<p>মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়ের নাম বিয়ে। বিয়ের মাধ্যমে দুজন নারী-পুরুষের নতুন পথচলা শুরু হয়। জীবনের এই পথ চলায় পারস্পরিক রাগ-অভিমান ও অভিযোগ-অনুযোগ থাকা আনুষঙ্গিক বাস্তবতা। এ বাস্তবতা মেনেই এগুলো দ্রুত মিটিয়ে ফেলতে হয়। দীর্ঘদিন জিইয়ে রাখলে দাম্পত্য জীবনে তিক্ততা চলে আসে। এ ক্ষেত্রে নারীর পাশাপাশি পুরুষের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দাম্পত্য জীবনে একজন আদর্শ পুরুষের বৈশিষ্ট্য কী হবে কোরআন-হাদিসের আলোকে এর  কয়েকটি দিক এ লেখায় তুলে ধরা হলো।</p> <p><strong>স্বামী দ্বিনদার ও সচ্চরিত্রবান হওয়া</strong></p> <p>একজন আদর্শ স্বামী হিসেবে সচ্চরিত্রবান হওয়া একান্ত কাম্য। অন্যথায় স্বামী-স্ত্রী পরস্পরে অস্থিরতা ও দূরুত্ব তৈরি হয়। কোরআনে সচ্চরিত্রবান স্বামীদের  প্রশংসা করে আল্লাহ বলেন, অপবিত্র নারীগণ অপবিত্র পুরুষদের উপযুক্ত এবং অপবিত্র পুরুষগণ অপবিত্র নারীদের উপযুক্ত। পবিত্র নারীগণ পবিত্র পুরুষদের উপযুক্ত এবং পবিত্র পুরুষগণ পবিত্র নারীদের উপযুক্ত। (সুরা : নুর, আয়াত : ২৬)</p> <p>এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা যে লোকের দ্বিনদারি ও নৈতিক চরিত্রে সন্তুষ্ট আছ, তোমাদের কাছে যদি সে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তবে তার সঙ্গে (তোমাদের পাত্রীর) বিয়ে দাও। তা না করলে পৃথিবীতে ফিতনা-ফ্যাসাদ ও বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়বে।’ সাহাবিগণ বলেন, হে আল্লাহর রাসুল, কিছু (ত্রুটি) তার মাঝে থাকলেও কি? তিনি বলেন, ‘তোমাদের কাছে যে লোকের ধর্মভীরুতা ও নৈতিক চরিত্র পছন্দ হয় সে লোক তোমাদের কাছে বিয়ের প্রস্তাব করলে তবে তার সঙ্গে বিয়ে দাও।’ (বর্ণনাকারী বলেন) এ কথা তিনি তিনবার বলেন। (তিরমিজি, হাদিস : ১০৮৫)</p> <p><strong>স্ত্রীর নামাজের ব্যাপারে যত্নবান হওয়া</strong></p> <p>দাম্পত্য জীবনের প্রধান সুখ আল্লাহর বিধান নামাজ আদায়ে। নামাজের এই বিধান যথাযথ আদায় করতে স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে সহযোগিতা করবে। তবে স্বামী এ ব্যাপারে বিশেষ সতর্ক দৃষ্টি রাখবে।  </p> <p>হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ ওই ব্যক্তির ওপর রহম করেন, যে রাত জেগে সালাত আদায় করে; অতঃপর সে তার স্ত্রীকে ঘুম থেকে জাগ্রত করে। আর যদি সে ঘুম থেকে উঠতে না চায়, তাহলে সে তার মুখে পানি ছিটিয়ে দেয় (নিদ্রাভঙ্গের জন্য)।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ১৩০৮)</p> <p><strong>স্ত্রীকে পর্দায় রাখা</strong></p> <p>স্ত্রী পর্দা করার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর আনুগত্য করা। কেননা তাঁদের আনুগত্য প্রতিটি নর-নারীর ওপর ফরজ করা হয়েছে। তাই একজন আদর্শ স্বামী হিসেবে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো, স্ত্রীকে পর্দায় রাখা, যাতে পরপুরুষ তার সৌন্দর্য দেখতে না পারে। অন্যথায় পাপ ও ফেতনার অনেক রাস্তা খুলে যাবে। একবার আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) পাতলা কাপড় পরিহিত অবস্থায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এলে রাসুল (সা.) তার থেকে নিজের মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলেন, ‘হে আসমা, মেয়েরা যখন সাবালিকা হয়, তখন এই দুটি অঙ্গ ছাড়া অন্য কোনো অঙ্গ প্রকাশ করা তার জন্য সংগত নয়, এ বলে তিনি তাঁর চেহারা ও দুই হাতের কবজির দিকে ইশারা করেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪১০৪)</p> <p><strong>স্ত্রীর প্রতি আন্তরিক হওয়া</strong></p> <p>যেকোনো কাজে স্ত্রীর প্রতি আন্তরিক হওয়া একজন আদর্শ স্বামীর অনন্য বৈশিষ্ট্য। বিশেষভাবে স্বামীর পরিবারের সব সদস্যের স্বভাব-চরিত্র ও মেজাজ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া, যাতে পরিস্থিতির বাস্তবতা বুঝে সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলতে পারে। তা ছাড়া সময়-সুযোগে তাদের সঙ্গে দ্বিনি আলোচনা করা। এক বর্ণনায়  নবীজি (সা.) বলেন, ‘তোমরা নারীদের ব্যাপারে উত্তম ব্যবহারের উপদেশ গ্রহণ করবে। কেননা নারী জাতিকে পাঁজরের হাড় দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। আর পাঁজরের হাড়গুলোর মধ্য থেকে ওপরের হাড়টি অধিক বাঁকা। তুমি যদি তা সোজা করতে যাও, তাহলে তা ভেঙে ফেলবে আর যদি ছেড়ে দাও, তাহলে সব সময় তা বাকাই থেকে যাবে। কাজেই নারীদের নম্র উপদেশ দিতে থাকো।’ (বুখারি, হাদিস : ৩৩৩১)</p> <p><strong>স্ত্রীর সার্বিক খোঁজখবর রাখা</strong></p> <p>আদর্শ স্বামীর পরিচয় হলো, প্রতিনিয়ত স্ত্রীর খোঁজখবর রাখা। কখন কী প্রয়োজন তা পূরণে সচেষ্ট হওয়া। আমাদের প্রিয়নবী (সা.)-ও তাঁর স্ত্রীদের প্রতি অত্যন্ত যত্নশীল ছিলেন। তিনি প্রতিদিন সব স্ত্রীর খোঁজ নিতেন এবং সবার সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটাতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘ফজরের নামাজের পর নবী (সা.) নামাজের স্থানে বসে থাকতেন। সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত লোকেরাও তাঁর চারপাশে বসে থাকত। অতঃপর তিনি তাঁর প্রত্যেক স্ত্রীর কাছে যেতেন, তাদের সালাম দিতেন, তাদের জন্য দোয়া করতেন আর যার দিন থাকত তার কাছে গিয়ে বসতেন।’ (তাবরানি, হাদিস : ৮৭৬৪)</p> <p><strong>স্ত্রীর ওপর অযথা রাগ না করা</strong></p> <p>একজন আদর্শ স্বামীর বৈশিষ্ট্য হলো স্ত্রীর ওপর অযথা রাগ, শারীরিক বা মানসিক আঘাত ও সামান্য ব্যাপারে প্রভাব বিস্তার না করা। কারণ এর দ্বারা পারিবারিক অস্থিরতা তৈরি হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো তাঁর স্ত্রীদের শারীরিক বা মানসিক আঘাত করেননি। কোনো কারণে ক্রোধান্বিত হলে তিনি চুপ হয়ে যেতেন এবং তাঁর চেহারা মোবারক লাল হয়ে যেত। কিন্তু তিনি কোনো কটু কথা বলতেন না। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে খাদেম ও কোনো স্ত্রীকে প্রহার করতে দেখিনি।’ ( আবু দাউদ, হাদিস : ৪৭৮৬)</p> <p><strong>স্ত্রীর মন বোঝার চেষ্টা করা</strong></p> <p>স্ত্রী কখনো অভিমান করলে বা মন খারাপ করলে তাকে বোঝার চেষ্টা করা এবং তার কষ্টের কথা গুরুত্বের সঙ্গে শোনা। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) তাঁর স্ত্রীদের মন বোঝার চেষ্টা করতেন। এবং তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করতেন। এক সফরে রাসুলুল্লাহ (সা.) এগিয়ে যান এবং সাফিয়া (রা.) পিছিয়ে পড়েন। এতে তিনি কেঁদে ফেলেন। মহানবী (সা.) তখন নিজ হাতে তাঁর চোখ মুছে দেন এবং কাঁদতে নিষেধ করেন।’ (সুনানে কুবরা লিন-নাসায়ি, হাদিস : ৯১৬২)</p> <p><strong>স্ত্রীর পরিবার ও প্রিয়জনকে ভালোবাসা</strong></p> <p>স্বামীর পরিবার ও প্রিয়জনকে আদর আপ্যায়ন ও ভালোবাসা যেমন স্ত্রীর দায়িত্ব তেমনিভাবে স্ত্রীর পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবকে উত্তমরূপে আতিথেয়তা ও আদর যত্ন করাও স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুল (সা.) খাদিজা (রা.)-এর বান্ধবীদের খোঁজখবর নিতেন ও তাঁদের জন্য খাবার পাঠাতেন। (মুসলিম, হাদিস : ২৪৩৫)</p> <p><strong>ঘরের কাজে সহযোগিতা করা </strong></p> <p>সাধারণত ঘরের কাজগুলো স্ত্রীরা গুছিয়ে রাখে। স্বামী বাইরে উপার্জনে ব্যস্ত থাকে। তবে একজন আদর্শ পুরুষের কর্তব্য হলো, ঘরে থাকাকালীন সাংসারিক কাজগুলোতে স্ত্রীকে সহযোগিতা করা। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) ও পরিবারের কাজে সহায়তা করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘মহানবী (সা.) জুতা ঠিক করতেন, কাপড় সেলাই করতেন এবং তোমরা যেমন ঘরে কাজ করো তেমনি কাজ করতেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২৫৩৮০)</p> <p><strong>স্ত্রীর কাজের প্রশংসা ও তার অবদান স্বীকার করা </strong></p> <p>খাদিজা (রা.) সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মানুষ যখন আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে তখন সে [খাদিজা (রা.)] আমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে, মানুষ যখন আমাকে বঞ্চিত করেছে তখন সে তাঁর সম্পদ দ্বারা আমাকে সমৃদ্ধ করেছে, আল্লাহ আমাকে তাঁর গর্ভ থেকে সন্তান দিয়েছেন যখন তিনি অন্য স্ত্রীদের সন্তান থেকে আমাকে বঞ্চিত করেছেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২৪৮৬৪)</p> <p>মহান আল্লাহ আমাদের সবার দাম্পত্য জীবন সুখময় করুন।</p> <p> </p> <p> </p>