ঢাকা, সোমবার ৩১ মার্চ ২০২৫
১৭ চৈত্র ১৪৩১

ঢাকা, সোমবার ৩১ মার্চ ২০২৫
১৭ চৈত্র ১৪৩১
জেলার খেলা

থমকে আছে মেহেরপুর

  • মেহেরপুর
জাতীয় পর্যায়ে খেলোয়াড় জোগাড়ের পাইপলাইনই হচ্ছে ছোট-
জাতীয় পর্যায়ে খেলোয়াড় জোগাড়ের পাইপলাইনই হচ্ছে ছোট-
শেয়ার
থমকে আছে মেহেরপুর

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে মেহেরপুর নামটা। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বৈদ্যনাথতলা গ্রামের ঐতিহাসিক আম্রকাননেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথ। মুক্তিযুদ্ধে নতুন প্রাণ সঞ্চার করে এটা। সেই সঙ্গে বৈধতাও দেয় বাংলাদেশ সরকারের।

শপথ গ্রহণের জায়গাটিতে নির্মিত হয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ। এ ধরনের 'স্মৃতিফলক' নির্মাণ হতে পারে মেহেরপুর জেলা স্টেডিয়ামেও! কেননা এই জেলার ক্রীড়াঙ্গনের যা ঐতিহ্য সবই হয়ে পড়ছে স্মৃতি, মাঠের খেলায় নেমে এসেছে স্থবিরতা। গত তিন বছর এক প্রকার থমকেই আছে ক্রীড়াঙ্গন।

ক্রীড়াঙ্গনে সুনাম থাকা মেহেরপুরের এই হাল কেন? জেলা ক্রীড়া সংস্থায় নির্বাচন না হওয়াই এর আসল কারণ।

সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালেহ উদ্দিন আহমেদ আবলুর মেয়াদ শেষে গঠন করা হয় অ্যাডহক কমিটি। তিন মাসের মধ্যেই নতুন নির্বাচন দেওয়ার কথা তাদের। সেই কমিটি গলার কাঁটা হয়ে রয়ে গেছে তিন বছর! নির্বাচনের খবর নেই কোনো। এ নিয়ে হয়েছে মানববন্ধন, জেলা প্রশাসককে দেওয়া হয়েছে স্মারকলিপি।
নতুন নির্বাচনের আশ্বাস দিয়েছেন জেলা প্রশাসকও, কিন্তু তিন বছর কেটে গেলেও হয়নি সেটা। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালেহ উদ্দিন আহমেদ আবলু, 'গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অ্যাডহক কমিটির কাজ নির্বাচন দেওয়া, কারো বিচার করা নয়। অথচ সাধারণ সম্পাদক হলেও আমাকে পর্যন্ত দেওয়া হয়নি নির্বাচনের সুযোগ। এমনকি মামলা করে সেই অধিকার ফিরে পেলেও জেলা ক্রীড়া সংস্থার সদস্যসচিবের দায়িত্ব পাওয়া আতাউল হাকিম লাল মিয়া ক্ষমতার জোরে আটকে রেখেছেন নির্বাচন। এতে প্রশাসনেরও যোগসাজশ আছে।
হাইকোর্টে এই রায় স্টে করে নির্বাচন প্রলম্বিত করার পাঁয়তারাও হয়তো আছে। না হলে জেলা প্রশাসক বারবার আশ্বাস দিয়েও নির্বাচন দিচ্ছেন না কেন।'

নিজের নির্বাচন করার অধিকার ফিরে পেতে নিম্ন আদালতে মামলা করেছিলেন সালেহ উদ্দিন। সেখানে জেতার পর অ্যাডহক কমিটি রায়ের বিপক্ষে আপিল করে। তাতে খারিজ হয়ে যায় অ্যাডহক কমিটির আপিল। তার পরও নির্বাচন হচ্ছে না কেন? জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও একসময় ঢাকার ফুটবল মাতানো গোলরক্ষক ইমদাদুল হক জানালেন, 'ক্ষমতার দাপট আর রাজনৈতিক প্রভাবেই হচ্ছে না নির্বাচন। জেলা প্রশাসক বারবার আশ্বাস দিয়েছেন আমাদের। কখনো বলেছেন এক মাসের মধ্যে নির্বাচন হবে তো কখনো ১৫ দিনের মধ্যে। কিন্তু ক্ষমতার বলয়ে হয়তো তিনিও আটকে গেছেন, তাই নির্বাচন দিতে পারছেন না। এভাবে চললে ধংস হয়ে যাবে জেলার ক্রীড়াঙ্গন।'

পদাধিকার বলে জেলা প্রশাসকই জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি। মেহেরপুরের বর্তমান জেলা প্রশাসক মাহমুদ হোসেনের বিপক্ষেও যেহেতু অভিযোগের আঙুল তুলেছেন স্থানীয় সংগঠকরা তাই যোগাযোগ করা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি অবশ্য প্রতিশ্রুতি দিলেন যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের, 'এত দিন একটা মামলার জন্য কিছু করার ছিল না আমার। সেই মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। তাই নির্বাচনে আর বাধা নেই। আপনার মাধ্যমে ক্রীড়া সংগঠকদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দিয়ে দেব আমি।' জেলার ক্রীড়া সংগঠকরা এর আগেও এ ধরনের প্রতিশ্রুতি পেয়ে আশাহত হওয়ায় আস্থা রাখতে পারছেন না এর পরও। বরং তাদের কারো কারো শঙ্কা যাত্রাপালা আর হাউজি এনে খেলার অঙ্গনটা না আবার ধংস করে দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে সদস্য সচিব আতাউল হাকিম লাল মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে কথা বলতে রাজি হননি তিনি।

স্থবিরতা নেমে আসায় মাঠের বদলে খেলা হচ্ছে কাগজ-কলমে এমন অভিযোগ অনেকেরই। এর একটা উদাহরণ দিতে অ্যাপোলো ক্রীড়া চক্রের সভাপতি শামীমুল ইসলাম শামীম জানালেন, 'ভলিবল লিগ তিন বছর পর হলো এবার। আমারও ক্লাব আছে। কিন্তু টুর্নামেন্টে দেখলাম একই খেলোয়াড় খেলছে ছয় দলের হয়ে! পোশাকের কোনো বালাই নেই। কেউ খেলছে শার্ট পরে, কেউ গেঞ্জি পরে তো কেউ কোর্টে নেমেছে লুঙ্গি পরেই! দেখার কেউ নেই।' তাঁর মতো অনেকের অভিযোগ প্রায় সব খেলাই হয়ে পড়েছে এমন নামসর্বস্ব। ২৫টি দলের নাম দেখিয়ে খেলানো হচ্ছে আট দল! এ জন্যই ফুটবল লিগ শেষ হয়েছে মাত্র ২০ দিনে। সেই টুর্নামেন্টে লাঞ্ছিত হয়েছে পুলিশ আর সাংবাদিকও। কিন্তু জেলা ক্রীড়া সংস্থার সঙ্গে জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের যোগটা কোথায়? দুটো তো আলাদা সংস্থা। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক আতাউল হাকিম লাল মিয়াই আবার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। দুটো প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার একজন থাকার নজির রয়েছে বাংলাদেশের অনেক জেলা ক্রীড়া সংস্থায়। কিন্তু সেই ব্যক্তির জন্য খেলার গতি থমকে যাওয়াটা অবশ্যই দুঃখজনক।

মেহেরপুরের ক্রীড়াঙ্গনে ক্রিকেটে দ্বিতীয় বিভাগ হয়েছে দুইবার। তবে সর্বসম্মতভাবেই সিদ্ধান্ত হয় শুধুই প্রথম বিভাগের। সেই থেকে প্রথম বিভাগে অংশ নিচ্ছে ২৮টির মতো দল। এই ২৮ দলের ১৩টিই আবার মেহেরপুর সদরের। তবে তিন বছরের মতো খেলা বন্ধ থাকায় হতাশ খেলোয়াড়দের সবাই। ক্রিকেটের চর্চা না থাকার প্রভাব পড়েছে বয়সভিত্তিক খেলাগুলোতেও। বিভাগীয় পর্যায়ের ম্যাচে গত বছর ৫৪ রানেও গুটিয়ে যাওয়ার লজ্জা আছে বয়সভিত্তিক একটা দলের। অথচ ২০১১ সালে বয়সভিত্তিক জাতীয় টুর্নামেন্টের অনূর্ধ্ব-১৮তে আঞ্চলিক রানার্সআপ হয়েছিল মেহেরপুর। ফাইনালে তারা হারে শক্তিশালী খুলনার কাছে। ২০১১ সালের ইন্টার স্কুল ক্রিকেটে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নও হয়েছিল মেহেরপুর সদরের কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিল। চর্চার অভাবে হারিয়ে গেছে সেই দলের খেলোয়াড়রা। কিছুদিন আগে অনূর্ধ্ব-১৪ ক্রিকেটে মাত্র ৫৪ রানে গুটিয়ে যাওয়ার লজ্জাও আছে তাদের। একটা সময় ছোট্ট মেহেরপুরের প্রতিভাবান ক্রিকেটার অনি অধিনায়ক হয়েছিলেন খুলনা অনূর্ধ্ব-১৮ দলের। খেলা না থাকায় হারিয়ে যেতে বসেছেন তিনিও। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ জেলা ক্রীড়া সংস্থার কাউন্সিলর ও ইমরুল কায়েস একাডেমির লেভেল ওয়ান করা কোচ মনিরুজ্জামান মনজা, 'খুব কষ্ট হয় ক্রীড়াঙ্গনের এই হাল দেখে। নোংরা রাজনীতির শিকার হয়ে ধ্বংস হতে চলেছে মেহেরপুরের খেলা। অনির মতো প্রতিভাবান খেলোয়াড় হারিয়ে যাচ্ছে কেবল খেলার সুযোগ না পাওয়াতেই।'

ব্রিটিশ আমল থেকেই টিনশেডের একটা স্টেডিয়াম ছিল মেহেরপুরে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অর্থায়নে ১৯৮৯ সালে নির্মিত হয় নতুন ভবন। সে সময় জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আজাদ স্পোর্টিংয়ের সভাপতি মকসুদ আলী। সেই স্টেডিয়ামের আধুনিকায়নে ১ কোটি ৮১ লাখ টাকায় চলছে উন্নয়নকাজ। নতুন করে নির্মিত হচ্ছে দুটো গ্যালারি। পানি নিষ্কাশনের জন্য উন্নত হচ্ছে ড্রেনেজ ব্যবস্থা। পাশাপাশি মাঠেও বসানো হবে সবুজ ঘাস। মোটামুটি এলাহি কাণ্ড। কিন্তু যার জন্য এত আয়োজন সেই খেলাই তো নেই? এর পরও মুজিবনগর বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী হওয়ায় পর্যটনের বিকাশে এখানে উন্নত মানের একটা স্টেডিয়াম নির্মাণের দাবি এলাকাবাসীর। 'মেহেরপুরনিউজ'-এর বার্তা সম্পাদক ইয়াদুল মোমিন জানালেন, 'মুজিবনগরে একটা ভালো মানের স্টেডিয়াম প্রাণের দাবি এলাকাবাসীর। এটা হলে স্টেডিয়াম ঘিরে গড়ে উঠবে উন্নতমানের কিছু হোটেল আর প্রসার ঘটবে পর্যটনের। এর আগে অবশ্য খেলা ফেরাতে হবে মাঠে।'

জেলার খেলা একপ্রকার ঘুমিয়ে থাকলেও ভারোত্তোলন গুরু মোয়াজ্জেম হোসেনের প্রচেষ্টায় এই খেলায় সাফল্য যথেষ্টই। ১৯৯৬ সালে জাতীয় জুনিয়র ভারোত্তোলনে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর থেকে জয়যাত্রার শুরু। হামিদুল ইসলাম তো এসএ গেমসে সোনাই জিতেছেন। এ ছাড়া জাতীয় পর্যায়ে অসংখ্য পদক আছে একরামুল হক, আশরাফুল হক, ফরিদ হোসেন, নজরুল ইসলামসহ আরো অনেকের। তাঁরা সবাই মোয়াজ্জেম হোসেনের ছাত্র। আর এই 'পাঠশালা' কিন্তু মেহেরপুর সদরে নয়, গাংনী উপজেলায় গড়ে তুলেছেন মোয়াজ্জেম।

জেলা ক্রীড়া সংস্থা সক্রিয় না হলেও স্থানীয় পর্যায়ে অবশ্য টুর্নামেন্ট হয় কিছু। গত বছর ডিসেম্বরে গভীপুর ভৈরব ক্লাব আয়োজন করেছিল ফুটবল টুর্নামেন্ট। ফাইনালে ঝাঁঝা একাদশকে হারিয়ে এর শিরোপা জেতে ফতেপুর একাদশ। মেহেরপুর টেবিল টেনিস ক্লাবের উদ্যোগে হয়েছে বিজয় দিবস টেবিল টেনিস। বিজয় দিবস সামনে রেখে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রীতি ফুটবল ও ক্রিকেট ম্যাচ হয়েছে মেহেরপুর জেলা প্রশাসন দল ও পৌরসভার দলের। ফুটবলের পাশাপাশি ক্রিকেটেও জিতেছিল জেলা প্রশাসন দল। বড়বাজার তরুণ সংঘের উদ্যোগে মরহুম সামসুজ্জোহা নগর উদ্যানে গত বছর অনুষ্ঠিত ছহিউদ্দিন স্মৃতি ব্যাডমিন্টনে চ্যাম্পিয়ন হয় পল্টু-সজীব জুটি।

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ