসেনের আঁকা হিন্দু দেবদেবীসংবলিত দুটি চিত্রকর্ম দিল্লির এক চিত্র প্রদর্শনশালায় প্রদর্শন করা হয়েছিল, যা ‘ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করেছে’। অমিতা সচদেবা নামের পেশায় এক আইনজীবী ওই অভিযোগ দায়ের করেছিলেন।
এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে চলতি সপ্তাহে পুলিশকে ওই ‘আপত্তিকর’ চিত্রকর্ম বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন নয়াদিল্লির আদালত।
তবে এমন ঘটনা নতুন নয়। ২০১১ সালে ৯৫ বছর বয়সে প্রয়াত এই বিখ্যাত চিত্রশিল্পীকে তার চিত্রকর্মে হিন্দু দেবদেবীর নগ্ন ছবি চিত্রায়ণের জন্য প্রায়ই সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। যে প্রদর্শনীকে ঘিরে বিতর্ক সেটা আয়োজন করেছিল দিল্লি আর্ট গ্যালারি (ডিএজি)।
তবে ডিএজি কর্তৃপক্ষ সব অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছে, পুলিশ এই মামলায় ‘বিস্তারিত’ তদন্ত করেছে। পুলিশি তদন্তের সময় প্রদর্শনশালার পক্ষ থেকে কোনো রকম ‘বিচারযোগ্য অপরাধ’ পাওয়া যায়নি।
গত বছর অক্টোবর মাসে আয়োজন করা হয়েছিল ওই প্রদর্শনী। ‘হুসেন : দ্য টাইমলেস মডার্নিস্ট’ শীর্ষক ওই প্রদর্শনীতে ২৬ অক্টোবর থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত তার আঁকা শতাধিক চিত্রকর্ম প্রদর্শন করা হয়েছিল।
অভিযোগকারিণী অমিতা সচদেবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে লেখেন, গত ৪ ডিসেম্বর তিনি ডিএজির প্রদর্শনশালায় প্রদর্শিত ‘আপত্তিকর চিত্রগুলোর’ ছবি তুলেছিলেন। প্রয়াত শিল্পীর বিরুদ্ধে ওঠা আগেকার অভিযোগের বিষয়ে খোঁজ খবর করার পাঁচ দিন পর তিনি পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেন।
এরপর ১০ ডিসেম্বর সচদেবা জানান, তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে ওই চিত্র প্রদর্শনশালায় গিয়েছিলেন তিনি। সেই সময় তিনি লক্ষ করেন ওই দুটি চিত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তার অভিযোগ, প্রদর্শনশালার পক্ষ জোর দিয়ে বলা হয়, ওই দুটি চিত্র কখনো প্রদর্শনীতে রাখাই হয়নি।
এক্সে সচদেবা তার তোলা যে ছবি পোস্ট করেছেন, সেখানে নগ্ন নারীর পাশে হিন্দু দেবতা গণেশ ও হনুমানকে চিত্রিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে ওই আইনজীবী আরো অভিযোগ করেছেন, সংশ্লিষ্ট মামলার প্রতিবেদন জমা দিতে ‘ব্যর্থ হয়েছে’ দিল্লি পুলিশ।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এরপর অমিতা সচদেবা আদালতের দ্বারস্থ হয়ে প্রদর্শনশালার সেই সময়কার সিসিটিভি ফুটেজ সংরক্ষণের আবেদন জানান, যে সময় ওই দুটি চিত্র প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছিল বলে অভিযোগ করা হয়েছে। চলতি সপ্তাহের সোমবার নয়াদিল্লির পাতিয়ালা হাউস কোর্টের বিচারক জানান, সিসিটিভির ফুটেজ হাতে পাওয়ার পর সেই সংক্রান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়েছে পুলিশ। তদন্তে জানা গেছে, ব্যক্তিগত পরিসরে ওই প্রদর্শনী আয়োজন করা হয়েছিল এবং এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল প্রয়াত শিল্পীর নিজস্ব কর্মকে তুলে ধরা।
এদিকে ডিএজি কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তদন্তের সময় তাদের পক্ষ থেকে পুলিশকে সব ধরনের সাহায্য করা হয়েছে। একই সঙ্গে এ-ও জানানো হয়েছে, আনুমানিক পাঁচ হাজার দর্শককে আকৃষ্ট করেছে ‘হুসেন : দ্য টাইমলেস মডার্নিস্ট’ শীর্ষক প্রদর্শনী এবং ‘গণমাধ্যমের পাশাপাশি জনসাধারণের কাছ থেকেও ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া মিলেছে’।
প্রদর্শনশালার দাবি, ‘অভিযোগকারিণীই একমাত্র দর্শক, যিনি ওই প্রদর্শনীর কোনো শিল্পকর্ম নিয়ে আপত্তি তুলেছেন।’
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘অভিযোগকারিণী ইচ্ছাকৃতভাবে ওই ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও টেলিভিশনের খবর মারফত প্রচার করেছেন, যাতে আরো বড়সংখ্যক মানুষ তা দেখতে পায় এবং পাশাপাশি এই যুক্তিও দিয়েছেন যে ওই একই চিত্র তার ব্যক্তিগত ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করেছে।’
মকবুল ফিদা হুসেন ভারতের অন্যতম নামকরা চিত্রশিল্পীদের মধ্যে একজন ছিলেন। ‘ভারতের পিকাসো’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। লাখ লাখ ডলারে বিক্রি হয়েছে তার বিভিন্ন শিল্পকর্ম। কিন্তু তার বহু চিত্রশিল্পই ভারতে বিতর্কের সৃষ্টিও করেছে।
কর্মজীবনে একাধিক বিতর্কের মুখে পড়তে হয়েছে হুসেনকে। তার বিরুদ্ধে ‘অশ্লীলতার’ অভিযোগ যেমন তোলা হয়েছিল, তেমনি হিন্দু দেবীর নগ্ন চিত্র আঁকার পর কট্টরপন্থী হিন্দুদের নিন্দার সম্মুখীনও হতে হয়েছে এম এফ হুসেনকে। তার চিত্রকর্মের মধ্যে অন্যতম ‘মাদার ইন্ডিয়া’ নিয়ে বিতর্কের পর প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন এই চিত্রশিল্পী। এটা ২০০৬ সালের ঘটনা। ‘মাদার ইন্ডিয়া’ শীর্ষক চিত্রে এক নগ্ন নারীকে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে ভারতীয় মানচিত্রের আকৃতি তৈরি করতে দেখা যায়, যাকে ঘিরে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। সেই বছরই দেশত্যাগ করেন হুসেন এবং মৃত্যুর আগে পর্যন্ত লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসনেই ছিলেন তিনি।
এরপর ২০০৮ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট মকবুল ফিদা হুসেনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা শুরু করতে অস্বীকার করেন। শীর্ষ আদালতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, তার চিত্রকর্ম কোনোভাবেই ‘অশ্লীল’ ছিল না এবং ভারতীয় আইকনোগ্রাফি ও ইতিহাসে নগ্নতা কিন্তু ‘একটা সাধারণ বিষয়’।
ভোপাল, ইন্দোর ও রাজকোটে এম এফ হুসেনের বিরুদ্ধে দায়ের করা ফৌজদারি মামলা বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। সেই রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল করা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। সেই আবেদনও খারিজ করে দেন ভারতের শীর্ষ আদালত। সেই সময় একই সঙ্গে ভারতে বাড়তে থাকা ‘নতুন বিশুদ্ধতাবাদের’ সমালোচনা করেছিলেন সুপ্রিম কোর্ট।
হুসেনের যেসব চিত্রশিল্পের বিরুদ্ধে ‘ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত হানা’ এবং ‘জাতীয় অখণ্ডতাকে বিঘ্নিত করার’ অভিযোগ উঠেছিল সেই শিল্পকর্মের বিষয়ে ব্যাখ্যা করার জন্য তলব করার আবেদনও জানানো হয়েছিল। সেই সময় নির্বাসনে ছিলেন তিনি। সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে শিল্পকর্মের বিষয়ে ব্যাখ্যা করার জন্য তাকে ডেকে পাঠানোর সেই আবেদনও খারিজ করে দেওয়া হয়।
সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ‘এই জাতীয় বহু বিষয়, আলোকচিত্র ও প্রকাশনা রয়েছে। সেই সব কিছুর বিরুদ্ধে মামলা করবেন কি? মন্দিরের কাঠামোতে থাকা শিল্পের বিষয়ে কী বলবেন? হুসেনের কাজ শিল্প। যদি আপনি তা না দেখতে চান, তাহলে দেখবেন না। এই জাতীয় অনেক শিল্পের নিদর্শন তো মন্দিরের কাঠামোতে রয়েছে।’
প্রসঙ্গত, অনেকের মতে ভারতে শৈল্পিক ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। গত অক্টোবরে শুল্ক বিভাগকে তিরস্কার করেছিলেন বম্বে হাইকোর্ট। বিখ্যাত শিল্পী এফ এন সুজা ও আকবর পদমসির শিল্পকর্মকে ‘অশ্লীল’ আখ্যা দিয়ে বাজেয়াপ্ত করেছিল শুল্ক বিভাগ। মামলা সম্পর্কিত নিদেশ দেওয়ার সময় বম্বে হাইকোর্ট জানিয়েছিলেন, প্রতিটা নগ্ন শিল্পকলা বা যৌনতা সম্পর্কিত শিল্পই যে অশ্লীল, তা নয়। এ কথা জানিয়ে শুল্ক বিভাগের বাজেয়াপ্ত করা সাতটা শিল্পকর্ম ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত।
সূত্র : বিবিসি