<p>মাথায় টাক আছে বলেই বাংলার মানুষ আদিকাল থেকে এ পাখিকে মদনটাক বলে আসছে। অতিকায় এ পাখির পুচ্ছ ও ডানায় বৈঠার মতো বড় বড় পালক থাকলেও মাথা প্রায় পালকহীন। কিন্তু মাথার এই টাক কিন্তু মদনটাকের জন্য কোনো সমস্যা নয় এবং টাক সমস্যার কোনো সমাধান চায় না এই টেকো পাখি। বল্লমের মতো বিরাট চঞ্চু কাদাপানির গভীরে ঢুকিয়ে খাদ্য খুঁজতে হয় বলে মাথায় পালক না থাকাই বরং ওদের জন্য সুবিধার। শিকারি পাখি নয় বলে মদনটাক শুধু মৃত, অর্ধমৃত ও দুর্বল প্রাণী খেয়ে বেঁচে থাকে। ওদিকে পাঁচ কেজি ওজনের বিশাল এ পাখির দৈনন্দিন আহার্যের চাহিদাটাও কম নয়। সেটাই হলো মদনটাকের বড় সমস্যা। এ দেশের জলাভূমিতে এখন মাছ, কাদামাছ, ব্যাঙ, সাপ, গুই ইত্যাদির যে আকাল তাতে প্রায়ই মদনটাকের ভাগ্যে পর্যাপ্ত আহার জোটে না। দু-একটি এলাকায় দু-চারটি পাখির তা জুটলেও প্রজনন মৌসুমে বাড়ন্ত ছানার জন্য বাড়তি আহার্য সংগ্রহ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।                     </p> <p>ভারতবর্ষ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জনাকীর্ণ দেশেই ছিল মদনটাকের বসবাস। প্রায় শত বছর ধরে এসব দেশে মানুষ বেড়েছে হুড়মুড় করে এবং ক্রমাগত কমে গেছে মদনটাকের মতো অতিকায় পাখির সংখ্যা। অনন্য এই পাখিটিকে বিজ্ঞানীরা তাই স্থান দিয়েছেন বিশ্বের বিপন্ন পাখির তালিকায়। বাংলাদেশে মদনটাকের সংখ্যা আজ মহাবিপন্ন বাংলা শকুনের চেয়েও কম। ওজনে ও খাদ্যাভ্যাসে তুলনীয় হলেও এই দুটি প্রজাতির বিচরণভূমিতে পার্থক্য অনেক : শকুনের বিচরণ লোকালয়ে আর মদনটাকের বসবাস বাদাবন ও প্যারাবনে। শকুনের জন্য লোকালয়ে আজও অনেক গৃহপালিত পশুর মৃতদেহ আছে; কিন্তু মদনটাকের জন্য বাদাবনে মৃত অথবা মৃতপ্রায় মাছ, উভচর ও অন্যান্য বুনো প্রাণী তত নেই। গরুর চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক নামক শকুনঘাতী ওষুধের ব্যবহার বন্ধ করায় গত দুই দশকে বাংলা শকুনের অধোগতি রোধ হয়েছে এ দেশে। কিন্তু মদনটাকের জন্য অমন কোনো সহজ সমাধান আমাদের হাতে নেই। আমরা বাদাবন থেকে প্রাণী নিঃশেষ করেছি শত বছরে; তাই চাইলেও দু-চার দশকে তাদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। </p> <p>পাঁচ শ বছর আগে লেখা জীবনীগ্রন্থে মদনটাক নিয়ে সম্রাট বাবরের একটি মজার কথা আছে। সম্রাটের কথায় :  ‘পাখিটি বেশ পোষ মেনেছিল এবং মাংস ছুড়ে দিলে তা ধরে খেত। তার চঞ্চু থেকে কিছুই ফসকে যেত না। একবার সে একটি পাদুকা গিলে ফেলল; তারপর গিলল পালকসমেত আস্ত একটি মুরগি।‘ মৃগচর্মে তৈরি রাজকীয় পাদুকার সঙ্গে অনায়াসে উদরে কুক্কুটের স্থান দিয়েছিল যে পাখি, ভারতবর্ষে তার ছানার ছানার ছানাদের একদিন আহার্যের অভাব হবে এ কথা সম্রাট বাবরের জন্য নিশ্চয়ই ছিল অভাবনীয়।       </p> <p>শত বছর আগেও এ দেশের মানুষ মদনটাকের মতো অতিকায় অনেক পাখিকে প্রজনন ঋতুতে জোড়া বেঁধে বিলের পারে হাঁটতে দেখেছেন। তাই কাব্য করে তাঁরা এদের বলতেন ‘মানিকজোড়’। আজও তাই এসব পাখির পারিবারিক নাম মানিকজোড়; যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘স্টর্ক’। বাংলাদেশে সে আমলে আট প্রজাতির মানিকজোড় ছিল; আজ বড়জোর তার ছয়টি প্রজাতির দেখা পাবেন। তার মধ্যে একমাত্র শামখোল ছাড়া বাকি সবাই এ দেশে বিরল অথবা অতিবিরল আখ্যায়িত হয়েছে।</p> <p> </p> <p> </p> <p> </p> <p> </p> <p> </p>