গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ছয় মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। গত দেড় দশকে সীমাহীন লুটপাটের মাধ্যমে দেশকে জরাজীর্ণ করে ফেলা হয়েছিল। দেশের ব্যাংকিং খাতের রীতিমতো মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলা হয়েছিল। শঙ্কা কাটিয়ে রপ্তানি আয়েও সুখবর এসেছে।
প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকুক
- রপ্তানি আয়ে সুখবর

দেশ নানামুখী চ্যালেঞ্জ ও বহু ধরনের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেছে। এর মধ্যেও কিছু প্রাপ্তি, কিছু অর্জন আমাদের উৎসাহিত করে। গত সোমবার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) পণ্য রপ্তানি আয়ের যে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) দেশ থেকে মোট দুই হাজার ৮৯৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
দেশ এগিয়ে চলেছে—দেশপ্রেমিক যেকোনো মানুষের কাছে তা স্বস্তিকর, আনন্দদায়ক। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত থাকুক।
আমরা চাই বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত থাকুক। এ জন্য গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসহ অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। ব্যাংকঋণসহ পুঁজির জোগান বৃদ্ধি ও সহজলভ্য করতে হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমাতে হবে। এ থেকে শিল্প ও বাণিজ্যকে রক্ষা করতে হবে। সর্বোপরি বাজার বিস্তৃত করা ও নতুন নতুন বাজার সৃষ্টির চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। আমরা আশা করি, সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে এবং উত্তরোত্তর আরো সমৃদ্ধ হবে।
সম্পর্কিত খবর

শুল্ক-কর কমানো প্রয়োজন
- সংকটে নির্মাণশিল্প

দেশের অর্থনীতিতে এখন নানামুখী সংকট চলছে। সংকট উত্তরণে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও অনেক সংকট থেকেই গেছে। আগে থেকেই অর্থনীতির স্থবিরতা, এরপর ক্ষমতার পালাবদলের রেশ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, ব্যবসা-উদ্যোগে আস্থাহীনতা, ডলার সংকট, উচ্চ সুদহার, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা, রাজস্ব আয়ে বড় ঘাটতি—সব মিলিয়ে অর্থনীতি ঠিকমতো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এসবের প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান খাত নির্মাণশিল্পেও।
সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম বাস্তবায়িত হয়েছে। তা ১৭ শতাংশের কাছাকাছি। এর অর্থ হলো দেশের সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বলতে গেলে স্থবির।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমইএ) ও বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএ) নির্মাণ খাতকে এগিয়ে নিতে এ খাতের শুল্ক-কর কমানোর আহ্বান জানায়। তারা চায় আসছে বাজেটে সিমেন্টের মূল উপকরণ ক্লিংকারের শুল্ক প্রতি মেট্রিক টনে ৫০০ থেকে কমিয়ে ২০০ টাকা করা হোক। একইভাবে নির্মাণশিল্পের অন্যতম প্রয়োজনীয় উপকরণ স্টিলের নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক প্রত্যাহার ও শুল্কহার কমিয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণেরও প্রস্তাব উদ্যোক্তাদের।
আমরা মনে করি, নির্মাণ খাতকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে এ খাতের সঙ্গে জড়িত শতাধিক উপখাতকে টিকিয়ে রাখা, ব্যবসা চাঙ্গা করা এবং নতুন বিনিয়োগ-কর্মসংস্থান করতে হলে উদ্যোক্তাদের দাবিগুলো সদয় বিবেচনায় নিতে হবে। আসছে বাজেটে ব্যবসাবান্ধব নীতি গ্রহণ করা হলে অর্থনীতিতে যে স্থবিরতা বিরাজ করছে, তা অনেকটাই কেটে যাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে হবে
- মাদকের ভয়াবহ বিস্তার

শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্রই মাদকের ছোবল ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। তরুণরা তো বটেই, কিশোর-কিশোরীরাও মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। এর প্রধান কারণ মাদকের সহজলভ্যতা। হাত বাড়ালেই মাদক পাওয়া যায়।
মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) তথ্য মতে, দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা বেড়ে এখন দেড় কোটির কাছাকাছি।
বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা গেছে, সারা দেশে অনেক জায়গায়ই নিয়মিত মাদকের হাট বসে। রাজধানীতেও বেশ কিছু স্পটে মাদক বিক্রি হয়। অভিযোগ আছে, পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অবৈধ যোগসাজশেই সেগুলো পরিচালিত হয়। কথিত ‘সোর্সের’ মাধ্যমে বিরাট অঙ্কের আর্থিক লেনদেন হয়। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অবৈধ যোগসাজশের কারণেই মাদকের কারবার বিস্তার লাভ করছে। আরেকটি বড় কারণ সীমান্ত পেরিয়ে বিপুল পরিমাণ মাদক আসা রোধ করতে না পারা। পাশাপাশি মাদক মামলার বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, তদন্তের দুর্বলতা, জামিন পেয়ে কারবারিদের পুনরায় কারবারে নামা মাদকের বিস্তারে ভূমিকা রাখছে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
মাদক নিয়ন্ত্রণে কঠোর ও সমন্বিত কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। মাদকের অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। গডফাদারসহ ছোট-বড় সব কারবারিকে আইনের আওতায় আনতে হবে। মাদকসেবীদের চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। বিচারকাজের দীর্ঘসূত্রতা দূর করতে হবে।

অর্থনীতিতে আরো গতি আসুক
- যমুনা রেল সেতুর উদ্বোধন

যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একসময় দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ছিল সবচেয়ে অনুন্নত। ফেরিতে যমুনা নদী পার হতে ১০-১২ ঘণ্টাও লেগে যেত। শুষ্ক মৌসুমে ফেরি আটকে যেত চরে।
সড়কপথের তুলনায় রেলপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন অনেক বেশি সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব।
আমরা আশা করি, যমুনা রেল সেতুর মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেক বেশি গতি পাবে এবং ওই অঞ্চলের মানুষও উন্নত সেবা পাবে।

সুশাসন ফেরাতেই হবে
- ব্যাংক খাতে মূলধন ঘাটতি

ব্যাংক খাত মানুষের আস্থা, ভরসা ও নির্ভরতার প্রতীক। বিনিয়োগ-ব্যবসা-বাণিজ্য ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে অন্যতম সহায়ক হলো এই ব্যাংক খাত। কোনো দেশের অর্থনীতির রক্তপ্রবাহ হিসেবেও এই খাতকে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত কঠিন সংকট পার করছে।
মূলত খেলাপি ঋণ কিভাবে ব্যাংক খাতকে মূলধন ঘাটতির চোরাবালিতে নিয়ে যাচ্ছে সেই চিত্রই তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ভালো ও মন্দ ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রভিশন রাখতে পারছে না সরকারি ও বেসরকারি খাতের ১০টি ব্যাংক। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর শেষে এসব ব্যাংকে মোট প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ৫৬ হাজার ৩৬ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। গত জুনে এটি ছিল ৩১ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা। অর্থাত্ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ২৪ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা। ১৬টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতিও ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরানোর এবং এই খাত থেকে লুটে নেওয়া টাকা ফেরানোর চেষ্টা করছে। একইভাবে পাচার হওয়া লাখ লাখ কোটি টাকা ফেরাতেও বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু এসব পদক্ষেপ আরো ফলপ্রসূ ও জোরদার করতে হবে। ব্যাংক খাতে কঠোর নজরদারি করতে হবে। বিশেষ করে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ আদায়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। লুটেরা ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ত্বরিত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। মোটকথা, ব্যাংক খাতকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে মানুষ আস্থা ফিরে পায় এবং তারা যেন ব্যাংকমুখী হয়। ব্যাংক খাতে আস্থা না ফিরলে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য গতি পাবে না। এ বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের আরো বেশি কৌশলী ও জনবান্ধব নীতি গ্রহণ করতে হবে।