আবারও প্রচণ্ড ছাত্র বিক্ষোভে উত্তাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্লোগানে কম্পিত বিশেষভাবে বুয়েট। কারণ আর কিছু নয়, বুয়েটের একজন মেধাবী ছাত্রকে পিটিয়ে মারা, নিছক ফেসবুকের স্ট্যাটাসে ভিন্নমতের কারণে। এ যেন আরেক ব্লগার হত্যার মতোই ঘটনা—অভিজিত, দীপন তথা কয়েকটি নাম।
সাদাকালো
আবরার হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই
- আহমদ রফিক
অন্যান্য

ব্লগার নিয়ে অনেক বিতর্ক। বাদ দিই সে প্রসঙ্গ।
তাদের বাধা দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। না ছাত্র, না শিক্ষক-প্রশাসক, না পুলিশ। সংবাদ বিবরণে প্রকাশ, পুলিশ খবর পেয়ে ছাত্রাবাসে গেলেও ছাত্রলীগ তাদের ঢুকতে দেয়নি।
এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ ঘটনায় তাঁর প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে বলেছেন, ভিন্নমত হলেই মেরে ফেলতে হবে এমন ঘটনা তো মানা যায় না। অপরাধীদের শাস্তি পেতে হবে। তাঁর এ বক্তব্যের সূত্র ধরে বলতে হয়, এই কি ষাটের দশকের ছাত্রলীগ? এ নৃশংসতা মেনে নেওয়া যায় না। আমরা এ ঘটনায় দুর্বৃত্তদের শাস্তি বিধানে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের দ্রুত ফলাফল দেখতে চাই।
বিচার চাই এ হত্যাকাণ্ডের, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকের ন্যায়নিষ্ঠ বিচার। সম্ভবত ক্ষুব্ধ, মর্মাহত প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়ার কারণে উদাসীন পুলিশ এখন সক্রিয়।
অতি দ্রুততায় ১০ জন শিক্ষার্থী পাঁচ দিনের রিমান্ডে, মোট ১৩ জন গ্রেপ্তার। এর আগে আমরা পুলিশকে এতটা দ্রুততার সঙ্গে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মোকাবেলা করতে কমই দেখেছি।
এখন বড় প্রশ্ন, যা বরাবরই করে এসেছি, সঠিক বিচার এবং অপরাধীদের শাস্তি হলেও আবরার তো তার পরিবারে, তার মা-বাবার কাছে ফিরে আসবে না? তাই প্রশ্ন প্রবাদবাক্যে উচ্চারণে ‘প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ শ্রেয়’—এ হত্যাকাণ্ড কি ঠেকানো যেত না? বিশেষ করে যদি পুলিশ তার দায়িত্ব পালনে সক্রিয় ও পেশাদারিত্বের পরিচয় দিত?
যদি হলের প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র না সেজে সক্রিয় হতেন, নিরপেক্ষ ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে দুর্বৃৃত্ত ছাত্রদের মোকাবেলায় দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতেন? দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা সময় ধরে নির্বিবাদে এ পৈশাচিক নির্যাতনকাণ্ড চলেছে। এত সময় কী করছিলেন হল কর্তৃপক্ষসহ বুয়েটের উপাচার্য? তাঁরা এ খবর পাননি—এমন কথাও কি বিশ্বাস করতে হবে? ছাত্রদের প্রশ্নের কী জবাব দেবেন উপাচার্য? তিনি কি পদত্যাগ করে দায়িত্ব পালনে অক্ষমতার দায়মুক্তির চেষ্টা করবেন? মনে হয় না।
বুয়েটের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে মাসুদ বলেছেন, ‘উপাচার্যের ব্যর্থতায় আমরা মর্মাহত।’ তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, ছাত্রাবাসে নিরাপত্তাহীনতা দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে; কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আমাদের প্রশ্ন: দীর্ঘস্থায়ী এ অনাচারের বিরুদ্ধে শিক্ষক সমিতির কি করণীয় কিছু ছিল না? না কি তেমন সৎ সাহস, নৈতিক সাহস তাঁদের ছিল না।
আবরার হত্যাকাণ্ড উপলক্ষে আজ সংবাদ শিরোনাম প্রকাশিত হচ্ছে, ‘বুয়েটের তিন হলে সাত টর্চার সেল’, ‘স্টাম্প ও লাঠি সব সময়ই প্রস্তুত রাখে ছাত্রলীগ।’ ভয়ংকর এ খবরটি কি জানা ছিল না বুয়েটের প্রশাসন ও প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের? কী ব্যবস্থা নিয়েছেন তাঁরা? এক সূত্রমতে, পূর্ববর্তী ছাত্র হত্যার (আবুবকর হত্যার) বিচার হলে এ অবস্থা ঘটত না। নতুন করে প্রশ্ন তুলতে হয়, ওই ছাত্র হত্যার বিচার হয়নি কেন? বিচার না হওয়ার দায় কার?
ক্ষমতাসীন ছাত্ররাজনীতি অর্থ, ক্ষমতা, কৃতিত্ব-প্রভুত্বের দূষণে এতই দূষিত হয়েছে যে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন ছাত্র নেতৃত্ব নিশ্চিন্তে তাদের নিজস্ব শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। কেউ তাতে বাধা দেয়নি। দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, দেয়নি মূল রাজনৈতিক সংগঠন।
একটি বর্বর হত্যাকাণ্ডের পর আজ যাঁরা বলছেন, অপরাধী কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না, তাঁরা যদি আগেই তাঁদের অঙ্গসংগঠনের অনাচারী নেতাদের সম্পর্কে, ছাত্রনেতা-যুবনেতাদের সম্পর্কে সতর্ক হতেন, তাহলে আজকের ঘটনা, এর পূর্ববর্তী হত্যাকাণ্ডের বর্বরতা ঘটত না কিংবা ক্যাসিনোকাণ্ডও ঘটত না, অভিযান চালাতে হতো না সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।
ছাত্ররাজনীতির এ দূষণ তো আজ থেকে নয়। অনাচারী ছাত্রনেতা-উপনেতাদের ঘাতক মনোবৃত্তির প্রকাশ দেখলেই মনে পড়ে যায় অসহায় দরজি যুবকটির কথা, যার রাজনৈতিক আনুগত্যের বারংবার ঘোষণা সত্ত্বেও তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ঘাতক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু তথাকথিত ছাত্রনেতা।
বিচারহীনতা সম্পর্কে একটি দৈনিকের সংবাদ শিরোনাম : ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন হয়, বিচার হয় না’। তাদের সংবাদ পরিসংখ্যান জানাচ্ছে : ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন সাধারণ শিক্ষার্থী হত্যার একটিরও বিচার হয়নি।’ ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দশকে পাঁচ শিক্ষার্থী খুন, বিচার পায়নি পরিবার।’ ‘সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের তিন কর্মী হত্যার বিচার হয়নি।’ কেন হয়নি? কে বা কারা দায়ী এ বিচারহীনতার জন্য?
শুধু কি বিচারহীনতাই ছাত্ররাজনীতি, যুব রাজনীতির বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী। এর সঙ্গে আরো বড় ধরনের, তাৎপর্যময় কারণ কি জড়িত নেই? শুধু বিশ্ববিদ্যালয় বা কারিগরি শিক্ষায়তনই নয়, কলেজ ও স্কুলের মতো শিক্ষায়তন এ দূষণের শিকার। রাজনৈতিক-সামাজিক দূষণ, দূষণ নৈতিকতাবোধের অভাবে।
এর দায় যেমন পারিবারিকভাবে অভিভাবকদের, তেমনি শিক্ষায়তনিক স্তরে দায় শিক্ষকদের, শিক্ষায়তনিক কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের। তাদের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, স্বার্থপরতা, সব কিছু দলাদলির দূষণে শিক্ষকতার আদর্শ থেকে বিচ্যুত। এতে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরাও—পদমর্যাদা ও সুবর্ণ প্রাপ্তির অন্ধ আকর্ষণে। ব্যতিক্রমীরা সংখ্যালঘু, শক্তিহীন। কাজেই শুভবুদ্ধিসম্পন্নদের শুভ প্রচেষ্টা কাজে আসে না।
দুই.
বাংলাদেশে আদর্শবাদী ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্র আন্দোলনের ঐতিহ্য গর্ব ও অহংকারের। আটচল্লিশ থেকে পঞ্চাশের দশকে ভাষা আন্দোলন, প্রগতিবাদী সাংস্কৃতিক আন্দোলন, ষাটের দশকে মূলত দুই ধারায় জাতীয়তাবাদী ও প্রগতি ছাত্র আন্দোলন—শিক্ষা আন্দোলন ও রাজনৈতিক আন্দোলন যে ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছিল, আজ তা দূষণে ও আদর্শচ্যুতিতে, ক্ষমতা প্রদর্শনের দম্ভে-ঔদ্ধত্যে ও সংকীর্ণ স্বার্থপরতায় বিপথগামী ও আদর্শচ্যুত।
আগেই বলেছি এর দায় নিয়ন্ত্রক জাতীয় রাজনীতির। যে ছাত্ররা—যাদের আমরা সাধারণ ছাত্র বলি, যারা একুশের আন্দোলনকে সার্থক করে তুলেছিল, আজ হঠাৎ করে আবরার হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে তারা হাজার কণ্ঠে বলছে, আমরা চুপ করে থাকব না। যারা লাঠি, ছোরা, হকিস্টিকের ভয়ে স্তব্ধ হয়েছিল, তাদের কণ্ঠে প্রতিবাদী গর্জন—‘আমরা চুপ করে থাকব না।’ অর্থাৎ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রুখে দাঁড়াব।
এই ছাত্রসাধারণের নিঃস্বার্থ ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তপনা থেকে আক্রান্ত নিরীহ ছাত্রকে বা ছাত্রদের রক্ষা করতে পারে, রক্ষা করতে পারত আবরার ফাহাদকেও। ঐক্যবদ্ধ সে শক্তিমত্তা ও নৈতিক সাহস বুয়েটের এই প্রতিবাদী ছাত্ররা আগে দেখাতে পারেনি। পারলে অন্তত একটি অঘটন ঠেকানো যেত।
বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করছি, প্রতিবাদী ছাত্রদের অন্যতম প্রধান একটি দফা—ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা। যে ছাত্রদের বরাবর দেখেছি ছাত্ররাজনীতিতে প্রবল আগ্রহ, অন্তত সচেতনতা, তাদের কণ্ঠে এই যে বিপরীত ঘোষণা—এর মূল কারণ ছাত্ররাজনীতির দূষণ, অনৈতিকতা ও আদর্শহীনতা। তারা স্বধর্মচ্যুত বলেই এই বিপরীতমুখী যাত্রা।
পরিস্থিতির সামগ্রিক বিচার-বিশ্লেষণে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিকল্প হতে পারে শুদ্ধ আদর্শনিষ্ঠ, নীতিবাদী ছাত্ররাজনীতির ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন সংগঠন, যারা আপন বিচার-বিবেচনায় ছাত্রদের শিক্ষাগত স্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থের পক্ষে কাজ করবে। কারো তল্পিবাহক হয়ে নয়, কারো রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির ধারক-বাহক হয়ে নয়।
সব শেষে আলোচ্য বিষয়ের মূল কথা হলো, আবরার হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় ছাত্রদের প্রতিবাদী আন্দোলনের মুখে হত্যাকাণ্ডের নায়কদের যেন যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে বিচারাধীন করে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। পূর্বোক্ত একাধিক ঘটনার মতো এ ক্ষেত্রেও যেন কোনো ফাঁপা যুক্তি শাস্তির বিরুদ্ধে বাধা না হয়ে দাঁড়ায়। আমরা মাদরাসাছাত্রী নুসরাত হত্যা মামলার সঠিক রায়ের অপেক্ষায়। আবরার হত্যার ক্ষেত্রেও একই কথা। ছাত্ররাও যেন তাদের তুমুল আবেগ শিকেয় তুলে না রাখে। চলমান রাখে তাদের প্রতিবাদ। শেষ কথা, বুয়েটের দায়িত্বহীন প্রশাসন কি তাদের দায় থেকে মুক্ত থাকবে?
লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী
সম্পর্কিত খবর

ঋণের উচ্চ সুদহার কমানো প্রয়োজন
- নিরঞ্জন রায়

সম্প্রতি একটি ইংরেজি দৈনিক ব্যাংকঋণের ওপর উচ্চ সুদহার এবং দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যা রীতিমতো উদ্বেগজনক। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে গড় সুদের হার ছিল ৭.২৪ শতাংশ, যা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে এসে দাঁড়ায় ৯.৭৫ শতাংশে এবং ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১১.৮৯ শতাংশ। বিগত দুই বছরে ঋণের ওপর সুদের হার ৭.২৪ থেকে বৃদ্ধি করে ১১.৮৯ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাত্ মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে সুদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে ৫ শতাংশ, যা এককথায় নজিরবিহীন।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন যে দেশের ব্যবসায়ীরা যতই চাপ সৃষ্টি করুন না কেন, তিনি সুদের হার হ্রাস করবেন না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ীদের চাপ সৃষ্টি করার মতো অবস্থা কি আসলেই আছে! ব্যবসায়ীরা তাঁদের ব্যবসা টিকিয়ে রেখে কোনো রকমে বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত এবং প্রতিনিয়ত উদ্বেগজনক অবস্থার মধ্যে আছেন। চাপ সৃষ্টি করবেন কিভাবে? তা ছাড়া রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় না থাকলে যে কোনো রকম চাপ সৃষ্টি করা যায় না, সেটি তাঁরা ভালো করেই জানেন।
আমরা যারা অর্থনীতি নিয়ে লেখাপড়া করেছি, তারা ভালো করেই জানি যে অর্থনীতির কোনো তত্ত্ব তখনই কাজ করে, যখন অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকে এবং স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করে। এ কারণেই অর্থনীতির যেকোনো সূত্র লেখার আগে একটি কথা প্রথমেই উল্লেখ করা হয় তা হচ্ছে, ‘অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে (ceteris paribus, meaning other things will ermain unchanged) ।’ এমনকি যেসব দেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করে, মানসম্পন্ন মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি এবং সুশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থা বিদ্যমান; যেমন—কানাডা, আমেরিকা, ইউরোপ, সেখানেও এই নীতি সুদ হার প্রয়োগ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সব সময় সম্ভব হয় না। এ কারণেই সেসব দেশে একাধিক মূল্যস্ফীতির সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে; যেমন—মৌলিক মূল্যস্ফীতি যেখানে অতি মূল্য পরিবর্তনশীল পণ্য বিবেচনায় নেওয়া হয় না; অমৌলিক মূল্যস্ফীতি, যেখানে সব রকম পণ্য বিবেচনায় নেওয়া হয় এবং গড় মূল্যস্ফীতি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু মৌলিক মূল্যস্ফীতিই বিবেচনা করে। এই যেখানে অবস্থা, সেখানে আমাদের দেশে না আছে মানসম্পন্ন মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি, না আছে বাজারব্যবস্থায় শৃঙ্খলা। সর্বক্ষেত্রে এক বিশৃঙ্খল অবস্থা। এর ওপর এখন তো বিরাজ করছে একেবারেই অস্বাভবিক অবস্থা এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। এ রকম অবস্থায় উচ্চ সুদহার প্রয়োগ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার কাজটি মোটেই সফল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অন্তত আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। মাঝখান থেকে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে দুই ধরনের উপাদানের প্রভাব। একটি হচ্ছে অর্থনৈতিক উপাদান; যেমন—মুদ্রা সরবরাহ, চাহিদা, জোগান। আরেকটি হচ্ছে অর্থনীতিবহির্ভূত উপাদান; যেমন—বিশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থা, আধুনিক গুদামজাত ব্যবস্থার অভাব, মানসম্পন্ন মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি, অনিয়ন্ত্রিত সরবরাহ ব্যবস্থা প্রভৃতি। নীতি সুদ হার প্রয়োগ করে মূল্যস্ফীতির অর্থনৈতিক উপাদানকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও অর্থনীতিবহির্ভূত উপাদানের ক্ষেত্রে তেমন কিছুই করার সুযোগ থাকে না। এ কারণেই দেখা যায়, যেসব দেশে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণে অর্থনীতিবহির্ভূত উপাদান খুবই কম; যেমন—আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ, সেসব দেশে নীতি সুদ হার প্রয়োগ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কাজটি অনেকটা সহজ হয়। পক্ষান্তরে যেসব দেশে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণে অর্থনীতিবহির্ভূত উপাদান অনেক বেশি; যেমন—বাংলাদেশ, সেসব দেশে শুধু নীতি সুদ হার প্রয়োগ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ খুবই কম। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতাও তা-ই বলে।
উচ্চ সুদহারের কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। আমাদের দেশে উচ্চ সুদহারের নেতিবাচক প্রভাব মারাত্মক। কেননা এখানে বিনিয়োগযোগ্য অর্থ সংগ্রহের একমাত্র উৎস হচ্ছে ব্যাংকঋণ। উচ্চ সুদহার বহাল থাকলে ব্যাংক যেমন নতুন ঋণ দিতে আগ্রহী হয় না, তেমনি উদ্যোক্তারাও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করতে সাহস পান না। কেননা উচ্চ সুদহারের সময় ঋণ পরিশোধ বা ডেট সার্ভিসিং করতে না পারার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। আমাদের অনেকেরই মনে থাকার কথা, ১৯৮০-এর দশকে অসংখ্য ঋণগ্রহীতা ব্যাপকহারে ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়ে ঋণখেলাপির খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন এবং সেখান থেকেই দেশে ঋণখেলাপি সংস্কৃতির শুরু। সেই সময়ের অস্বাভাবিক খেলাপি ঋণের জন্য দেশের ব্যবসায়ীদের দোষারোপ করা হয়। এটিই স্বাভাবিক। কেননা ঋণ নিলে, সেই ঋণ পরিশোধের সব ধরনের দায়দায়িত্ব ঋণগ্রহীতার ওপরই বর্তায়, তাতে বাস্তব অবস্থা যেমনই হোক না কেন।
বাস্তবতা হচ্ছে সে সময়ের পর্যাপ্ত ঋণখেলাপির পেছনের আসল কারণ কখনোই অনুসন্ধান করা হয়নি এবং এ নিয়ে কোনো কথাও বলা হয় না। অথচ সে সময়ের মাত্রাতিরিক্ত ঋণপখেলাপির পেছনে যে কয়টি উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল, তার মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত সুদের হার, যা তখন ছিল ১৮ থেকে ২০ শতাংশ। এই উচ্চ সুদহারে এক কোটি ঋণ নিয়ে থাকলে চার বছরে তা সুদে-আসলে বেড়ে দুই কোটি টাকা হয়েছিল। কোনো ব্যবসায়ীর পক্ষে চার বছরের মধ্যে ব্যবসা করে গৃহীত এক কোটি টাকা ঋণ সুদে-আসলে দুই কোটি টাকা পরিশোধ করা সম্ভব নয়। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। ঋণগ্রহীতারা ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য বেড়ে গেছে। এখনো যদি সুদের হার হ্রাস না করে উচ্চ সুদহার বহাল রাখা হয়, তাহলে একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। অর্থাত্ দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে, যা এরই মধ্যে উদ্বেগজনক অবস্থায়ই আছে।
এ কারণেই শুধু অর্থনীতির নিয়মের মধ্যে বা আইএমএফের সুপারিশের মধ্যে আটকে না থেকে বাস্তবতার আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন আছে। এ রকম সিদ্ধান্ত বিশ্বের অনেক দেশই নিয়ে থাকে এবং সেসব দৃষ্টান্ত অসংখ্য আছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ের সে রকম একটি দৃষ্টান্ত পাঠকদের জ্ঞাতার্থে উল্লেখ করছি। কানাডায় ব্যাংক অব কানাডা (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) আগে বেশ কয়েকবার নীতি সুদ হার হ্রাস করেছে এবং এখন কোনো অবস্থায়ই এই সুদের হার আরো কমানোর অবস্থানে নেই। কেননা মূল্যস্ফীতি এখনো সেভাবে হ্রাস পায়নি। তদুপুরি কানাডিয়ান ডলারের বিনিময় মূল্য সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। মুদ্রাবাজার বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে পুনরায় নীতি সুদ হার হ্রাস করলে কানাডিয়ান ডলারের আরো অবমূল্যায়ন হবে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য খুব একটা ভালো হবে না। এর পরও ব্যাংক অব কানাডা পুনরায় নীতি সুদ হার হ্রাস করে ২.৭৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে জনগণের, বিশেষ করে ব্যবসায়ী এবং বিনিয়োগকারীদের কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা। কেননা এখানকার অর্থনীতি হচ্ছে ঋণনির্ভর। ফলে ঋণের ওপর উচ্চ সুদহারের কারণে কানাডার মানুষের দুর্বিষহ অবস্থা। এ কারণেই সরকার ডলারের অবমূল্যায়নের ঝুঁকি নিয়ে এবং বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা উপেক্ষা করে নীতি সুদ হার হ্রাস করেছে।
বাস্তবতা যখন দাবি করে, তখন বইয়ের সূত্র বা আইএমএফের সুপারিশের বাইরে গিয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এ রকম সিদ্ধান্ত বিশ্বের অনেক দেশই নিয়ে থাকে, তাই আমাদের দেশকেও নিতে হবে। আগে ব্যবসায় গতি আনতে হবে, ব্যবসায়ীদের আস্থা ফেরাতে হবে, বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে হবে এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে হবে। আর এগুলো নিশ্চিত করতে হলে অনেক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা আছে, যার মধ্যে সুদের হার হ্রাস করা অন্যতম এবং সবার আগে এটি করা প্রয়োজন। আশা করব, অর্থ উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন এবং এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।
লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা
nironjankumar_roy@yahoo.com

দেশীয় পণ্য উৎপাদন ও ব্যবহারের অর্থনৈতিক প্রভাব
- ড. ফজলে এলাহী মোহাম্মদ ফয়সাল

বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে উন্নতি লাভ করছে। এ উন্নতির পেছনে রেডিমেড গার্মেন্টস সেক্টরের উন্নয়ন এবং প্রবাসীদের মাধ্যমে প্রেরিত অর্থের বিরাট অবদান রয়েছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ছিল মাত্র ৯৪ মার্কিন ডলার এবং ২০২৪ সালে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৬৭৫ মার্কিন ডলার। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে বেশ কয়েক গুণ।
একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশে ব্যবহৃত ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস পণ্যের প্রায় পুরোটাই বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো।
প্রকৃতপক্ষে আমরা যদি ব্যবহারের জন্য আমাদের দেশে তৈরি পণ্য অর্থাত্ আমাদের নিজস্ব ব্র্যান্ড অথবা বিদেশি ব্র্যান্ডের পণ্য, যেগুলো আমাদের দেশে উৎপাদন করা হয় সেসব পণ্য ব্যবহার করি, তাহলে আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা কমবে এবং ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অথবা ব্যালেন্স অব ট্রেড-এর উন্নয়ন ঘটবে। আমরা জানি, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন অর্থাত্ মুনাফা অর্জনের জন্য প্রয়োজন বিক্রয় বৃদ্ধি। বিক্রয়মূল্য যদি উৎপাদন খরচ ও অন্যান্য খরচের চেয়ে বেশি হয় এবং কোনো প্রতিষ্ঠান যদি বেশি পরিমাণ দ্রব্য বিক্রয় করতে পারে, তাহলে প্রতিষ্ঠানটি মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হবে। তাদের ব্যবসায়ের পরিধি বৃদ্ধির জন্য পুনরায় বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিধি বৃদ্ধি পেলে বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে এবং কর্মে জড়িত ব্যক্তিদের আয়স্তর বৃদ্ধি পাবে। বেকার যুবকরা কর্মের সুযোগ পেলে এবং আয়স্তরের বৃদ্ধি ঘটে থাকলে দ্রব্যের সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি পাবে এবং বিনিয়োগ, উৎপাদন ও ব্যবসায় বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং নতুন নতুন পণ্যের উৎপাদনের মাধ্যমে পণ্যের জোগান বাড়বে। এর ফলে আবারও কর্মসংস্থান ও আয়স্তর বৃদ্ধি পাবে। এতে আমাদের দেশে পুনরায় কর্মসংস্থান, আয়স্তর সামগ্রিক চাহিদা, পণ্যের উৎপাদন ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। বৃদ্ধি পাবে সরকারের রাজস্ব আয় এবং সরকারের পক্ষে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা সম্ভব হবে।
একটি সহজ উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি আলোচনা করা যাক। মনে করি, কোনো একটি প্রতিষ্ঠান ‘নিউটন’ ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল বাংলাদেশে ফ্যাক্টরির মাধ্যমে উৎপাদন করে। বাংলাদেশের নাগরিকরা যদি বিদেশি ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল না কিনে বেশি পরিমাণ ‘নিউটন’ মোটরসাইকেল কেনা শুরু করে, তবে প্রতিষ্ঠানটি মুনাফা বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে আরো বেশি ‘নিউটন’ মোটরসাইকেল উৎপাদন করতে চাইবে। মনে করি, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটিতে উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে নতুনভাবে আরো দুই হাজার তরুণের কর্মসংস্থানের সুযোগ হলো। দুই হাজার জনের কর্মসংস্থান হওয়ার ফলে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্র তৈরি হলো। দুই হাজার জনের আয়স্তর বৃদ্ধির কারণে দ্রব্যের চাহিদা তৈরি হলো। এতে চায়নিজ রেস্টুরেন্ট, লন্ড্রি, ফার্মেসি, বিস্কুট ফ্যাক্টরি তৈরি হলো এবং এসব ব্যবসায়ের মালিকদের আয় বৃদ্ধি পেল এবং নতুন করে ২০০ জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলো। রাজস্ব বৃদ্ধি হলে মনে করি, কোনো এলাকার নতুন রাস্তা তৈরি হলো এবং একটি সরকারি হাসপাতাল নির্মিত হলো। আরো মনে করি, ওই এলাকায় যাদের জমি ছিল রাস্তা ও হাসপাতাল নির্মিত হওয়ার ফলে তাদের জমির মূল্য দ্বিগুণ হয়ে গেল। হাসপাতাল ও রাস্তা নির্মিত হওয়ায় সেখানেও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হলো। সুতরাং একটি সহজ উদাহরণে দেখা গেল দেশীয় পণ্য বিক্রির ফলে সরকারের রাজস্ব আয়, উন্নয়ন কার্যক্রম, কর্মসংস্থান, আয়স্তর, চায়নিজ রেস্টুরেন্ট, বিস্কুট ফ্যাক্টরি, ফার্মেসি ইত্যাদি তৈরি হলো এবং আবারও কর্মসংস্থান ও আয়স্তর বৃদ্ধি পেল এবং হাসপাতাল ও রাস্তা নির্মিত হওয়ার ফলে জনগণের সম্পদের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলো। মুনাফা বৃদ্ধির ফলে প্রতিষ্ঠানটি সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য একটি স্কুল নির্মাণ করল।
দেশীয় পণ্য বিক্রয় বৃদ্ধি পেলে অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক এবং রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন হয়ে থাকে। একইভাবে দেশে উৎপাদিত বৈদেশিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিক্রয় বৃদ্ধি পেলেও কর্মসংস্থান, আয়স্তর, রাজস্ব আয় এবং উন্নয়ন বৃদ্ধি পায়। আমরা যদি আমাদের দেশকে প্রকৃত অর্থেই ভালোবাসি, তাহলে দেশে উৎপাদিত পণ্য ব্যবহারের জন্য অনুপ্রাণিত হতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

ভেজালের রাজ্যে আসল খুঁজে পাওয়া ভার
- ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী

গল্পটি অনেক দিন আগে শুনেছিলাম। নন্দ ঘোষ নামে এক গোয়ালা প্রতিদিন পুরান ঢাকার এক অভিজাত পরিবারে দুধ সাপ্লাই করতেন। নন্দ ঘোষ অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং দায়িত্বশীল একজন মানুষ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। একদিন হঠাত্ করেই নন্দ ঘোষ অসুস্থ হয়ে পড়েন।
এটি একটি প্রতীকী গল্প, তবে গল্পটি নিরর্থক নয়। এই গল্পের মাধ্যমে আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। তবে সেই উন্নয়ন কতটা টেকসই এবং গুণগত মানসম্পন্ন তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিশ্বব্যাংকের রেটিংয়ে বাংলাদেশকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক তালিকায় স্থান দিয়েছে। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী বছর (২০২৬) বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হবে। দৃশ্যত এসব উন্নয়ন সূচক আমাদের আশান্বিত করে। তার পরও মনে শঙ্কা জাগে আমরা কি সত্যি উন্নয়ন অর্জন করছি? আর যে উন্নয়ন প্রত্যক্ষ করছি তা কতটা মানবকল্যাণমূলক? অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। কিন্তু সেই অর্জন কোন কোন ক্ষেত্রে আমাদের জন্য বিপদ ডেকে আনছে।
বাংলাদেশ একসময় খাদ্যঘাটতি এলাকা হিসেবে পরিগণিত হতো। স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫৩ বছরে বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে ব্যাপক উন্নতি অর্জন করেছে। আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ হ্রাস পেলেও বাংলাদেশ এখন খাদ্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশে চাল উৎপাদিত হতো এক কোটি ১০ লাখ টন। এখন চাল উৎপাদনের পরিমাণ সাড়ে তিন গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে তিন কোটি ৭০ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। চাল উৎপাদনে বিশ্ব প্রথম স্থানে রয়েছে চীন। তাদের বার্ষিক চাল উৎপাদনের পরিমাণ হচ্ছে ১৪ কোটি ৪৬ লাখ টন। ১৩ কোটি ৭৮ লাখ টন চাল উৎপাদন করে ভারত দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ এখন খাদ্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও আমরা কি নিশ্চয়তা দিতে পারি যে খাদ্যপণ্য ভোক্তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে তা শতভাগ নিরাপদ ও ভেজালমুক্ত? আমরা প্রায়ই খাদ্য নিরাপত্তা এবং নিরাপদ খাদ্য শব্দ দুটি শুনে থাকি। কিন্তু অনেকেই এর পার্থক্য সম্পর্কে অবহিত নন। খাদ্য নিরাপত্তার অর্থ হচ্ছে নাগরিকদের জন্য প্রয়োজীয় খাদ্য জোগান নিশ্চিত করা। আর নিরাপদ খাদ্যের অর্থ হচ্ছে, যে খাবার ভোক্তার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে তা তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ কি না। সরবরাহকৃত খাদ্য যদি নিরাপদ না হয়, তাহলে খাদ্য নিরাপত্তা অর্থহীন হয়ে পড়তে পারে।
বিশ্বব্যাপী নিরাপদ খাদ্যের আন্দোলন জোরদার হচ্ছে। উন্নত দেশগুলোতে ভোক্তাদের হাতে কোনো খাবার তুলে দেওয়ার আগে তার গুণগত মান এবং মানবদেহের জন্য তা ক্ষতিকর কি না সেটা নিশ্চিত করা হয়। উন্নত দেশগুলোর ভোক্তারাও অধিকতর সচেতন। তারা কোনোভাবেই ভেজাল ও নিম্নমানের খাবার গ্রহণ করেন না। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতনতার প্রচণ্ড অভাব পরিলক্ষিত হয়। কিছু কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা মনে করেন খাবার হলেই হয়, ভালো আর মন্দ কী? বিশ্বের প্রতিটি দেশেই স্ট্রিট ফুড অত্যন্ত জনপ্রিয়। স্ট্রিট ফুডের দোকানগুলোতে কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বাংলাদেশে স্ট্রিট ফুডের দোকানে মাননিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। শুধু স্ট্রিট ফুডের দোকানেই নয়, সর্বত্রই চলছে ভেজাল পণ্যের কারবার। শহর থেকে গ্রাম সর্বত্রই ভেজাল পণ্যের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা যায়। এক শ্রেণির অতি মুনাফাখোর জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনা না করেই খাদ্যপণ্যে ভেজাল মেশাচ্ছে। বাড়তি মুনাফা অর্জনের জন্য তারা এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত রয়েছে। যেকোনো পণ্যেই ভেজাল মেশানো মারাত্মক অপরাধ। আর তা যদি হয় খাদ্যপণ্য, তাহলে তো কথায় নেই। ভেজাল পণ্য গ্রহণ করা হলে ভোক্তা সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে না। সাধারণত ভেজাল খাদ্য গ্রহীতা নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তাঁরা মৃত্যুবরণ করেন। ভেজাল খাদ্যের ক্ষতিকর প্রভাব তাত্ক্ষণিকভাবে উপলব্ধি করা যায় না। ভেজাল খাদ্যকে স্লো পয়জনিং বলা যেতে পারে। এমন অনেক রোগ আছে, যা ভেজাল খাদ্য গ্রহণের কারণেই সংক্রমিত হয়ে থাকে।
রাজধানীর বিভিন্ন দোকানে বাহারি ফলের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা যায়। এসব ফলের বেশির ভাগই নানা ধরনের ক্ষতিকর কেমিক্যাল মেশানো। মৌসুমি ফলে ফরমালিন, কার্বাইডসহ নানা ধরনের ক্ষতিকর কেমিক্যাল মেশানো হয়। ফরমালিন ব্যবহার করা হয় মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্য। এখন তা ফল এবং অন্যান্য খাদ্যপণ্য তাজা রাখার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব কেমিক্যাল মেশানো খাদ্যপণ্য গ্রহণ করা হলে একজন মানুষ ধীরে ধীরে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন। একসময় তার মৃত্যু ঘটবে অথবা পঙ্গুত্ববরণ করবে।
বাংলাদেশ এখন মাছ উৎপাদনে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পাঁচটি মৎস্য উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। কিন্তু আমরা বাজারে গিয়ে যেসব মাছ ক্রয় করছি তা কতটা স্বাস্থ্যসম্মত এবং ভেজালমুক্ত তা কি আমরা ভেবে দেখেছি? রাজধানী ঢাকা শহরের এক অভিজাত মাছের দোকান থেকে জনৈক ভদ্রলোক বড় আকারের একটি কাতলা মাছ কিনে গাড়ির পেছনে (ব্যাক ডালায়) একটি বালতির মধ্যে রাখেন। বাসায় ফিরে একজন আত্মীয়ের দুর্ঘটনা সংবাদ শুনে তিনি তাত্ক্ষণিকভাবে হাসপাতালে ছুটে যান। মাছের কথা তিনি ভুলে যান। কয়েক দিন পর মাছের কথা মনে পড়লে তিনি গাড়ির পেছনের ডালা খুলে দেখেন মাছটি তখনো তরতাজাই রয়েছে। সামান্য কিছু নষ্ট হয়নি। ভদ্রলোক বুঝতে পারেন মাছে ফরমালিন দেওয়া আছে। তাই তিনি মাছটি না খেয়ে ফেলে দেন। আমরা প্রায়শই এমন ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছি। সবজির রং অক্ষুণ্ন রাখার জন্য সবুজ রং মেশানো হয়। এই রং মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। কয়েক বছর আগে গাড়ি থামিয়ে রাস্তার পাশ থেকে কিছু বরই কিনে আনি। বরইগুলো খুবই সুন্দর এবং মনোলোভা ছিল। কিন্তু বাসায় আনার পর আমরা বুঝতে পারি এগুলো আসল বরই নয়। রং মেশানো বরই মাত্র।
পণ্যের মাননিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) আছে। কোনো পণ্য বাজারে ছাড়ার আগে এই প্রতিষ্ঠান থেকে ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হয়। আর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রয়েছে। তারা মাঝে মাঝে বাজারে অভিযান চালিয়ে ভেজাল পণ্য বিপণনকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু লোকবল স্বল্পতা এবং অন্যান্য সীমাবদ্ধতার কারণে তারা ভেজাল প্রতিরোধে খুব একটা সফল হচ্ছে না। আজ দুর্নীতি যেমন রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থাকে গ্রাস করেছে, ঠিক তেমনি ভেজাল পুরো দেশবাসীকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। মেধাবী ও কর্মক্ষম জাতি গঠনে ভেজাল নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই। পৃথিবীর আর কোনো দেশে বাংলাদেশের মতো খাদ্যপণ্যে এত ভেজাল মেশানো হয় বলে আমাদের জানা নেই। ভেজাল খাদ্য গ্রহণ করলে একজন শিশু কখনোই মেধাবী হয়ে গড়ে উঠতে পারবে না।
ভেজাল নিয়ন্ত্রণের জন্য সবার আগে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। যাঁরা বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করেন তাঁদের বোঝাতে হবে সামান্য মুনাফার আশায় তাঁরা জাতির কতটা ক্ষতি করছেন। ভোক্তাদের তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। কোনো পণ্যে ভেজাল মেশানো হয়েছে এটা সন্দেহ হলেই সেই পণ্য কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে। দামে কম হলেও ভেজাল পণ্য ক্রয় করা যাবে না। ভেজাল প্রতিরোধে যে আইন প্রচলিত আছে তা পর্যাপ্ত নয়। সময়োপযোগী করে ভেজাল প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন করতে হবে। ভেজালকারী দেশ ও জাতির শত্রু। তাই তাদের কঠোর শাস্তি বিধান করতে হবে। বড় অপরাধীকে আইনের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা করতে হবে। ভেজালকারীকে কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া যাবে না। খাদ্য বা অন্যান্য পণ্যে যেসব ভেজাল মেশানো হয় তার ব্যবহার সীমিত করতে হবে। পণ্য ভেজালকারীর কাছে ফরমালিন বা এজাতীয় কেমিক্যাল বিক্রি বন্ধ করতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে যে তারা যদি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়, তাহলে ভেজালের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বর্তমানে বাংলাদেশ একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে পরিচালিত হচ্ছে। সব কলুষতা মুছে ফেলে সুন্দরের পথে যাত্রা শুরুর এখনই শ্রেষ্ঠ সময়। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। ভেজালকারীদের কোনো ছাড় নেই। জেনেশুনে ভেজালকারীদের সঙ্গে আত্মীয়তা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ঘৃণা ছড়িয়ে দিতে হবে সমাজের সর্বত্র। বর্তমান মুক্ত পরিবেশে দেশ হোক ভেজালমুক্ত। জাতি হোক কলঙ্কমুক্ত—এই আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত

জাতি ও শ্রেণির প্রশ্নে বিভক্ত সমাজ
- সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

জাতি ও শ্রেণির প্রশ্নে উপমহাদেশে এবং বাংলাদেশেও আমরা চার ধরনের চিন্তা ও দুশ্চিন্তার তৎপরতা দেখি। প্রথমটি জাতীয়তাবাদী, দ্বিতীয়টি উদারনৈতিক, তৃতীয়টি ধর্মীয় মৌলবাদী এবং ৪ নম্বরটি সমাজতান্ত্রিক। এদের ভেতর বিরোধ আছে, কিন্তু স্বল্প সন্ধানেই ধরা পড়বে যে মস্ত মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও প্রথম তিনটি একই ধারার এবং চতুর্থটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকারের। জাতীয়তাবাদী, উদারনৈতিক ও ধর্মীয় মৌলবাদীরা একে অপরের থেকে দূরেই থাকে, মৌলবাদীরা তো অপর দুই পক্ষ থেকে খুবই দূরের, কিন্তু তবু অন্তর্গতভাবে তিন ধারাই এক ধারা এই অর্থে যে তিনটিই পুঁজিবাদে বিশ্বাসী।
জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন প্রকাশ ঘটে। তবে প্রধান প্রকাশ দুই রকমের—একটি আগ্রাসনের, অপরটি আত্মরক্ষার। ব্রিটিশ ভারতে ব্রিটিশের জাতীয়তাবাদ ছিল আগ্রাসনের, লক্ষ্য ছিল লুণ্ঠন; আর যে ভারতবর্ষীয়রা ব্রিটিশকে বিতাড়িত করে স্বাধীন হতে চাইছিল, তাদের জাতীয়তাবাদটি ছিল আত্মরক্ষার।
দেশীয় জাতীয়তাবাদীদের ভেতরে সশস্ত্র বিপ্লবীরা ছিল। বিপ্লবী তারা এই অর্থে যে অহিংস নয়, সশস্ত্র; নইলে অহিংস গান্ধীবাদীদের সঙ্গে তাদের মৌলিক কোনো বিরোধ নেই। কারণ গান্ধীবাদীদের মতো তারাও ব্যক্তিগত সম্পত্তির পবিত্রতায় আস্থা রাখত। গান্ধী নিজে বিলাসিতাকে ঘৃণা করতেন, বস্তিতে থাকতে তাঁর অসুবিধা হতো না, কিন্তু তাঁর কাঙ্ক্ষিত রামরাজ্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকবে না এমন অলক্ষুনে চিন্তাকে তিনি কখনো প্রশ্রয় দেননি। তিনি কংগ্রেসেরই নেতা। কংগ্রেসকে তিনি জনগণের কাছে নিয়ে গেছেন, কিন্তু জনগণের স্বার্থে নয়। কংগ্রেস ছিল বিত্তবানদের দল, তিনি তাদের স্বার্থই দেখতেন। শ্রমিক ও কৃষকরা রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হোক, এটিও তাঁর কাম্য ছিল না। সমাজতন্ত্রীরা তখনো প্রবল হননি, কিন্তু ওই উঠতি সমাজতন্ত্রীরাও তাঁকে প্রীত করেনি, বিরক্তই করেছে। ওদিকে সহিংস বিপ্লবীরাও সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন চায়নি, তারা সনাতন ধর্মের পুনরুজ্জীবনে বিশ্বাস করত। এই বিপ্লবীদের অনেকেই আন্দামানে নির্বাসিত হয়েছিল। ১৯৩৭ সালে মুক্তি পেয়ে তাদের কেউ কেউ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিল। তাদের কথা আলাদা। বলা যায়, তারা একটি সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিল, যে কাজটি অন্যরা করতে পারেনি।
জওয়াহেরলাল নেহরু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে একসময় তিনি প্রায় কমিউনিস্টই হয়ে যাচ্ছিলেন, হতে পারলেন না। কারণ টের পেয়ে গেলেন যে কমিউনিস্টরা যথেষ্ট ভারতীয় নয়। দেখা যাচ্ছে, জাতীয়তাবাদ কতটা প্রভাব ফেলেছিল তাঁর ওপর; আর ওই জাতীয়তাবাদের কারণেই তিনি বাপুজির সঙ্গেই রয়ে গেলেন, যে বাপুজি আবার তাঁর নিজের পাশে রাখতেন বড় শিল্পপতি ঘনশ্যামদাস বিড়লাকেও। কমিউনিস্টদের শ্রেণিসংগ্রাম বাপুজির অনুসারী নেহরুর পছন্দ হওয়ার কথা নয়। নেহরু বছরের পর বছর কারাযন্ত্রণা ভোগ করতে পেরেছেন, তাই বলে শ্রেণিচ্যুত হয়ে যাবেন এবং সামাজিক বিপ্লবের পক্ষে লড়বেন—এমনটি তাঁর পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। তাঁর রাজনীতি বুর্জোয়া গণতন্ত্রীরই। তাঁর শাসনামলে কমিউনিস্টরা যে সুবিধায় ছিল তা নয়, খুব অসুবিধায়ই ছিল।
স্বাধীনতার প্রশ্নে নেহরুর তুলনায় সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন অনেক বেশি অনমনীয়। গান্ধীর নেতৃত্বকে আপসকামী মনে করে সেটিকে পরিত্যাগ করে তিনি চলে গিয়েছিলেন সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ আধিপত্যের অবসান ঘটানোর পথে। সুভাষ বসু সমাজতন্ত্রের কথা ভাবতেন এবং ভারতবর্ষের সমস্যার পথ যে সমাজতান্ত্রিক, সেটিও মানতেন। কিন্তু তিনিও জাতীয়তাবাদীই ছিলেন; নেহরুর চেয়ে কম নয়, বরং বেশিই। তাই দেখি তিনি কংগ্রেস ছেড়ে ফরওয়ার্ড ব্লক গড়ছেন ঠিকই, কিন্তু ফরওয়ার্ড ব্লক কংগ্রেসের ভেতরই থেকে যাচ্ছে। গান্ধীকে ‘জাতির পিতা’ উপাধি তাঁরই দেওয়া। সে জন্য এটি অস্বাভাবিক ছিল না যে সমাজতন্ত্রকে তিনি ভারতবর্ষীয় রূপ দিতে চাইবেন। তাঁর মতে, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ‘সমাজতান্ত্রিক’ পথটিই ছিল সঠিক, মার্ক্স-এঙ্গেলসের পথের তুলনায়। অর্থাত্ সমাজতন্ত্র থাকবে আবার ব্যক্তিমালিকানারও অবসান ঘটবে না। মালিকের সঙ্গে শ্রমিকের যে বিরোধ অনিবার্য ছিল, সেখানে তাঁর প্রবণতা মালিকের দিকেই ঝোঁকার। ঝুঁকেছেন যে তার দৃষ্টান্তও রয়েছে।
এটির উল্লেখ আছে মণি সিংহের আত্মজীবনীতে। ১৯২৮ সালের কথা। মণি সিংহ তখনো কমিউনিস্ট হননি, তবে শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। কলকাতার উপকণ্ঠে মেটিয়াবুরুজে বিড়লাদের পাটকলে শ্রমিকরা ধর্মঘট করেছে। পুলিশ ও মালিকের পোষা বাহিনীর যৌথ আক্রমণে শ্রমিকরা বিধ্বস্ত। এরই মধ্যে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের এক সভা ডেকেছে; বিড়লারা যে মহত্, তাঁরা যে শ্রমিকের মা-বাবা এসব কথা বলার জন্য। মণি সিংহ তখন যুবক, বয়স ২৮; তিনি ধর্মঘটি শ্রমিকদের সঙ্গে ছিলেন। শোনা গেল মালিকপক্ষের সভায় সুভাষ বসু আসবেন, ধর্মঘটের বিরুদ্ধে বলার জন্য। শুনে মণি সিংহ ঘাবড়ে গেছেন। শ্রমিকরা তাঁকে সাহস দিয়েছে, বলেছে আপনাকে কিছু করতে হবে না, সুভাষ বসুর বক্তব্যের পর দাঁড়িয়ে শ্রমিকদের মত কী, তা জানতে চাইবেন। সুভাষ বসু ঠিকই এসেছিলেন। ধর্মঘট তুলে নেওয়ার পক্ষেই বলেছেন তিনি। শ্রমিকরা শুনেছে। শুনে চুপ হয়ে গেছে। শ্রমিক নেতারা চায়ের দোকান থেকে একটি টুল নিয়ে এসেছিল। মণি সিংহ সেটির ওপর দাঁড়িয়ে তাঁর জীবনে প্রথম এবং সংক্ষিপ্ততম বক্তব্যটি দিয়েছিলেন। ধর্মঘটের পক্ষে শ্রমিকদের শিখিয়ে দেওয়া কথা কয়টিই শুধু বলেছিলেন। এতেই কাজ হয়েছে। স্তব্ধতা ভেঙে শ্রমিকরা চিৎকার করে বলে উঠেছে, ‘হরতাল চালু রহেগা।’ সভা পণ্ড হয়ে গেছে। হরতাল চালু থেকেছে। বিড়লারা সমঝোতায় এসেছেন।
সুভাষ বসু পুরোপুরি বাঙালি ছিলেন। রাজনীতিতে তাঁর প্রবেশ চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে। চিত্তরঞ্জনের চেষ্টা ছিল বাংলার রাজনীতিকে ভারতীয় রাজনীতি থেকে পৃথক রাখার; চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু অকালমৃত্যুর দরুন কাজটা খুব একটা এগোতে পারেনি। বাংলার রাজনীতি যদি ভারতের রাজনীতি থেকে আলাদা থাকতে পারত, তাহলে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের জন্য অবশ্যই সুবিধা হতো এবং কংগ্রেস যে এক জাতিতত্ত্বের সাম্প্রদায়িকতাকে পুষ্ট করার কাজটা করছিল, সে কাজে কিছুটা হলেও বিঘ্ন ঘটত। সুভাষ বসুর বাঙালিত্ব কিন্তু বাংলার রাজনীতিকে সর্বভারতীয় রাজনীতির আওতামুক্ত করার কাজে উৎসাহের সঞ্চার করতে পারেনি, তিনি রয়ে গেছেন ভারতীয় রাজনীতিতেই। ১৯৪৬-৪৭-এ তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শরত্চন্দ্র বসু সর্বভারতীয় ওই রাজনীতি যে বাংলাকে খণ্ডিত করতে তৎপর হয়ে উঠেছিল, সেটা চোখের সামনে দেখতে পেয়েছেন। বাংলার অখণ্ডতা রক্ষার জন্য তিনি আবুল হাশিম ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে যুক্ত উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কাজটায় সুভাষ বসু সময়মতো যদি হাত দিতেন, তবে সেটা উপমহাদেশের জন্য মঙ্গলজনক হতো বলেই আমাদের ধারণা।
পরাধীন ভারতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা যে জাতীয়তাবাদী রূপ নেবে, সেটা ছিল অনিবার্য; তবে জনগণের মুক্তির আন্দোলন শক্তিশালী হতো, যদি তাতে সমাজতান্ত্রিক উপাদান কার্যকর থাকত। কিন্তু জাতীয়তাবাদী সংগ্রামটা সংগঠিতরূপে শুরুই হয়েছিল সমাজ বিপ্লবের সম্ভাবনাকে ঠেকানোর জন্য। ওই সূচনাটা ঘটে ১৮৮৫ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে। উদ্যোগটা এসেছিল একজন ব্রিটিশ আইসিএস অফিসারের দিক থেকে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন উঠতি ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিনিধিরা। ব্রিটিশ শাসকরা খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিল, ১৮৫৭ সালের সিপাহি অভ্যুত্থান দেখে। তাদের দুশ্চিন্তা ছিল যে পরবর্তী কোনো অভ্যুত্থানে সাধারণ মানুষের সঙ্গে যদি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যুক্ত হয়ে যায়, তবে ফরাসি বিপ্লবের মতো ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবে। মধ্যবিত্তকে তারা তাই কাছে টেনে নিতে চেয়েছে, মধ্যবিত্তের জন্য সুযোগ করে দিতে চেয়েছে অভাব-অভিযোগের দরখাস্ত নিয়ে হাজির হতে। বলা বাহুল্য, শ্রেণিগত কারণেই এই মধ্যবিত্ত ওপরের দিকে উঠতে চেয়েছে, তারা ভীষণ ভয় পেয়েছে নিচের দিকে নামতে। তারা ইংরেজকে ভয় করত, কিন্তু আতঙ্কিত হতো সমাজ বিপ্লবের আশঙ্কায়। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সর্বভারতীয় জাতীয়তাকে প্রধান রাজনৈতিক সত্য করে তুলল। বলা বাহুল্য, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য প্রধান সমস্যাটা জাতিগত ছিল না, ছিল শ্রেণিগত; কৃষক শোষিত হচ্ছিল জমিদার ও মহাজনের হাতে, শ্রমিকদের শোষক ছিলেন পুঁজির মালিকরা, কিন্তু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি শ্রেণিবাস্তবতাকে আড়ালে ঠেলে দিয়ে জাতীয় ঐক্যকে প্রধান করে তোলে; ‘আমরা সবাই ভাই ভাই’ আওয়াজের নিচে চাপা পড়ে যায় ‘ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই’-এর নিষ্ঠুর বাস্তবতা।
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ প্রচার করল, বলল ঐক্যের কথা, কিন্তু সে ঐক্যের ভেতরে চাপা রইল না সাম্প্রদায়িকতা এবং ক্রমান্বয়ে ঐক্যের ভৌগোলিক দিকটাকে ছাপিয়ে উঠল ধর্মের দিকটা। সে ধর্ম সনাতন ধর্ম। রণধ্বনি উঠল ‘বন্দেমাতরমে’র, যার ফলে ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবারে’র পাল্টা আওয়াজ ওঠার পটভূমিটা তৈরি হয়ে গেল। যে শাসকরা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস গঠনে উৎসাহ জুগিয়েছিল, তারাই আবার উৎসাহ দিল অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ গঠনের। চেষ্টা শুরু হলো সম্প্রদায়কে জাতিতে পরিণত করার। শুরুতে ভোট ছিল শতকরা মাত্র দুজনের; তারই মধ্যে বিভাজন দাঁড় করানো হলো হিন্দু-মুসলমানের পৃথক নির্বাচনের। পরিণামে কী ঘটেছে, সেটা তো আমরা জানি। সমাজতন্ত্রীরা সংগঠিত হচ্ছিল, তাদের আওয়াজ ছিল ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’। হিন্দু-মুসলমানকে তারা নিয়ে আসতে চেয়েছে বিপ্লবের পক্ষে, কিন্তু তাদের আওয়াজটা জোরদার হয়নি। কারণ ছিল। প্রধান কারণ জাতীয়তাবাদীদের গলার জোর। তারা বিত্তবান, নেতারা উচ্চশিক্ষিত, সংবাদপত্র তাদের পক্ষে। ব্রিটিশ শাসকরাও তাদের উৎসাহ দিয়েছে। উঠতি জাতীয়তাবাদীরা ব্রিটিশকে ভয় পায়, কিন্তু আরো বড় ভয় তাদের কৃষককে, কারণ জমিদারি ব্যবস্থার সুবিধাগুলো তারা ভোগ করে। তারাই আবার পেশাজীবী, ব্যবসা-বাণিজ্যও তারাই করে। এর মধ্যে কৃষক যদি খেপে ওঠে, তাহলে তো সর্বনাশ। সে জন্য শ্রেণি হিসেবে সমাজ বিপ্লবের অনুমোদন তারা তো দেয়ইনি, উল্টো যতভাবে পারা যায় ওই ধরনের বিপ্লবের বিরোধিতা করেছে। অন্য ব্যাপারে প্রবল শত্রুতা থাকলেও বিপ্লববিরোধিতার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ স্বার্থ আর ভারতীয় বিত্তবানদের স্বার্থ এক হয়ে গেছে; যেন বড় ভাই ছোট ভাইয়ের মিলন, অভিন্ন এক শত্রুর বিরুদ্ধে।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়