<p>হোমিও ওষুধ তৈরি কিংবা আসবাবের রঙে মেশানো স্পিরিটই প্রধান উপাদান। মেশানো হয় চিনি আর পচা পানির সিরা। এর সঙ্গে দেওয়া হয় গন্ধযুক্ত কিছু তরল রাসায়নিক, রং আর পানি। এই হলো কারবারিদের ভেজাল রসায়ন! মূল উপাদান সংগ্রহ করা হয় মিটফোর্ডসহ বিভিন্ন চোরাই মার্কেট থেকে। মেশানো তরল ঢোকানো হয় বিদেশি দামি ব্র্যান্ডের খালি মদের বোতলে। কখনো সামান্য আসল মদও জুড়ে দেওয়া হয়। এসব বোতল সংগ্রহ করা হয় পুরান ঢাকার ঠাটারীবাজার, মিটফোর্ড, লালবাগ ও চকবাজার থেকে। ছিপি এমনভাবে লাগানো হয়, মনে হবে বিদেশি মদের বোতল। মাত্র ৩০ থেকে ৫০ টাকা খরচে এভাবে তৈরি হচ্ছে রাশিয়ান, স্কটিশ, সুইডিশ ও ইংলিশ ব্র্যান্ডের ‘বিদেশি মদ’, যা ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হয় কয়েক হাজার টাকায়। ভাঙ্গারি দোকানে বসে এই ভেজাল মদ যিনি তৈরি করেন, তিনি সেই ভাঙ্গারি দোকানেরই কর্মচারী। গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তদন্তে উঠে এসেছে ঢাকা ও গাজীপুরে এমন ‘বিদেশি মদ’ সেবন করেই মারা গেছেন দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীসহ ছয়জন। গত সোমবার রাতে ভাটারা এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই চক্রের ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য।</p> <p>ডিবি পুলিশের কর্মকর্তা, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) কর্মকর্তা, রাসায়নিক বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে অবৈধভাবে বিদেশি মদের কারবারে কড়াকড়ি হওয়ায় ওয়্যারহাউস, বার, রিসোর্ট ও তারকা হোটেলে মদের সংকট দেখা দিয়েছে। এই সুযোগে অবৈধভাবে মদ বিক্রির সঙ্গে জড়িতরা এখন ভেজাল কারবারে নেমেছে। মদ ঝাঁজালো করতে তারা হোমিও ওষুধ ও রঙের উপাদান রেকটিফায়েড স্পিরিট (আরএস) মিশিয়ে দিচ্ছে। প্রায় ৯৫ শতাংশ অ্যালকোহলের এই রাসায়নিক সরাসরি পানে প্রাণহানি ঘটছে। মদের উপাদান হিসেবে প্রচলিত ইথানলের বদলে কম দামি ও ক্ষতিকর মিথানল মেশানো হচ্ছে। এই দুটি উপাদান বিক্রি করতে হলে ডিএনসির লাইসেন্স প্রয়োজন হলেও ওষুধ তৈরির অনুমোদন নিয়ে কিছু বড় প্রতিষ্ঠান আমদানি করছে। এ কারণে বাজারে প্রাণঘাতী দুই উপাদানের দেদার বিক্রি ঠেকাতে পারছে না ডিএনসি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত দুই সপ্তাহে ঢাকাসহ সারা দেশে ২০ জনের মৃত্যু এবং অর্ধশতাধিক অসুস্থ হয়েছে এই ভেজাল কারবারে। গ্রেপ্তার হওয়া চক্র ছাড়াও ঢাকায় কয়েকটি চক্র এই কারবার করছে, যাদের ধরতে মাঠে নেমেছেন ডিবি ও ডিএনসি গোয়েন্দারা।</p> <p>ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, গত সোমবার রাতে তেজগাঁও ও ভাটারায় অভিযান চালিয়ে মনতোষ চন্দ্র অধিকারী আকাশ (৩৫), রেদুয়ান উল্লাহ (৩৫), সাগর বেপারী (২৭), নাসির আহমেদ রুহুল (৪৮), জাহাঙ্গীর আলম (৪৫), সৈয়দ আল আমিন (৩০) নামের ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।  এ সময় নকল বিদেশি মদ, খালি মদের বোতল, বোতলের মুখ আটকানো কর্ক, স্টিকার, স্পিরিট, কৃত্রিম রং, সিলগালার সামগ্রী, হলোগ্রামসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। গত এক সপ্তাহে তাঁরা ২৩১ বোতল মদ বিক্রি করেছেন। ঢাকায় ছয়জনের মৃত্যুর ঘটনায় তাঁরা ভেজাল মদ সরবরাহ করেছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে।</p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2021/02.February/03-02-2021/Kalerkantho_21-02-03-32.jpg" /></p> <p><em>ভেজাল মদ কারখানা থেকে গ্রেপ্তাকৃতদের চারজন। ছবি : কালের কণ্ঠ</em></p> <p>ডিবির সূত্র জানায়, গত ১৮ জানুয়ারি রাজধানীর ভাটারার নূরেরচালা এলাকায় মদপানে অসুস্থ হয়ে মারা যান স্বর্ণালী বাগচী তন্বী নামের এক তরুণী। ময়মনসিংহে গ্রামের বাড়িতে তাঁর লাশ সৎকারের পরই অসুস্থ হয়ে মারা যান তাঁর দুই বন্ধু শরীফুল ইসলাম নাঈম (২৭) ও সারোয়ার হোসেন অভি (২৭)। ময়মনসিংহের পুলিশের সন্দেহ হলে ভাটারার পুলিশকে ঘটনাটি জানায়। ভাটারায় তাঁদের ভাড়া বাসায় পুলিশ তল্লাশি চালিয়ে মদের দুটি বোতল জব্দ করে। বোতলে সামান্য পরিমাণে মদ ছিল। অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক পরীক্ষায় প্রাথমিকভাবে ওই আলামতে বিষাক্ত উপাদানের উপস্থিতি মেলে। ভাটারা থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করেন এক স্বজন। এরই মধ্যে গত রবিবার হাসপাতালে মারা যান একটি বেসরকারি সংস্থার কর্ণধার। তিনি বন্ধুকে অফিসে বিদেশি মদ পান করান। গত বৃহস্পতিবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে সাড়ে সাত হাজার টাকায় একটি ভদকা মদের বোতল কেনেন। ওই মদ পান করার পরেই তিনি মারা যান। তাঁর বন্ধু ধানমণ্ডির একাধিক হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। এ ছাড়া গত শুক্রবার উত্তরার একটি রেস্তোরাঁয় পার্টিতে মদ পান করেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ বন্ধু। এঁদের মধ্যে দুই বন্ধু এরই মধ্যে মারা গেছেন। গত রবিবার গাজীপুরের একটি রিসোর্টে মদপানে অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন একটি বেসরকারি সংস্থার তিন কর্মকর্তা।</p> <p>এসব ঘটনার পর তদন্তে নামে ডিবি পুলিশ। গত সোমবার রাতে তেজগাঁওয়ের ইয়ানতুন চায়নিজ রেস্টুরেন্টের সামনে থেকে আকাশ, <img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2021/02.February/03-02-2021/Kalerkantho_21-02-03-34.jpg" style="float:left; height:475px; margin:8px; width:180px" />রেদুয়ান উল্লাহ ও সাগর বেপারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ডিবি। এতে বেরিয়ে আসে মোহাম্মদপুরের দুই শিক্ষার্থী এবং ভাটারার তিনজন তাঁদের মদপানেই মারা গেছেন। তাঁদের তথ্যের ভিত্তিতে ভাটারার খিলবাড়ীরটেক এলাকার একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালানো হয়। সেখানে পাওয়া যায় কারখানার মালিক নাসির আহমেদ রুহুল, ব্যবস্থাপক সৈয়দ আল আমিন ও কথিত চিফ কেমিস্ট জাহাঙ্গীর আলমকে।</p> <p>ডিবির উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি গুলশান) মশিউর রহমান বলেন, ভাঙ্গারি দোকানের কর্মচারী জাহাঙ্গীর আলম বানাতেন এই ভেজাল মদ। নাসির এই দলের প্রধান। তাঁরা অনেক দিন ধরে এই অপকর্ম করছেন। প্রাথমিক তদন্তে ছয়জনের মৃত্যুর জন্য তাঁদের জড়িত থাকার সত্যতা মিলেছে। আরো কেউ জড়িত কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।</p> <p>অভিযানের সময় কথিত চিফ কেমিস্ট জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এক ড্রাম (২০ লিটারের বেশি) স্পিরিটে ৫০ লিটারেরও বেশি মদ বানানো যায়। ৩০ টাকা খরচ হলেও ওই মদ বিক্রি হতো ৫০০ থেকে আড়াই হাজার টাকায়। দলের প্রধান নাসির আগে মদের দোকানে কাজ করতেন। এ কারণে মদ কিভাবে বিক্রি করতে হয় এবং গ্রাহক কারা, তা জানতেন তিনি। এই সূত্রে কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করেন অপকর্ম। গ্রেপ্তারের পর নাসির বলেন, ‘খালি বোতল এনে স্পিরিট ও পানি মিশিয়ে মদ বানানোর পর আমরা আল-আমিনের কাছে দিই। সে বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে।’ গ্রেপ্তারের পর আল-আমিন বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় আমি গিয়ে এগুলো বিক্রি করি।’</p> <p>জানতে চাইলে ডিএনসির উপপরিচালক (ঢাকা মেট্রো) মানজুরুল ইসলাম বলেন, নতুন আইনে রেকটিফায়েড স্পিরিটের মতোই মিথানল মাদকের একটি উপাদান। আইন অনুযায়ী এগুলো সংরক্ষণ ও বিক্রি করতে ডিএনসির লাইসেন্স লাগে। তবে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে এবং আদালতের অনুমোদন পেয়ে এগুলো আমদানি করছে।</p> <p>ডিএনসির আরেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “হোমিওসহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধ তৈরির চাহিদা দেখিয়ে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ‘ফিনার’ হিসেবে কাস্টমসের অনুমোদন নিয়ে মিথানল এবং ‘ব্লক লিস্টে’ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়ে রেকটিফায়েড স্পিরিট আমদানি করে। এসব উপাদান পরবর্তী সময়ে কাঁচামাল ও প্রক্রিয়াকরণ হিসেবে বিক্রি হচ্ছে।”</p> <p>ডিএনসি ও ডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, মদপানে মৃত্যুর ঘটনায় মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনের বিধিমালায় অবৈধভাবে মদ তৈরি ও বিক্রির অভিযোগে মামলা করার পাশাপাশি দণ্ডবিধির হত্যার অভিযোগ দায়ের করার সুযোগ আছে।</p> <p>সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ওয়্যারহাউস থেকে শুধু বিদেশি নাগরিকরা শুল্কমুক্ত মদ কিনতে পারে। আগে ওয়্যারহাউস থেকে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি অবৈধ পথে শুল্কমুক্তভাবে যে মদ বিদেশিদের কাছে বিক্রি করার কথা, তা বের করে বাইরে বার, রিসোর্ট, হোটেলে সরবরাহ করতেন। করোনার মধ্যে প্রশাসন ওয়্যারহাউস থেকে অবৈধভাবে বাইরে মদ যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। এ কারণে বাজারে মদের ব্যাপক সংকট তৈরি হয়েছে। </p>