আরবিতে ‘হায়া’ অর্থ লজ্জা বা সংকোচ বোধ করা, ইতস্তত বোধ করা ইত্যাদি। সহজভাবে বলা যায়, লজ্জা হচ্ছে এক ধরনের মানবীয় অনুভূতি, যা মানুষকে মন্দ কাজে বাধা দেয় এবং জনসমক্ষে সম্মানহানির ভয় সৃষ্টি করে। ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, ‘হায়া’ অর্থ শরম, বৃষ্টি, তরতাজা ইত্যাদি, যা ‘হায়াত’ শব্দমূল থেকে উৎপন্ন। এর অর্থ হলো ‘জীবন’।
মুসলমানের জীবনযাপনে শালীনতা
আলেমা হাবিবা আক্তার

ইসলামে লজ্জা ও শালীনতার গুরুত্ব
ইসলামের দৃষ্টিতে লজ্জা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণ। যেমন—
১. লজ্জা ঈমানের অংশ : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘লজ্জা ঈমানের অঙ্গ।’
(মুসলিম, হাদিস : ৫১)
২. আল্লাহর গুণ : লজ্জা মহান আল্লাহর গুণ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীল, লজ্জাশীল।
৩. নবী-রাসুলদের গুণ : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, মুসা (আ.) ছিলেন অত্যন্ত লজ্জাশীল একজন ব্যক্তি। অধিক লজ্জার কারণে তাঁর শরীরের সামান্য ত্বকও দেখা যায়নি। (বুখারি, হাদিস : ৩৪০৪)
৪. লজ্জা কল্যাণের বাহক : মহানবী (সা.) বলেছেন, লজ্জা-শালীনতার পুরোটাই কল্যাণ। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪৭৯৬)
৫. লজ্জা জান্নাত লাভের মাধ্যম : লজ্জা ঈমানের অঙ্গ, আর ঈমানদারদের স্থান জান্নাত।
৬. লজ্জা ইসলামের চরিত্র : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, প্রতিটি ধর্মের একটা চরিত্র আছে, আর ইসলামের মূল চরিত্র হলো লজ্জাশীলতা।
(ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪১৮১)
জীবনযাপনে লজ্জার প্রয়োগ
১. স্বভাবজাত লজ্জা রক্ষা : আল্লাহ সৃষ্টিগতভাবে মানুষের মধ্যে লজ্জা ও শালীনতার বোধ রেখেছেন। মুমিনের উচিত তা রক্ষা করা। এ জন্য নবীজি (সা.) কারো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেন না, তিনি খোলা স্থানে গোসল করতেন না। পাপ কাজে সংকোচ বোধ করা স্বভাবজাত লজ্জার একটি দিক। তাকে গুরুত্ব দেওয়া।
২. একান্ত ব্যক্তিগত জীবনে শালীনতা : একান্ত ব্যক্তিগত জীবনেও মুমিন লজ্জা ও শালীনতা রক্ষা করবে। যেমন—আয়েশা (রা.) বলেছেন, আমি ও রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো পরস্পরের লজ্জাস্থান দেখিনি।
৩. কথা ও কাজে শালীনতা রক্ষা করা : মুমিন তার কথা ও কাজে লজ্জা ও শালীনতা রক্ষা করে চলবে। কেননা লজ্জা ও শালীনতা না থাকলে ব্যক্তি যেকোনো অন্যায় কাজও করে ফেলতে পারে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যখন তুমি নির্লজ্জ হয়ে পড়বে, তখন যা ইচ্ছা তা-ই করো।
(বুখারি, হাদিস : ৬১২০)
৪. পোশাক-আশাকে শালীনতা রক্ষা করা : নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য শালীন পোশাক পরা আবশ্যক। কেননা আল্লাহ পোশাককে লজ্জা নিবারণের মাধ্যম বানিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে বনি আদম! তোমাদের লজ্জাস্থান ঢাকার জন্য ও বেশভূষার জন্য আমি তোমাদের পোশাক দিয়েছি। আর তাকওয়ার পোশাক, এটাই সর্বোত্কৃষ্ট।’
(সুরা : আরাফ, আয়াত : ২৬)
৫. সমাজ থেকে অশ্লীলতা দূর করা : সামাজিক জীবন থেকে অশ্লীলতা দূর করা না গেলে শালীন জীবন যাপন করা সম্ভব নয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে দিতে ভালোবাসে, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। (সুরা : নুর, আয়াত : ১৯)
আল্লাহ সবাইকে সুমতি দান করুন। আমিন।
সম্পর্কিত খবর

কোরআন থেকে শিক্ষা
- পর্ব, ৭৪৬

আয়াতের অর্থ : ‘কিন্তু তারা কিয়ামতকে অস্বীকার করেছে এবং যে কিয়ামতকে অস্বীকার করে তার জন্য আমি প্রস্তুত রেখেছি জ্বলন্ত অগ্নি। দূর থেকে অগ্নি যখন তাদেরকে দেখবে তখন তারা শুনতে পাবে তার ক্রুদ্ধ গর্জন ও চিৎকার; আর তাদেরকে শৃঙ্খলিত অবস্থায় তার কোনো সংকীর্ণ স্থানে নিক্ষেপ করা হবে, তখন তারা তথায় ধ্বংস কামনা করবে। তাদেরকে বলা হবে, আজ তোমরা একবারের জন্য ধ্বংস কামনা কোরো না, বহুবার ধ্বংস হওয়ার কামনা করতে থাকো। ...সেথায় তারা যা চাইবে তাদের জন্য তাই থাকবে এবং তারা স্থায়ী হবে; এই প্রতিশ্রুতি পূরণ তোমার প্রতিপালকেরই দায়িত্ব।
আয়াতগুলোতে জাহান্নামের ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে।
শিক্ষা ও বিধান
১. কিয়ামতের বিশ্বাস ঈমানের অপরিহার্য অংশ। কিয়ামতে বিশ্বাস না করলে কেউ মুসলমান হতে পারে না।
২. কিয়ামতে অবিশ্বাসের শাস্তি জাহান্নাম।
৩. আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বিশ্বাস হলো, জাহান্নাম এখনো বিদ্যমান। আল্লাহ তা অনাদিকাল থেকে জাহান্নামিদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন।
৪. পৃথিবীতে মানুষের কাছে মৃত্যু যতটা অনাকাঙ্ক্ষিত, জাহান্নামে পাপীদের কাছে মৃত্যু ততটা কাঙ্ক্ষিত হবে।
৫. আল্লাহ অনুগ্রহপূর্বক বান্দাকে জান্নাত দানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। নতুবা আল্লাহর ওপর কোনো কিছু অপরিহার্য নয়। (বুরহানুল কুরআন : ২/৬০৭)

জাহেলি আরবে যেসব মূর্তির পূজা হতো
মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ

লাত ও উজ্জা ছিল কুরাইশের দুই দেবতা। কুরাইশের লোকেরা ঘুমানোর আগে লাত ও উজ্জার পূজা করত।
(মুসনাদে আহমাদ, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-২২২)
এ দুটির নামে কসম খেতো। হজের সময় তারা ‘মানাত’কে ঘিরে তাওয়াফ করত।
(মুজামুল বুলদান, ‘আল-উজ্জা’ ভুক্তি)
সুরা নুহের ভেতর যেসব মূর্তির কথা বলা হয়েছে আরবের বিভিন্ন গোত্র এগুলোর পূজা করত। ‘ওয়াদ্দ’ ছিল দুমাতুল জান্দালে বনি কালবের দেবতা। ‘সুওয়াআ’ ছিল হুজাইল গোত্রের দেবতা। মুরাদ ও বনি গাতফানের গোত্রগুলোর দেবতা ছিল ‘ইয়াগুস’।
মূর্তির নাম বিশ্লেষণ
লাত : আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) ও অন্যদের থেকে বর্ণিত হয়েছে যে লাত শব্দটি থেকে এটা নিষ্পন্ন, এর অর্থ হলো সংমিশ্রণ।
আল-উজ্জা : আল-উজ্জা অর্থ হলো প্রতাপ, প্রতিপত্তি। এই শব্দের ইসমুত তাফজিল বা অগ্রাধিকার-বিশেষণ ও স্ত্রীলিঙ্গ হলো উজ্জা। অর্থাৎ মহাপরাক্রমশালী দেবী।
(সহিহ বুখারি, গাজওয়াতু উহুদ)
মানাত : মানাত শব্দটি কয়েকটি মূল ধাতু থেকে নির্গত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। ‘লিসানুল আরব’ প্রণেতা উল্লেখ করেছেন যে মানাত-এর ‘তা’ স্ত্রীলিঙ্গবাচক। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, মানাত ভাগ্য ও মৃত্যুর দেবী ছিল।
ওয়াদ্দ : ওয়াদ্দ অর্থ অনুরাগ ও ভালোবাসা। এর বিপরীতে ছিল ঘৃণা ও শত্রুতার দেবী, তার নাম ছিল নিকরা। ওয়াদ্দ দেবতার কথা বিভিন্ন শিলালিপিতে পাওয়া যায়।
সুওয়াআ : আরবি ভাষা সুওয়াআ শব্দটির মূল ধাতু পাওয়া যায় না। যার অর্থ যুগ।
ইয়াউক : যার অর্থ রুখে দেওয়া। এই মূর্তির পূজা করত ইয়ামানবাসীরা। তাদের মধ্যে প্রতীক হিসেবে ভবিষ্যত্বাচক ক্রিয়াপদের ব্যাপকতা ছিল।
ইয়াগুস : ইয়াউকের পদ্ধতি অনুযায়ী ইয়াগুসও একটি প্রতীক। এর অর্থ হলো ফরিয়াদ করা। সুতরাং ইয়াগুসের অর্থ হলো যে ফরিয়াদ শোনে এবং ফরিয়াদের প্রতিকার করে।
নাসর : নাসর একটি পরিচিত পাখি শকুন। আকাশে শকুন আকৃতি ধারণকারী একগুচ্ছ নক্ষত্রকে নাসর (ভেগা) বলা হয়। ভেগা নক্ষত্র একটি দেবতা হিসেবে দীর্ঘকাল পর্যন্ত সেমেটিক জাতিগোষ্ঠীগুলোর পূজা লাভ করেছে। বাবেলের অন্যতম দেবতা ছিল নাসরুক। ইদানীংকালে বাবেলে এই দেবতার মূর্তি উদ্ঘাটিত হয়েছে।
বায়াল : বায়াল সম্পর্কে আগেই বলা হয়েছে যে এই দেবতা শামের উপাস্য ছিল। এ প্রসঙ্গেই এটির উল্লেখ কোরআন মাজিদে রয়েছে। বায়ালের শাব্দিক অর্থ শক্তি। রূপকার্থে নেতা ও সর্দারকেও বায়াল বলা হয়। একইভাবে স্বামী অর্থেও বায়াল শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কোরআন মাজিদে শব্দটি দ্বিতীয় অর্থে বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। আরবের একটি বিখ্যাত দেবতা ছিল হুবাল। হুবাল ছিল কুরাইশের সবচেয়ে বড় উপাস্য। হুবাল বায়ালেরই
বিকৃতরূপ।
আরবের মূর্তি ইউরোপে
বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে আরবের তাওহিদবাদীরাই প্রথমে ইউরোপীয় দেশগুলোতে একত্ববাদের আলো ছড়ান, একইভাবে আরবের জাহেলি যুগই ইউরোপের মূর্তিপূজাকালের শিক্ষক ছিল। আরব বণিকদের মাধ্যমে গ্রিসে, গ্রিস থেকে ইউরোপের অন্যান্য দেশে আরবের দেবদেবী ছড়িয়ে পড়ে। সেসব দেশের লোকেরা এসব মূর্তির সামনে সিজদাবনত হয়ে এগুলো উপাসনা করতে শুরু করে। কথিত আছে যে গ্রিক দেবী লেটো (জিউসের পত্নী খবঃড়) আরবের লাতেরই বিকৃতরূপ। একইভাবে হুবাল হার্মিস হয়েছে। হুবাল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা এসেছে ‘মুজামুল বুলদান’ নামক গ্রন্থে। কিছু প্রাচ্যবিদ এ বিষয়ে পুস্তিকা রচনা করেছেন। (এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলাম,
খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩৮০)

নবীযুগের প্রখ্যাত কারি উবাই ইবনে কাব (রা.)
মাওলানা মুহিউদ্দীন হাতিয়ূভী

নবীজি (সা.)-এর বিশেষ প্রতিভাবান সাহাবিদের একজন সাইয়্যিদুল কুররা উবাই ইবনে কাব (রা.)। তাঁর নাম উবাই। উপনাম আবু মুনযির ও আবুত তুফাইল। প্রথমটি দিয়েছেন রাসুল (সা.) এবং দ্বিতীয়টি হজরত উমর (রা.)।
ইসলাম-পূর্ব জীবন ও ইসলাম গ্রহণ
হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে ইসলাম-পূর্ব জীবনে মদিনায় ইহুদিদের অন্যতম ধর্মগুরু গণ্য করা হতো।
রাসুল (সা.) মদিনায় হিজরতের পূর্বে কোনো একসময় উবাই ইবনে কাব (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন।
ওহি লেখার সৌভাগ্য
যাঁরা রাসুল (সা.)-এর ওহি লিখতেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.)। হজরত যায়েদ ইবনে সাবিত (রা.)-এর পূর্বে তিনিই ওহি লিখতেন। তিনি উপস্থিত না থাকলে রাসুল (সা.) হজরত যায়েদ (রা.)-কে ডেকে নিতেন। পরবর্তী সময়ে হজরত যায়েদ (রা.) বেশি লিখতেন।
(আল-ইস্তিআব : ১/৬৮)
ইলমি দক্ষতা
উবাই ইবনে কাব (রা.) ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদিতে ব্যস্ত না হয়ে মসজিদে নববীতে কোরআনের পাঠ-পঠন-পদ্ধতিসহ দ্বিনি ইলম অর্জনের পেছনে সময় দিতেন। এভাবে রাসুল (সা.)-এর সাহচর্যে থেকে ইলমে ওহির বিশাল ভাণ্ডার অর্জন করেন। একসময় তিনি ইলম ও আমলের সাজে সজ্জিত হয়ে মহান মর্যাদার অধিকারী হন। রাসুল (সা.)-এর যুগেই তিনি ফতোয়া দিতেন। দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.) তারাবির জামাত চালু করেন। ইমাম হিসেবে নিয়োগ দেন হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে।
(আল-আ‘লাম : ১/৮২; সিয়ার আ‘লামিন নুবালা : ১/৩৯৪; আবু দাউদ : ১/২০২)
ইমাম শাবি (রহ.) তাবেঈ মাসরূক (রহ.) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.)-এর পক্ষ থেকে অনুমোদনপ্রাপ্ত বিচারক ও ফতোয়া দাতা ছয়জনের একজন ছিলেন উবাই ইবনে কাব (রা.)।
(উসদুল গাবাহ : ১/৬২)
ইলমে কিরাআত ও উবাই ইবনে কাব (রা.)
রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায় তিনি কোরআনের একটি পূর্ণ সংকলন প্রস্তুত করেন এবং তা রাসুল (সা.)-এর সামনে পেশ করেন। এই সংকলনটি ‘মাসহাবে উবাই’ নামে খ্যাত ছিল। কোরআনের বিভিন্ন পাঠ-পদ্ধতিতে ছিল তাঁর অসাধারণ দক্ষতা। তাঁর তিলাওয়াতে ছিল বিশেষ আকর্ষণ। রাসুল (সা.) মাঝেমধ্যে তাঁর থেকে কোরআন শুনতেন। আনাস (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.) উবাইকে বললেন, আল্লাহ আমাকে আদেশ করেছেন, তোমাকে কোরআন শোনাতে। হজরত উবাই বললেন, ‘আল্লাহ কি আমার নাম উল্লেখ করেছেন?’ ইরশাদ করলেন, ‘হ্যাঁ।’ এরপর বললেন, ‘আমি রাব্বুল আলামিনের দরবারে আলোচিত হয়েছি?’ ইরশাদ করলেন, ‘হ্যাঁ।’ তখন তাঁর দুই চোখ অশ্রুতে ভরে গেল। (বুখারি : ৭৪১, মুসলিম : ১/২৬৯,
সিয়ার আ‘লামিন নুবালা : ১/৩৯৪)
হাদিস : উবাই ইবনে কাব (রা.) সূত্রে ১৬৪টি হাদিস বর্ণিত আছে। এর মধ্যে বুখারি-মুসলিম যৌথভাবে তিনটি এবং পৃথকভাবে বুখারি তিনটি ও মুসলিম সাতটি হাদিস বর্ণনা করেছেন।
ইন্তেকাল : উবাই ইবনে কাব (রা.) মদিনায় ইন্তেকাল করেন। (মু‘জামুস সাহাবা : ১/৩)
তবে কোন সনে, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। আবু নু‘আইম (রহ.) বলেন, এক মতে ২২ হিজরি উমর (রা.)-এর খিলাফতে, আবার এক মতে ৩০ হিজরি উসমান (রা.)-এর খিলাফতে। দ্বিতীয় মতই গ্রহণযোগ্য। (উসদুল গাবাহ : ১/৬৩ পৃ.; আল-ইসাবাহ : ১/১৮১-১৮২ পৃ.; আত-ত্বাবাকাতুল কুবরা : ৩/৩৮১ পৃ., ক্র.১৭৪; তাহজিবুল আসমা ওয়াল লুগাত : ১/১০৯-১১০ পৃ.)
লেখক : মুহাদ্দিস ও গবেষক

জান্নাতে আল্লাহর দিদার লাভের ৬ আমল
আসআদ শাহীন

আল্লাহ তাআলাকে নিজ চোখে দেখা মহা সৌভাগ্যের বিষয়, যা পরকালে মুমিনদের জন্য নির্ধারিত। জান্নাতের অফুরন্ত সুখ-সুবিধা ও অনাবিল আনন্দের মধ্যেও আল্লাহর দিদার হবে এমন এক পরম আনন্দ, যা জান্নাতবাসীরা অন্য সব আনন্দ ভুলে যাবে।
আসুন, জান্নাতে আল্লাহর দিদার লাভের কিছু আমল জেনে নিই—
প্রথম আমল : ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করা
আল্লাহর দিদার লাভের প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো, একজন ব্যক্তি ইসলামের অনুসরণে থেকে মৃত্যুবরণ করবে। কারণ অবিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহর দিদার হারাম করা হয়েছে।
(সুরা : আল মুতাফফিফীন, আয়াত : ১৫)
অর্থাৎ গুনাহ ও কুফরির জন্য তাদের কঠিন শাস্তি হলো, তারা কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার দিদার থেকে বঞ্চিত হবে। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে মুমিনরা কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলাকে দেখতে পাবে, আর কাফিররা এই মহান নিয়ামত থেকে বঞ্চিত থাকবে।
দ্বিতীয় আমল : আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করা
আল্লাহ তাআলার দিদার লাভের অন্যতম মাধ্যম হলো—তাঁর কাছে এই মহান নিয়ামত লাভের জন্য আন্তরিকভাবে দোয়া করা।
তৃতীয় আমল : ফজর ও আসরের নামাজের পাবন্দি করা
জান্নাতে আল্লাহ তাআলার দিদার লাভের অন্যতম মাধ্যম হলো সব নামাজের প্রতি যত্নবান হওয়া, বিশেষত ফজর ও আসরের নামাজ নিয়মিতভাবে আদায় করা। জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন : একদা আমরা নবী করিম (সা.)-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তিনি রাতে (পূর্ণিমার) চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ওই চাঁদকে তোমরা যেমন দেখছ, ঠিক তেমনি অচিরেই তোমাদের প্রতিপালককে তোমরা দেখতে পাবে। তাঁকে দেখতে তোমরা কোনো ভিড়ের সম্মুখীন হবে না। কাজেই সূর্য উদয়ের ও অস্ত যাওয়ার আগের নামাজ (শয়তানের প্রভাবমুক্ত হয়ে) আদায় করতে পারলে তোমরা তা-ই করবে।
চতুর্থ আমল : গুনাহ থেকে মুক্ত থাকা
জান্নাতে আল্লাহ তাআলার দিদার লাভের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো—সব ধরনের গুনাহ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। হজরত আবু জর গিফারি (রা.) বর্ণনা করেন যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণির লোকের সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না এবং তাদের পবিত্র করবেন না; বরং তাদের জন্য রয়েছে ভয়ানক শাস্তি। বর্ণনাকারী বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এ কথাটি তিনবার পাঠ করলেন। আবু জর (রা.) বলে উঠলেন, তারা ধ্বংস হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে। হে আল্লাহর রাসুল! এরা কারা? তিনি বলেন, যে লোক পায়ের গোছার নিচে কাপড় ঝুলিয়ে চলে, কোনো কিছু দান করে খোঁটা দেয় এবং মিথ্যা শপথ করে পণ্যদ্রব্য বিক্রি করে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৯৪)
পঞ্চম আমল : আল্লাহ তাআলার সাক্ষাৎ ও দিদারের আকাঙ্ক্ষা
জান্নাতে আল্লাহ তাআলার দিদার লাভের অন্যতম মাধ্যম হলো—আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সাক্ষাতের প্রবল আকাঙ্ক্ষা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ পছন্দ করে, আল্লাহও তার সাক্ষাৎ পছন্দ করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ পছন্দ করে না, আল্লাহও তার সাক্ষাৎ পছন্দ করেন না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৫০৭)
ষষ্ঠ আমল : ইহসান করা
জান্নাতে আল্লাহ তাআলার দিদার লাভের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো ইহসান বা সৎকর্ম করা।
ইহসানের অর্থ হলো, সৃষ্টিজীবের প্রতি যেকোনো ভালো কাজ করা এবং কল্যাণমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখা। এটি এমন একটি গুণ, যা মানুষের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ সুগম করে। ইমাম জুরজানি (রহ.) ইহসানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, ইহসান হলো সেই কাজ, যা দুনিয়াতে প্রশংসিত হয় এবং পরকালে প্রতিদান ও সওয়াবের কারণ হয়। (আল-তারিফাত, পৃষ্ঠা-৯১)
আল্লাহ তাআলা আমাদের উপরিউক্ত আমল পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।