বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বন্দর

জয়নাল আবেদীন
জয়নাল আবেদীন
শেয়ার
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বন্দর

উন্নতির মহাশিখরে আরোহণ করছে বাংলাদেশ। একের পর এক দুর্ভেদ্য প্রতিকূলতা জয় করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে দেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। বাস্তব হতে চলেছে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা। বঙ্গবন্ধুকন্যা এনে দিয়েছেন অর্থনৈতিক মুক্তি।

অর্থনীতিবিদদের ভাষ্য মতে, এই সাফল্যে অবিচ্ছেদ্য অবদান চট্টগ্রাম বন্দরের। দেশের যা কিছু অর্জন, তার মূলে এই বন্দর। দখিন কোণের শহর চট্টগ্রামের বুক চিরে বয়ে চলা কর্ণফুলী নদীর মোহনায় ১৮৮৬ সালে যাত্রা শুরু। ১৩৬ বছরে সেই বন্দরই দেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা।
বন্দর কর্তৃপক্ষ একে আখ্যায়িত করেছে সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার বলে। কেননা এই বন্দর বাংলাদেশের শির উঁচু করেছে বিশ্বভুবনে। বাণিজ্যে দিয়েছে গতি। স্বপ্নের সঙ্গে সমন্বয় করে এগিয়ে চলছে দুর্বার।

সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেছেন, সমগ্র বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়বে, যদি ক্ষণিকের জন্য থমকে যায় চট্টগ্রাম বন্দর। এ কারণে বন্দর কর্তৃপক্ষ স্লোগান দিয়েছে—‘কান্ট্রি মুভস উইথ আস। দেশের অর্থনীতিতে এর অবদান এতখানিই যে অন্য যেকোনো বন্দর এর ধারেকাছেই নেই। কর্তৃপক্ষের হিসাব মতে, দেশের মোট আমদানি ও রপ্তানি পণ্যের ৯২ শতাংশই পরিবাহিত হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। সময়ের পরিক্রমায় দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরে পরিণত হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর, বেড়েছে বন্দরের পরিধিও।

গত ২৮ ডিসেম্বর বিকেলে রোদের সঙ্গে কুয়াশার লুকোচুরির মধ্যেই জাহাজ থেকে কনটেইনার খালাস কার্যক্রম চলছিল। দীর্ঘদেহী ক্রেন যেন তার লম্বা হাতের মুঠোয় পুরে জাহাজ থেকে নামিয়ে আনছিল পণ্যভর্তি আস্ত কনটেইনার। সেগুলো একে একে উঠছে লরির পিঠে। লরি ছুটছে অন্যত্র। নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল-২-এ যখন এই দৃশ্যপট, তখন সেখানে হাজির হন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল। তিনি নির্ভার কণ্ঠে বললেন, বেশ অনিশ্চয়তার মধ্যেই এ বছরও আমরা তিন মিলিয়ন কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে যাচ্ছি। বছরের শেষ দিন অবধি তা তিন মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। এ নিয়ে গত পাঁচ বছরে চারবার থ্রি মিলিয়ন ক্লাবের সদস্য চট্টগ্রাম বন্দর।

এর আগে চবক চেয়ারম্যান তাঁর নিজ কার্যালয়ে কালের কণ্ঠর মুখোমুখি হন। তিনি খোলামেলা কথা বলেন বন্দরের সামগ্রিক বিষয়ে। মোহাম্মদ সোহায়েল বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের ঐতিহ্য হাজার বছরের। এই বন্দর দিয়েই বাংলাদেশকে চিনত গোটা পৃথিবী। চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধ হলে দেশ অচল হয়ে পড়বেএই মন্ত্র বুকে ধারণ করে আমরা প্রতিটি কর্মী নিরলস কাজ করছি। বন্দর এখন সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান। এসব কারণে গতিশীলতা বেড়েছে। আমাদের লক্ষ্য দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ বন্দর হিসেবে একে প্রতিষ্ঠা করা।

শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে উঠে আসে চট্টগ্রাম বন্দরের জানা-অজানা অধ্যায়। তিলে তিলে উত্থান থেকে শুরু করে একটি দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে ওঠার গল্প তুলে ধরেন তাঁরা। দীর্ঘ শত বছরের পটপরিবর্তনে বদলে গেছে অনেক কিছু। স্মার্ট পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় বন্দর এখন বেশ গতিশীল। অথচ কয়েক বছর আগেও ছিল ব্যবসায়ীদের অসন্তোষ, শ্রমিক আন্দোলন আর জাহাজজটের নিত্য অপবাদ। ছিল না আধুনিক প্রযুক্তিসই যন্ত্রপাতি, দক্ষ জনবল। এখন সেসব অভিযোগ নেই, নেই অসন্তোষও। অনেক ঘাটতি ঘুচিয়ে বন্দর এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিশ্বদরবারে খেতাব কুড়িয়েছে জিরো ক্রাইম বা শতভাগ অপরাধমুক্ত বন্দরের।

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর কালের কণ্ঠকে বলেন, আমাদের যা কিছু অর্জন, তার মূলে চট্টগ্রাম বন্দর। ভবিষ্যতে যে বন্দরই আসুক না কেন, ঐতিহ্যের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব ও অবদান অটুট থাকবে। কেননা এই বন্দর এক দিনে এই পর্যায়ে আসেনি। এর সঙ্গে শত-সহস্র বছরের ঐতিহ্য মিশে আছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব লাভের অংশ থেকে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক এবং রোল মডেল। তবে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরসহ অন্য বন্দরগুলো চালু হলে একটি সুন্দর প্রতিযোগিতা ও চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হবে।

কিছু জায়গায় ঘাটতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত যানবাহন রাখার কোনো জায়গা নেই। গাড়িগুলো রাস্তা দখল করে থাকছে। কিছু বেসিক জায়গায় অবশ্যই কাজ করতে হবে। কাস্টমসের কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেগুলোও নিরসন করা জরুরি। নইলে বন্দরের কার্যক্রম গতিশীল হবে না। তবে কয়েক বছর ধরে শ্রমিক অসন্তোষ না থাকাটা অবশ্যই ইতিবাচক দিক। এর ফলে বন্দরে কর্মচাঞ্চল্য বেড়েছে। যার সুফল পাচ্ছেন ব্যবসায়ী ও ভোক্তারা।

 

লক্ষ্যমাত্রায় বাধা হতে পারেনি বৈশ্বিক সংকট

চলমান বৈশ্বিক প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব দক্ষতার মাধ্যমে কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। এতে শুধু গতিবৃদ্ধিই নয়, অর্থও সাশ্রয় হয়েছে। কর্মকর্তাদের মতে, দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের বেশির ভাগই সামাল দিচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। দেশের মোট জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার (জিডিপি) যেখানে ৭ থেকে ৮ শতাংশ, সেখানে চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের প্রবৃদ্ধির হার ২১ শতাংশ।

জানা গেছে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্তরিক চেষ্টার পাশাপাশি সরকারের সদিচ্ছায় বিশ্বনন্দিত অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি সংযোজন বন্দরকে এনে দেয় ভিন্ন মাত্রা। ফলে বন্দরের গতিশীলতা অবিশ্বাস্যভাবে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে ২০১৯ সালে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে রেকর্ড গড়ে তিন মিলিয়ন ক্লাবে প্রবেশের মধ্য দিয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে চট্টগ্রাম বন্দর। সে সময় ৩০ লাখ ৮৮ হাজার ১৮৭ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছিল। তবে করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবা এতে রাশ টানে। বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, কভিড পরিস্থিতির মধ্যে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে ২০২০ সালে কনটেইনার হ্যান্ডলিং ২৮ লাখ টিইইউতে নেমে আসে। তবে ঘুরে দাঁড়াতে বেশি সময় লাগেনি। পরের বছরই তা আবার ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ৩২ লাখ ১৪ হাজার ৫৪৮ একক কনটেইনারে পৌঁছে। ২০২২ সালে তা একটু কমে ৩১ লাখ ৪২ হাজার ৫০৪ টিইইউ এবং সর্বশেষ ২০২৩ সালে ৩০ লাখ ৫০ হাজার ৭৯৩ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করে।

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, বন্দরের টার্মিনাল ব্যবস্থাপনা, গেট অপারেশন সিস্টেমসহ সব কিছুতে ডিজিটাইজেশন হয়েছে। একসময় জেটি সরকাররা সহস্র কনটেইনারের ভিড়ে নিজের কনটেইনার খুঁজে বের করতেন। এখন সেই দুর্ভোগ নেই। সাধারণ একটি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে মুহূর্তেই কনটেইনারের লোকেশন বের করা যাচ্ছে। এখন কেবল একটি ফিঙ্গার ট্রিপে সব কিছু পেয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া সামগ্রিক ডকুমেন্টেশন সিস্টেম, যেটি কার্গো ডেলিভারি ডিসচার্জ থেকে শুরু করে একেবারে দোরগোড়ায় ডেলিভারি পর্যন্ত পুরো জিনিসটাই কম্পিউটারাইজড। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে অনেক গতি ফিরেছে।

 

সক্ষমতা বৃদ্ধিতে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোগ

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড রক্ষায় জাহাজের কনটেইনার লোড-আনলোড ও পরিবহনে চট্টগ্রাম বন্দরে রয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন বিভিন্ন রকমের ক্রেন। জানা গেছে, ২০২২-২৩ সালে বন্দরের বহরে যুক্ত হয় চারটি মোবাইল ক্রেন, যার মধ্যে দুটি ৫০ টন ও দুটি ১০০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন। এ ছাড়া ছয়টি রাবার টায়ারড গ্যান্ট্রি ক্রেন, ৩৪টি কিউজিসি এবং দুটি কনটেইনার মোভার কেনা হয়। শিগগিরই প্রায় ৯১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০৪টি যন্ত্রপাতি কেনার পরিকল্পনা রয়েছে।

চবক চেয়ারম্যান কালের কণ্ঠকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর দিন দিন তার সক্ষমতা বাড়িয়ে চলছে। এটা বলতে পারি, চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান যে ব্যবস্থা সেটা আগের যেকোনো সময় থেকে অনেক ভালো। বিশেষ করে গত ১০ থেকে ১২ বছরে বন্দরের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এতে সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রাম বন্দরে নতুন টার্মিনাল সংযুক্ত হয়েছে। নতুন জেটি সংযুক্ত হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, নিয়মিতভাবে চট্টগ্রাম বন্দর ও অন্যান্য বন্দরের উন্নয়ন হচ্ছে। চমৎকারভাবে সক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যারা বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীমহল, দেশে-বিদেশে তারা দিন দিন ভালো পোর্ট সার্ভিস পাচ্ছে। সার্ভিস পাচ্ছে বলেই নানা ধরনের বিদেশি বিনিয়োগ দেশে বাড়ছে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বন্দরের আলাদা ১৭টি শেডে রাখা হয়েছে রাসায়নিক পদার্থ, গাড়ি ও অন্যান্য সাধারণ মালপত্র। বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যগুলো অক্ষতভাবে রাখার সর্বাঙ্গীণ ব্যবস্থা রয়েছে। বন্দরের ভেতরে দিন বা রাতের কোনো পার্থক্য দেখা যায়নি। কর্মচঞ্চল ২৪ ঘণ্টা মালপত্র ঢুকছে কিংবা বের হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ এলাকাগুলোর প্রতিটি ব্লকে নিরাপত্তাকর্মীদের সক্রিয় অবস্থান দেখা গেছে। অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা থেকে রক্ষায় নিরাপত্তা চৌকি থেকে প্রতিটি মুহূর্ত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

 

অপরাধমুক্তিতে সুনাম বেড়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে

মাত্র দেড় দশক আগেও চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর ডাকাতপ্রবণ হিসেবে পরিচিত ছিল। বন্দর কর্তৃপক্ষ ও কোস্ট গার্ডের পদক্ষেপে এই জলসীমা এখন অপরাধমুক্ত। সেই চুরি-ডাকাতি নেই। এর ফলে বন্দরের সুনাম বেড়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। বাণিজ্যিক জাহাজে সংঘটিত সশস্ত্র ডাকাতি, দস্যুতা ও চুরির ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে রেটিং প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক সংগঠন রিক্যাপ। সেখানে গত কয়েক বছর চট্টগ্রাম বন্দরকে জিরো ক্রাইম বা অপরাধমুক্ত বন্দর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। চবক চেয়ারম্যানের নির্দেশনায় বন্দরের অভ্যন্তরে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে না বলে জানান কর্মকর্তারা।

রিক্যাপের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমায় ২০১৯ সালে দস্যুতার ঘটনা শূন্যে নেমে আসে। সে বছর বিভিন্ন দেশের জলসীমায় ৮২টি ঘটনা রেকর্ড করেছে রিক্যাপ। এর মধ্যে বাংলাদেশ ও বঙ্গোপসাগরের জলসীমায় কোনো ঘটনা ঘটেনি। এরপর আর কোনো বছরই দস্যুতার ঘটনা ঘটেনি। বিশাল জলসীমায় দস্যু দমনের সাফল্য বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে।

শুধু জলসীমা নয়, বন্দরের অভ্যন্তরেও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে বলে দাবি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। তাঁরা বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থা বিশ্বমানের। বন্দরের প্রায় পুরো অংশই সিসি ক্যামেরার নিয়ন্ত্রণে। বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও বলেছেন, কয়েক বছর আগেও বন্দরে পণ্য রাখা ছিল অত্যন্ত অনিরাপদ। এখন সেই দুশ্চিন্তা নেই। কর্তৃপক্ষের বিচক্ষণ নিরাপত্তাব্যবস্থার কারণে বন্দর এখন শতভাগ নিরাপদ জায়গা।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (নিরাপত্তা) লে. কর্নেল মোস্তফা আরিফ-উর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর একটি আইএসপিএস কমপ্লায়েন্ট বন্দর। বন্দরের সংরক্ষিত ও সংলগ্ন এলাকার প্রায় ৯৮ শতাংশ সিসিটিভি মনিটরিংয়ের আওতায়। অত্যাধুনিক সিসিটিভি কন্ট্রোল সেন্টার থেকে সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের প্রতিটি প্রবেশপথে অ্যাকসেস কন্ট্রোল রয়েছে। অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে বন্দরের নিজস্ব ফায়ার ইউনিটে রয়েছে ফায়ার ফাইটিং ফোম টেন্ডার, রেসকিউ ভেহিকল, রিকভারি ভেহিকল। বন্দর এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি নিরাপদ এবং স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা।

বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, বন্দরের ভেতরে ছিঁচকে চুরি বা কোনো কর্মী দ্বারা ছোটখাটো চুরির টুকটাক অভিযোগ মাঝেমধ্যে ওঠে। এগুলো আসলে ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। সামগ্রিকভাবে এখানে অপরাধ কর্মকাণ্ড নেই বললেই চলে। রিক্যাপের প্রতিবেদনেও সে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। জিরো পাইরেসি পোর্ট হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যে খেতাব পাওয়া গেছে, তা সত্যিই গর্বের।

বন্দর ব্যবহারকারীদের একজন ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) এজেন্ট হায়দার ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার মো. বেলাল উদ্দিন। বন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থায় সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, বন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থা অতীতের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। একসময় আমাদের নানা ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে হতো। মালপত্র রাখলে অনেক সময় খুঁজে পাওয়া যেত না। এখন আমরা যারা পণ্য আমদানি-রপ্তানি বা পণ্য খালাস প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত, তাদের জন্য বন্দরের ভেতরে আলাদা শেড রয়েছে। মালপত্রের জন্য আমরা যথেষ্ট নিরাপত্তা পাচ্ছি। এটি অত্যন্ত স্বস্তিদায়ক দিক।

 

বছরে ১২০০ কোটি টাকা সাশ্রয়

ব্যয় সংকোচন বা সাশ্রয়ের দিক থেকেও অনন্য প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। চেয়ারম্যানের সুদক্ষ নেতৃত্বে বিদায়ি বছরে অন্তত ১২০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ নিরীক্ষণ বিভাগের তথ্যে জানা গেছে।

বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ধারাবাহিকতা রক্ষার কারণে রাজস্ব আয়ও স্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এদিকে আমরা নানাভাবে ব্যয় সংকোচন করে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করেছি। সেটার সুফলও অচিরেই দেখা মিলবে। রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করতে পেরেছি আমাদের কর্মদক্ষতার মাধ্যমে। বন্দর কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি বন্দরের প্রতিটি স্টেকহোল্ডারের ভূমিকা রয়েছে। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পেছনে তাদের কঠিন পরিশ্রম, ২৪ ঘণ্টা কাজ করার যে প্রবণতা, তাদের যে শ্রম-ত্যাগ, এটা হলো অন্যতম কারণ।

বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (হারবার ও মেরিন) কমোডর এম ফজলার রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের মোট রাজস্ব আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ হয় জাহাজ সেবা ও মালপত্র হ্যান্ডল খাত থেকে। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময় রাজস্ব আয় ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, রাজস্ব ব্যয় প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে এবং রাজস্ব উদ্বৃত্ত প্রায় ২২ শতাংশ বেড়েছে।

প্রসঙ্গত, বিশ্বের বন্দরগুলোর কনটেইনার পরিবহনের সংখ্যার নিরিখে প্রতিবছর শীর্ষ ১০০ বন্দরের তালিকা করে লন্ডনভিত্তিক শিপিং বিষয়ক বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো সংবাদমাধ্যম লয়েডস লিস্ট। কয়েক বছর ধরে এই তালিকায় শীর্ষ ১০০ বন্দরের মধ্যে অবস্থান করছে চট্টগ্রাম বন্দর। সর্বশেষ ২০২৩ সালের তালিকায় এর অবস্থান ৬৭তম।

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

প্রকল্পে বিনিয়োগ কাটছাঁট, রাজস্ব ও কর্মসংস্থানে প্রভাব

    এডিপির আকার কমল ৪৯ হাজার কোটি টাকা
এম আর মাসফি
এম আর মাসফি
শেয়ার
প্রকল্পে বিনিয়োগ কাটছাঁট, রাজস্ব ও কর্মসংস্থানে প্রভাব

উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতা নেই। এটিও গতানুগতিক ধারায় চলছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন প্ল্যান অনুযায়ী বরাদ্দ দিলেও তারা খরচ করতে পারে না। এর ফলে দফায় দফায় বাড়ে প্রকল্পের খরচ ও মেয়াদ, যার কারণে প্রতিবছরই মূল বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কম বাস্তবায়ন হয়।

এবারও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। প্রকল্প বাস্তবায়নের নেতিবাচক প্রভাব রাজস্ব আয় ও কর্মসংস্থানে। প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে উৎস করসহ বিভিন্ন মালপত্র আমদানি থেকে সরকার রাজস্ব পায়। সেখানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
আর কাটছাঁট করার ফলে মানুষের কাজের সুযোগ কমে যায়। অনেক মানুষ বেকার হয়ে যায়। তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের এডিপি থেকে ৪৯ হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট হচ্ছে।

এর মধ্যে সরকারের অংশ থেকে ৩০ হাজার কোটি এবং বৈদেশিক বরাদ্দ থেকে ১৯ হাজার কোটি টাকা। এর আগে কোনো অর্থবছরে এত বেশি পরিমাণ অর্থ এডিপি থেকে কাটছাঁট করা হয়নি। শুধু সড়ক-মহাসড়ক বিভাগ থেকেই ১১ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা কাটছাঁটের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরের এডিপির আকার ধরা হয় দুই লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা।

পরিকল্পনা কমিশনের এক অতিরিক্ত সচিব জানান, চলতি অর্থবছরের এডিপি থেকে প্রায় অর্ধলক্ষ কোটি টাকা কাটছাঁট করা হচ্ছে।

যদিও মন্ত্রণালয়গুলোর চাহিদা আরো প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা কম। মূলত প্রকল্পগুলোতে বরাদ্দে সঠিক পরিকল্পনার অভাব এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অদক্ষতায় প্রতিবছরই এডিপি বাস্তবায়ন কম হচ্ছে।

আইএমইডির সর্বশেষ এডিপি বাস্তবায়নের তথ্যে দেখা যায়, ছয় মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে ১৭.৯৭ শতাংশ। এর চেয়ে কম এডিপি বাস্তবায়নের তথ্য সংস্থাটির ওয়েবসাইটে নেই। সেই আলোকে গত এক যুগে এত কম এডিপি বাস্তবায়ন হয়নি। এদিকে ছয় মাসে ৫০ হাজার দুই কোটি টাকা অর্থছাড় হয়েছে, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরের পর সর্বনিম্ন। গত অর্থবছরে ৬১ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা ছাড় হয়েছিল এই সময়ে। শুধু গত ডিসেম্বর মাসে অর্থছাড় হয়েছে ১৫ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা, যেখানে আগের অর্থবছরের ডিসেম্বর মাসে ছাড় হয়েছিল ১৪ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা।

এদিকে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, আগের সরকারের সময়ে নেওয়া চলমান সব প্রকল্পই সরকার পর্যালোচনা করেছে। অগুরুত্বপূর্ণ ও রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া অনেক প্রকল্প বা স্কিম বাদ যাচ্ছে। এতে অর্থ ব্যয়ের চাহিদা কমেছে। আবার জুলাই অভ্যুত্থানের পর অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক চলে গেছেন। অনেক প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ফলে এডিপি বাস্তবায়নের হারও কমে গেছে। অনেক দেশি ঠিকাদারও প্রকল্প এলাকায় এখনো ফিরে আসেননি। একইভাবে বৈদেশিক অর্থায়নের অনেক প্রকল্পে বিদেশি ঠিকাদার অনুপস্থিত রয়েছেন। এই বাস্তবতায় এডিপিতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে বলে জানান তাঁরা।

পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বাস্তবায়ন গতি কম থাকায় সরকারি তহবিলের চাহিদাও অনেক কমেছে। সাধারণত অন্যান্য অর্থবছরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সরকারি তহবিল থেকে চাহিদা অনেক বেশি থাকে। কিন্তু চলতি অর্থবছরে এডিপিতে যে পরিমাণ সিলিং বেঁধে দেওয়া হয়েছে, চাহিদা তার চেয়ে কম রয়েছে। তবে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে চলতি অর্থবছরে চাহিদার চেয়ে বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান থেকে ৭০-৭৫ হাজার কোটি টাকা চাহিদা দিয়েছিল। কিন্তু সরকার বৈদেশিক অর্থায়ন ব্যবহারের গুরুত্ব দেওয়ায় বরাদ্দ বাড়িয়ে ৮১ হাজার কোটি টাকার সিলিং দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সচিব মামুন আল রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রকল্প পরিচালকদের কখন কোন কাজ করতে হবে সেই পরিকল্পনা দেওয়া থাকে। কিন্তু সে অনুযায়ী তাঁরা সময়মতো কাজ করতে পারেন না। বড় সমস্যা হচ্ছে, আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করায় অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি। প্রকল্প বাস্তবায়নে এটি প্রথম বাধা। দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, যাঁরা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন, সেই প্রকল্প পরিচালকদের প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে, অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে। তৃতীয়ত, প্রকল্পে কেনাকাটার ক্ষেত্রেও তাঁদের কারিগরি জ্ঞান খুবই সীমিত।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, প্রকল্পের কাটছাঁটে টাকা বাঁচে ঠিক। তবে সরকারি কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ না হলে রাজস্ব আয় হয় না। আবার মানুষেরও কাজের সুযোগ কমে যায়। এগুলো আবার প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দেয়। এদিকে সরকারকে ট্রেড অফ করতে হবে।

মন্তব্য

উচ্চ সুদহারে বিপাকে ব্যবসা ও কর্মসংস্থান

    ► ঋণের সুদহার ছাড়িয়েছে ১৫% ► নভেম্বরে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ৭.৬৬%-এ নেমেছে ► উৎপাদন কমেছে ৪০% পর্যন্ত ► দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়ে ২৬ লাখ ৬০ হাজার ► নীতি সুদহার আরো বাড়িয়ে ১১ শতাংশ করার পরিকল্পনা
নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
উচ্চ সুদহারে বিপাকে ব্যবসা ও কর্মসংস্থান

উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে কমছে সাধারণ মানুষের আয় ও কর্মসংস্থান। এর অন্যতম কারণ ব্যাংকঋণের সুদের হার বৃদ্ধি এবং উৎপাদন হ্রাস। সুদের হার বাড়ার কারণে আমানতকারীরা কিছুটা লাভবান হলেও ব্যাংক ও ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন করে সংকট তৈরি হয়েছে। একদিকে উচ্চ সুদ দিতে চেয়েও আমানত পাচ্ছে না ব্যাংক, অন্যদিকে ঋণসংকটে পড়ছে বেসরকারি খাত।

বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণে ধীরগতি এবং কর্মসংস্থান ঘাটতি দেশের অর্থনৈতিক সংকট বাড়াতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য ব্যাংকঋণের সুদের হার ক্রমাগতভাবে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি কমানোর একমাত্র উপাদান সুদহার বৃদ্ধি নয়; আরো অনেক উপায় রয়েছে। তথ্য-উপাত্ত বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে নীতি সুদহার বা রেপো রেট আরো ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করায় ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে ব্যাংকঋণের সুদ।

এতে ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরশীল ছোট, মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এলসি খোলার হার কমেছে ৭ শতাংশ আর উৎপাদন কমেছে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত।

দফায় দফায় ঋণের সুদহার বাড়ানোয় চরম সংকটে পড়েছে বেসরকারি খাত। ফলে ব্যবসা প্রসারসহ থমকে রয়েছে বিনিয়োগ।

ব্যবসা ও বিনিয়োগে খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে রয়েছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। তাঁরা বলছেন, দেশে এখন বিনিয়োগের কোনো পরিবেশ নেই। বরং ব্যবসায়ীরা টিকে থাকার লড়াই করছেন।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে চলমান অস্থিরতায় অত্যাবশ্যকীয় নিত্যপণ্যের চাহিদা কমে গেছে। এতে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের বিক্রিতে ধস নেমেছে।

এমন পরিস্থিতিতে ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। সুদহার অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা সম্প্রসারণ ও নতুন বিনিয়োগের পরিকল্পনা আপাতত তুলে রাখছেন অনেক উদ্যোক্তা।

তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম কালের কণ্ঠকে বলেন, এমনিতেই ব্যবসায়ীরা ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ বেশি সুদ দিয়ে আসছিল। নীতি সুদহার বাড়ানোর ফলে সেটা আরো বেড়ে গেছে। এখন নতুন বিনিয়োগ তো দূরের কথা, টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত ব্যবসায়ীসমাজ। কোথায় কত টাকা খরচ হবে এবং কতটা মুনাফা হতে পারে, সেটা হিসাব করে আমরা বিনিয়োগ করি। কিন্তু মাঝপথে যখন ব্যাংকের সুদহার বেড়ে যায় তখন সব হিসাব ওলটপালট হয়ে যায়। কারণ কিস্তির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং মুনাফার হার কমে আসে।

সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি আর অর্থনীতির ধীরগতিতে বেসরকারি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধি কমে সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থায় নেমেছে। নভেম্বরে এই হার দাঁড়িয়েছে ৭.৬৬ শতাংশ। এর আগে ২০২১ সালের মে মাসে কভিড মহামারির মধ্যে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৭.৫৫ শতাংশে নেমেছিল।

সরকার পতনের পর নতুন নতুন নীতিমালা, শ্রমিক অসন্তোষ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, রাজনীতিকদের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন মামলায় আসামি করা, মূল্যস্ফীতি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতিসহ নানা কারণে বিনিয়োগে নিম্নমুখী প্রবণতা প্রকাশ পাচ্ছিল।

সূত্র জানায়, সুদের হার বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারে টাকার সরবরাহ কমানোর পথে হাঁটছেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরও। এবার ১০০ বেসিস পয়েন্ট বা ১ শতাংশ সুদ বাড়ানো হতে পারে। বিষয়টি আগাম আঁচ করতে পেরে ব্যবসায়ী নেতারা গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে বিদ্যমান সুদহার কমাতে অনুরোধ জানিয়েছেন।

দেশের কর্মে নিয়োজিত বা শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় বেকারের সংখ্যা বেড়েছে। সম্প্রতি ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) শ্রমশক্তি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ( বিবিএস)। সেখানে বলা হয়, কৃষি, সেবা ও শিল্পসব খাতেই কমেছে কর্মে নিয়োজিত জনগোষ্ঠী। নারীর চেয়ে উল্লেখযোগ্য হারে পুরুষ বেকারের সংখ্যা বেশি বেড়েছে।

গেল বছরের শুরুতে দেশে বেকারের সংখ্যা কম থাকলেও বছর শেষে ধারাবাহিকভাবে এই সংখ্যা বেড়েছে। মূলত জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের প্রভাবে বছরের শেষ সময়ে বেড়েছে বেকারের সংখ্যা। বর্তমানে দেশে মোট বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৬০ হাজার। ২০২৩ সালের একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৯০ হাজার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে এক লাখ ৭০ হাজার।

মন্তব্য

টাকা জোগাড়ে করের বোঝা

    ছয় মাসে রাজস্ব ঘাটতি ৫৮ হাজার কোটি
মো. জাহিদুল ইসলাম
মো. জাহিদুল ইসলাম
শেয়ার
টাকা জোগাড়ে করের বোঝা

দেশের রাজনীতির অনিশ্চয়তা ভর করেছে দেশের অর্থনীতিতে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আস্থাহীনতায় ব্যবসা-বিনিয়োগে ভাটা। উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণনে ধীরগতি। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ।

ব্যবসার প্রসার কিংবা নতুন বিনিয়োগ করা না করা নিয়ে শঙ্কা থাকায় গতি নেই অর্থনীতিতে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার কাছে ঋণ পেতে মরিয়া সরকার। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বাড়ানোর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ঋণ সংগ্রহেরও চেষ্টা চলছে। তবে সাফল্য নেই কোথাও।
সার্বিকভাবে এর প্রভাব পড়েছে দেশের রাজস্ব আয়ে। টাকা জোগাড়ের সহজ পন্থা হিসেবে জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে করের বোঝা।

অর্থবছরের মাঝপথে চলতি বছরের শুরুতেই আইএমএফের প্রেসক্রিপশনে অধ্যাদেশ জারি করে অর্ধশতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট আরোপ করেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পরবর্তী সময়ে আন্দোলনে নামে ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ ও ভোক্তারা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই হঠকারী, অপরিণামদর্শী ও অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত থেকে আংশিক ইউ টার্ন নিতে বাধ্য হয়েছে সংস্থাটি। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ন্যুব্জ গণতান্ত্রিক একটি দেশে এমন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়াকে সরকারের স্ববিরোধী নীতির সঙ্গে তুলনা করছেন ব্যবসায়ীরা।

ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকার উচ্চাভিলাষী রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে গণ-অভ্যুত্থানে গদিছাড়া হলেও তাদের রেখে যাওয়া টার্গেট অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আসছে না। বরং রাজস্ব আয় বড় ধরনের ঘাটতির পথে। অর্থবছরের ছয় মাসেই রাজস্ব আয়ে টানাটানি চলছে।

ঘাটতি ছাড়িয়েছে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা। এমন পরিস্থিতিতে করজাল সম্প্রসারণ না করে উল্টো করের হার বাড়িয়ে আবার কিছু পণ্যে করের হার কমিয়ে অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

জানা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আইএমএফ বাংলাদেশকে কর-জিডিপি অনুপাত ০.২ শতাংশ বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে। বাড়তি এই টাকা চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার সঙ্গে যুক্ত হবে। জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নানা সংকটে রাজস্ব আদায়ে ধস। প্রথম ছয় মাসে রাজস্ব ঘাটতি ৫৮ হাজার কোটি টাকা। এমন অবস্থায় তৃতীয় কিস্তির টাকা পেতেই এই পদক্ষেপ। যদিও এর ফলে আগে থেকেই অস্থির থাকা বাজার আরো অস্থির হয়েছে। বেড়েছে ভ্যাটের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি পণ্য ও সেবার দাম। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে দেশের খেটে খাওয়া কোটি মানুষ।

নতুন বছরে বিস্কুট, ওষুধ, আমদানি করা ফল, ফলের রস, সাবান, সাবানজাতীয় পণ্য, পোশাক কেনাকাটা, মিষ্টি, বেশ কয়েক ধরনের টিস্যু, মোটরগাড়ির গ্যারেজ, রেস্তোরাঁ, এলপি গ্যাসের মতো পণ্যে ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। সিগারেটে আরেক দফা দাম ও কর বাড়ানো হয়েছে। মোবাইল ফোনের সিম কার্ডের ওপর সম্পূরক শুল্ক ২০ থেকে বাড়িয়ে ২৩ শতাংশ করা হয়েছে। ইন্টারনেট সেবা বা আইএসপির ওপর প্রথমবারের মতো ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বসানো হয়েছে।

পরে আন্দোলনের মুখে রেস্তোরাঁ, মোবাইল ফোন, ওয়ার্কশপ, ওষুধসহ ৯ পণ্য ও সেবার বাড়তি ভ্যাট প্রত্যাহার করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে এনবিআর। যদিও আন্দোলনের জেরে এই ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়নি বলে জানিয়েছেন এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, আইএমএফ সরকারকে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের শর্ত দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আইএমএফের সঙ্গে বসেই আমরা নীতি প্রণয়ন করেছি। সরকার তাতে সম্মত হয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদ থেকেও কিছু সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। আন্দোলনের কারণেই ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে, তা ঠিক নয়। বিভিন্ন কারণে সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে সরকারের মনে হয়েছে যে কয়েকটি পণ্যের ওপর ভ্যাট সমন্বয় করা প্রয়োজন। তখন এই কাজগুলো করা হয়েছে।

যদিও ব্যবসায়ীদের অভিযোগের তীর এনবিআরের দিকে। এনবিআরের সমালোচনা করে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, সব সময়ই এনবিআর এ ধরনের কাজগুলো করে। অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করার কোনো প্রয়োজন তারা অনুভব করে না। এসি চেয়ারে বসে যদি তারা একটা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় তাহলে সেটা ব্রিটিশ জমিদারি প্রথার মতোই হয়ে গেল। গণতান্ত্রিক দেশে এটা হওয়ার কথা নয়। আমলাতন্ত্রের কালো থাবা ও চরম অব্যবস্থাপনার কোনো সীমারেখা নেই, তা আবারও স্পষ্ট হলো। এই সরকারকে একটা জটিল পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেওয়ার জন্যই এসব করা হয়েছে।

টাকা জোগাড়ে ভ্যাট বাড়িয়ে পরে আবার চাপের মুখে ভ্যাট কমানোর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, কোনো ধরনের প্রভাব পর্যালোচনা করা হয়নি। খুবই তড়িঘড়ি করে এসব করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হলে সেটার যে একটা পুশব্যাক আসবে তা বোঝার জন্য কোনো বিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই। এটা তো সাধারণ জ্ঞান প্রয়োগ করেই বোঝা যায়। এই অর্থবছরেই রাজস্ব আদায় বাড়ানোর একটা চাপ ছিল আইএমএফের পক্ষ থেকে, কিন্তু এখানে আরো নেগোসিয়েশন করা যেত।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজনীতি ও অর্থনীতি দুটি বিষয়কে আলাদা করা যাবে না। একটা দেশে যদি রাজনীতি ভালো না হয়, সেই দেশে কখনোই অর্থনীতি ভালো হয় না। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, বিনিয়োগ বৃদ্ধি তথা সার্বিক অর্থনীতির পরিস্থিতির উন্নতির জন্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ। সবাই সামনে তাকিয়ে আছে, সামনে যে দেশের রাজনীতির কী হবে।

তিনি বলেন, অর্থনীতির এই নাজুক পরিস্থিতিতে নতুন করে ভ্যাট ও কর চাপিয়ে দেওয়া অনুচিত। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ করতে হলে ব্যবসায়ীদের ওপরে নতুন করে কোনো বোঝা চাপানোর সুযোগ নেই। মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকার যে নীতিতে চলছিল সেখান থেকে ভ্যাট আরোপ করা স্ববিরোধী।

মন্তব্য

আস্থাহীনতা ও বাড়তি খরচে ধুঁকছে শিল্প

মিরাজ শামস
মিরাজ শামস
শেয়ার
আস্থাহীনতা ও বাড়তি খরচে ধুঁকছে শিল্প

গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকার থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতির দৈন্যদশা কাটাতে পারছে না অন্তর্বর্তী সরকারও। বেসরকারি খাতে নানা সমস্যার কারণে সৃষ্ট সংকটের সঙ্গে আরো নতুন করে যোগ হচ্ছে প্রতিবন্ধকতা। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে চরম আস্থাহীনতা ও বাড়তি উৎপাদন ব্যয়ের চাপে আছে শিল্প। এতে বরং ঝুঁকি আরো বাড়ছে।

 

দেশের রাজনৈতিক সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতার পালাবদল হওয়ার পরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে আরো দুরবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় দিনে দিনে দায়-দেনা ভারী হচ্ছে। ফলে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলার সংকট কাটেনি।

দফায় দফায় করকাঠামোর পরিবর্তন। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, তবু ঘাটতি আছে। উচ্চ সুদের হারে ব্যয়ের চাপ বেড়েছে। কমে যাচ্ছে রপ্তানি আয়, শিল্পের উৎপাদন।
এমন পরিস্থিতিতে বাড়ছে শ্রমিকের বেতন। বৃদ্ধি পেয়েছে সব ধরনের কাঁচামালের দাম। এসব কারণে বেড়ে যাচ্ছে শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যয়, যার সরাসরি চাপ পড়ছে ভোক্তার ওপরে। এসব সমস্যা অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে নাজুক করে তুলেছে। প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বিনিয়োগ প্রসারের পথ রুদ্ধ। এমনকি চলমান ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই কঠিন, বলছেন ব্যবসায়ীরা।

শিল্প খাতে এক বছরের ব্যবধানে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। সব মিলিয়ে শিল্প খাতের আকাশে অমানিশার অন্ধকার দেখতে পাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করছে, কিন্তু তেমন সুফল দেখা যাচ্ছে না।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো ও সিটিজেনস প্ল্যাটফর্ম ফর এসডিজিএস বাংলাদেশের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে কোনো সংশোধিত বাজেট দিতে পারেনি। এটা না থাকার কারণে প্রবৃদ্ধির ধারা কমেছে, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কমেছে এবং কর্মসংস্থানে সমস্যা রয়ে গেছে। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা, প্রবৃদ্ধির ধারা, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক সুরক্ষা যদি নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে যাঁরা সংস্কারকে গতিশীল করতে চান তাঁরা ধৈর্যহারা হয়ে যাবেন। 

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেছেন, আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে অসংগত নীতি। প্রতিবছর ব্যবসায়ীরা ভয়ভীতির মধ্যে থাকে যে ট্যাক্স বাড়ল কি কমল। তিনি বলেন, এরপর আছে ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউয়ের হয়রানি। যারা ভালো ট্যাক্স দিচ্ছে তাদের আবার দিচ্ছে। পরের বছর আবার অডিট করছে। লজিস্টিক ঘাটতি রয়েছে। সেখানে ইচ্ছাকৃতভাবে একটা পণ্যের ওপর ডেমারেজ দিয়ে, আরবিটারি ট্যাক্স বসিয়ে দিচ্ছে। ফলে যে দামে পণ্য আনছেন তার দ্বিগুণ বা তিন গুণ দামে কস্ট বেড়ে যাচ্ছে। কে দেখছে? কেউ দেখছে না। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়ে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে এগিয়ে যাওয়া উচিত।

দেশের অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে একের পর এক পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো। পরিস্থিতি উত্তরণে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ দিলেও সঙ্গে আছে কঠিন শর্ত। এই শর্ত বাস্তবায়নে জনভোগান্তি বাড়ায় বিপাকে পড়েছে সরকার। এর প্রভাবে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। বাড়ছে ব্যবসা খরচ, টাকার মান কমে যাচ্ছে। ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ না কমে বরং আরো বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির প্রভাবে ভোক্তাদের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সমন্বয় হচ্ছে না। ফলে পণ্যের বিক্রি কমে গেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। তাই এখন শিল্প টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে। ব্যয়ের চাপ সামলাতে না পারায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন ব্যবসায়ীরা, পাশাপাশি সাধারণ মানুষও। বর্তমান পরিস্থিতিতে শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য রক্ষা এবং জনজীবনে স্বাভাবিক অবস্থা ফেরাতে ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ তৈরির দাবি করেছেন তাঁরা।

আইএমএফের শর্তের মধ্যে রয়েছে ঋণের সুদহার বৃদ্ধি, টাকার প্রবাহ হ্রাস, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির পদক্ষেপ, ভ্যাটের আওতা ও হার বৃদ্ধি, ভর্তুকি কমানো। এসব বাস্তবায়নে গেছে সরকার, যা সংকট আরো ঘনীভূত করেছে। এর প্রভাব সরাসরি পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও জনজীবনে।

ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো নিয়মিত ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন করছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার কিছু খাত থেকে ভ্যাট প্রত্যাহারের বিষয়ে ইতিবাচক পরিকল্পনা নিতে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার শর্ত বাস্তবায়ন না করে দেশের বাস্তবতায় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান ব্যবসায়ীরা। 

আওয়ামী লীগ সরকার মূল্যস্ফীতি কমাতে তিন অর্থবছর ধরে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করে আসছে। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বর্তমান সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর মুদ্রানীতিকে আরো কঠোর করা হয়েছে। ফলে বাজারে টাকার প্রবাহ কমানো হয়েছে। এতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমে প্রবৃদ্ধি মাত্র দেড় শতাংশে নেমেছে। ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সৃষ্ট অস্থিরতা, শ্রমিক অসন্তোষ, উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থাহীনতা, ডলারের সংকট, গ্যাস ও বিদ্যুতের উচ্চ মূল্য ও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহে ঘাটতিএসব কারণে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমেছে, ফলে ঋণের প্রবাহও কমে গেছে। অথচ কর্মসংস্থানের ৯৫ শতাংশই হচ্ছে বেসরকারি খাতে। মাত্র ৫ শতাংশ হচ্ছে সরকারি খাতে। ফলে কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

নতুন সরকার আসার পর প্রথমে ডলারের দাম বাড়িয়ে ১২০ টাকা করে। গত ১ জানুয়ারি থেকে তা আরো বাড়িয়ে ১২২ টাকা করা হয়। কিন্তু ব্যাংকে আমদানির জন্য আগাম ডলার আরো বেশি দামে বেচাকেনা হচ্ছে। ডলারের দাম বাড়ায় আমদানি খরচ বেড়েছে। এতে আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়েছে। টাকার মান কমেছে। এর প্রভাবে অন্য পণ্য ও সেবার দামও বেড়েছে। ফলে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে, ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এদিকে বাজারে চাহিদা অনুযায়ী ডলার মিলছে না। এ কারণে আমদানি খাতেও স্থবিরতা বিরাজ করছে।

ব্যবসায়ীরা অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে দেখা করে ঋণের সুদের হার কমানোর জোর দাবি করেছেন। কারণ বাড়তি সুদের কারণে শিল্পের খরচ বেড়ে গেছে। এ কারণে তাঁরা শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জে পড়েছেন। এমন পরিস্থিতি আগামী দিনে শিল্পকে আরো ঝুঁকিতে ফেলবে। এটি উত্তরণে সরকারের সহযোগিতা চান তাঁরা। 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ