জাহান্নামের ভয়ংকর জাক্কুম বৃক্ষ

ইজাজুল হক
ইজাজুল হক
শেয়ার
জাহান্নামের ভয়ংকর জাক্কুম বৃক্ষ

পবিত্র কোরআনে বর্ণিত জাহান্নামের মর্মন্তুদ শাস্তির বিবরণে আল্লাহ তাআলা জাক্কুম বৃক্ষের প্রসঙ্গ এনেছেন। আরবি জাক্কুম শব্দটি এসেছে ‘তাজাক্কুম’ থেকে, যার অর্থ ক্ষুধার তাড়নায় গোগ্রাসে গিলে খাওয়া। কুফর, অবিশ্বাস ও পাপাচারের চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে ভয়ংকর রকমের তিক্ত-বিস্বাদ ও কুৎসিত জাক্কুম ফল জাহান্নামিদের খেতে দেওয়া হবে। প্রচণ্ড ক্ষুধার জ্বালায় তারা তা গোগ্রাসে গিলবে এবং শাস্তির ভয়াবহতায় ফেঁসে যাবে।

জাক্কুমের আলোচনা মুমিনের জন্য গুনাহমুক্তির অনন্ত অনুপ্রেরণা এবং অবিশ্বাসীদের জন্য কঠিন সতর্কবাণী ও পরীক্ষাস্বরূপ।

 

কেমন হবে জাক্কুমের শাস্তিপর্ব?

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আপ্যায়নের জন্য কি এটিই উত্তম, না জাক্কুম বৃক্ষ? সীমা লঙ্ঘনকারীদের জন্য আমি এ সৃষ্টি করেছি পরীক্ষাস্বরূপ; এ বৃক্ষ জাহান্নামের তলদেশ থেকে উদগত, এর গুচ্ছ শয়তানের মাথার মতো। সীমা লঙ্ঘনকারীরা তা ভক্ষণ করবে এবং তা দিয়ে উদর পূর্ণ করবে। তার ওপর অবশ্যই তাদের জন্য ফুটন্ত পানির মিশ্রণ থাকবে, তারপর অবশ্যই ওদের প্রত্যাবর্তন হবে জাহান্নামের দিকে।

’ (সুরা : সাফফাত, আয়াত : ৬২-৬৮)

 

জাক্কুমের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া

সেদিনের ভয়াবহতার বর্ণনা দিয়ে সাঈদ ইবনে জুবাইর বলেন, ‘জাহান্নামিরা যখন ক্ষুধার কারণে খাদ্যের প্রার্থনা করবে, তখন তাদের জাক্কুম খাওয়ানো হবে। ফলে তাদের মুখের চামড়া সম্পূর্ণ খসে পড়বে। এমনকি কোনো পরিচিত ব্যক্তি সেই মুখের চামড়া দেখেই তাদের চিনে নেবে। তারপর পিপাসায় ছটফট করে যখন পানি চাইবে, তখন ফুটন্ত গরম তেল তাদের পান করতে দেওয়া হবে।

ওই তেল হবে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার। তা মুখের সামনে আসা মাত্রই মুখমণ্ডলের মাংস ঝলসে যাবে। আর যে সামান্য অংশ তাদের পেটে গিয়ে পৌঁছবে তার ফলে নাড়িভুঁড়ি গলে যাবে। এমন অবস্থায় ওপর থেকে লোহার হাতুড়ি দিয়ে তাদের প্রহার করা হবে। ফলে দেহের একেকটি অংশ পৃথক হয়ে যাবে।
তখন তারা চিৎকার করে মৃত্যু কামনা করতে থাকবে। এরপর তাদের জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে এবং নতুন শাস্তির মুখোমুখি করা হবে।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির : ১৬/২২২)

রাসুল (সা.) জাক্কুমের ভয়াবহতা সম্পর্কে বলেন, ‘ওই জাক্কুমের সামান্য পরিমাণ যদি জাহান্নাম থেকে পৃথিবীতে আসে, তবে পৃথিবীর খাদ্য ও পানীয় তার বিষাক্ততায় বিনষ্ট হয়ে যাবে।’ (তিরমিজি : ২৫৮৫)

 

পৃথিবীতে জাক্কুমের অস্তিত্ব আছে?

পৃথিবীতে জাক্কুম বৃক্ষের অস্তিত্ব আছে কি নেই, তা নিয়ে মুফাসসিরদের দুই ধরনের বক্তব্য পাওয়া যায়। এক দল বলে, কোরআনে বর্ণিত জাক্কুম আরবের এক প্রকার কাঁটাযুক্ত বৃক্ষ, যা তিহামা অঞ্চলে রয়েছে। অন্যান্য অনুর্বর অঞ্চলেও তা উৎপন্ন হয়। আরেক দল বলে, এটি জাহান্নামেরই বৃক্ষ, দুনিয়ার কোনো বৃক্ষের সঙ্গে এটিকে মেলানো ঠিক হবে না। এ বিতর্কের অবসানে মুফতি শফি (রহ.) বলেন, ‘পৃথিবীতে যেমন সাপ-বিচ্ছু রয়েছে, তেমনি জাহান্নামেও তা থাকবে। তবে জাহান্নামের সাপ-বিচ্ছু দুনিয়ার সাপ-বিচ্ছু অপেক্ষা বহুগুণে ভয়ংকর হবে। ঠিক তেমনিভাবে জাহান্নামের জাক্কুম প্রজাতি হিসেবে দুনিয়ার জাক্কুমের মতো হলেও তা দুনিয়ার জাক্কুম অপেক্ষা অনেক বেশি কদাকার ও তিক্ত-বিস্বাদ হবে।’ (মাআরিফুল কোরআন : ৭/৪২৯)

মুফতি শফি (রহ.) ভারত উপমহাদেশের ফণীমনসা বা ক্যাকটাসকেই জাক্কুম বলেছেন। উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা তিন অঞ্চলের তিন ধরনের বৃক্ষকে জাক্কুম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলের ‘ইউফোরবিয়া আবিসিনিকা’ (Euphorbia abyssinica), জর্দানের ‘ব্যালানাইটস অ্যাজিপটিকা’ (Balanites aegyptiaca) এবং তুরস্কের ‘জিক্কিম’ (Zikkim)প্রজাতির বৃক্ষকে জাক্কুম বলেছেন তাঁরা। (উইকিপিডিয়া)

 

জাক্কুম নিয়ে বিভ্রান্তি

মানবখুলি আকৃতির বাদামি রঙের এবং হালকা আঁশযুক্ত এক ধরনের ফল জাক্কুম হিসেবে বেশ পরিচিতি পেয়েছে, যা ভুল প্রচলন বা একপ্রকার গুজবই বলা চলে। জাক্কুম ফল বাদামি রঙের হলেও মানবখুলিসদৃশ ফলের সঙ্গে এর দূরতম সম্পর্ক নেই। বরং সেটি স্ন্যাপড্রাগন ফুল (Snapdragon Flower)-এর খুলি। ফুলটি পরিণত রূপে অনেকটা মানবখুলির আকার ধারণ করে। সম্ভবত পবিত্র কোরআনে জাক্কুমকে শয়তানের মাথার সঙ্গে উপমায়িত করার কারণে কঙ্কালসৃদশ এই ফুলকে মানুষ জাক্কুম বলে ভ্রম করে থাকে। মূলত কোরআনের উপমা প্রতীকী, তা দ্বারা কুৎসিত-কদাকারই বোঝানো হয়েছে। তা ছাড়া শয়তানের মাথার প্রকৃত আকৃতি মানুষের জ্ঞানের বাইরে। তাই মানবখুলিকে শয়তানের মাথা ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই।

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

কোরআন থেকে শিক্ষা

    পর্ব, ৭৩৫
শেয়ার
কোরআন থেকে শিক্ষা

আয়াতের অর্থ : ‘আমি সুস্পষ্ট নিদর্শন অবতীর্ণ করেছি, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সরল সঠিক পথ প্রদর্শন করেন। তারা বলে, আমরা আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি ঈমান আনলাম এবং আমরা আনুগত্য স্বীকার করলাম। কিন্তু তারপর তাদের একদল মুখ ফিরিয়ে নেয়; বস্তুত তারা মুমিন নয়... যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর অবাধ্যতা থেকে সাবধান থাকে তারাই সফলকাম।’

(সুরা : নুর, আয়াত : ৪৬-৫২)

আয়াতগুলোতে মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে।

 

শিক্ষা ও বিধান

১.  কোরআন অনুধাবনের জন্য ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা যথেষ্ট নয়, এ জন্য আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ আবশ্যক।

২.  যারা মুখে নিজেকে মুসলিম দাবি করে কিন্তু অন্তরে কুফরি বিশ্বাস ও মতবাদ লালন করে কোরআনের ভাষায় তারা মুমিন নয়।

৩.  নিফাকের একটি প্রমাণ হলো যাপিত জীবনে দ্বিন পালনে অনীহা এবং মানবজীবনের যেকোনো স্তরে শরিয়তের বিধান ও সমাধান গ্রহণে অস্বীকৃতি।

৪.  দ্বিন-শরিয়তের ওপর অন্য কিছুকে প্রাধান্য দেওয়া এবং কোনো কিছুকে ইসলামের চেয়ে উত্তম মনে করা নিফাকের নিদর্শন।

৫.  মুসলিম শাসক যদি দ্বিন ও শরিয়তের বিরুদ্ধাচরণ না করে তবে তার আনুগত্য করা উচিত এবং অবাধ্য হাওয়া অনুচিত। তারা আল্লাহর অবাধ্য হলে তাদেরও অবাধ্য হওয়া যাবে।

(তাফসিরে ইবনে কাসির : ৪৬-৫২)

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য
পর্ব : ২৮

তারাবিতে কোরআনের বার্তা

শেয়ার
তারাবিতে কোরআনের বার্তা

সুরা সাফ্ফ

এ সুরার মূল আলোচ্য বিষয় যুদ্ধ ও আল্লাহর দুশমনদের সঙ্গে যুদ্ধ, আল্লাহর পথে প্রাণ বিসর্জন, মুজাহিদদের সওয়াব বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। এ ছাড়া শরিয়তের কিছু বিধান বর্ণিত হয়েছে।

আদেশ-নিষেধ-হেদায়েত

১. কথা ও কাজে মিল রেখো। (আয়াত : ২)

২. আল্লাহর পথে সংগ্রম করো।

(আয়াত : ৪)

৩. দ্বিনের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান কোরো না। (আয়াত : ৭)

৪. দ্বিনি কাজে সাহায্য করো। (আয়াত : ১৪)

সুরা জুমা

এই সুরায় জুমার নামাজের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহর পবিত্রতা ও নিরঙ্কুশ মাহাত্ম্য বর্ণনা করে এ সুরা শুরু হয়েছে।

এরপর রাসুল (সা.) এর বিভিন্ন গুণাগুণ আলোচনা করা হয়েছে। ইহুদিদের তাওরাতের বিধি-বিধান ছেড়ে দেওয়া প্রসঙ্গ এসেছে। জুমার নামাজ আদায়ে উৎসাহ ও তাগিদ দিয়ে সুরা শেষ করা হয়েছে।

আদেশ-নিষেধ-হেদায়েত

১. শিক্ষা নবীদের অন্যতম মিশন।

(আয়াত : ২)

২. আসমানি শিক্ষার মর্ম অনুধাবন করো। (আয়াত : ৫)

৩. জুমার নামাজে অংশ নাও। (আয়াত : ৯)

৪. নামাজ শেষে জীবিকার অনুসন্ধান করো। (আয়াত : ১০)

৫. নামাজ ছেড়ে যেয়ো না। (আয়াত : ১১)

সুরা মুনাফিকুন

এই সুরায় শরিয়তের কিছু বিধান বর্ণিত হয়েছে।

মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে সুরা শুরু হয়েছে। ঈমানের মিথ্যা দাবি, মিথ্যা কসম, আল্লাহর রাসুল (সা.) ও তাঁর সঙ্গীদের ওপর তাদের দুর্বলতা এবং মানুষদের দ্বিন থেকে সরানোর অপচেষ্টা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

আদেশ-নিষেধ-হেদায়েত

১. মিথ্যা বলা মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য।

(আয়াত : ১)

২. মিথ্যা শপথ কোরো না। (আয়াত : ২)

৩. ধারাবাহিক পাপাচার বোধ-বুদ্ধি লোপ করে। (আয়াত : ৩)

৪. সীমাহীন পাপাচার ক্ষমার দুয়ার বন্ধ করে। (আয়াত : ৬)

৫. দ্বিনি কাজে নিরুৎসাহ কোরো না।

(আয়াত : ৭)

৬. মৃত্যু আসার আগে আল্লাহর জন্য ব্যয় করো। (আয়াত : ১০)

সুরা তাগাবুন

আলোচ্য সুরায় আকিদাবিষয়ক আলোচনা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর গুণাগুণ ও কুদরত বর্ণনা করে মানুষ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। এরপর আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর দ্বিনের সমুন্নতায় তাকওয়া অর্জন ও তাঁর রাস্তায় ব্যয়ের আদেশ দেওয়া হয়েছে। কৃপণতা ও ইতরতা করতে নিষেধ করা হয়েছে।

আদেশ-নিষেধ-হেদায়েত

১. আল্লাহ মানুষকে সর্বোত্তম আকৃতি দিয়েছেন। (আয়াত : ৩)

২. আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করো। (আয়াত : ১২)

৩. পরিবারের ব্যাপারেও সতর্ক থেকো। (আয়াত : ১৪)

৪. মানুষকে ক্ষমা করো। (আয়াত : ১৪)

 

সুরা তালাক

এ সুরায় হুকুম বাস্তবায়নের সময় পরিবারের গঠনের অবস্থা ও স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদের আহকাম ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে। তালাকে সুন্নতের বিধি-বিধান, ইদ্দত ও ইদ্দতের আহকাম ইত্যাদির আলোচনার মাধ্যমে সুরাটি শুরু হয়েছে। এরপর হায়েজহীন নারীর ইদ্দতের হুকুম, গর্ভবতী নারীর ইদ্দতের হুকুম ইত্যাদি আলোচনা করা হয়েছে। ইদ্দতাবস্থায় খরচপাতি ও বাসস্থান দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আল্লাহর হুকুম ও সীমারেখা অতিক্রম করতে নিষেধ করে সুরাটি শেষ করা হয়েছে।

আদেশ-নিষেধ-হেদায়েত

১. তালাকের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। (আয়াত : ১)

২. আল্লাহর অবাধ্যতা নিজের প্রতি অবিচার। (আয়াত : ১)

৩. বাসস্থান স্ত্রীর অধিকার। (আয়াত : ৬)

৪. পরিবারের জন্য উদারভাবে খরচ করো। (আয়াত : ৭)

৫. পরিবারপ্রধানের ওপর বোঝা চাপিয়ো না। (আয়াত : ৭)

সুরা তাহরিম

উম্মাহাতুল মুমিনিনদের সম্পৃক্ত বিভিন্ন আহকাম আলোচিত হয়েছে মদিনায় অবতীর্ণ এ সুরায়। ঈমানদার পরিবার জাহান্নামকে ভয় করা ও প্রতিদান সম্পর্কে সতর্ক থাকা এবং কাফির-মুনাফিকদের বিপক্ষে ঘর-পরিবার ও স্ত্রী-সন্তানের কারণে বিরত না থাকার কথা বলা হয়েছে। শেষে দুই ধরনের নারীর উদাহরণ টেনে সুরা শেষ করা হয়েছে।

আদেশ-নিষেধ-হেদায়েত

১. বৈধ জিনিস অবৈধ কোরো না। (আয়াত : ১)

২. ভুল হলে অনুতপ্ত হও। (আয়াত : ৪)

৩. রাসুলের বিরুদ্ধাচরণ কোরো না।

(আয়াত : ৪)

৪. উত্তম স্ত্রীর বৈশিষ্ট্য পাঁচটি : তারা হবে আত্মসমর্পণকারী, বিশ্বাসী, অনুগত, তাওবাকারী, ইবাদতকারী, রোজা পালনকারী অকুমারী ও কুমারী। (আয়াত : ৫)

৫. পরিবারকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করো। (আয়াত : ৬)

৬. তাওবা পাপমোচন করে। (আয়াত : ৮)

সুরা মুলক

এই সুরায় আকিদার মৌলিক বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে। সাত আসমান সৃষ্টি, চাঁদ-তারার মাধ্যমে সেগুলোর সজ্জা এবং শয়তান বিতাড়নে ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, পৃথিবীর একই নিয়মে পরিচালিত। তাতে পরিবর্তন বা স্খলন হবে না। আল্লাহর রাসুলের দাওয়াত অস্বীকারকারীদের সতর্ক করে সুরার ইতি টানা হয়েছে।

আদেশ-নিষেধ-হেদায়েত

১. আল্লাহ জীবন-মৃত্যু দিয়ে পরীক্ষা করেন। (আয়াত : ২)

২. জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সদ্ব্যবহার করো।

(আয়াত : ১০)

৩. আল্লাহ ভূমিকে সুগম করেছেন।

(আয়াত : ১৫)

সুরা কালাম

কলমের কসমের মাধ্যমে সুরা শুরু হয়েছে। যাতে কলমের পবিত্রতা ফুটে ওঠে। এরপর রাসুলের চরিত্র-মাধুর্যের কথা বলা হয়েছে। নবুয়ত-রিসালত, পুনরুত্থান ও আখিরাত এবং কিয়ামতের দিন মুমিন ও কাফিরদের পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

আদেশ-নিষেধ-হেদায়েত

১. মহানবী (সা.) সর্বোত্তম আদর্শের অধিকারী। (আয়াত : ৪-৬)

২. মিথ্যাবাদীদের অনুসরণ কোরো না।

(আয়াত : ৮-৯)

৩. কথায় কথায় শপথ ভালো নয়।

(আয়াত : ১০)

৪. পরনিন্দা নিন্দনীয়। (আয়াত : ১১)

৫. রূঢ়তা মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়।

(আয়াত : ১৩-১৪)

৬. অভাবীদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। (আয়াত : ২৩-২৪)

৭. সীমা লঙ্ঘনকারী বঞ্চিত হয়।

(আয়াত : ২৬-২৭)

সুরা হাক্কা

এই সুরায়ও আকিদার মৌলিক বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে। সুরা শুরু হয়েছে কিয়ামতের দিনের ভয়াবহতা ও আগের জাতিগোষ্ঠীকে শাস্তি প্রদানের ঘোষণা দিয়ে। রাসুল (সা.)-এর সত্যতা, ওহি পৌঁছানের ক্ষেত্রে তাঁর আমানত, কোরআন মুমিনদের জন্য রহমত ও কাফিরদের জন্য আফসোস ইত্যাদি আলোচনার মাধ্যমে সুরা শেষ করা হয়েছে।

আদেশ-নিষেধ-হেদায়েত

১. সামগ্রিক পাপ বিপর্যয় ডেকে আনে।

(আয়াত : ৯)

২. মৃত্যুই জীবনের শেষ নয়। (আয়াত : ২৭)

৩. অভাবীদের অন্নদান করো।

(আয়াত : ৩৩-৩৪)

৪. কোরআন কোনো কাব্য নয়।

(আয়াত : ৪০-৪১)

সুরা মাআরিজ

এই সুরায় পুনরুত্থান, হাশর-নশর, হিসাব-নিকাশ, প্রতিদান ও জাহান্নামের শাস্তি ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর দাওয়াতের প্রতি মক্কার কাফিরদের অবস্থান ও তাচ্ছিল্যতা করে তাদের আল্লাহর আজাব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা এবং দ্রুত আজাব পেতে চাওয়া ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে। কাফিরদের যে শাস্তি দেওয়া হবে তা বর্ণনা করে সুরার সমাপ্তি টানা হয়েছে।

আদেশ-নিষেধ-হেদায়েত

১. আল্লাহর কাছে শাস্তি চেয়ো না।

(আয়াত : ১-২)

২. মানুষ অস্থির চিত্ত, যা নিন্দনীয়।

(আয়াত : ১৯-২১)

৩. যথানিয়মে নামাজ আদায় করো।

(আয়াত : ২২-২৩)

৪. অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াও।

(আয়াত : ২৪-২৫)

৫. আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করো।

(আয়াত : ২৭-২৮)

৬. ব্যভিচার কোরো না। (আয়াত : ২৯-৩০)

৭. নামাজে যত্নবান হও। (আয়াত : ৩৪-৩৫)

৮. মিথ্যা প্রত্যাশা ভালো নয়।

(আয়াত : ৩৮-৩৯)

সুরা নুহ

ঈমানের বিভিন্ন উপাদান, আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য, মূর্তি ও পৌত্তলিকতার অসারতা এবং আল্লাহর অস্তিত্ব ও কুদরতের প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে। নুহ (আ.)-কে তাঁর জাতির কাছে আল্লাহর দাওয়াত নিয়ে পাঠানো প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে সুরার শুরুতে। এরপর সমগ্র পৃথিবীর সৃষ্টি ও মানুষের কল্যাণে হিরারত্ন, ধনভাণ্ডার ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। নুহ (আ.)-এর জাতির ধ্বংসের বর্ণনা দিয়ে সুরা শেষ হয়েছে।

আদেশ-নিষেধ-হেদায়েত

১. দিন-রাত আল্লাহর পথে আহ্বান করো। (আয়াত : ৫-৬)

২. প্রকাশ্যে ও গোপনে দ্বিনের কাজ করো। (আয়াত : ৮-৯)

৩. অনাবৃষ্টি হলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। (আয়াত : ১০-১১)

৪. প্রশস্ত পথ আল্লাহর দান।

(আয়াত : ১৯-২০)

৫. অন্যদের বিভ্রান্ত কোরো না। (আয়াত : ২৪)

৬. জালিমের বিরুদ্ধে আল্লাহর সাহায্য চাও। (আয়াত : ২৬)

৭. পরিবারের জন্য দোয়া করো।

(আয়াত : ২৮)

সুরা জিন

এই সুরার দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে : জিন জাতি ও মানুষকে দাওয়াত দেওয়ার ক্ষেত্রে নবী করিম (সা.)-এর প্রতি কিছু নির্দেশনা। জানানো হয়েছে যে জিনদের মধ্যেই মুমিন ও কাফির রয়েছে। রাসুল (সা.) কারো লাভ-ক্ষতি করতে পারেন না। কাউকে আল্লাহর শাস্তি থেকে মুক্তি দিতে পারেন না এবং আজাবের ক্ষণকাল সম্পর্কে জানেন না।

আদেশ-নিষেধ-হেদায়েত

১. অসৎ কাজে জিনের সহায়তা নিয়ো না। (আয়াত : ৬)

২. জিনরা অদৃশ্যের কোনো সংবাদ জানে না। (আয়াত : ১০)

৩. জিনরা আল্লাহর হুকুমের সামনে অসহায়। (আয়াত : ১২)

৪. আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হয়ো না। (আয়াত : ১৭)

৫. মসজিদ কেবল আল্লাহর জন্য।

(আয়াত : ১৮)

৬. আল্লাহর রাসুলরা সুরক্ষিত। (আয়াত : ২৭)

গ্রন্থনা : মুফতি আতাউর রহমান

 

 

মন্তব্য
রমজানের শেষ মুহূর্ত

ফিরে আসার এক সুবর্ণ সুযোগ

আইয়ূব হুসাইন
আইয়ূব হুসাইন
শেয়ার
ফিরে আসার এক সুবর্ণ সুযোগ

রমজান বিদায়ের পথে, সময়ের চাকা দ্রুত ঘুরে চলছে। কিন্তু এখনো আপনার জন্য দুয়ার খোলা। হয়তো আপনি এখনো গভীরভাবে রমজানের মাহাত্ম্য অনুভব করতে পারেননি, ইবাদতে একাগ্রতা খুঁজে পাননি, অন্তরে প্রশান্তির পরশ লাগেনি। চারপাশে মানুষ ইবাদতে মশগুল, কেউ কোরআন তিলাওয়াতে রত, কেউ লাইলাতুল কদরের সন্ধানে রাত জাগরণে মগ্ন।

অথচ আপনার হৃদয় যেন শূন্য, আবেগহীন, কাঠিন্যে মোড়ানো! তবে সুখবর হলোআল্লাহর রহমত এতটাই বিশাল যে তিনি মুহূর্তের মধ্যে আপনার অবস্থান বদলে দিতে পারেন। তিনি বলেন, হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গুনাহ মাফ করে দেন। তিনি ক্ষমাশীল, দয়ালু।
(সুরা : আজ-জুমার, আয়াত : ৫৩)

এই আয়াত কি যথেষ্ট নয় আমাদের জন্যযেখানে মহান রব নিজেই ডাকছেন, তোমরা নিরাশ হয়ো না! তাহলে আমরা কেন তার রহমত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেব?

লাইলাতুল কদরএক রাতের ইবাদতে ৮৪ বছরের সওয়াব

এখন রমজানের শেষ দশকের গুরুত্বপূর্ণ রাতগুলো পার হচ্ছে। হতে পারে, এটাই লাইলাতুল কদর! যে রাত সম্পর্কে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন : নিশ্চয়ই আমি কদরের রাতে কোরআন নাজিল করেছি। আর তুমি কী জানো কদরের রাত কী? কদরের রাত হলো এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম!

(সুরা : আল-কদর, আয়াত : ১-৩)

ভাবুন, এই রাতে যদি আপনি নফল নামাজ পড়েন, একটি তাসবিহ বলেন, একটি দোয়া করেনআপনার আমলনামায় ৮৪ বছরের ইবাদতের সওয়াব লেখা হবে! এমন সুবর্ণ সুযোগ আর কোথায় পাওয়া যাবে?

তাওবার দরজা এখনো খোলা

হয়তো আপনি ভাবছেন—‘আমি অনেক গুনাহ করে ফেলেছি, আল্লাহ কি আমাকে মাফ করবেন? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—‘যে ব্যক্তি অন্তর থেকে খাঁটি মনে তাওবা করে, আল্লাহ তার গুনাহ এমনভাবে মাফ করে দেন, যেন সে কখনো সেই পাপ করেনি।

(ইবন মাজাহ, হাদিস : ৪২৫০)

সুতরাং, আপনি যতই পাপ করে থাকুন না কেন, এই মুহূর্তে যদি আল্লাহর দরবারে ফিরে আসেন, তিনি আপনাকে ক্ষমা করবেন।

শেষ সময়ে বিজয়ীর মতো ছুটুন

আমাদের পূর্বসূরিরা রমজানের শেষ দশকে নিজেদের আরো বেশি ইবাদতে ডুবিয়ে দিতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, নবী (সা.) যখন রমাদানের শেষ দশকে প্রবেশ করতেন, তখন তিনি রাত জাগতেন, পরিবারের সবাইকে জাগাতেন এবং ইবাদতে অধিক মনোযোগী হতেন। (বুখারি, হাদিস : ২০২৪)

আমরা কি সেই সুন্নাহকে অনুসরণ করব না?

এখনো সময় আছেআল্লাহর কাছে ফিরে যান। অনেকেই মনে করেন, আরেকটা বছর আসবে, তখন ভালোভাবে ইবাদত করব। কিন্তু আপনি কি নিশ্চিত যে আপনি আরেকটি রমজান পাবেন?

রাসুল (সা.) বলেছেন : সুযোগ থাকতেই পাঁচটি জিনিসকে গ্রহণ করো(১) বৃদ্ধ হওয়ার আগে তোমার যৌবনকে, (২) অসুস্থ হওয়ার আগে তোমার সুস্থতাকে, (৩) দরিদ্র হওয়ার আগে তোমার সম্পদকে, (৪) ব্যস্ত হওয়ার আগে তোমার অবসরকে, (৫) মৃত্যুর আগে তোমার জীবনকে।

(হাকিম, হাদিস : ৭৮৪৬) এখনো সময় আছে! আল্লাহর দিকে ফিরে যান, তাহাজ্জুদের মিহরাবে দাঁড়ান, হাত তুলে দোয়া করুন, অশ্রু ঝরান, কোরআনে মনোযোগ দিন।

এই রমজান হতে পারে আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ রমজান

রমজান শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এই শেষ সময়ে আপনি যে আমল করবেন, সেটাই হতে পারে আপনার জান্নাতের চাবিকাঠি। হাদিসে আছে, যে ব্যক্তি শেষ সময়ে ভালো আমল নিয়ে মৃত্যুবরণ করে, সে ভালো পরিণতি লাভ করবে। (তিরমিজি, হাদিস : ২১৪১)

এখনো সময় আছেনিজেকে বদলানোর, আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়ার, কদরের রাতের সর্বোচ্চ ফায়দা নেওয়ার।

উঠুন, ফিরে আসুন! রমজান চলে যাচ্ছে, কিন্তু আপনার সুযোগ এখনো শেষ হয়নি। ইতিহাসে অনেক মানুষ জীবনের শেষ সময়ে আমল বাড়িয়ে বিজয়ী হয়েছেন। আপনি কি সেই তালিকায় থাকতে চান না?

আল্লাহ আপনাকে ডাকছেন। আপনি কি সাড়া দেবেন?

 

লেখক : সহকারী শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা)

আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ

মতিঝিল, ঢাকা-১০০০

 

মন্তব্য

রমজানে মুসলিম-বাঙালি সংস্কৃতি

আহমাদ আরিফুল ইসলাম
আহমাদ আরিফুল ইসলাম
শেয়ার
রমজানে মুসলিম-বাঙালি সংস্কৃতি
ছবি : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি

রমজান মাস বাঙালি মুসলিম সমাজের জন্য এক অপূর্ব আধ্যাত্মিক ও সামাজিক উৎসবের সময়। এই মাসে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সামাজিক বন্ধন, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অনন্য মেলবন্ধন ঘটে। রমজান মাসের প্রতিটি মুহূর্ত যেন এক বিশেষ আবেগ ও উদ্দীপনায় ভরপুর। সাহরি ও ইফতারের প্রস্তুতি থেকে শুরু করে তারাবি নামাজ, দান-খয়রাত, সামাজিক সমাবেশ এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসব মিলিয়ে রমজান মাস বাঙালি মুসলিম সমাজের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।

বাঙালি মুসলিম সমাজে রমজান মাসের আগমনকে স্বাগত জানানো হয় বিশেষ উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে। এই মাসে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী রীতি ও আচার পালন করা হয়, যা বাঙালিয়ানা সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

রমজানের পূর্বপ্রস্তুতি

রমজান মাস আসার আগেই বাংলাদেশের ঘরে ঘরে শুরু হয় প্রস্তুতি। বিশেষভাবে শাবান মাসে বেশি বেশি ইবাদত, দোয়া ও নফল রোজা রাখার চল রয়েছে।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ সংসারের ভারী কাজগুলো আগেই সেরে নেন বাড়ির কর্তা-মহিলারা মিলে। রমজানের জন্য আগেভাগে ইফতার ও সাহরির উপকরণ কেনার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।

রমজান মাস আসার নিকটবর্তী জুমা থেকেই খুতবাগুলোয় মসজিদে মসজিদে রমজানের গুরুত্ব, ফজিলত ও করণীয়-বর্জনীয় নিয়ে চলে বিশেষ বয়ান বা আলোচনা। এতে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা রোজা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারেন এবং বাড়ির মহিলাদের জানিয়ে উপকৃত করতে পারেন।

রমজান মাসকে স্বাগত জানানো

বাংলাদেশের মুসলমানরা বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় আনন্দঘন পরিবেশে রমজানকে বরণ করে নেয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনগুলো রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় বিভিন্ন স্লোগান নিয়ে শোভাযাত্রা, প্রচারপত্র বিতরণ ও পোস্টারিং করে থাকে। রমজান শুরু হওয়ার আগেই ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত প্রধান প্রধান মসজিদে সাহরি ও ইফতারের সময়সূচি সংবলিত সুন্দর সুন্দর ক্যালেন্ডার সরবরাহ করা হয়। মুসল্লিরাও সেগুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বাড়িতে নিয়ে তা টানিয়ে দেয়।

বাঙালির রমজানের চাঁদ দেখার সংস্কৃতি

রমজানের চাঁদ দেখা বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

চাঁদ দেখার দিন বিকেলের পর থেকেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা এক ধরনের রীতি হয়ে গেছে। অনেকে বাড়ির ছাদে, উঠানে বা খোলা জায়গায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে চাঁদ দেখার চেষ্টা করে। শিশুদের মধ্যে চাঁদ দেখার ব্যাপারে বাড়তি কৌতূহল থাকে, তারা প্রথম চাঁদ দেখার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে।

রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ২৯ শাবান রমজানের চাঁদ দেখার জন্য বৈঠক হয়। চাঁদ দেখা গেলেই তা দ্রুত প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো চাঁদ দেখার খবর প্রচার করে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে।

তারাবি নামাজ ও বাঙালি মুসলিম সমাজ

বাঙালি মুসলিম সমাজে তারাবি নামাজ একটি সামাজিক ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে। রমজানের চাঁদ উঠতেই পাড়া-মহল্লা ও শহরে নেমে আসে রমজানের পবিত্র আমেজ। জায়নামাজ হাতে মুসলমানরা মসজিদে ছুটে চলে তারাবি নামাজ আদায়ের জন্য। মসজিদগুলোয় নেমে আসে মুসল্লিদের ঢল। ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই তারাবি নামাজে দাঁড়িয়ে যায় এককাতারে। বাবার সঙ্গে শিশুদের মসজিদে যাওয়াও বাংলার এক অনন্য সংস্কৃতি। অনেক মসজিদে তারাবি নামাজের জন্য হাফেজ ইমাম রাখা হয়, যাঁদের সুললিত তিলাওয়াতে ছড়িয়ে পড়ে মুগ্ধতা।

তারাবি শেষ হলে মানুষের দল বেঁধে বাসায় ফেরা ঈদের দিনের মতো রাস্তাঘাটে শুধু টুপি, পাঞ্জাবিতে এক আলাদা ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের পরিবেশ ফুটে ওঠে। বাসায় বাসায় মহিলারা ছোট শিশুদের নিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে যান।

সাহরিতে বাঙালি সংস্কৃতি

বাংলাদেশে রমজান মাসে শেষ রাতে সাহরির সময় অন্য রকম এক আবহ তৈরি হয়। মহল্লার অলিগলিতে চলে রোজাদার মুসল্লিদের জাগানোর মহড়া। মসজিদের মিনার থেকে ইমাম-মুয়াজ্জিনের দরদি কণ্ঠে ভেসে আসে সাহরির আহ্বান। একসময় পুরান ঢাকায় কিশোররা দল বেঁধে বাংলা-উর্দু মিশ্রিত ভাষায় সুর তুলে  রোজাদারদের জাগিয়ে তুলত। বাংলাদেশে সাহরিতে কাসিদা গেয়ে ডাকাডাকির এ রেওয়াজ দীর্ঘদিনের।

আজ থেকে তিন-চার দশক আগে থানা-উপজেলা পর্যায়ে কোনো মসজিদ বা প্রতিষ্ঠান থেকে তীব্র আওয়াজের হুইসেল বাজানো হতো। এ আওয়াজ পেয়ে কয়েক গ্রামের মানুষ সাহরির জন্য ঘুম থেকে জাগত। এ ছাড়া মফস্বল অঞ্চলে মুড়ির টিনখ্যাত টিনের পাত্রে কাঠির আঘাতে শব্দ করে বলত, রোজাদার উঠুন। সাহরির সময় হয়েছে।

প্রযুক্তির উন্নতির আগে এভাবে সাহরিতে জাগানো হলেও বর্তমানে দল বেঁধে ডাকা ও কাসিদা গাওয়া অনেকাংশে কমে এসেছে। মাইকের আহ্বান এখনো প্রচলিত আছে। কিছু সময় পরপর ছোট্ট শব্দে সাহরির সময় মনে করিয়ে দিতে থাকেন ইমাম, মুয়াজ্জিন সাহেবরা। আধুনিক বিভিন্ন হামদ-নাত ও রমজানের বিশেষ নাশিদ বাজিয়েও রোজাদারদের সাহরির জন্য ঘুম থেকে জাগানো হয়।

সাহরির ডাকে নারীরা প্রথমে জেগে ওঠে, আহারের প্রাথমিক প্রস্তুতি শেষে সবাইকে জাগিয়ে তোলে। সাহরিতে একসময় দুধ, চিনি, নারকেল খাওয়া হতো, বাংলাদেশের প্রায় সব প্রান্তেই তা  প্রসিদ্ধ ছিল।

ইফতারে বাঙালি সংস্কৃতি

বাঙালি মুসলিমদের ইফতার সংস্কৃতি ধর্মীয় অনুশীলন, ঐতিহ্য ও সামাজিক রীতিনীতির এক অনন্য মিশ্রণ। বাঙালির ইফতার মানেই ঐতিহ্যবাহী কিছু বিশেষ খাবারের সমাহার। যদিও ইসলামে সহজ ইফতার ও সংযমের তাগিদ দেওয়া হয়েছে, তবু বাঙালির ইফতার টেবিল সাধারণত বেশ বৈচিত্র্যময় হয়।

উনিশ শতকে ইফতার করাকে বলা হতো রোজা খোলা, অর্থাৎ খাবার গ্রহণের মাধ্যমে রোজা ভাঙা। সে সময় গ্রামগঞ্জে  চাল, চালভাজা, ভাত, খই-চিড়ার মাধ্যমে ইফতার করার রেওয়াজ ছিল। সেসবের জায়গায় মাখানো ছোলামুড়ি এখন বাঙালি মুসলমানের ইফতারির মূল উপকরণ। শহর কী গ্রাম, ধনী অথবা গরিব সবার ইফতার তালিকায় স্থায়ী পত্তনি করে যাচ্ছে ছোলামুড়ি, পেঁয়াজু। বাঙালির ইফতারিতে শরবত খুবই জনপ্রিয়, বিশেষ করে বেলের শরবত, লেবুর শরবত, দুধ-লাচ্ছি এবং বাজারে প্রচলিত স্ন্যাকস ড্রিংক খাওয়া হয়।

বাংলার হাটবাজারে বাহারি ধরনের ইফতারের পসরা সাজিয়ে দোকানিরা বসেন। তবে পুরান ঢাকার ইফতার বহুল প্রচারিত ও প্রসিদ্ধ ইফতার। আরব-পারসিয়ান, মোগল ও ভারতীয় ভোজের সমন্বয়ে বাঙালির ইফতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।

বেশির ভাগ পরিবারে সবাই একসঙ্গে বসে ইফতার করার সংস্কৃতি রয়েছে। আত্মীয়-স্বজন বা পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে ইফতার ভাগাভাগি করার রেওয়াজ আছে। গ্রামাঞ্চলে সাধারণত মসজিদে একত্র হয়ে ইফতার করার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। সাধারণত নিজ থেকেই মহল্লাবাসী কে কবে ইফতারের আয়োজন করবে, তা মসজিদ কমিটি বা ইমাম সাহেবকে জানিয়ে রাখা হয়।

অনেকে প্রান্তিক ও অসহায় গোষ্ঠীর মধ্যে ইফতার বিতরণ করেন। এভাবেই ধর্মীয় অনুপ্রেরণা ও মানবতার মিশ্রণে বাঙালির ইফতার হয়ে উঠেছে জাতিগত সংস্কৃতি ও মানবতার প্রতিবিম্ব।

ইফতার মাহফিল

বাংলাদেশে রমজান মাসজুড়ে ইফতার পার্টি আয়োজনের সামাজিক প্রচলন রয়েছে, যেখানে আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী বা ব্যাবসায়িক পার্টনারদের আমন্ত্রণ জানানো হয়, বিশেষ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ইফতার মাহফিল ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইফতার ও রোজার আবেদনকে কেন্দ্র করে আয়োজিত এই ইফতার মাহফিলগুলোতে সরকারি দল, বিরোধী দল ও ভিন্নমতের নানা সংগঠন দেশের চলমান বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে গঠনমূলক কথা বলে। রাষ্ট্রীয় উন্নতি-অবনতি, সামাজিক অবক্ষয়, দুর্নীতিসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংগতি-অসংগতির আলোচনা-সমালোচনা এবং সমাজসেবামূলক কোনো উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য প্রেরণা জোগাতে সাধারণত এজাতীয় ইফতার মাহফিলগুলো অনুষ্ঠিত হয়। এ ধরনের ইফতার মাহফিলে সাধারণত বিভিন্ন শ্রেণির নেতারা, সংবাদকর্মী ও ধর্মীয় নেতারা উপস্থিত থাকেন। অনুষ্ঠান শেষে দেশ, জাতি, ধর্ম ও মানবতার কল্যাণ কামনা করে দোয়া-মোনাজাত করা হয়।

শবেকদরের সংস্কৃতি

বাঙালি মুসলিম সমাজে রমজান উদযাপনের অন্যতম উপলক্ষ হলো শবেকদর। মহিমান্বিত এ রাতের সন্ধানে রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে বিশেষ ইবাদতের আয়োজন করা হয়। সাতাশতম রাতকে শবেকদর হিসেবে ধরে নেওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়, যদিও ইসলামে কোনো নির্দিষ্ট দিন বলা হয়নি। এ রাতে মসজিদ, ঘর ও বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সুন্দর করে সাজানো হয়। রাতভর নফল নামাজ, তিলাওয়াত, দোয়া ও জিকির করা হয়। প্রায় মসজিদগুলোতে বিশেষ ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন হয়। অতঃপর মধ্য রাতে মোনাজাতে জীবনের গুনাহ মাফ, আত্মীয়-স্বজনের কল্যাণ, দুনিয়া ও আখিরাতের শান্তি কামনা করা হয়। অনেকে শবেকদরের বরকত লাভের জন্য শেষ ১০ দিন মসজিদে ইতিকাফে বসেন।

 

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ