গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জানিয়েছে, আগামী দুই বছরে দেশের অর্থনীতিতে তিন ধরনের ঝুঁকি থাকবে। পাশাপাশি দুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য।
মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক মন্দা এবং দারিদ্র্য ও বৈষম্য—এই তিন ধরনের অর্থনৈতিক ঝুঁকির পাশাপাশি আলোচ্য সময়ে তিন ধরনের সামাজিক ঝুঁকিও রয়েছে। যেগুলো হলো বেকারত্ব, জ্বালানি ঘাটতি এবং হৃদরোগ, ক্যান্সার ও ডায়াবেটিস রোগের প্রাদুর্ভাব অর্থাৎ স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থা ও সামাজিক অবক্ষয়।
গতকাল রবিবার মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে ‘বাংলাদেশে ব্যাবসায়িক পরিবেশ সংস্কার : অন্তর্বর্তী সরকারের এজেন্ডা’ শীর্ষক একটি সংলাপে সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে এসব কথা বলেন।
সংলাপে প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত (উপদেষ্টা পদমর্যদার) অধ্যাপক লুৎফে সিদ্দিকী প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন, এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু, এফআইসিসিআইর সভাপতি জাভেদ আখতার, বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান, ডিসিসিআইর সভাপতি আশরাফ আহমেদ ও বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল।
প্রবন্ধ তৈরিতে দেশের সেবা, কৃষি, ম্যানুফ্যাকচারিং ও নন-ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের এক দশকের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত নেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, ব্যাবসায়িক প্রতিযোগিতার মানদণ্ডে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা ও ভারতের চেয়ে পিছিয়ে। অর্থনীতির তুলনায় ব্যাবসায়িক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে।
ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বাংলাদেশে ডুয়িং ব্যবসা করার জন্য ১৭টি সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি, আমলাতন্ত্রের অদক্ষতা, বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিশীলতা, মুদ্রাস্ফীতি, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, নীতির অস্থিতিশীলতা, দুর্বল শ্রমশক্তি, উচ্চ করহার, উদ্ভাবনের জন্য অপর্যাপ্ত ক্ষমতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ঝুঁকিপূর্ণ জনস্বাস্থ্য এবং শ্রমনীতির সীমাবদ্ধতা।’
ড. মোয়াজ্জেম আরো বলেন, ‘আমরা মনে করি, দুর্নীতি সর্বদাই প্রধান সমস্যা; যদিও অপর্যাপ্ত অবকাঠামোর সমস্যা ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে। বছরের পর বছর অদক্ষ আমলাতন্ত্র একটি প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিরতা একটি বড় কারণ হয়ে উঠেছে। মুদ্রাস্ফীতি সব সময় বড় চিন্তার কারণ।
’
সংলাপে আরো বলা হয়, সার্বিকভাবে অর্থনীতির অবস্থা যথেষ্ট খারাপ। ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা, দুর্নীতি, প্রবৃদ্ধির হিসাবে গরমিলের কারণে অর্থনীতিকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হচ্ছে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থনীতির বড় অনিশ্চয়তা এখন উৎপাদন খাতে। নানা রকম উদ্যোগের পরও সবচেয়ে বড় রপ্তানি শিল্প পোশাক খাতে উৎপাদনব্যবস্থা এখনো ভঙ্গুর রয়ে গেছে।
বিভিন্ন খাতের সমস্যা ও সংস্কার প্রসঙ্গে বলা হয়, এনবিআর বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। ফলে ট্যাক্স জালিয়াতি কমানোর চেষ্টা চলছে। বর্তমান ভ্যাট ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি এবং মূল ব্যাবসায়িক প্রক্রিয়াগুলো প্রধানত ম্যানুয়াল। এখানে স্বচ্ছতার জন্য আধুনিকীকরণের প্রয়োজন। আর্থিক খাতেও ন্যায়পাল নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি।
ডিসিসিআই সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, ‘বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের প্রধান সমস্যা দুর্নীতি। বাণিজ্য বাড়াতে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।’
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘গত এক দশকে বাংলাদেশে যে অলিগার্ক শ্রেণির উত্থান ঘটেছে, সেই গোষ্ঠী ভেঙে দিতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে কোনো সংস্কার সম্ভব হবে না। এই অলিগার্ক গোষ্ঠী ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্র মেরামত করতে হবে এবং এর মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার কর্মসূচি এগিয়ে নিতে হবে।’
এ সময় তিনি গত দেড় দশকে আর্থিক খাত কিভাবে কিছু রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলার মাধ্যমে লুটপাটের শিকার হয়েছে, তার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, ‘এই গোষ্ঠী সংস্কারের বিপক্ষে ও দুর্নীতির পক্ষে যোগসাজশ করে একটি অলিগার্ক শ্রেণির উত্থান ঘটিয়েছে।’
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরো বলেন, উন্নয়নের যে বয়ান তৈরি করা হয়েছিল, সেটি বাংলাদেশের অর্থনীতির ইতিহাসে পরিচিতি পাবে অলিগার্ক উত্থানের দশক হিসেবে।’
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, দুর্নীতি ও ঘুষ চক্র থেকে উত্তরণের উপায় বের করতে হবে। ডিজিটাল করাসহ এনবিআরের শুল্ক, ভ্যাটসহ সব বিভাগের জন্য পৃথক পৃথক পলিসি নিতে পারলে দুর্নীতি অর্ধেক কমে আসবে।
এ ছাড়া ব্যাংকিং খাত সংস্কারে দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দেন বক্তারা। আর রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নকে সব সমস্যার মূল হিসেবে দাবি করে রাজনীতির সংস্কারের তাগিদ দেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সংস্কার চাওয়া ভুল।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, ‘সরকার ১০০ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের লক্ষ্য থেকে সরে আসছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস, অবকাঠামো সুবিধা নিশ্চিত করে দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য অর্থনৈতিক অঞ্চলের সংখ্যা ৫ অথবা ১০টি হবে।’
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, ‘প্রয়োজনে বিজনেস রেগুলেটরি রিফর্ম কমিশন গঠন করা হবে।’