ঢাকা, সোমবার ০৭ এপ্রিল ২০২৫
২৪ চৈত্র ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৬

ঢাকা, সোমবার ০৭ এপ্রিল ২০২৫
২৪ চৈত্র ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৬
মত ও মন্তব্য

দেশ ও বিদেশে বঙ্গবন্ধুচর্চা

  • হারুন হাবীব
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
দেশ ও বিদেশে বঙ্গবন্ধুচর্চা

অতি সম্প্রতি ভারতের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ প্রতিষ্ঠার খবরটি  গণমাধ্যমে যথাযোগ্য গুরুত্বে প্রচারিত হয়েছে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ও ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব কালচারাল রিলেশনস’ কর্তৃপক্ষ, যারা উদ্যোগটি নিয়েছিল  তারা জানিয়েছে, চেয়ারটি প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রক্তার্জিত স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি ও বাংলাদেশের জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে।

ব্রিটিশ ভারতে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার একটা ঐতিহাসিক পটভূমি আছে। ১৯১১ সালের ১২  ফেব্রুয়ারি  ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জ এক রাজকীয়  দরবারে কলকাতা থেকে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।

কিন্তু সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়িত হয়  আরো ২০ বছর পর লর্ড আরউইনের হাতে ১৯৩১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি। ১৯৩০-এর  দশকে এসে সিদ্ধান্তটি ত্বরান্বিত হয় স্বদেশি আন্দোলনের তীব্রতায় এবং বিশেষত বঙ্গভঙ্গ রোধ আন্দোলনে বাঙালি জনগোষ্ঠীর সক্ষমতায়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা কলকাতা ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে নানা কারণে। প্রধানতম কারণ যে বাংলার মহানগরী কলকাতা তাদের জন্য ক্রমান্বয়েই অনিরাপদ হয়ে উঠেছিল।
অতএব সুবিশাল ভারতকে শাসন করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা অধিকতর নিরাপদ দিল্লি থেকে।   এই স্থানান্তরের পর থেকেই ব্রিটিশের নতুন রাজধানী হিসেবে গড়ে উঠতে থাকে দিল্লি। এর আগে এই  শহরে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠেনি। সুদীর্ঘ ঔপনিবেশিক আধিপত্যকালে এই শহরে প্রথমত ১৭৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দিল্লি কলেজ, যা জাকির হোসেন কলেজ নামে এখন পরিচিত।
এরপর ১৮৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সেন্ট স্টিফেন কলেজ, ১৮৯৯ সালে গড়ে ওঠে হিন্দু কলেজ এবং ১৯১৭ সালের রামজাস কলেজ। এরপর ১৯২২ সালে গড়ে ওঠে দিল্লি ইউনিভার্সিটি। সেই থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ, যেখান থেকে ভারতীয় রাজনীতি, বিজ্ঞান ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বহু শ্রেষ্ঠ মানুষের জন্ম ঘটেছে। পরবর্তী সময়ে স্বাধীন ভারতের প্রায় সব প্রান্তে বড় এবং বিশ্বখ্যাত বহু বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে, কিন্তু দিল্লি ইউনিভার্সিটি আজও তার ইতিহাস ও ঐতিহ্য  নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অতএব এমন একটি মর্যাদাশীল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রজনকের নামে একটি চেয়ার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে গুরুত্ব বহন করে।
 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক ও স্বপ্নদ্রষ্টা, যিনি পাকিস্তানের ২৩ বছরের সামরিক ও ধর্মতান্ত্রিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। তাঁরই নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গ বা সেদিনকার পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন চার দশকেরও বেশি সময় আগে, দেশের স্বাধীনতার প্রতিপক্ষদের  সম্মিলিত আগ্রাসনে।  ১৯৭৫-এর সেই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ঘাতকরা  সদ্যঃস্বাধীন বাংলাদেশের স্বাভাবিক যাত্রাপথ রুদ্ধ করতে চেয়েছিল। অনেকটা সফলও হয়েছিল তারা। যে জাতীয় চেতনা ও আদর্শের ভিত্তিতে এই যুগশ্রেষ্ঠ মহানায়কের নেতৃত্বে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক আধিপত্যবাদী অগণতান্ত্রিক অপশাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি গণমানুষ একটি জাতীয় গণবিপ্লব সম্পন্ন করেছিল, সেই আদর্শকেই প্রতিপক্ষরা ধ্বংস করতে চেয়েছিল। তারা বঙ্গবন্ধুকে বিস্মৃতিতে হারিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই দুই যুগের অমানিশার পর নতুন ভোরের আলো দেখা দিয়েছে, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ পুনর্জাগরিত হয়েছে। অতএব বাংলাদেশের ইতিহাস ও তার অন্তরাত্মার সঠিক পরিচর্চা ও সংরক্ষণে বঙ্গবন্ধুচর্চা একটি অতি জরুরি  কাজ। এটি কোনো হুজুগে রাজনৈতিক বিষয় নয়, কোনো শ্রেণি বা পেশার সাময়িক স্বার্থসিদ্ধির ব্যাপারও নয়, এটি এমন এক অতি প্রয়োজনীয় জাতীয় দায়িত্ব, যাকে সম্পাদন করতে হবে পরিপূর্ণ আবেগ ও  ইতিহাসের নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে।

বাংলাদেশের বেশ কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এরই মধ্যে এসব কাজে ব্রতী হয়েছে। তারা বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতির পিতার জীবনাদর্শ নিয়ে গবেষণায় আছে। এই উদ্যোগগুলো নিঃসন্দেহে প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় চেয়ার প্রতিষ্ঠা ছাড়াও পূর্ণ নতুন কোর্স ও ডিপার্টমেন্ট খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরই মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধুর নামে তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে একটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছে। আমি মনে করি এসব উদ্যোগ প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।

তবে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে এসব উদ্যোগের কতটা নিছক রাজনীতির হুজুগে বিবেচনায় বা কতটা সত্যিকারের বোধ থেকে উৎসারিত। দেশে সম্ভবত এখন ৩৭টি কিংবা আরো বেশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, আছে ৯৫টি ব্যক্তিমালিকানার বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু কয়েকটি মাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বাদে অন্য কোথাও বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৯৯ সালে। ২০১৬ সালে ‘বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস’ বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রতিষ্ঠা করে। এরপর কুষ্টিয়ার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তারও পরে চেয়ারটি প্রতিষ্ঠা পায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক অনুষদে। খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং ও প্রযুুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও চেয়ারটি স্থাপন করা হয়েছে জানতে পেরেছি। এসব উদ্যোগের পেছনের মূল উদ্দেশ্য মহান এই নেতার জীবন ও কর্ম, তাঁর রাজনীতি ও আদর্শ এবং বাংলাদেশের ইতিহাস বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা কর্মসূচি গ্রহণ করা। তবে কতটা সফলভাবে এসব উদ্যোগ  প্রয়োজনীয় গবেষণায়  রত হতে পেরেছে এবং যদি না পেরে থাকে তাহলে সীমাবদ্ধতাগুলো কী, সেগুলোও মূল্যায়নের দাবি রাখে বৈকি।

জাতির পিতার নামে এমন কোনো চেয়ার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণার বিষয়টি নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। যত দূর জানি, এসব পদে যাঁরাই নিয়োগ পাবেন তাঁদের মূল কাজ হবে গবেষণা এবং নির্মোহ ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে নানা যোগ্য কর্মসূচি নিয়ে চেয়ারটির মর্যাদা রক্ষা করা। এসব কাজ অবশ্যই দৃশ্যমান হতে হবে, অন্যথায় এই চেয়ার প্রতিষ্ঠা অর্থহীন হবে। বলা বাহুল্য, দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগ এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন মহলে বিশেষ আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। কারণ বঙ্গবন্ধু চেয়ারের প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়েছে মূলত কয়েকটি বিষয়কে মাথায় রেখে। সেখানে রয়েছে যেমন বঙ্গবন্ধুর  স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতা-উত্তর রাজনৈতিক জীবন, তেমনি আছে সদ্যঃস্বাধীন দেশের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো নির্মাণে তাঁর অবদানের চুলচেরা বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা। আমার বিশ্বাস, জাতীয়  ইতিহাসের এসব মৌলিক দিকগুলোর ওপর বিস্তারিত ও বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা হওয়া উচিত। কারণ এসবের মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধু নতুন প্রজন্মের মানুষের কাছে স্বমহিমায় প্রস্ফুটিত হবেন।

শুধু দেশের মাটিতে নয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিদেশের মাটিতেও বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে থাইল্যান্ডে অবস্থিত এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, যা একটি আন্তর্জাতিক মর্যাদাশীল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এই চেয়ারে যাঁরা বসবেন তাঁরা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিজ্ঞান  ও প্রযুক্তির বিষয়ে উচ্চতর গবেষণায় রত হবেন, যেন তা বিশ্বে শান্তি ও সৌহার্দ স্থাপনে ভূমিকা রাখে। যত দূর জানি, এআইটিতে ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার ফেলো’ বৃত্তিও দেওয়া হচ্ছে, যা গবেষণারত ছাত্র-ছাত্রীদের সহায়তা করে। কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান অধ্যাপক জয়শ্রী রায় এই চেয়ারের প্রথম ব্যক্তি। আইইটির চেয়ারটির পত্তন করা হয়েছে মুখ্যত বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের ওপর গবেষণা এবং একই সঙ্গে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, উচ্চশিক্ষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং সেই সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং ও প্রযুুক্তি ক্ষেত্রে উচ্চতর গবেষণার লক্ষ্যে।

অন্যদিকে ব্রাজিলের মর্যাদাপূর্ণ ‘দি ইউনিভার্সিটি অব ব্রাজিল’ তার ‘সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’ ডিপার্টমেন্টে বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রতিষ্ঠা করেছে। দৃশ্যতই এই উদ্যোগ লাতিন আমেরিকার সমাজে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। খ্যাতিমান বিশ্ববিদ্যালয়টি একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পর্তুগিজ ভাষায় অনুবাদেরও উদ্যোগ নিয়েছে।

ভারত বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বপ্রধান মিত্র দেশ। অন্যদিকে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্তঘেরা ভারত, যার সঙ্গে গণমানুষের ঐতিহাসিক মেলবন্ধন আছে। অতএব ভারতের মাটিতে কোনো সুপ্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রতিষ্ঠা পায়, তখন তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবে, সেটিই প্রার্থিত। স্বভাবতই আশা করতে পারি যে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ারটি একদিকে যেমন ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে, অন্যদিকে আঞ্চলিক শান্তি ও সৌহার্দ স্থাপনে এর তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা থাকবে। জেনেছি, চলতি বছরে  ঢাকা সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠকে চেয়ারটি স্থাপনের সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে। উদ্যোগটি দুই দেশের সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখুক, একই সঙ্গে জ্ঞানবিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্পকলার বিকাশ ও লেনদেনে ভূমিকা রাখুক—এই আমাদের  প্রত্যাশা।  দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক পি সি যোশী বলেছেন, ভারতের মাটিতে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রতিষ্ঠার উপলক্ষটি নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক, কারণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মুক্ত জীবনের প্রতীক। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নৃতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এই চেয়ার অলংকৃত করবেন এবং এতে বাংলাদেশসহ দেশ-বিদেশের শিক্ষার্থীদের পড়ার সুযোগ উন্মুক্ত হবে। আমার বিশ্বাস, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার পরিবর্তিত সময়ের বাস্তবতায় দুই দেশের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে, যদি উপযুক্ত কর্মপরিকল্পনায় অগ্রসর হওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে জেনেছি, এই  চেয়ারের আওতায় নৃতত্ত্ব, ভূগোল, ইতিহাস, বাংলাসহ আধুনিক ভাষাগুলো, সংগীত, শিল্পকলা, আন্তর্জাতিক সম্পর্কসহ সমাজবিজ্ঞান নিয়ে উচ্চতর গবেষণা হবে। আশা রাখি ভারতের মাটিতে এই বঙ্গবন্ধু চেয়ার এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পাদন করতে সফল হবে। কারণ বাংলাদেশের হলেও বঙ্গবন্ধু এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর জীবন-সংগ্রাম ও আদর্শ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উন্নয়নে তাৎপর্যবহ।

শুধু ভাষা ও সাংস্কৃতিক নৈকট্য নয়, শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কর্ম একই সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জন্যও বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। তিনি শুধু ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে  ইসলামিয়া কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন লাভ করেননি, একই সঙ্গে বিভাগপূর্ব কালের জনজীবনের দ্বন্দ্ব, তিক্ততা ও নানা অভিজ্ঞতা তাঁকে এমনভাবে সমৃদ্ধ  করেছিল যে তিনি তাঁর সময়ে মানুষে মানুষে সৌহার্দ ও  শান্তি স্থাপনের অগ্রদূত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সে কারণে ঐতিহ্যবাহী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রতিষ্ঠিত হলে তা দুই দেশের গণমানুষের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আমার বিশ্বাস। বঙ্গবন্ধু শুধু সফল প্রবাদতুল্য রাজনীতিবিদ ছিলেন না, ছিলেন একই সঙ্গে প্রবল অসাম্প্রদায়িক ও সাহসী সমাজসংস্কারকও, যিনি সব কূপমণ্ডূকতার বাইরে দাঁড়িয়ে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে মানুষকে সত্যের পথে সাহসী করে তুলেছিলেন। কাজেই তাঁর মানবতাবাদী নীতি ও আদর্শ শুধু আজকের জন্য নয়, অনাগত দিনের সমাজ নির্মাণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

লেখক : গবেষক ও সমাজচিন্তক 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের বরপুত্র পিটার হিগস

ড. কানন পুরকায়স্থ
ড. কানন পুরকায়স্থ
শেয়ার
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের বরপুত্র পিটার হিগস

তাত্ত্বিক কণা পদার্থবিজ্ঞানী ও নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক পিটার হিগস ৮ এপ্রিল ২০২৪ সালে ৯৪ বছর বয়সে এডিনবরায় তাঁর নিজ বাসভবনে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজ তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি প্রায় ছয় দশক এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও শিক্ষকতা করেন। হিগস গাণিতিকভাবে দেখান, কোনো কণা একটি নতুন ধরনের ক্ষেত্রের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে ভর অর্জন করে।

এই ক্ষেত্রই হিগস ক্ষেত্র এবং কণার নাম হিগস বোসন। ২০১২ সালে সার্নে হিগস বোসন আবিষ্কৃত হয়। ফলে ২০১৩ সালে পিটার হিগস ও ফ্রাঁসো ইংলার্ট পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান।      

এই আবিষ্কারের পেছনের ইতিহাস একটু জানা যাক।

ছাত্রাবস্থায় হিগস বিজ্ঞান ও দর্শনের নানা বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। ১৯৫০ সালের মে মাসের কোনো এক বিকেল। লন্ডনের কিংস কলেজে ম্যাক্সওয়েল সোসাইটি আয়োজন করেছে এক বিজ্ঞান সভা। সোসাইটির সেই সময়ের নবীন সভাপতি ২০ বছরের যুবক পিটার হিগস।
সভায় হিগস প্রশ্ন তুললেন, একজন বিজ্ঞানী কি প্রকৃতির সূত্রকে সত্যিকার অর্থে জানতে পারেন?

বিজ্ঞান হচ্ছে বাস্তবতার সূত্র অনুসন্ধান করার একটি পদ্ধতি এবং এই অনুসন্ধানের জন্য বিজ্ঞানী পরীক্ষণপদ্ধতি ব্যবহার করেন। কিন্তু হিগসের প্রশ্ন, একজন বিজ্ঞানী কিভাবে নিশ্চিত হন যে তিনি যা পর্যবেক্ষণ করছেন, তা-ই সত্য। আমরা কি নিশ্চিত যে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো এই বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের সঠিক ধারণা দেয়? যদি আমরা বিশ্বাস করি যে হ্যাঁ, সঠিক কাজ করছে, তবে হিগসের মতে এটি বিশ্বাসের বিষয়, যুক্তির বিষয় নয়। হিগস বস্তুত বলতে চেয়েছেন যেহেতু বিষয়টি বিশ্বাসের, সেহেতু এটি বিজ্ঞান নয়। প্রকৃতির স্বভাব নিরূপণ করতে গিয়ে আমরা যে বাস্তবতাকে দেখি, তা কল্পনাপ্রসূত হতে পারে।

হিগসের এই যুক্তি সেদিনের সভায় বিতর্কের ঝড় তুলেছিল।

হিগসের এই জিজ্ঞাসা দার্শনিকদের কাছে নতুন কোনো বিষয় নয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে দার্শনিক রেঁনে দেকার্ত দর্শনের দুটি সমস্যা নিয়ে কাজ করেন। একটি হলো—আমরা কী জানতে পারি? এবং অন্যটি হলো—আমরা কিভাবে তা জানতে পারি? দেকার্ত তাঁর যুক্তি বিনির্মাণে কল্পনার সাহায্য নিয়েছিলেন এভাবে যে এক দৈত্য তাঁকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে। যদি তা-ই হয়, তাহলে কি জানা যাবে দৈত্য যা বলছে, তা প্রকৃত সত্য কি না। দেকার্ত চিন্তা করলেন দৈত্য কোন বিষয়টি তাকে বিশ্বাস করানোর মাধ্যমে বোকা বানাতে পারবে না। দেকার্ত তার উত্তর দিলেন এভাবে, ‘একটিমাত্র বিষয় আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে যদি আমি চিন্তা করি, তাহলেই আমার অস্তিত্ব আছে।’ দার্শনিক দেকার্তের ভাষায়, cogito ergo sum’   বা ইংরেজিতে বলা যায়,

I think, therefore I am.’  দেকার্ত এ কথা বলেই থেমে যাননি। তিনি সমস্যাটি অন্যভাবে দেখার চেষ্টা করেন। দেকার্ত উল্লেখ করেন, আমরা যদি কোনো সদাশয় ঈশ্বরের কাছ থেকে আমাদের ইন্দ্রিয় পেয়ে থাকি, তাহলে এই ইন্দ্রিয় দ্বারা আমরা যে বাস্তবতাকে প্রত্যক্ষ করব, তা সত্যি হবে। প্রশ্ন হলো, ঈশ্বর যদি সদাশয় না হন, যদি তিনি বোকা বানানোর চেষ্টা করেন, তাহলে আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তবতার পর্যবেক্ষণ সত্য না-ও হতে পারে। এভাবে পর্যবেক্ষণের উভয়সংকটের মধ্যে পিটার হিগস যেতে চাননি। তাই তিনি তাঁর অধ্যয়ন ও গবেষণার জন্য তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানকে বেছে নেন। 

তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের বরপুত্র পিটার হিগস১৯৬০ সালে হিগস এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যোগদান করেন। হিগস সেখানে একাডেমিক জার্নাল রক্ষণাবেক্ষণের অতিরিক্ত দায়িত্ব পান। ১৯৬১ সালের বসন্তকালে হিগস ফিজিক্যাল রিভিউ লেটারস জার্নালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত পদার্থবিদ ইওশিরো নামবুর  অতি পরিবাহী তত্ত্ব  (super conductivity)  দিয়ে মৌলিক কণার ভর পরিমাপ সংশ্লিষ্ট গবেষণাপত্র দেখতে পান। এই গবেষণাপত্রই হিগসের গবেষণার মূল বীজমন্ত্র। সাধারণ পরিবাহক; যেমন—তামার তার ও অতিপরিবাহকের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। অতিপরিবাহককে ১৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে ফেলে ঠাণ্ডা করলে তার বিদ্যুৎ রোধের ক্ষমতা লোপ পায়। এই ধর্মের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখেন যে অতি নিম্ন তাপমাত্রায় অতিপরিবাহক পদার্থের মধ্যে ইলেকট্রন কণা জোড়ায় অবস্থান করে। এই অবস্থায় অতিপরিবাহক পদার্থে কোনো ল্যাটিস  (lattice)  নেই বলে মনে হয়। এই অবস্থায় পদার্থ অধিফ্লুয়িডের (superfluid) মতো আচরণ করে। এই আচরণের কারণে শক্তির ক্ষয় না করে পদার্থ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে পারে। অতিপরিবাহকের মধ্যে রোধের ক্ষমতা লোপ পাওয়াকে পদার্থবিজ্ঞানীরা বলেন ভগ্ন প্রতিসাম্য। নামবু তাঁর গবেষণাপত্রে দেখান যে এই ভগ্ন প্রতিসাম্যই মহাবিশ্বে ভরশূন্য বস্তুকে ভর দান করে।

ইওশিরো নামবু তাঁর অতিপরিবাহী তত্ত্বের জন্য ২০০৮ সালে নোবেল পুরস্কার পান। হিগস অতি দ্রুত অনুধাবন করেন যে কণা পদার্থবিজ্ঞান এই ভগ্ন প্রতিসাম্যের ধারণাকে কাজে লাগিয়ে কোনো কণার ভরের কারণ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

১৯৬৪ সালে গ্রীষ্মকালে অবকাশযাপন শেষে ফিরে এসে তাঁর এক ছাত্র লক্ষ করে যে তাঁর ডেস্কে রয়েছে একটি নোট, যাতে লেখা রয়েছে ‘This summer I have discovered something that is totally useless.’  এর নিচে পিটার হিগসের স্বাক্ষর। ১৯৬৪ সালের জুলাই মাসে হিগস ফিজিকস লেটার জার্নালে ৭৯ লাইনের একটি গবেষণাপত্রে ভগ্ন প্রতিসাম্যের বিষয়টি গাণিতিকভাবে প্রমাণ করেন। এভাবেই তাত্ত্বিকভাবে হিগস বোসন ও হিগস ক্ষেত্রের (Higgs field) জন্ম হয়। এই বোসনের সঙ্গে ফার্মিয়ন কণার পার্থক্য হচ্ছে ঘূর্ণন মানের। যেমন—ইলেকট্রনের ঘূর্ণন মান ১/২, ফোটন কণার ঘূর্ণন মান  ১ এবং হিগস বোসন কণার ঘূর্ণন মান শূন্য।

এই গবেষণাপত্র প্রকাশের প্রায় অর্ধশতাব্দী পর ৪ জুলাই ২০১২ সালে সার্নের বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করেন যে তাঁরা পৃথিবীর শক্তিশালী ত্বরকযন্ত্র বৃহৎ হেড্রন কলাইডারে এক নতুন কণার সন্ধান পেয়েছেন, যার সঙ্গে পিটার হিগসের ‘ঁংবষবংং’ ধারণার মিল রয়েছে। সার্নের মহাপরিচালক রল্ফ ডিটার হিউয়ার ঘোষণা দেন যে ‘ we have now found the last missing cornerstone of the standard model.’  হিউয়ার আরো জানালেন যে হিগস বোসন কণার ভর ১২৫ বিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্টের কাছাকাছি, যা প্রোটনের ভরের প্রায় ১৩৩ গুণ। সার্ন দুটি পরীক্ষা দ্বারা হিগস কণাকে শনাক্ত করে। পরিসংখ্যানগত দিক থেকে তাঁদের প্রাপ্ত ফলাফল অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য। কয়েক বছর আগে রয়াল ইনস্টিটিউশনে প্রদত্ত বক্তৃতায় (যেখানে আমি উপস্থিত ছিলাম) হিগস বলেছিলেন যে সম্ভবত আমার জীবদ্দশায় এই কণার সন্ধান মিলবে না। কারণ এর জন্য প্রয়োজন অত্যন্ত শক্তিশালী ত্বরকযন্ত্র, যার অর্থায়নে রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাব রয়েছে।

কণা পদার্থবিজ্ঞানে হিগস বোসন আবিষ্কার অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এই কণার আবিষ্কার প্রমাণ করে হিগসের ক্ষেত্রের অস্তিত্ব। এই ক্ষেত্র ব্যাখ্যা করে ভগ্ন প্রতিসাম্যের কলাকৌশল, যা থেকে পাওয়া যায় কোনো কণার ভর। সার্নের সামনে দাঁড়িয়ে সার্নের একদল বিজ্ঞানীকে (আমাদের গাইড) প্রশ্ন করেছিলাম, ‘হিগস বোসন কি কণা, না ক্ষেত্র?’ উত্তরে হিগস বললেন, ‘হিগস ক্ষেত্রকে যখন ঝাঁকুনি দেওয়া হয়, তখন তা থেকে বেরিয়ে আসে হিগস বোসন কণা।’ পিটার হিগস আজ আর আমাদের মাঝে নেই,  কিন্তু তাঁর গাণিতিক ভাবনা কণা পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় বলিষ্ঠ অবদান রেখে চলেছে।

লেখক : অধ্যাপক এবং বিজ্ঞান ও পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা, যুক্তরাজ্য

 

মন্তব্য

আমেরিকার পারস্পরিক শুল্ক এবং বাংলাদেশ

    আব্দুল বায়েস
শেয়ার
আমেরিকার পারস্পরিক শুল্ক এবং বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় বসা মানে যেন পৃথিবীতে ভূমিকম্প অনুভূত হওয়া। এরই মধ্যে তাঁর কিছু পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী, এমনকি খোদ আমেরিকায়ও  নিন্দিত হয়েছে। তবে আমেরিকা ফার্স্ট প্রতিপাদ্যের প্রবর্তক ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। তাঁর আগ্রাসী মনোভাবের ইঙ্গিত আগেরবার প্রেসিডেন্ট থাকাকালে আঁচ করা গিয়েছিল।

বর্তমান সময়ে আগ্রাসী মনোভাব আরো বেগবান। সর্বশেষ যে বোমাটি তিনি ফাটালেন, তা হচ্ছে আমেরিকায় আমদানি পণ্যের ওপর শুল্কের হার বৃদ্ধি১০ থেকে ৪৮ শতাংশ। তাঁর এই পদক্ষেপ বর্তমান বিতর্কের বেদিতে অবস্থান গ্রহণ করেছে। প্রথম প্রতিক্রিয়া ডলারের জন্য দুঃসংবাদ।
বিভিন্ন দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক পরিকল্পনা ঘোষণা দেওয়ার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বিশ্ববাজারে বেড়েছে সোনার দাম। রয়টার্স জানাচ্ছে, প্রতি আউন্স (২৮.৩৫ গ্রাম) সোনার দাম পৌঁছেছে তিন হাজার ১২৯.৪৬ ডলারে (বাংলাদেশি মুদ্রায় তিন লাখ ৭৬ হাজার ৮৯৯.৩৩ টাকা), যা আগের চেয়ে ০.৬ শতাংশ বেশি। যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সোনা ব্যবসায়ী তাই উওং রয়টার্সকে এ প্রসঙ্গে বলেন, নতুন এই শুল্ক পরিকাল্পনা আমাদের প্রত্যাশার চেয়েও বেশি আগ্রাসী। এই পরিকল্পনা কার্যকর করা হলে ভবিষ্যতে একদিকে বাজারে সোনার বিক্রি বাড়বে, অন্যদিকে ডলারের মান কমবে।

দুই

আন্তর্জাতিক পণ্য প্রবাহে কোনো একটি দেশ কর্তৃক শুল্ক আরোপ (আমদানি কর) কিভাবে আরোপকারী দেশের অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলে, তা অর্থশাস্ত্রে সুন্দরভাবে বিধৃত আছে। প্রথমত, শুল্ক বসালে বা বৃদ্ধি করলে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পায়। বস্তুত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে বাংলাদেশসহ অনেক দেশ শুল্কপ্রাচীর সৃষ্টি করে। অন্যভাবেও রাজস্ব আদায় করা যায়, তবে তা রাজনৈতিক লাভালাভে সুবিধাজনক নয় বলে এই ব্যবস্থা। দ্বিতীয়ত, শুল্কের ফলে দেশীয় শিল্প সুরক্ষা পায়।

কারণ বিদেশি পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা যায়। তার মানে, অভ্যন্তরীণ শিশু শিল্প সুরক্ষায় বড় হয় এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। তৃতীয়ত, শুল্ক আরোপ বা বৃদ্ধির ফলে ভোক্তার উদ্বৃত্ত (যে দামে কিনতে আশা করে এবং যে দাম দিতে হয় তাদের পার্থক্য) হ্রাস পায়। অন্যদিকে দেশীয় সরবরাহকারীর উদ্বৃত্ত বৃদ্ধি পায় (যে দামে বিক্রি করতে আগ্রহী তার চেয়ে বেশি দামে বিক্রি)। শুল্ক আরোপের পেছনে আরো অনেক কারণ থাকে, তবে মুক্ত বাণিজ্য বা অবাধ বাণিজ্য হলে বাণিজ্যে নিয়োজিত দুই দেশের কল্যাণ অনেক বৃদ্ধি পায় বলে বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদ মনে করে থাকেন। থাক সে কথা।

তিন

তবে ট্রাম্প বলছেন, যেসব দেশের ওপর তিনি শুল্ক বাড়িয়ে দিলেন, সেসব দেশ আমেরিকায় উৎপাদিত পণ্য যত কেনে, তার চেয়ে তারা আমেরিকায় তাদের পণ্য বেশি বিক্রি করে অর্থাৎ আমেরিকার সঙ্গে এই প্রতিটি দেশ বাণিজ্য উদ্বৃত্ত উপভোগ করছে। দেশগুলো আমেরিকার পণ্যের ওপর অনেক বেশি হারে শুল্ক আরোপ করে ওই সব দেশে আমেরিকার পণ্যপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে। অথচ আমেরিকার শুল্কের হার কম বিধায় অবাধে তাদের পণ্য আমেরিকায় ঢুকে আমেরিকার জন্য বাণিজ্য ঘাটতি সৃষ্টি করছে। এবং তা বছরের পর বছর, এমনকি যুগের পর যুগ। কাঁহাতক এই বৈষম্য! সুতরাং দেখিয়া শুনিয়া খেপিয়া গিয়া প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুল্ক-বোমাটি ফাটালেন এবং বলতে হয় হাটে হাঁড়িও ভাঙলেন।

চার

বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছেন। আগে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে শুল্ক ছিল ১৫ শতাংশ, এর বিপরীতে বুধবার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছেন। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল আনুমানিক ১০.৬ বিলিয়ন ডলার। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২.২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে বাংলাদেশে আর বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি হয়েছে প্রায় সাড়ে আট বিলিয়ন ডলারের মতো। ধারণা করা যায়, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব পণ্য রপ্তানি হয়, তার মধ্যে রয়েছে কৃষিপণ্য (খাদ্যশস্য, বীজ, সয়াবিন, তুলা, গম ও ভুট্টা), যন্ত্রপাতি, লোহা ও ইস্পাত পণ্য। আর বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি পণ্যের মধ্যে আছে তৈরি পোশাক, জুতা, টেক্সটাইল সামগ্রী, কৃষিপণ্য ইত্যাদি।

আমেরিকার পারস্পরিক শুল্ক এবং বাংলাদেশতবে কেবল বাংলাদেশই আঘাতপ্রাপ্ত নয় নয়া শুল্ক ব্যবস্থায়। এ ছাড়া ট্রাম্প প্রশাসন নতুন শুল্ক পরিকল্পনায় এশিয়ার দেশগুলোর পণ্য আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্র সর্বনিম্ন ১০ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৪৮ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছে। যেমনচীন ৩৪ শতাংশ, ভিয়েতনাম ৪৬ শতাংশ, তাইওয়ান ৩২ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়া ৩২ শতাংশ, জাপান ২৪ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়া ২৫ শতাংশ, থাইল্যান্ড ৩৬ শতাংশ, মালয়েশিয়া ২৪ শতাংশ, কম্বোডিয়া ৪৯ শতাংশ, বাংলাদেশ ৩৭ শতাংশ, ভারত ২৬ শতাংশ, পাকিস্তান ২৯ শতাংশ, সিঙ্গাপুর ১০ শতাংশ, নেপাল ১০ শতাংশ, ফিলিপাইন ১৭ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ৪৪ শতাংশ, মায়ানমার ৪৪ শতাংশ, লাওস ৪৮ শতাংশ। মনে রাখা দরকার, আমেরিকার সঙ্গে উল্লেখিত দেশগুলোর বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বিদ্যমান।

জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম শুল্ক আরোপ করা হয়েছে ভারতের ওপর, যার পরিমাণ ২৬ শতাংশ। এ ছাড়া বাংলাদেশের চেয়ে পাকিস্তান ও তুরস্কের ওপর শুল্কের হার কম বলে মনে হয়। আর এই কম শুল্কের ফায়দা নিয়ে বাংলাদেশকে হটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাকের বাজার ধরতে চায় কম শুল্কের দেশগুলো। এর মধ্যে অন্যতম দেশ নাকি ভারতএমন অভিযোগ করছে অনেকে। তবে মনে রাখা দরকার যে ভারত, পাকিস্তান ও তুরস্কের ওপর আগেই শুল্কের হার অপেক্ষাকৃত বেশি ছিল বলে সম্ভবত এবার কম।

পাঁচ

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পাল্টা শুল্ক আরোপ করার প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিস্তর মূল্যায়ন প্রকাশিত হচ্ছে। কেউ বলছে ইতিবাচক দিকের কথা, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পাল্টাপাল্টি শুল্ককাঠামো বাণিজ্য অংশীদারদের মধ্যে একটি ন্যায্য প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরির লক্ষ্যে করা হয়েছে। এটি মাঝারি থেকে দীর্ঘমেয়াদি সুযোগ তৈরি করবে। বিশেষ করে ভারতীয় অর্থনীতিবিদ কেউ কেউ ভাবেন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় টেক্সটাইল ও পোশাক রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।

তবে পর্যবেক্ষণের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মার্কিন ভোক্তাদের প্রতিক্রিয়া। তাদের মনোভাব ও ভোগের আচরণ স্বল্পমেয়াদি রপ্তানিপ্রবণতা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সম্পূর্ণভাবে শুল্ক কার্যকর করা হলে খুচরা পর্যায়ে কিছু অস্থিরতা দেখা যেতে পারে, যা প্রত্যাশিত। প্রতিটি দেশ যেভাবে এর প্রতিশোধ নেবে এবং প্রতিক্রিয়া জানাবে, তা-ও বাণিজ্য গতিশীলতার পরবর্তী পর্যায়কে প্রভাবিত করবে বলে বলছেন কেউ কেউ।

এ ছাড়া পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মার্কিন ভোক্তারা এমনিতেই কিনবে কম; এর জেরে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে শুল্কের হিসাবে ফাঁকি আছে। যেমন একটি সূত্র বলছে, বাংলাদেশ থেকে কোনো একটি শার্ট আগে ১০ ডলার দিয়ে ক্রয় করত মার্কিন ক্রেতারা। সেটি ক্রয়মূল্য কম দেখিয়ে শুল্কের ভারসাম্য সমন্বয় করবে। অথবা আগের ১০ ডলারের শার্টে শুল্ক দুই ডলার আসত। বর্তমানে আসবে চার ডলার। আগের চেয়ে দুই ডলার বেশি। ফলে শার্টের দাম ১২ ডলার করে সমন্বয় করবে। এর কারণ শুল্ক আরোপ করা হয় বন্দরে আমদানির সময়ের ক্রয়মূল্যের ওপর, বাজারমূল্যের ওপর নয়। আরেকটি সুবিধা হলো, বাংলাদেশ মূলত মধ্যম ও কম দামের পণ্য রপ্তানি করে। এসব পণ্যের দাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ২০ থেকে ৬০ ডলারের মধ্যে। অন্যদিকে ভিয়েতনাম, চীন বা এমনকি ভারত এখন উচ্চমূল্যের পোশাক রপ্তানি করছে। ফলে তারা যতটা আক্রান্ত হবে, বাংলাদেশ ততটা হবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়।

ছয়

বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্পের এই পাল্টা শুল্ক বিশ্বকে বাণিজ্যযুদ্ধের দিকেও ঠেলে দিতে পারে। এই শুল্ক যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও মন্দা পরিস্থিতি তৈরি করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে একাধিক বিশেষজ্ঞ ও বাজার সমীক্ষা সংস্থা। এরই মধ্যে তার লক্ষণ দেখা গেছে। ট্রাম্প যখনই শুল্ক নিয়ে কিছু বলেছেন বা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন, তাত্ক্ষণিকভাবে মার্কিন শেয়ারবাজারে তার প্রভাব পড়ছে, সোনার দামের ওপর ঊর্ধ্বমুখী এবং ডলারের দামের ওপর নিম্নমুখী প্রভাবের কথা আগেই বলা হয়েছে।

তার পরও আমরা মনে করি, বাংলাদেশের উচিত হবে মার্কিন পণ্যের ওপর প্রচলিত শুল্কের হার ৭৪ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং আলোচনার বা দর-কষাকষির ক্ষেত্র তৈরি করা। এর ফলে বাংলাদেশি পণ্যে মার্কিন শুল্ক হবে ১৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাদের আমদানি এবং বাংলাদেশ থেকে সেখানে রপ্তানি যোগ-বিয়োগ এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার দিকে তাকালে দেখা যাবে, এই প্রক্রিয়ায় আমরা লাভবান হব। এমনটি মনে করছে অনেকেই।   

সাত

আমেরিকা ফার্স্ট বা জাতীয়তাবাদী স্লোগানের ওপর ভর করে পাল্টা শুল্ক বসানো আমেরিকাকে হয়তো স্বল্পকালীন স্বস্তি দেবে। এমনও হতে পারে যে অতি উৎসাহী ট্রাম্প সমর্থক তাঁকে গাধার পিঠে উল্টো বসিয়ে আনন্দ উপভোগ করবেন এবং পরবর্তী সময়ে হাসাহাসি হবে এ নিয়ে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তা আমেরিকা কিংবা বিশ্ব কারো জন্যই কল্যাণকর নয়। পৃথিবীর সব দেশের উচিত হবে তাদের শুল্কের কাঠামো যৌক্তিক করা। বাংলাদেশ যেসব পণ্য রপ্তানি করে, তা কম মূল্য সংযোজক এবং এর চাহিদা স্থিতিস্থাপকতাও অপেক্ষাকৃত কম। সুতরাং ২০ ডলারের শার্ট খুচরা বাজারে ২৩ ডলার হলে আমেরিকার নিম্নবিত্ত শ্রেণি পালাই পালাই বলবে তেমনটি নয়, আবার ভারত, চীন কিংবা ভিয়েতনাম মূলত উচ্চমূল্য সংযোজিত পণ্য (হাই ভ্যালু প্রডাক্ট) রপ্তানি করে বিধায় বাংলাদেশের বাজার হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা কম বলে মনে হয়। আখেরে নিজের দ্রব্য প্রতিযোগী করার বিকল্প নেই—‘সেই দিন নাইরে নাতি গাবুতগুবুত খাতি।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন ও ইউনূস-মোদি বৈঠক

    ড. সুজিত কুমার দত্ত
শেয়ার
ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন ও ইউনূস-মোদি বৈঠক

গত ৩ ও ৪ এপ্রিল ব্যাঙ্ককে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ বিমসটেক (বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন) শীর্ষ সম্মেলন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এই সম্মেলনে বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কার নেতারা অংশগ্রহণ করেন। বিশেষ করে সম্মেলনের পার্শ্বক্রমে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যকার বৈঠক আঞ্চলিক কূটনীতিতে নতুন সমীকরণ সৃষ্টি করেছে। সম্মেলনে সদস্য দেশগুলো বাণিজ্য ও পরিবহন সহযোগিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত প্রচেষ্টার ওপর জোর দেয়।

মায়ানমারে সংঘটিত ৭.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে তিন হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে এবং সম্মিলিতভাবে দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুতি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়।

ব্যাঙ্ককে অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে অনুষ্ঠিত আধাঘণ্টার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকটি আঞ্চলিক কূটনীতির প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই বৈঠকটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হলো, যখন ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বেশ টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকে দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক যোগাযোগ অনেকটাই সীমিত হয়ে পড়েছিল।

শুধু অভিনন্দনবার্তা, স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা এবং প্রধানমন্ত্রী মোদির পক্ষ থেকে ইউনূসকে ঈদের শুভেচ্ছা জানানো ছাড়া আর তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক তৎপরতা দেখা যায়নি। এই পরিস্থিতিতে ইউনূস-মোদি বৈঠকটি দুই দেশের মধ্যে পুনরায় কূটনৈতিক যোগাযোগের পথ খুলে দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের নৈশভোজেও ইউনূস ও মোদি পাশাপাশি বসেছিলেন এবং তাঁদের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ আলাপচারিতা হয়। এই ঘটনাও দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের বরফ গলানোর ইঙ্গিত দেয়।

এই পরিস্থিতিতে ইউনূস-মোদি বৈঠকটি নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে নতুন সমীকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বৈঠকের পর বাংলাদেশের প্রেস সচিবের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দুই সরকারপ্রধানের মধ্যে পারস্পারিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ। এ ছাড়া সীমান্ত হত্যা, তিস্তা নদীর পানিবণ্টনসহ অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় ইস্যু নিয়েও আলোচনা হয়েছে। প্রেস সচিবের মতে, বৈঠকটি অত্যন্ত গঠনমূলক ও ফলপ্রসূ ছিল এবং দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/04.April/06-04-2025/Sohan/kalerkantho-ed-2a.jpgইউনূস-মোদি বৈঠকের ফলাফল এবং এর প্রভাব আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর এই বৈঠকের প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বৈঠকে হাসিনার প্রত্যর্পণের বিষয়টি উত্থাপন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এই বিষয়টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অত্যন্ত সংবেদনশীল। সীমান্ত হত্যা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি দুই দেশের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। বৈঠকে এই বিষয়ে আলোচনা হওয়ায় সীমান্ত হত্যা বন্ধে এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নয়নে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে এই বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন দুই দেশের মধ্যে একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। বৈঠকে এই বিষয়ে আলোচনা হওয়ায় সমস্যা সমাধানে নতুন করে আলোচনার পথ খুলেছে। তবে এই বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সমাধান না হলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে।

বিমসটেক আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ ফোরাম। এই শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে ইউনূস-মোদি বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ায় এই ফোরামের গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিমসটেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ইউনূস-মোদি বৈঠকের ফলাফল এবং এর প্রভাব আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। এই বৈঠকের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে পুনরায় কূটনৈতিক যোগাযোগের পথ খুলেছে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন করে আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে এই আলোচনার ফলাফল নির্ভর করবে দুই দেশের সরকারপ্রধানদের সদিচ্ছার ওপর। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের স্বার্থে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।

বিমসটেক সদস্য দেশগুলো বাণিজ্য, পরিবহন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশের চেয়ারম্যানশিপে এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নে নতুন গতি আসবে বলে আশা করা যায়। তবে মায়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করাও জরুরি। ড. ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদির বৈঠক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। মায়ানমারের ভূমিকম্প ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে বিমসটেক সদস্য দেশগুলো উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার পথে এগিয়ে যেতে পারে।

 

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

datta.ir@cu.ac.bd

মন্তব্য

ড. ইউনূসের আরো স্থায়িত্বের প্রশ্নে কিছু কথা

    গাজীউল হাসান খান
শেয়ার
ড. ইউনূসের আরো স্থায়িত্বের প্রশ্নে কিছু কথা

আজকাল কোনো রাজনৈতিক কথা বলা কিংবা লেখার ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা সংকট দেখা দিয়েছে বলে মনে হয়। কোনো ব্যাপারে বক্তা কিংবা লেখকের নিজস্ব মতামত প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গেই একটি পক্ষ নির্ধারণের প্রবৃত্তি দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ বক্তা বা লেখক রাজনীতিগতভাবে কোন পক্ষের লোক, সেটি নির্ধারণের একটি প্রবণতা দেখা দিয়েছে। এটি আমাদের পারস্পরিক সমঝোতা কিংবা বৃহত্তরভাবে বোঝাপড়ার অভাবেও হতে পারে।

একই রাজনীতি কিংবা দর্শনে বিশ্বাস করলেও বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন জনের কিছুটা মতপার্থক্য দেখা দিতেই পারে। এটিই আমাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং অন্যদিকে গণতন্ত্রের একটি অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। নিজেদের মধ্যে বহুমত বিরাজ করলেও বৃহত্তর সমঝোতা কিংবা অবাধ মতবিনিময়ের কারণে অনেক বন্ধুর পথ অতিক্রম করেও হয়তো বা দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে একটি কমন প্ল্যাটফর্মে সমবেত হওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে। কিংবা বাংলাদেশের বর্তমান চলমান রাজনীতিতে এ ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা ব্যত্যয় দেখা দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দেড় দশক ধরে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম করে গেছে, তাদের মধ্যে বর্তমানে একটি সুস্পষ্ট মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এই মতবিরোধ দেশের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র মেরামত বা প্রয়োজনীয় সংস্কারকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খাচ্ছে। এর মূল লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচন। দুই দিন আগে হোক আর পরেই হোক, গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে দেশ পরিচালনার জন্য জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের কোনো বিকল্প পথ নেই।

সুতরাং সে জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে এসে যাতে সঠিকভাবে দেশ পরিচালনা করতে পারেন, সে লক্ষ্যেই রাষ্ট্র মেরামত বা প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলোর প্রশ্ন উঠে এসেছে। একাত্তরের পর থেকে, বিশেষ করে বিগত ১৮ বছরের আওয়ামী শাসনামলে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনকে যেভাবে কবর দেওয়া হয়েছে, তা সম্পূর্ণভাবে দূরীভূত করা। এই পর্বতপ্রমাণ কাজ একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সুসম্পন্ন হবেতার যেমন কোনো নিশ্চয়তা নেই, তেমনি তাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলিয়ে রাখতে হবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা থাকতে পারে না। রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক, বিচারিক কিংবা প্রশাসনিক ক্ষেত্রে যত সংস্কারই আনা হোক, তা একটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার (Trial and Error) মধ্যে চলতে থাকবে যতক্ষণ না সেসব সংস্কার জনগণের কাছে সন্তোষজনক বলে বিবেচিত হয়।

নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ক্ষমতায় এসে যদি সব কিছু অর্থাৎ গণবিরোধী সব আইনকানুন বদলে ফেলতে পারতেন, তাহলে বিগত বছরগুলোতে এ দেশে ফ্যাসিবাদী শাসন, দুর্নীতি এবং সম্পদ পাচারসহ একটি জাতি বিধ্বংসকারী অবস্থার সৃষ্টি হতো না।

আওয়ামী ফ্যাসিবাদ কিংবা দুঃশাসন এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। সরকার ও বিরোধী দলগুলোর পর্যায়ক্রমিক ব্যর্থতার কারণেই জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। সেই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে দেশের সর্বক্ষেত্রে যদি একটি সুস্পষ্ট পরিবর্তনের ধারা লক্ষ করা না যায়, তাহলে বিগত ৫৩ বছরে রাজনীতির নামে এ দেশে যা হয়েছে, ভবিষ্যতেও দেশ আবার সেখানেই ফিরে যেতে বাধ্য হবে। এ দেশের রাজনীতিতে দু-একজন রাজনীতিক ছাড়া আর বাদবাকি সবার যোগ্যতা, আদর্শ ও মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে সবাই অবগত রয়েছে। সে কারণেই দেশের রাজনীতিতে এবং রাজনীতিকদের মধ্যে একটি গুণগত পরিবর্তন আনা আবশ্যক। নতুবা জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের কোনো প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয় না। তবু শেষ পর্যন্ত দেশ রাজনীতিকরাই পরিচালনা করবেন। তাঁদের নেতৃত্বেই দেশ শাসিত হবে, পরিচালিত হবে এবং এগিয়ে যাবে। সে কারণেই যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমাদের বেশ কিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/04.April/06-04-2025/Sohan/kalerkantho-ed-2a.jpgঅর্থ-বিত্ত কিংবা সম্পদের মালিকরাই রাজনীতি করবেন, আর কেউ নয়সেটি আর চলতে দেওয়া যেতে পারে না। আজ যাঁরা দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে রয়েছেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তাঁদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং একটি বৃহত্তর সমঝোতার মাধ্যমে দেশের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য এগিয়ে যেতে হবে। মতবিরোধ, দ্বন্দ্ব কিংবা সংঘাত কোনো সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। সে জন্য বিভিন্ন সংকট নিরসনে এখনই বিভিন্ন দল ও নেতার মধ্যে ঘন ঘন অন্তর্দলীয় আলোচনা শুরু করতে হবে এবং গড়ে তুলতে হবে একটি সর্বদলীয় ঐক্য ও সমঝোতা। ফ্যাসিবাদ-পরবর্তী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি একটি ন্যূনতম ঐক্য, সমঝোতা ও সংহতি গড়ে না ওঠে, তাহলে বৈদেশিক শক্তি, যারা আমাদের পদানত করে শোষণ করতে চায়, তারা আবার অবাধে আমাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ইন্ধন জোগাতেই থাকবে। সে কারণেই দেশের অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার এবং ভবিষ্যৎ নির্বাচন নিয়ে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য ও সমঝোতা গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। তা না করে নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান চলমান বিভেদ ও অনৈক্যকে আরো ব্যাপক এবং আত্মঘাতী করে তুলবে। এ দেশে রাজনীতি করতে হলে সবাইকে নিয়েই করতে হবে। কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না। সুতরাং সে জাতি গঠনমূলক এবং জাতীয় স্বার্থের রাজনীতিতে সবাইকে একদলীয় রাজনীতির মনোভাব দূর করতে হবে।

ওপরে উল্লিখিত বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে স্বদেশ থেকে পাঁচ হাজার মাইল দূরে অবস্থানরত বিএনপি নেতা তারেক রহমান বহুদিন ধরে অনেক গঠনমূলক কথাবার্তা বলেছেন। অনেকে সেগুলোকে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখেছে আবার কেউ কেউ বিভিন্ন ব্যক্তিস্বার্থ বা নেতৃত্বের টোপ হিসেবেও উল্লেখ করেছে। কিন্তু এই বিষয়টিকে গঠনমূলকভাবে জাতীয় স্বার্থের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করাই অত্যন্ত সমীচীন হবে বলে আমি মনে করি। আমি একজন সাংবাদিক, লেখক ও কলামিস্ট। সুতরাং এ ক্ষেত্রে আমি আমার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়ে একটি কথাই বলতে চাইসব দল একসঙ্গে ক্ষমতায় যায় না। তবে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে দেশের ছোট-বড় সব দল একসঙ্গে কাজ করতে পারে। তাহলেই রাজনীতির ক্ষেত্রে সাফল্য আসে। দেশ ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যায়। ফিরে আসি তারেক রহমানের সাম্প্রতিক বক্তব্যে। তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে বলেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তিনি একটি সর্বদলীয় সরকার (নির্দিষ্ট সময়ের জন্য) গঠন করতে চান, যাতে শুরুতেই জাতীয় ঐক্য ও স্বার্থ বিনষ্ট না হয়। উপরন্তু আগামী নির্বাচনে তারেক রহমান নবগঠিত নাগরিক পার্টির সঙ্গে একটি জোট গঠনেরও বাসনা প্রকাশ করেছেন।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনেক রাজনৈতিক প্রস্তাব আসা শুরু হয়েছে। এতে বিরোধিতা থাকবে না এমন নয়। জাতীয় স্বার্থে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ কিংবা কর্মসূচির গঠনমূলক সমালোচনা থাকতেই পারে। কেউ না কেউ সরকারি পদক্ষেপ বা কর্মসূচির বিকল্প লাভজনক পথও দেখাতে পারে। এতে জাতীয় স্বার্থে ঐক্য, সংহতি কিংবা সমঝোতা বিনষ্ট হবে না। তা ছাড়া নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির কয়েকজন নেতা নির্বাচনের পর দেশে রাজনীতির কিংবা রাষ্ট্রব্যবস্থার এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে সফল উত্তরণের জন্য অর্থাৎ মধ্যবর্তী সময়ের জন্য একটি ট্রানজিশনাল সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। গভীরে তলিয়ে দেখতে গেলে সে প্রস্তাব তারেক রহমানের প্রস্তাব থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। সুতরাং এ ক্ষেত্রে কোনো মতবিরোধ আছে বলে মনে হয় না। মতবিরোধ যা-ই আছে, তা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতায় পৌঁছা অসম্ভব নয়। তা ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার সূচনায় রাষ্ট্র মেরামতের প্রশ্নে তারেক রহমান তাঁর একটি সংস্কার প্রস্তাব সংবলিত ৩১ দফা ঘোষণা করেছিলেন, যার মধ্যে বিবেচনা করার মতো যথেষ্ট বিষয়বস্তু রয়েছে। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। যত দিন কোনো জাতি বা রাষ্ট্র থাকবে, তত দিনই এই প্রক্রিয়া চলমান থাকবে। তবে কথা হচ্ছে, অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী শাসনের ফলে বর্তমানে রাষ্ট্র মেরামত বা জরুরি সংস্কারের যে বিষয়গুলো রয়েছে, সেগুলোকে তো অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনা করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এটি বিবেচনা করার সময় যাঁদের হাতে নেই, তাঁরা দীর্ঘ ১৮ বছর কোথায় ছিলেন?

দেশের আপামর জনগণ রাষ্ট্রক্ষমতায় যোগ্য নেতৃত্বের অবস্থান কামনা করে। সে কারণেই অনেকে মনে করে, রাষ্ট্রক্ষমতায় অধ্যাপক ইউনূসের আরো কিছুটা সময় থাকা আবশ্যক। তাহলে দেশ ও জাতি একটি কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারবে। এটি কোনো অযৌক্তিক দাবি বা আকাঙ্ক্ষা নয়। কারণ ড. ইউনূস আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তি, যাঁর প্রতি দেশের জনগণ এবং প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মহলের আস্থা রয়েছে। অন্যরা এই মুহূর্তে ক্ষমতায় আসীন হলে পতিত ফ্যাসিবাদীদের দোসর এবং আধিপত্যবাদী আন্তর্জাতিক মহলের চাপ নেওয়ার মতো শক্তি দেখাতে সক্ষম না-ও হতে পারে। এই কথাটি কি সার্বিকভাবে অস্বীকার করা যায়? যায় না। সুতরাং যাঁরা ড. ইউসূসের প্রতি আস্থা দেখাচ্ছেন, তাঁদের অপরাধটা কী? একাত্তর-পরবর্তী দেশীয় রাজনীতিতে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া ছাড়া কেউ তো তেমনভাবে কোনো আশার আলো দেখাতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে বিএনপির কেউ কেউ যদি মনে করেন, তাঁরা অনেকেই শহীদ জিয়া কিংবা খালেদা জিয়ার মতো পরীক্ষিত নেতা হয়ে গেছেন, তাহলে সেটি হবে একটি দিবাস্বপ্নের মতো। তাঁদের প্রতি জনগণের তেমন আস্থা থাকলে তো বহু আগেই শেখ হাসিনার পতন ঘটত। সুতরাং সমালোচকের মুখে কথা তুলে না দিয়ে বাস্তববাদী হওয়া অনেক বুদ্ধিমানের কাজ। এ ক্ষেত্রে যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে দিব্যদৃষ্টি ও বাস্তববাদিতা। একটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল টিমকে মাঠে নামিয়ে খেলায় হেরে যাওয়ার চেয়ে বাছাইকৃত শক্তিশালী একটি টিমকে মাঠে নামিয়ে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেওয়াই প্রকৃত ক্রীড়ামোদীদের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে দেশপ্রেমিক জনগণের লক্ষ্যও একটিই। বাংলাদেশকে জেতাতে হবে। সব ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন করতে হবে। শত্রুর সব অপকৌশল ঠেকাতে হবে। দেশের অভাবনীয় উন্নয়ন সাধন করতে হবে। বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও সমৃদ্ধির গতি বেগবান করতে হবে। তরুণদের দিয়ে সেটি সম্ভব। জরাগ্রস্ত বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাদের দিয়ে সেটি কতটুকু অর্জিত হতে পারে? এ কথা দেশপ্রেমিক জনগণ যতটা ভাবে, ক্ষমতালোভী দলীয় নেতাদের অনেকে মনকে সেটি বোঝাতে পারেন না।

এসব কারণে তরুণ নেতা তারেক রহমান চান জাতীয় ভিত্তিতে একটি বৃহত্তর ঐক্য, যা তাঁকে এবং দেশের তরুণ নেতৃত্বকে একটি বলিষ্ঠ নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করবে। লুকোছাপার কিছু নেই। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অনেকেই চায় অতি প্রয়োজনীয় বা আবশ্যকীয় সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে অধ্যাপক ইউনূসের উল্লিখিত সময়ের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেওয়া হোক। তা থেকে বাছাইকৃত তরুণ নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে (দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা কিংবা প্রাপ্ত ভোটের হিসাবে) একটি মধ্যবর্তী কিংবা Transitional Governmentগঠন করা হোক, যার নেতৃত্বে থাকবেন ড. ইউনূস। তাঁকে যেকোনো একটি আসন খালি করে পাস করিয়ে আনা সম্ভব হবে। তা ছাড়া সেই সরকারের নেতৃত্বে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকবেন তরুণ নেতা তারেক রহমান। তাঁকে রাষ্ট্র পরিচালনায় সাহায্য করবেন তরুণ নেতারা, যাঁদের দিনে দিনে যোগ্য রাজনীতিক ও নেতা হিসেবে গড়ে (প্রশিক্ষিত) তোলা যাবে। জামায়াতে ইসলামী কিংবা অন্যদের মধ্যে কেউ ইচ্ছা করলে বিরোধী দলের আসন অলংকৃত করতেও বাধা থাকবে না। দেশের বৃহত্তর বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী মহলের একটি বিশাল অংশের ভবিষ্যৎ নির্বাচন ও সরকার গঠন নিয়ে চিন্তা-চেতনা এমনই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষককুল কিংবা শহর-নগরে কর্মরত শ্রমজীবী মানুষের ধ্যান-ধারণাও এখন এভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে। এগুলো আমার কোনো ব্যক্তিগত অভিলাষ নয়।

লেখক, সাংবাদিক কিংবা বিশেষ করে কলাম লেখকরা যা শোনেন, যা দেখেন, সেটি নিয়েই লিখে থাকেন। এতে কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই। এর পেছনে দেশপ্রেম বা দেশের বৃহত্তর স্বার্থ ছাড়া আর যা-ই থাক, কোনো চক্রান্ত বা ষড়যন্ত্র নেই। দেশের সাধারণ মানুষ অনেক কিছুই রাজনীতিকদের চেয়ে আগে ভেবে থাকে। তারা দেশের স্বার্থ, উন্নতি ও সমৃদ্ধি ছাড়া আর কিছুই চায় না। অন্যদিকে দেশের চিন্তাশীল মানুষ ও বুদ্ধিজীবীরা চান দেশের আর্থ-রাজনৈতিক সমৃদ্ধি ও মুক্তি। আধিপত্য কিংবা সম্প্রসারণবাদীদের প্রভাব কিংবা নিয়ন্ত্রণমুক্ত একটি দেশ, যেখানে থাকবে মানুষের গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার। এবং ঘটবে অর্থনৈতিক মুক্তি কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ ও ছাত্র-জনতার।

 

লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

gaziulhkhan@gmail.com

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ