এতে নবীন-প্রবীণ কর্মকর্তাদের মিলনমেলায় পরিণত হয় সভাটি। বড়দিনের সরকারি ছুটির দিনেও মিলনায়তন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের জেলা সভাপতি হিসেবে ঢাকার বাইরের জেলা প্রশাসকরা অনলাইনে এই প্রতিবাদসভায় অংশ নেন। ঢাকার জেলা প্রশাসক (ডিসি) তানভীর আহমেদ সশরীরে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দেন।
বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএসএ) মহাসচিব মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমানের সঞ্চালনায় প্রতিবাদসভায় বক্তব্য দেন প্রশাসনের ১৯৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তা মাহমুদ হোসেন আলমগীর, সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব ও ১৯৭৯ ব্যাচের এস এম জহিরুল ইসলাম, ১৯৮১ ব্যাচের হেলালুজ্জামান, ১৯৮৪ ব্যাচের এম এ খালেক, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এ এস এম সালেহ আহমেদ, আবু ইউসুফ, ১৯৮৫ ব্যাচের মোহাম্মদ মসিউর রহমান, ১৯৮৬ ব্যাচের মো. জাকির হোসেন কামাল, শামীম আল মামুন, ঢাকার জেলা প্রশাসক তানভীর আহমেদ, উপসচিব নূরুল করিম ভুঁইয়া, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টার একান্ত সচিব মো. সারওয়ার আলম, পররাষ্ট্র উপদেষ্টার একান্ত সচিব মো. সামিউল মাসুদ, ২৮ ব্যাচের খন্দকার মুশফিক রহমান, ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. বদরুদ্দোজা, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহীদুল ইসলাম, যুগান্তরের উপসম্পাদক বি এম জাহাঙ্গীর, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ প্রমুখ। এ ছাড়া বৈঠকে অনলাইনে যুক্ত ছিলেন দেশের সব বিভাগীয় কমিশনার এবং জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)।
সভায় বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি এ বি এম আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘আমরা আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মুয়ীদ ভাইয়ের অপসারণ চাই। সরকার যদি অপসারণ না করে, কিভাবে অপসারণ করতে হবে সেই কৌশল আমাদের জানা আছে।’
প্রতিবাদসভায় আরো একাধিক কর্মকর্তা জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধানের পদত্যাগ দাবি করে কমিশন পুনর্গঠনের আহবান জানান। বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব সোহেল রানা সিভিল সার্ভিসের বিভিন্ন ইতিহাস ও নানা তথ্য তুলে ধরেন। একই সঙ্গে উপসচিবের পদটি শুধু যে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য হওয়া উচিত, তার পক্ষে নানা যুক্তি তুলে ধরেন। উপসচিব পদ নিয়ে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, এটি বৈষম্যমূলক, অযৌক্তিক ও ষড়যন্ত্রমূলক। রাষ্ট্রকে দুর্বল করার কোনো প্রচেষ্টা চলছে কি না, এটাও আমাদের দেখতে হবে।’

কঠোর কর্মসূচির হুমকি ও ছয় দফা : বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আনোয়ার উল্ল্যাহ কঠোর কর্মসূচির হুমকি দেন এবং নিজেদের ছয় দফা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ‘প্রথমত, আমরা এক আছি, এক থাকব। দ্বিতীয়ত, আমরা প্রশাসন ক্যাডারের ওপর কোনো রকমের সার্জারি বা কোটা আরোপ করতে দেব না। তৃতীয়ত, কমিশন কোনো অযাচিত সুপারিশ করলে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। চতুর্থত, প্রশাসনে কোনো পর্যায়ে অন্ধভাবে বহিরাগত কাউকে বসানোর চেষ্টা করা হলে তা কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে। পঞ্চমত, পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে বঞ্চিত কর্মকর্তাসহ সব ধরনের কর্মকর্তাকে সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অবিলম্বে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ষষ্ঠত, দেশকে কোনোভাবে অস্থিতিশীল করার জন্য যেকোনো ধরনের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করার জন্য প্রশাসন সারা দেশে সতর্ক থেকে দায়িত্ব পালন করবে।’ এ সময় উপস্থিত কর্মকর্তারা তাতে সম্মতি দেন।
সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব ও ১৯৭৯ ব্যাচের কর্মকর্তা এস এম জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসকে দুর্বল করতে ষড়যন্ত্র এটিই প্রথম নয়, অতীতেও এ ধরনের ষড়যন্ত্র হয়েছে; কিন্তু কোনো কাজে আসেনি। এখনো কিছুই হবে না, যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকি।’
বিসিএস ১৯৮১ ব্যাচের কর্মকর্তা হেলালুজ্জামান বলেন, যাদের কারণে গত ১৫ বছর প্রশাসনের শত শত কর্মকর্তাকে বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে, সেই কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। তাঁদের বিচার করতে হবে।
প্রশাসনের ১৯৮৫ ব্যাচের কর্মকর্তা মশিউর রহমান বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল কোটা তুলে দেওয়ার জন্য। সংস্কার কমিশনের উচিত এই কোটা তুলে দেওয়া। কিন্তু সেটা না করে তাঁরা উল্টো কোটা বাড়ানোর চিন্তা করছেন, এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। এই কমিশনের মাধ্যমে কর্মকর্তারা সুবিচার পাবেন না। তাই তাঁদের পদত্যাগ দাবি করছি।’
বিসিএস নবম ব্যাচের কর্মকর্তা জাকির হোসেন কামাল বলেন, ‘জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীকে পদত্যাগ করতে হবে। শুধু পদত্যাগ করলেই হবে না, সব স্টেকহোল্ডারকে নিয়ে এই সংস্কার কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। তিনি নিজে কি পরীক্ষা দিয়ে পদোন্নতি পেয়েছিলেন? তাহলে আমাদের বাচ্চাদের কেন পরীক্ষা দিতে হবে?’
ঢাকার ডিসি তানভীর আহমেদ তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘জেলা ও উপজেলায় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ক্ষমতা এরশাদ সরকারের আমলে খর্ব করা হয়েছে। এখন কেন্দ্রীয়ভাবে সেই ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা কোটামুক্ত পদোন্নতি চাই। এখনো আমাদের পদোন্নতির জন্য মাঠ পর্যায়ের একজন কনস্টেবলের প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এটা খুবই অবমাননাকর। পদোন্নতির ক্ষেত্রে গোয়েন্দা প্রতিবেদন তুলে দিতে হবে।’
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘যার কাজ তাকে করতে দিন। অন্যকে অন্যের কাজে দেবেন না। এর ফল ভালো হবে না। যিনি যে ক্যাডারে প্রবেশ করেছেন, তিনি সেখানে থেকে দেশ ও জাতিকে সর্বোচ্চ সেবা দিন—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’
যুগান্তরের উপসম্পাদক বি এম জাহাঙ্গীর বলেন, ‘প্রশাসন ক্যাডারকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। দেশের জন্য দক্ষ, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী প্রশাসন দরকার। চূক্তিভিত্তিক নিয়োগ, কোটার নিয়োগ তুলে দিন। মেধার ভিত্তিতে সব পর্যায়ে নিয়োগ হবে। কর্মকর্তাদের দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। প্রশাসনে পুরনো ঐতিহ্য ফেরত আনতে হবে। আগামী দিনে যাঁরা ক্ষমতায় আসবেন তাঁদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা নিজের লোক খুঁজবেন না। কারণ প্রশাসনের সব লোক রাষ্ট্রের।’
বিসিএস ২৫ ব্যাচের সভাপতি উপসচিব নূরুল করিম ভুঁইয়া বলেন, ‘আমরা কোনো নোংরা প্রতিযোগিতায় নামতে চাই না। এক কথা আমাদের, আমরা প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তা, আমাদের আলাদা সার্ভিস হতে হবে। আমরা কারো আঙিনায় যাব না, আমাদের পরিধিতে কাউকে আসতে দেব না। কোটামুক্ত পদোন্নতি হতে হবে।’
জানা যায়, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন এখনো তাদের সুপারিশ জমা দেয়নি। কিন্তু গত ১৭ ডিসেম্বর সচিবালয় বিটের সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেন, পরীক্ষা ছাড়া সিভিল সার্ভিসের উপসচিব ও যুগ্ম সচিব পর্যায়ে কেউ পদোন্নতি পাবেন না। উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য ৫০ এবং অন্য ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ কর্মকর্তা নেওয়া হবে। বিদ্যমান বিধিমালা অনুযায়ী, উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডারের ৭৫ শতাংশ এবং অন্য সব ক্যাডারের ২৫ শতাংশ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মতো স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে ক্যাডার সার্ভিস থেকে আলাদা করার জন্য সরকারকে সুপারিশ করা হবে। এমন খবরে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন প্রশাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ক্যাডারসহ সব ক্যাডার কর্মকর্তা।