<p>৫৭১ খ্রিস্টাব্দ : দুনিয়ায় আল্লাহ তাআলা প্রেরিত শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) এ বছর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম তারিখ নিয়ে খুব বেশি বিতর্ক নেই। আগের ঐতিহাসিকদের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্য ৫৭০ খ্রিস্টাব্দ তাঁর জন্ম বছর বলে উল্লেখ করেন। প্রকৃতপক্ষে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে পিতা আবদুল্লাহর ঔরসে ও মাতা আমেনার গর্ভে তিনি আগমন করেন। ৫৭১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভূমিষ্ঠ হন।</p> <p>খ্রিস্টীয় পঞ্জিকা অনুযায়ী তাঁর জন্ম তারিখ ২০ এপ্রিল। আরবি হিজরি সন অনুযায়ী তারিখটি ৯ রবিউল আউয়াল। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ বলেছেন, ১২ রবিউল আউয়াল।</p> <p>তবে দিন হিসেবে সোমবার সম্পর্কে মতভেদ নেই। কারণ জীবনচরিতকাররা একমত যে রবিউল আউয়াল মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে সোমবার দিন নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম। এই সোমবার ৮ অথবা ৯ কিংবা ১২—এটুকুতেই হিসাবের পার্থক্য রয়েছে মাত্র। (ইসলামী বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা)</p> <p>তবে নবী (সা.)-এর প্রথমদিককার জীবনীকারদের অন্যতম ইবনে হিশাম তাঁর গ্রন্থের পাদটীকায় উল্লেখ করেছেন, ‘রাসুল (সা.)-এর জন্ম সম্পর্কে সাধারণত প্রসিদ্ধ উক্তি এই যে তিনি রবিউল আউয়াল মাসে আবির্ভূত হন। তবে যুবায়র বলেছেন, তিনি রমজান মাসে জন্মগ্রহণ করেন। কারো কারো মতে, আমিনা গর্ভধারণ করেন আইয়ামে তাশরিকে—অর্থাৎ জিলহজ মাসের মাঝামাঝি সময়। এ উক্তি সঠিক হলে রাসুল (সা.)-এর রমজানে জন্মগ্রহণের অভিমত সঠিক। সংখ্যাগুরু ঐতিহাসিকদের বক্তব্য এই যে হাতিবাহিনী মক্কা শরিফে এসেছিল মহরম মাসে এবং এর ৫০ দিন পর তিনি আবির্ভূত হন। এ মতটিই অধিক প্রচলিত এবং সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, সৌর হিসাবে তাঁর জন্ম তারিখ ২০ সেপ্টেম্বর। তিনি জন্মগ্রহণ করেন মক্কা শরিফের পাহাড়ের উপত্যকায় অবস্থিত বাড়িতে। কারো কারো মতে, সাফা পর্বতের কাছে অবস্থিত বাড়িতে।’ (ইবনে হিশাম : সিরাতুন্ নবী (সা.), ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ঢাকা, ২০১৩ (তৃতীয় সংস্করণ), পৃষ্ঠা ১৫৭)</p> <p>নবী (সা.)-এর জন্ম কাহিনীতে হস্তীবর্ষ বা হাতিবাহিনী শব্দগুলো জুড়ে রয়েছে। এটা হলো সুরা ফিলে বর্ণিত ইয়েমেনের বাদশাহ আবরাহা কর্তৃক কাবাঘর ধ্বংস করার অভিযানের বছরের কথা অথবা সে কাহিনীর কথা। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, ৫৭১ খ্রিস্টাব্দে আবরাহা কাবাঘর ধ্বংসের জন্য অভিযান পরিচালনা করেছিল। এর ৫০ দিন পরই নবী (সা.) কাবাঘরের সন্নিকটে তাঁর পিতৃভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।</p> <p>আরব ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রথমদিকে যাঁরা নবী (সা.)-এর জীবনী লিখেছেন, তাঁদের মধ্যে ইবনে ইসহাক অন্যতম। ইবনে হিশাম তাঁর গ্রন্থ থেকে অনেক তথ্য ও সূত্র উল্লেখ করেছেন। মুহাম্মদ ইবনে ইসহাকের গ্রন্থের নাম ‘কিতাবুল মুবতাদা’। এ গ্রন্থে ইবনে ইসহাক জনৈক কায়েস ইবনে মাখরামার সাক্ষাত্কার প্রকাশ করেন, যেখানে কায়েস বলেছেন, ‘আমি এবং রাসুল (সা.) আবরাহার হামলার বছর জন্মগ্রহণ করি। তাই আমরা সমবয়সী।’</p> <p>এ থেকে নবী (সা.)-এর জন্ম বছরটি ৫৭১ খ্রিস্টাব্দ হিসেবে সঠিক আছে।</p> <p>এ যুগের জীবনীকার মুফতি মুহাম্মদ শফী (রহ.) নবী (সা.)-এর জন্ম তারিখ সম্পর্কে আরো ভিন্ন ভিন্ন মত তাঁর গ্রন্থে পর্যালোচনার জন্য গ্রহণ করেছেন। তিনি লিখেছেন : এ বিষয়ে সবাই একমত যে নবী করিম (সা.)-এর জন্ম রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার দিন হয়েছিল। কিন্তু তারিখ নির্ধারণে চারটি রেওয়ায়েত (বর্ণনা) প্রসিদ্ধ রয়েছে। ২, ৮, ১০ ও ১২ তারিখ। তন্মধ্যে হাফিজ মুগলতাই (রহ.) ২ তারিখের রেওয়ায়েত গ্রহণ করে অন্য রেওয়ায়েতগুলোকে দুর্বল বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু প্রসিদ্ধ হচ্ছে ১২ তারিখের রেওয়ায়েত। হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) এই মতে সবাই একমত বলে দাবি করেছেন। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ইবনে আসিরের ‘আল কামিল’ গ্রন্থে এ তারিখই গ্রহণ করা হয়েছে। মাহমুদ পাশা মিসরি গণনার মাধ্যমে ৯ তারিখ গ্রহণ করলেও তা সবার মতের বিপরীত ও সনদবিহীন উক্তি। যেহেতু চাঁদ উদয়ের স্থান বিভিন্ন, তাই গণনার ওপর এতটুকু বিশ্বাস ও নির্ভরতা জন্মায় না যে তার ওপর ভিত্তি করে সবার বিরোধিতা করা যাবে। (মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ.), করাচি : সিরাতে খাতামুল আম্বিয়া, ইসলামিয়া কুতুবখানা, ঢাকা, ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ১৭)</p> <p>মহানবী (সা.)-এর জন্মকালে তাঁর পিতার অবস্থান নিয়েও মতভেদ রয়েছে। প্রচলিত মত হচ্ছে, নবী (সা.)-এর জন্মের আগেই তাঁর পিতা আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। তবে আলেমদের মত হচ্ছে, রাসুল (সা.)-এর বয়স যখন দুই মাস তখন দোলনায় থাকাকালে পিতার মৃত্যু হয়। অন্য আরেকটি মত হচ্ছে, নবী (সা.)-এর বয়স যখন ২৮ মাস, তখন তাঁর পিতা আবদুল্লাহ নিজ মামার বাড়িতে মারা যান। সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। (ইবনে হিশাম : সিরাতুন নবী (সা.), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৫৬)</p> <p>লেখক : সিনিয়র উপ-প্রধান তথ্য অফিসার, তথ্য অধিদপ্তর</p>