ঈদকে কেন্দ্র করে জমে উঠেছে দেশের পোশাকের বাজার। তবে বিশ্বের শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হওয়ার পরও দেশের পোশাকের বাজারে আধিপত্য ভারত-পাকিস্তানের। এই দুটি দেশ থেকে আমদানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় কমলেও বিপণিবিতানগুলোতে এর প্রভাব নেই। সঠিক নজরদারির অভাবে চোরাচালানের মাধ্যমে বিদেশি পোশাকে সয়লাব দেশের বাজার।
একদিকে ব্যবসার খরচ বৃদ্ধি অন্যদিকে বাজারে বিদেশি পোশাকের আধিপত্যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশের উদ্যোক্তারা।
রাজধানীর বিভিন্ন বিপণিবিতান, ব্র্যান্ড ও নন-ব্র্যান্ডের বিভিন্ন দোকান ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে। কারওয়ান বাজারের বসুন্ধরা সিটি শপিং মলে পোশাক কিনতে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান বলেন, ‘পাকিস্তানি পোশাকের ডিজাইন, এমব্রয়ডারি সুন্দর। তাই পাকিস্তানি পোশাকই প্রথম পছন্দ।
তবে দাম বেশি হওয়ায় বাজেট নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। কিছু দোকানে ভারতীয় পোশাকও পাওয়া যাচ্ছে, ওগুলোরও দাম বেশি।’ দেশীয় পোশাক তাঁর অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই।
ইস্টার্ন মল্লিকায় ঈদের কেনাকাটা করতে এসেছিলেন গৃহিণী সাবিহা রহমান।
তিনি বলেন, ‘আমি সাধারণত ভারতীয় পোশাক পরি, কিন্তু এবার বাজারে সেভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই পাকিস্তানি পোশাক দেখছি। ডিজাইন সুন্দর, তবে দাম একটু বেশি মনে হচ্ছে।’
স্ত্রীর জন্য পোশাক কিনতে আসা ব্যাংকার মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘পাকিস্তানি পোশাক দেখতে ভালো লাগলেও দাম বেশি। আগে তিন-চার হাজার টাকায় যে রকম ভালো একটা পোশাক পাওয়া যেত, এখন ছয়-সাত হাজার টাকা লাগছে।
’
বসুন্ধরা সিটির ব্যবসায়ী আসিফ বলেন, ‘মানুষ নতুনত্ব পছন্দ করে। আগে ভারতীয় পোশাকের প্রতি নির্ভরতা থাকলেও এখন কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। ৫ আগস্টের পর পরিস্থিতি বদলেছে। বর্তমানে ভারতীয় পোশাক সেভাবে দেশে আসছে না। ফলে মানুষ পাকিস্তানি পোশাকের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে।’
জনপ্রিয় ফ্যাশন হাউস জাফিরা ক্লথিংয়ের ব্যবস্থাপক সাজু আহমেদ পাকিস্তানি পোশাক নিয়ে বলেন, ‘পাকিস্তানি পোশাকের দাম সব সময়ই একটু বেশি থাকে। কারণ কাপড়ের মান ভালো। এ ছাড়া আমাদের দেশে পরিবহন খরচ ও ভ্যাট বেশি, যা পোশাকের দামে প্রভাব ফেলে। যদি খরচ কমানো যায় বা পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি ফ্লাইট চালু হয়, তাহলে পোশাকের দাম আরো কমবে।’
দামের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘গর্জিয়াস ও ফ্যাশনেবল পোশাকগুলোর দাম তিন হাজার ৫০০ থেকে ১০ হাজার টাকার বেশি পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর সাধারণ সুতি কাপড়ের পোশাকের দাম এক হাজার ২০০ থেকে চার হাজার টাকার মধ্যে। মধ্যবিত্তরা পাকিস্তানি পোশাক কিনলেও তারা মূলত মাঝারি দামের পোশাকই কিনছে।’
সিদ্দিকী এন্টারপ্রাইজের দায়িত্বে থাকা মো. হানিফ বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে আমরা পাকিস্তানি পোশাক নিয়ে কাজ করছি। তবে এবারের মতো এত বেশি চাহিদা আগে দেখিনি। পাকিস্তানি পোশাকের কাপড়, সূচিকর্ম ও ডিজাইন একটু ব্যতিক্রমী, তাই যারা ট্রেন্ডি পোশাক পছন্দ করে, তারা এগুলো কিনছে।’
ঈদের বাজারে যেভাবে দোকানে দোকানে ভারত-পাকিস্তানের পোশাক বেচাকেনা হয়, সে তুলনায় বৈধ পথে আমদানি খুবই কম। মূলত ভারত থেকে অবৈধ পথে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ তৈরি পোশাক আমদানি করা হয়। অন্যদিকে পাকিস্তান থেকে লাগেজে করে তৈরি পোশাক আসছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, গত তিন মাসে (ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি) ভারত ও পাকিস্তান থেকে ২২ লাখ ৩৫ হাজার পিস পোশাক আমদানি করা হয়েছে। গত রোজার আগে একই সময়ে আমদানি করা হয়েছিল ২৬ লাখ পিস পোশাক।
ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ
দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা এবং রাজস্ব বাড়াতে ট্যারিফ কমিশন সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। তারা বলেছে, ভারত থেকে শুল্ক ফাঁকি ও চোরাচালানের মাধ্যমে শাড়ি, টু-পিস, থ্রি-পিস দেশে আসছে। কারণ স্থানীয় বাজারে যে পরিমাণ ভারতীয় টু-পিস, থ্রি-পিস, লেহেঙ্গা, জামদানি ও তাঁতের শাড়ি বিক্রি হয়, তার তুলনায় বৈধ আমদানি অনেক কম। সংস্থাটি চোরাচালান রোধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো এবং তৈরি পোশাকের আমদানি চালান শতভাগ পরীক্ষার সুপারিশ করেছে।
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশীয় ব্যবসায়ীরা
ভারত-পাকিস্তানের পোশাক বিক্রির ধুম পড়ায় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন দেশের পোশাক ব্যবসায়ীরা। এ প্রসঙ্গে রঙ বাংলাদেশের স্বত্বাধিকারী সৌমিক দাশ বলেন, ‘ভারত ও পাকিস্তান থেকে অবৈধভাবে তৈরি পোশাক আসায় দেশীয় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দেশীয় উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের সুরক্ষা দিতে ভারত-পাকিস্তান থেকে অবৈধ পথে পোশাক আসা বন্ধ করতে হবে। তাহলে সরকারের রাজস্বও বাড়বে।’