বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি মার্চ মাসের প্রথম ২৬ দিনে ২৯৪ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এলেও গত বছরের একই সময় আসে ১৯৭ কোটি ডলার; হিসাব অনুযায়ী যা আগের বছরের তুলনায় ৪৯.৪৯ শতাংশ বেশি।
গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রথম ঈদ সমাগত। বিদেশ থেকে প্রবাসীরা বৈধ পথে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি পরিমাণে রেমিট্যান্স বা প্রবাস আয় পাঠাচ্ছেন। ব্যাংকাররা বলছেন, মূলত অর্থপাচার কমে আসায় প্রবাসীরা তাঁদের আয় পাঠাতে বৈধ পথ বেছে নিয়েছেন। এর ফলে পবিত্র রমজান মাসে প্রবাস আয়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে।
প্রবাস আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাংকগুলোয় ডলারের যে সংকট চলছিল, তা অনেকটা কেটে গেছে বলে কর্মকর্তারা জানান। তাঁরা বলেন, ডলারের দাম নিয়ে অস্থিরতাও কমেছে। ব্যাংকগুলো এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ ১২৩ টাকার মধ্যেই প্রবাস আয় কিনছে।
মার্চ মাসে রেমিট্যান্সপ্রবাহ : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনে প্রবাস আয় আসে ১৬৬ কোটি ডলার। চার দিন পর, অর্থাৎ ১৯ মার্চে ব্যাংকিং চ্যানেল তথা বৈধ পথে আসা প্রবাস আয় দাঁড়ায় ২২৫ কোটি ডলার। এর মধ্যে শুধু ১৯ মার্চ এক দিনেই এসেছে ১৩ কোটি ডলার। আবার ১ থেকে ২২ মার্চ তথা মাসের প্রথম ২২ দিনে প্রবাস আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৪৩ কোটি ডলার, যা ২৪ মার্চে বেড়ে ২৭০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। ২৬ দিনে আয় বেড়ে হয় ২৯৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে গড়ে ১১ কোটি এবং দ্বিতীয় সপ্তাহে গড়ে ১২ কোটি ডলার করে এসেছে।
সাধারণত দুই ঈদের আগে প্রবাস আয় বছরের অন্য যেকোনো মাসের চেয়ে বেশি আসে। গত বছর পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে পাঁচ দিনেই ৪৫ কোটি ডলারের প্রবাস আয় এসেছিল। অর্থাৎ দিনে গড়ে ৯ কোটি ডলার করে এসেছিল। পরের চার দিনে প্রবাসীরা অর্থ পাঠানো আরো বাড়িয়ে দেন।
দেশে গত বছরের আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে সাত মাস ধরে প্রতি মাসে ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি মাসে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ২৫২ কোটি ৮০ লাখ ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি। এ বছরের জানুয়ারিতে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রবাস আয় ৩ শতাংশ বেশি আসে।
সব মিলিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাস জুলাই-মার্চে প্রবাসীরা দেশে এক হাজার ৮৪৯ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন, যা এর আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৪ শতাংশ বেশি। আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে প্রবাস আয় এসেছিল এক হাজার ৪৯৩ কোটি ডলার।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা করে প্রবাস আয়ের ডলার কেনা এখন অনেকটা কমে এসেছে। এতে ডলারের দাম ১২৩ টাকার মধ্যেই রয়েছে। এতে পণ্য আমদানিতেও ডলারের দাম কম পড়ছে। ফলে আমদানি খাদ্যপণ্যের দাম সেভাবে বাড়েনি। আগে একসময় প্রতি ডলারের দাম ১২৮ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, অর্থপাচার প্রতিরোধে বর্তমান সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। আবার ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠিয়ে প্রণোদনাসহ এখন যে পরিমাণ টাকা পাওয়া যাচ্ছে, তা খোলাবাজারের চেয়েও বেশি। সাধারণভাবে হুন্ডি চাহিদা কমলে এমন হয়। অন্যদিকে রপ্তানি আয়ও বাড়ছে। ফলে ডলার বাজারে স্বস্তি ফিরেছে। রিজার্ভও স্থিতিশীল হয়ে এসেছে।
বেসরকারি একটি ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, অর্থপাচার প্রতিরোধে বর্তমান সরকার বেশ সক্রিয়। পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে ১১টি যৌথ বিশেষ টিম কাজ করছে। শেখ হাসিনা পরিবার এবং ১০টি ব্যবসায়ী গ্রুপের অর্থপাচার, অনিয়ম ও জালিয়াতির তথ্য উদঘাটনে এসব টিম বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে। রেমিট্যান্স চাঙ্গা হওয়ার পেছনে এসব উদ্যোগের ভূমিকা রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন দেশের ব্যাংকগুলোতে ১২২ টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে ডলার। খোলাবাজারের সঙ্গে ব্যাংক রেটের পার্থক্য দুই থেকে আড়াই টাকা। কারণ খোলাবাজারে ১২৪ থেকে ১২৪.৫ টাকার মধ্যেই লেনদেন হচ্ছে প্রতি ডলার।
তথ্য বলছে, গত (২০২৪) বছরের মার্চে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলারের নির্ধারিত দাম ছিল ১১০ টাকা। কিন্তু নির্ধারিত দামে ডলার পাওয়া যাচ্ছিল না। আমদানি বিল পরিশোধের জন্য নির্ধারিত দামের বাইরে প্রতি ডলারে আরো ১৩ টাকা পর্যন্ত পে-অর্ডারের মাধ্যমে দিতে হয়েছে। এতে প্রতি ডলারের দাম পড়েছে ১২৩ টাকা। খোলাবাজারে ডলারের উত্তাপ ছিল আরো বেশি। কিন্তু বাংলাদেশের সব ব্যাংকের নথিপত্রে আমদানিতে ডলারের সর্বোচ্চ দর ১১০ টাকা। তবে বাস্তবে ডলারের দাম আরেক। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত বছর কয়েকটি ব্যাংকের ট্রেজারিপ্রধানকে জরিমানাও করা হয়। তবে ২০২৫ সালের ঈদে সেই চিত্র একেবারেই ভিন্ন।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রবাসীরা সব সময় দেশে টাকা পাঠান। তবে যেকোনো উৎসবে তাঁরা রেমিট্যান্স বেশি পাঠান। কারণ ওভারটাইম, বোনাস ইত্যাদি পেলে পরিবারের কাছে তাঁরা বেশি টাকা পাঠান। তা ছাড়া ব্যাংকিং চ্যানেলে এখন পাচার প্রায় বন্ধ। হুন্ডি বন্ধ না হলেও আগের মতো হচ্ছে না। এটা পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়। এসব কারণে রেমিট্যান্স বেড়েছে। হুন্ডি নিয়ন্ত্রণ ও পাচার বন্ধের বিষয়টি নতুন সরকার ভালোভাবে ম্যানেজ করছে। তা ছাড়া এখন স্কিলড লেবার পাঠানের প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে, যাঁদের বেতন তুলনামূলক বেশি। এখন খোলাবাজার ও ব্যাংকের রেটে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। ১২২ টাকা, ১২৪ টাকা ভালো রেট। সরকারি প্রণোদনা অব্যাহত এবং ক্যাম্পেইন করলে প্রতিবছর ৩৫ থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স সংগ্রহ করা সম্ভব। প্রবাসী ভাইদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা, যাতায়াতে ভোগান্তি দূর করাসহ রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের যথাযথ মর্যাদা দেওয়ার পরামর্শ এই বিশ্লেষকের।