ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২০ মার্চ ২০২৫
৬ চৈত্র ১৪৩১, ১৯ রমজান ১৪৪৬

ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২০ মার্চ ২০২৫
৬ চৈত্র ১৪৩১, ১৯ রমজান ১৪৪৬

মুজিবনগর সরকারের গুরুত্ব ও অবদান

  • মাহবুবউল আলম হানিফ
শেয়ার
মুজিবনগর সরকারের গুরুত্ব ও অবদান

আজ ১৭ এপ্রিল, ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। এই দিনটি বাঙালি জাতির জীবনে একটি অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়।

এ দেশ, এ দেশের মানুষ হাজার বছর ধরে বিদেশি হানাদারদের কবলে পড়েছে। অত্যাচারিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত হয়েছিল। কিন্তু তারা মাথা নোয়ায়নি। শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে, লড়াই করেছে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয়ে চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের পর ছেষট্টিতে ছয় দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন জাগিয়ে তুলেছিলেন। এরপর উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। যার ফলে সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল।

১৯৭০ সালের নির্বাচনেই বাঙালি স্বাধীনতার পক্ষে তাদের আকাঙ্ক্ষাটি জানিয়ে দেয়।

তারপর তারা পথে নেমে আসে। স্লোগান তোলে—‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। জনতার মনের আকাঙ্ক্ষাটি বহু আগে থেকেই জানতেন জনতার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই তিনি ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্সের জনসমুদ্রে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দিলেন : এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকাসহ সারা দেশে অপারেশন সার্চলাইট নামে ইতিহাসের বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।

তাত্ক্ষণিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এর পরপরই পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে।

বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ চার সহচর সর্বাত্মক জনযুদ্ধকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ভারতে আশ্রয় নেন এবং সেখানেই ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে প্রবাসী সরকারের এক অধ্যাদেশে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করা হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৭ এপ্রিল তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় এই সরকার শপথ গ্রহণ করে। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দায় শোধ হয়েছিল মুজিবনগর সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে। সব ধর্মের, সব বর্ণের মানুষের সম্প্রীতির বন্ধনে যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন, এই দিনে তা সত্যিকার অর্থে বাস্তবে রূপ নিল সরকার গঠনের মাধ্যমে।

বিশ্ব মানচিত্রে যে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল একটি ঐতিহাসিক ধাপ পেরিয়েছিল বাংলাদেশ।

সেদিন ছিল শনিবার। সীমান্তবর্তী বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আমবাগানের চারদিকে রাইফেল হাতে কড়া প্রহরায় বীর মুক্তিযোদ্ধারা। হাজার হাজার মুক্তিকামী বাঙালির উপচেপড়া ভিড় চারদিকে। ঐতিহাসিক মুহূর্তটি ধারণ করতে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরাও প্রস্তুত। মুক্ত আকাশের নিচে চৌকি পেতে তৈরি করা হয়েছে শপথ মঞ্চ। মঞ্চের ওপর সাজানো ছয়টি চেয়ার। অনুষ্ঠানের প্রবেশপথে বাংলায় লেখা স্বাগতম

স্থানীয় সময় ১১টা বেজে ৫০ মিনিটে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের নেতারা একে একে আসতে থাকেন। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে প্রকম্পিত চারদিক। প্রথম শপথ মঞ্চে উঠে এলেন বঙ্গবন্ধুর আজীবনের ঘনিষ্ঠ সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাঁর পেছনে তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, বিশ্বাসঘাতক খুনি খন্দকার মোশতাক আহমদ ও জেনারেল এম এ জি ওসমানী। যেকোনো মুহূর্তে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিমান হামলার আশঙ্কার মুখে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের স্থায়িত্ব হয় মাত্র ৪৫ মিনিট। অনুষ্ঠানের সূচনায় পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত এবং গীতা, বাইবেল থেকে পাঠ করা হয়। স্থানীয় শিল্পী এবং হাজারো মানুষের কণ্ঠে গাওয়া হয় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। এরপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম উত্তোলন করেন মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।

এরপর আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী ঐতিহাসিক দলিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এরপর নতুন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রীবর্গ ও সেনাবাহিনীর প্রধানকে শপথ বাক্য পাঠ করান তিনি। শপথ গ্রহণের পর সশস্ত্র তেজোদীপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা এবং আনসার বাহিনীর সদস্যরা মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের রাষ্ট্রীয় কায়দায় গার্ড অব অনার প্রদান করেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের।

শপথ গ্রহণের পরপরই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে বলেন, আমরা যা করছি সবই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে। এ অনুষ্ঠান থেকে নতুন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দুজনই বিশ্ববাসীর কাছে নতুন রাষ্ট্রের কূটনৈতিক স্বীকৃতিদান ও সামরিক সাহায্যের আবেদন জানান।

বঙ্গবন্ধুকে প্রেরণার কেন্দ্রে ধারণ করে, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মোতাবেক মুজিবনগর সরকার দেশপ্রেমিক মুক্তিপাগল জনতাকে সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধকে একটি সফল জনযুদ্ধে পরিণত করে। আন্তর্জাতিক সমর্থন ও সহযোগিতা আদায়ে তাঁরা অনন্য ভূমিকা পালন করেন। ফলে ৯ মাসেরও কম সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মুজিবনগর সরকারের গুরুত্ব ও অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

এই ঐতিহাসিক দিনে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতাকে।

 লেখক : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

ঋণের উচ্চ সুদহার কমানো প্রয়োজন

    নিরঞ্জন রায়
শেয়ার
ঋণের উচ্চ সুদহার কমানো প্রয়োজন

সম্প্রতি একটি ইংরেজি দৈনিক ব্যাংকঋণের ওপর উচ্চ সুদহার এবং দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যা রীতিমতো উদ্বেগজনক। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে গড় সুদের হার ছিল ৭.২৪ শতাংশ, যা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে এসে দাঁড়ায় ৯.৭৫ শতাংশে এবং ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১১.৮৯ শতাংশ। বিগত দুই বছরে ঋণের ওপর সুদের হার ৭.২৪ থেকে বৃদ্ধি করে ১১.৮৯ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাত্ মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে সুদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে ৫ শতাংশ, যা এককথায় নজিরবিহীন।

আমরা জানি না, বিশ্বের আর কোনো দেশে, বিশেষ করে যেসব দেশের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পন্ন হয়, সেসব দেশে এত অল্প সময়ের ব্যবধানে এই মাত্রার সুদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে কি না।

কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন যে দেশের ব্যবসায়ীরা যতই চাপ সৃষ্টি করুন না কেন, তিনি সুদের হার হ্রাস করবেন না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ীদের চাপ সৃষ্টি করার মতো অবস্থা কি আসলেই আছে! ব্যবসায়ীরা তাঁদের ব্যবসা টিকিয়ে রেখে কোনো রকমে বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত এবং প্রতিনিয়ত উদ্বেগজনক অবস্থার মধ্যে আছেন। চাপ সৃষ্টি করবেন কিভাবে? তা ছাড়া রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় না থাকলে যে কোনো রকম চাপ সৃষ্টি করা যায় না, সেটি তাঁরা ভালো করেই জানেন।

যা হোক, উচ্চ সুদহার অব্যাহত রাখার সমর্থনে গভর্নর আমেরিকা, ইউরোপ এবং ভারতের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বলেছেন যে সব দেশেই একটি কার্যকর (ইফেক্টিভ) সুদের হার থাকে এবং আমরাও তা-ই করব। তিনি আরো বলেন যে সুদের হার তখনই কমানো হবে, যখন দেশে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। কিন্তু গভর্নর যেসব দেশের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন, তারা তো সুদের হার হ্রাস করে চলেছে এবং এখন স্বল্প সুদহারের সময়ে আছে। তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও তো সেই পথ অনুসরণ করার কথা।
অর্থাত্ উচ্চ সুদহার হ্রাস করার সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। তবে গভর্নরের এ কথা ঠিক যে মূল্যস্ফীতি হ্রাসের পরই সুদের হার হ্রাস করতে হয়। কেননা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এখন পর্যন্ত যতগুলো অর্থনৈতিক অস্ত্র আবিষ্কার করা হয়েছে, তার মধ্যে নীতি সুদ হার অন্যতম। সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই অস্ত্রই ব্যবহার করে। কিন্তু অর্থনীতির এই তত্ত্ব তো কাজ করে একটি স্বাভবিক অবস্থায়।

ঋণের উচ্চ সুদহার কমানো প্রয়োজনআমরা যারা অর্থনীতি নিয়ে লেখাপড়া করেছি, তারা ভালো করেই জানি যে অর্থনীতির কোনো তত্ত্ব তখনই কাজ করে, যখন অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকে এবং স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করে। এ কারণেই অর্থনীতির যেকোনো সূত্র লেখার আগে একটি কথা প্রথমেই উল্লেখ করা হয় তা হচ্ছে, অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে (ceteris paribus, meaning other things will ermain unchanged) এমনকি যেসব দেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করে, মানসম্পন্ন মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি এবং সুশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থা বিদ্যমান; যেমনকানাডা, আমেরিকা, ইউরোপ, সেখানেও এই নীতি সুদ হার প্রয়োগ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সব সময় সম্ভব হয় না। এ কারণেই সেসব দেশে একাধিক মূল্যস্ফীতির সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে; যেমনমৌলিক মূল্যস্ফীতি যেখানে অতি মূল্য পরিবর্তনশীল পণ্য বিবেচনায় নেওয়া হয় না; অমৌলিক মূল্যস্ফীতি, যেখানে সব রকম পণ্য বিবেচনায় নেওয়া হয় এবং গড় মূল্যস্ফীতি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু মৌলিক মূল্যস্ফীতিই বিবেচনা করে। এই যেখানে অবস্থা, সেখানে আমাদের দেশে না আছে মানসম্পন্ন মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি, না আছে বাজারব্যবস্থায় শৃঙ্খলা। সর্বক্ষেত্রে এক বিশৃঙ্খল অবস্থা। এর ওপর এখন তো বিরাজ করছে একেবারেই অস্বাভবিক অবস্থা এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। এ রকম অবস্থায় উচ্চ সুদহার প্রয়োগ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার কাজটি মোটেই সফল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অন্তত আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। মাঝখান থেকে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এ কথা অনস্বীকার্য যে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে দুই ধরনের উপাদানের প্রভাব। একটি হচ্ছে অর্থনৈতিক উপাদান; যেমনমুদ্রা সরবরাহ, চাহিদা, জোগান। আরেকটি হচ্ছে অর্থনীতিবহির্ভূত উপাদান; যেমনবিশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থা, আধুনিক গুদামজাত ব্যবস্থার অভাব, মানসম্পন্ন মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি, অনিয়ন্ত্রিত সরবরাহ ব্যবস্থা প্রভৃতি। নীতি সুদ হার প্রয়োগ করে মূল্যস্ফীতির অর্থনৈতিক উপাদানকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও অর্থনীতিবহির্ভূত উপাদানের ক্ষেত্রে তেমন কিছুই করার সুযোগ থাকে না। এ কারণেই দেখা যায়, যেসব দেশে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণে অর্থনীতিবহির্ভূত উপাদান খুবই কম; যেমনআমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ, সেসব দেশে নীতি সুদ হার প্রয়োগ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কাজটি অনেকটা সহজ হয়। পক্ষান্তরে যেসব দেশে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণে অর্থনীতিবহির্ভূত উপাদান অনেক বেশি; যেমনবাংলাদেশ, সেসব দেশে শুধু নীতি সুদ হার প্রয়োগ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ খুবই কম। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতাও তা-ই বলে।

উচ্চ সুদহারের কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। আমাদের দেশে উচ্চ সুদহারের নেতিবাচক প্রভাব মারাত্মক। কেননা এখানে বিনিয়োগযোগ্য অর্থ সংগ্রহের একমাত্র উৎস হচ্ছে ব্যাংকঋণ। উচ্চ সুদহার বহাল থাকলে ব্যাংক যেমন নতুন ঋণ দিতে আগ্রহী হয় না, তেমনি উদ্যোক্তারাও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করতে সাহস পান না। কেননা উচ্চ সুদহারের সময় ঋণ পরিশোধ বা ডেট সার্ভিসিং করতে না পারার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। আমাদের অনেকেরই মনে থাকার কথা, ১৯৮০-এর দশকে অসংখ্য ঋণগ্রহীতা ব্যাপকহারে ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়ে ঋণখেলাপির খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন এবং সেখান থেকেই দেশে ঋণখেলাপি সংস্কৃতির শুরু। সেই সময়ের অস্বাভাবিক খেলাপি ঋণের জন্য দেশের ব্যবসায়ীদের দোষারোপ করা হয়। এটিই স্বাভাবিক। কেননা ঋণ নিলে, সেই ঋণ পরিশোধের সব ধরনের দায়দায়িত্ব ঋণগ্রহীতার ওপরই বর্তায়, তাতে বাস্তব অবস্থা যেমনই হোক না কেন।

বাস্তবতা হচ্ছে সে সময়ের পর্যাপ্ত ঋণখেলাপির পেছনের আসল কারণ কখনোই অনুসন্ধান করা হয়নি এবং এ নিয়ে কোনো কথাও বলা হয় না। অথচ সে সময়ের মাত্রাতিরিক্ত ঋণপখেলাপির পেছনে যে কয়টি উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল, তার মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত সুদের হার, যা তখন ছিল ১৮ থেকে ২০ শতাংশ। এই উচ্চ সুদহারে এক কোটি ঋণ নিয়ে থাকলে চার বছরে তা সুদে-আসলে বেড়ে দুই কোটি টাকা হয়েছিল। কোনো ব্যবসায়ীর পক্ষে চার বছরের মধ্যে ব্যবসা করে গৃহীত এক কোটি টাকা ঋণ সুদে-আসলে দুই কোটি টাকা পরিশোধ করা সম্ভব নয়। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। ঋণগ্রহীতারা ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য বেড়ে গেছে। এখনো যদি সুদের হার হ্রাস না করে উচ্চ সুদহার বহাল রাখা হয়, তাহলে একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। অর্থাত্ দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে, যা এরই মধ্যে উদ্বেগজনক অবস্থায়ই আছে।

এ কারণেই শুধু অর্থনীতির নিয়মের মধ্যে বা আইএমএফের সুপারিশের মধ্যে আটকে না থেকে বাস্তবতার আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন আছে। এ রকম সিদ্ধান্ত বিশ্বের অনেক দেশই নিয়ে থাকে এবং সেসব দৃষ্টান্ত অসংখ্য আছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ের সে রকম একটি দৃষ্টান্ত পাঠকদের জ্ঞাতার্থে উল্লেখ করছি। কানাডায় ব্যাংক অব কানাডা (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) আগে বেশ কয়েকবার নীতি সুদ হার হ্রাস করেছে এবং এখন কোনো অবস্থায়ই এই সুদের হার আরো কমানোর অবস্থানে নেই। কেননা মূল্যস্ফীতি এখনো সেভাবে হ্রাস পায়নি। তদুপুরি কানাডিয়ান ডলারের বিনিময় মূল্য সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। মুদ্রাবাজার বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে পুনরায় নীতি সুদ হার হ্রাস করলে কানাডিয়ান ডলারের আরো অবমূল্যায়ন হবে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য খুব একটা ভালো হবে না। এর পরও ব্যাংক অব কানাডা পুনরায় নীতি সুদ হার হ্রাস করে ২.৭৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে জনগণের, বিশেষ করে ব্যবসায়ী এবং বিনিয়োগকারীদের কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা। কেননা এখানকার অর্থনীতি হচ্ছে ঋণনির্ভর। ফলে ঋণের ওপর উচ্চ সুদহারের কারণে কানাডার মানুষের দুর্বিষহ অবস্থা। এ কারণেই সরকার ডলারের অবমূল্যায়নের ঝুঁকি নিয়ে এবং বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা উপেক্ষা করে নীতি সুদ হার হ্রাস করেছে।

বাস্তবতা যখন দাবি করে, তখন বইয়ের সূত্র বা আইএমএফের সুপারিশের বাইরে গিয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এ রকম সিদ্ধান্ত বিশ্বের অনেক দেশই নিয়ে থাকে, তাই আমাদের দেশকেও নিতে হবে। আগে ব্যবসায় গতি আনতে হবে, ব্যবসায়ীদের আস্থা ফেরাতে হবে, বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে হবে এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে হবে। আর এগুলো নিশ্চিত করতে হলে অনেক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা আছে, যার মধ্যে সুদের হার হ্রাস করা অন্যতম এবং সবার আগে এটি করা প্রয়োজন। আশা করব, অর্থ উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন এবং এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।

লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা

nironjankumar_roy@yahoo.com

 

মন্তব্য

দেশীয় পণ্য উৎপাদন ও ব্যবহারের অর্থনৈতিক প্রভাব

    ড. ফজলে এলাহী মোহাম্মদ ফয়সাল
শেয়ার
দেশীয় পণ্য উৎপাদন ও ব্যবহারের অর্থনৈতিক প্রভাব

বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে উন্নতি লাভ করছে। এ উন্নতির পেছনে রেডিমেড গার্মেন্টস সেক্টরের উন্নয়ন এবং প্রবাসীদের মাধ্যমে প্রেরিত অর্থের বিরাট অবদান রয়েছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ছিল মাত্র ৯৪ মার্কিন ডলার এবং ২০২৪ সালে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৬৭৫ মার্কিন ডলার। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে বেশ কয়েক গুণ।

ইউনিয়ন অথবা গ্রাম পর্যায়ের বাজারগুলোতে এখন কসমেটিক সামগ্রী, বিলাসদ্রব্য, ফাস্ট ফুড, ফ্রিজ, এসি ইত্যাদি বিক্রয় হচ্ছে, যা সত্তরের দশক অথবা আশির দশকে চিন্তাও করা যেত না। বিদ্যুতের সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে এসি, ফ্রিজ, মোটরসাইকেল, গাড়ি, বাড়িতে ব্যবহারের জন্য ইলেকট্রনিকস এবং ইলেকট্রক্যািল সামগ্রী, উন্নতমানের পোশাক ইত্যাদির চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকাংশে। এসব দ্রব্যের চাহিদা মেটানোর জন্য বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করা হচ্ছে এবং আশার কথা হলো, বাংলাদেশে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এবং বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে।
বেশ কিছুদিন পূর্বে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত পার্ক-ইয়ং-সিক আমাদের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন এবং ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দেশের জনগণকে বাংলাদেশি পণ্য ক্রয়ে উৎসাহ প্রদান করেন। দেশীয় পণ্যের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোকপাত করার জন্য ইলেকট্রনিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস খাত, অটোমোবাইল খাত এবং রেডিমেড গার্মেন্টস সেক্টর সম্পর্কে আলোচনা প্রয়োজন।

একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশে ব্যবহৃত ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস পণ্যের প্রায় পুরোটাই বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো।

অত্যন্ত আনন্দের বিষয় হলো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশেই ইলেকট্রনিকস পণ্য উৎপাদন, বিক্রয় ও রপ্তানি করে থাকে। বাংলাদেশে সর্বমোট ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিকস দ্রব্যের চাহিদা প্রায় ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ভোক্তাগণের ব্যবহারের প্রয়োজনে ইলেকট্রনিকস পণ্যের চাহিদা প্রায় ৫.১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের টেলিভিশন সেটের মোট চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ পূরণ হচ্ছে দেশে উৎপাদিত অথবা সংযোজিত টিভি সেটের মাধ্যমে। দেশের সর্বমোট এয়ারকন্ডিশনারের চাহিদার প্রায় ৭৫ শতাংশ পূরণ হচ্ছে বাংলাদেশে উৎপাদিত এয়ারকন্ডিশনারের মাধ্যমে। ফ্রিজ সেটের সর্বমোট চাহিদার ৮০ শতাংশ পূরণ হচ্ছে বাংলাদেশে উৎপাদিত ফ্রিজের মাধ্যমে।
বাংলাদেশে উৎপাদিত ফ্রিজ, এয়ারকন্ডিশনার, টেলিভিশন, ফ্যান, কেবল, সুইচ, সকেট ইত্যাদি ভারত, নেপাল, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ওয়ালটনের পণ্যসামগ্রী বিশ্বের ৪০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত ব্যাটারি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহে এবং আফ্রিকার দেশসমূহে রপ্তানি হচ্ছে। ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস সেক্টরে বিনিয়োগ করার জন্য বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ দেখাচ্ছেন। রপ্তানি ও দেশীয় চাহিদা মেটানোর জন্য দেশে মোট কাপড়ের চাহিদা ১২ বিলিয়ন মিটারের চেয়ে বেশি। আমাদের দেশে উৎপাদিত হয় মাত্র তিন বিলিয়ন মিটার। আমাদের দেশে বিভিন্ন ফ্যাশন ব্র্যান্ড থাকার পরও প্রায় ২৩.৫ বিলিয়ন পিস রেডিমেড গার্মেন্টস আমদানি করা হয়ে থাকে। ভারত থেকে প্রধানত শাড়ি, থ্রিপিস ও পাঞ্জাবি, পাকিস্তান থেকে থ্রিপিস এবং চীন থেকে টি-শার্ট, জার্সি এবং জ্যাকেট আমদানি করা হয়। বাংলাদেশে ২০২৩ সালে প্রায় চার লাখ ৬২ হাজার মোটরসাইকেল বিক্রি হয়েছে। দেশে বর্তমানে ১০টি মোটরসাইকেল ফ্যাক্টরি রয়েছে এবং ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা  মোটরসাইকেল ইন্ডাস্ট্রিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে।  মোটরসাইকেলের ইন্ডাস্ট্রিতে জড়িত রয়েছেন প্রায় দুই লাখ জনবল। জাপানি ব্র্যান্ডের হোন্ডা, সুজুকি, ইয়ামাহা, ভারতীয় ব্র্যান্ড বাজাজ, টিভিএস, হিরো এবং বাংলাদেশি ব্র্যান্ড রানার মোটরসাইকেল বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। প্রতিবছর প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার মোটরসাইকেল বিক্রি হয়। বাংলাদেশে বিদেশি ব্র্যান্ড মিতসুবিশি, হিরো, প্রটোন, হুন্দাই, টাটা, অশোক লেল্যান্ড, মাহিন্দ্রা ইত্যাদি সংযোজিত হচ্ছে। দেশীয় ব্র্যান্ডের গাড়ি হলো সোবারি, মিশুক এবং অ্যাগাটে। ২০১৯ সালে মোট গাড়ি আমদানির সংখ্যা ছিল ৬১  হাজার ৪৬৭টি। ২০২২ সালে আমদানির পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৮৮০টি গাড়ি। ২০২৩ সালে গাড়ি আমদানির সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ১৫০টি।

দেশীয় পণ্য উৎপাদন ও ব্যবহারের অর্থনৈতিক প্রভাবপ্রকৃতপক্ষে আমরা যদি ব্যবহারের জন্য আমাদের দেশে তৈরি পণ্য অর্থাত্ আমাদের নিজস্ব ব্র্যান্ড অথবা বিদেশি ব্র্যান্ডের পণ্য, যেগুলো আমাদের দেশে উৎপাদন করা হয় সেসব পণ্য ব্যবহার করি, তাহলে আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা কমবে এবং ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অথবা ব্যালেন্স অব ট্রেড-এর উন্নয়ন ঘটবে। আমরা জানি, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন অর্থাত্ মুনাফা অর্জনের জন্য প্রয়োজন বিক্রয় বৃদ্ধি। বিক্রয়মূল্য যদি উৎপাদন খরচ ও অন্যান্য খরচের চেয়ে বেশি হয় এবং কোনো প্রতিষ্ঠান যদি বেশি পরিমাণ দ্রব্য বিক্রয় করতে পারে, তাহলে প্রতিষ্ঠানটি মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হবে। তাদের ব্যবসায়ের পরিধি বৃদ্ধির জন্য পুনরায় বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিধি বৃদ্ধি পেলে বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে এবং কর্মে জড়িত ব্যক্তিদের আয়স্তর বৃদ্ধি পাবে। বেকার যুবকরা কর্মের সুযোগ পেলে এবং আয়স্তরের বৃদ্ধি ঘটে থাকলে দ্রব্যের সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি পাবে এবং বিনিয়োগ, উৎপাদন ও ব্যবসায় বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং নতুন নতুন পণ্যের উৎপাদনের মাধ্যমে পণ্যের জোগান বাড়বে। এর ফলে আবারও কর্মসংস্থান ও আয়স্তর বৃদ্ধি পাবে। এতে আমাদের দেশে পুনরায় কর্মসংস্থান, আয়স্তর সামগ্রিক চাহিদা, পণ্যের উৎপাদন ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। বৃদ্ধি পাবে সরকারের রাজস্ব আয় এবং সরকারের পক্ষে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা সম্ভব হবে।

একটি সহজ উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি আলোচনা করা যাক। মনে করি, কোনো একটি প্রতিষ্ঠান নিউটন ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল বাংলাদেশে ফ্যাক্টরির মাধ্যমে উৎপাদন করে। বাংলাদেশের নাগরিকরা যদি বিদেশি ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল না কিনে বেশি পরিমাণ নিউটন মোটরসাইকেল কেনা শুরু করে, তবে প্রতিষ্ঠানটি মুনাফা বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে আরো বেশি নিউটন মোটরসাইকেল উৎপাদন করতে চাইবে। মনে করি, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটিতে উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে নতুনভাবে আরো দুই হাজার তরুণের কর্মসংস্থানের সুযোগ হলো। দুই হাজার জনের কর্মসংস্থান হওয়ার ফলে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্র তৈরি হলো। দুই হাজার জনের আয়স্তর বৃদ্ধির কারণে দ্রব্যের চাহিদা তৈরি হলো। এতে চায়নিজ রেস্টুরেন্ট, লন্ড্রি, ফার্মেসি, বিস্কুট ফ্যাক্টরি তৈরি হলো এবং এসব ব্যবসায়ের মালিকদের আয় বৃদ্ধি পেল এবং নতুন করে ২০০ জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলো। রাজস্ব বৃদ্ধি হলে মনে করি, কোনো এলাকার নতুন রাস্তা তৈরি হলো এবং একটি সরকারি হাসপাতাল নির্মিত হলো। আরো মনে করি, ওই এলাকায় যাদের জমি ছিল রাস্তা ও হাসপাতাল নির্মিত হওয়ার ফলে তাদের জমির মূল্য দ্বিগুণ হয়ে গেল। হাসপাতাল ও রাস্তা নির্মিত হওয়ায় সেখানেও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হলো। সুতরাং একটি সহজ উদাহরণে দেখা গেল দেশীয় পণ্য বিক্রির ফলে সরকারের রাজস্ব আয়, উন্নয়ন কার্যক্রম, কর্মসংস্থান, আয়স্তর, চায়নিজ রেস্টুরেন্ট, বিস্কুট ফ্যাক্টরি, ফার্মেসি ইত্যাদি তৈরি হলো এবং আবারও কর্মসংস্থান ও আয়স্তর বৃদ্ধি পেল এবং হাসপাতাল ও রাস্তা নির্মিত হওয়ার ফলে জনগণের সম্পদের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলো। মুনাফা বৃদ্ধির ফলে প্রতিষ্ঠানটি সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য একটি স্কুল নির্মাণ করল।

দেশীয় পণ্য বিক্রয় বৃদ্ধি পেলে অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক এবং রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন হয়ে থাকে। একইভাবে দেশে উৎপাদিত বৈদেশিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিক্রয় বৃদ্ধি পেলেও কর্মসংস্থান, আয়স্তর, রাজস্ব আয় এবং উন্নয়ন বৃদ্ধি পায়। আমরা যদি আমাদের দেশকে প্রকৃত অর্থেই ভালোবাসি, তাহলে দেশে উৎপাদিত পণ্য ব্যবহারের জন্য অনুপ্রাণিত হতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

 

মন্তব্য

ভেজালের রাজ্যে আসল খুঁজে পাওয়া ভার

    ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী
শেয়ার
ভেজালের রাজ্যে আসল খুঁজে পাওয়া ভার

গল্পটি অনেক দিন আগে শুনেছিলাম। নন্দ ঘোষ নামে এক গোয়ালা প্রতিদিন পুরান ঢাকার এক অভিজাত পরিবারে দুধ সাপ্লাই করতেন। নন্দ ঘোষ অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং দায়িত্বশীল একজন মানুষ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। একদিন হঠাত্ করেই নন্দ ঘোষ অসুস্থ হয়ে পড়েন।

নন্দ ঘোষের পরিবর্তে তাঁর ছেলে দুধ সাপ্লাই দেন। সেই দুধ পান করে বাড়ির সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভদ্রলোক মহা খাপ্পা। তিনি এবার নন্দ ঘোষকে দেখে নেবেন বলে পণ করলেন।
পরদিন নন্দ ঘোষ নিজেই দুধ সাপ্লাই দেওয়ার জন্য আসেন। ভদ্রলোক নন্দ ঘোষকে আটক করেন। তিনি জানতে চাইলেন, কেন তাঁর বাড়িতে ভেজাল দুধ সাপ্লাই দেওয়া হলো? তিনি নন্দ ঘোষকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিলেন। নন্দ ঘোষ অত্যন্ত বিনীতভাবে হাত জোড় করে বলেন, স্যার, যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে আমি কিছু কথা বলতে চাই।
অনুমতি পাওয়ার পর নন্দ ঘোষ বলেন, হুজুর, আমার ছেলে আপনার বাড়িতে ভেজাল দুধ দেয়নি। বরং এত দিন আমি আপনাদের সরলতার সুযোগ নিয়ে ভেজাল দুধ সাপ্লাই দিয়েছি। হঠাত্ করে একদিন আসল দুধ সাপ্লাই দেওয়ার কারণেই এই বিপত্তি ঘটেছে। কারণ আপনারা ভেজাল দুধ পান করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এ জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
আমার ছেলে যদি ভেজাল দুধ সাপ্লাই দিত, তাহলে এমন দুর্ঘটনা হয়তো ঘটত না। নন্দ ঘোষের সত্য ভাষণে সন্তুষ্ট হয়ে গৃহকর্তা নন্দ ঘোষকে ক্ষমা করে দিলেন।

এটি একটি প্রতীকী গল্প, তবে গল্পটি নিরর্থক নয়। এই গল্পের মাধ্যমে আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। তবে সেই উন্নয়ন কতটা টেকসই এবং গুণগত মানসম্পন্ন তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিশ্বব্যাংকের রেটিংয়ে বাংলাদেশকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক তালিকায় স্থান দিয়েছে। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী বছর (২০২৬) বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হবে। দৃশ্যত এসব উন্নয়ন সূচক আমাদের আশান্বিত করে। তার পরও মনে শঙ্কা জাগে আমরা কি সত্যি উন্নয়ন অর্জন করছি? আর যে উন্নয়ন প্রত্যক্ষ করছি তা কতটা মানবকল্যাণমূলক? অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। কিন্তু সেই অর্জন কোন কোন ক্ষেত্রে আমাদের জন্য বিপদ ডেকে আনছে।

ভেজালের রাজ্যে আসল খুঁজে পাওয়া ভারবাংলাদেশ একসময় খাদ্যঘাটতি এলাকা হিসেবে পরিগণিত হতো। স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫৩ বছরে বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে ব্যাপক উন্নতি অর্জন করেছে। আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ হ্রাস পেলেও বাংলাদেশ এখন খাদ্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশে চাল উৎপাদিত হতো এক কোটি ১০ লাখ টন। এখন চাল উৎপাদনের পরিমাণ সাড়ে তিন গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে তিন কোটি ৭০ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। চাল উৎপাদনে বিশ্ব প্রথম স্থানে রয়েছে চীন। তাদের বার্ষিক চাল উৎপাদনের পরিমাণ হচ্ছে ১৪ কোটি ৪৬ লাখ টন। ১৩ কোটি ৭৮ লাখ টন চাল উৎপাদন করে ভারত দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ এখন খাদ্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও আমরা কি নিশ্চয়তা দিতে পারি যে খাদ্যপণ্য ভোক্তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে তা শতভাগ নিরাপদ ও ভেজালমুক্ত? আমরা প্রায়ই খাদ্য নিরাপত্তা এবং নিরাপদ খাদ্য শব্দ দুটি শুনে থাকি। কিন্তু অনেকেই এর পার্থক্য সম্পর্কে অবহিত নন। খাদ্য নিরাপত্তার অর্থ হচ্ছে নাগরিকদের জন্য প্রয়োজীয় খাদ্য জোগান নিশ্চিত করা। আর নিরাপদ খাদ্যের অর্থ হচ্ছে, যে খাবার ভোক্তার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে তা তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ কি না। সরবরাহকৃত খাদ্য যদি নিরাপদ না হয়, তাহলে খাদ্য নিরাপত্তা অর্থহীন হয়ে পড়তে পারে।

বিশ্বব্যাপী নিরাপদ খাদ্যের আন্দোলন জোরদার হচ্ছে। উন্নত দেশগুলোতে ভোক্তাদের হাতে কোনো খাবার তুলে দেওয়ার আগে তার গুণগত মান এবং মানবদেহের জন্য তা ক্ষতিকর কি না সেটা নিশ্চিত করা হয়। উন্নত দেশগুলোর ভোক্তারাও অধিকতর সচেতন। তারা কোনোভাবেই ভেজাল ও নিম্নমানের খাবার গ্রহণ করেন না। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতনতার প্রচণ্ড অভাব পরিলক্ষিত হয়। কিছু কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা মনে করেন খাবার হলেই হয়, ভালো আর মন্দ কী? বিশ্বের প্রতিটি দেশেই স্ট্রিট ফুড অত্যন্ত জনপ্রিয়। স্ট্রিট ফুডের দোকানগুলোতে কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বাংলাদেশে স্ট্রিট ফুডের দোকানে মাননিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। শুধু স্ট্রিট ফুডের দোকানেই নয়, সর্বত্রই চলছে ভেজাল পণ্যের কারবার। শহর থেকে গ্রাম সর্বত্রই ভেজাল পণ্যের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা যায়। এক শ্রেণির অতি মুনাফাখোর জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনা না করেই খাদ্যপণ্যে ভেজাল মেশাচ্ছে। বাড়তি মুনাফা অর্জনের জন্য তারা এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত রয়েছে। যেকোনো পণ্যেই ভেজাল মেশানো মারাত্মক অপরাধ। আর তা যদি হয় খাদ্যপণ্য, তাহলে তো কথায় নেই। ভেজাল পণ্য গ্রহণ করা হলে ভোক্তা সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে না। সাধারণত ভেজাল খাদ্য গ্রহীতা নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তাঁরা মৃত্যুবরণ করেন। ভেজাল খাদ্যের ক্ষতিকর প্রভাব তাত্ক্ষণিকভাবে উপলব্ধি করা যায় না। ভেজাল খাদ্যকে স্লো পয়জনিং বলা যেতে পারে। এমন অনেক রোগ আছে, যা ভেজাল খাদ্য গ্রহণের কারণেই সংক্রমিত হয়ে থাকে।

রাজধানীর বিভিন্ন দোকানে বাহারি ফলের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা যায়। এসব ফলের বেশির ভাগই নানা ধরনের ক্ষতিকর কেমিক্যাল মেশানো। মৌসুমি ফলে ফরমালিন, কার্বাইডসহ নানা ধরনের ক্ষতিকর কেমিক্যাল মেশানো হয়। ফরমালিন ব্যবহার করা হয় মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্য। এখন তা ফল এবং অন্যান্য খাদ্যপণ্য তাজা রাখার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব কেমিক্যাল মেশানো খাদ্যপণ্য গ্রহণ করা হলে একজন মানুষ ধীরে ধীরে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন। একসময় তার মৃত্যু ঘটবে অথবা পঙ্গুত্ববরণ করবে।

বাংলাদেশ এখন মাছ উৎপাদনে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পাঁচটি মৎস্য উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। কিন্তু আমরা বাজারে গিয়ে যেসব মাছ ক্রয় করছি তা কতটা স্বাস্থ্যসম্মত এবং ভেজালমুক্ত তা কি আমরা ভেবে দেখেছি? রাজধানী ঢাকা শহরের এক অভিজাত মাছের দোকান থেকে জনৈক ভদ্রলোক বড় আকারের একটি কাতলা মাছ কিনে গাড়ির পেছনে (ব্যাক ডালায়) একটি বালতির মধ্যে রাখেন। বাসায় ফিরে একজন আত্মীয়ের দুর্ঘটনা সংবাদ শুনে তিনি তাত্ক্ষণিকভাবে হাসপাতালে ছুটে যান। মাছের কথা তিনি ভুলে যান। কয়েক দিন পর মাছের কথা মনে পড়লে তিনি গাড়ির পেছনের ডালা খুলে দেখেন মাছটি তখনো তরতাজাই রয়েছে। সামান্য কিছু নষ্ট হয়নি। ভদ্রলোক বুঝতে পারেন মাছে ফরমালিন দেওয়া আছে। তাই তিনি মাছটি না খেয়ে ফেলে দেন। আমরা প্রায়শই এমন ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছি। সবজির রং অক্ষুণ্ন রাখার জন্য সবুজ রং মেশানো হয়। এই রং মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। কয়েক বছর আগে গাড়ি থামিয়ে রাস্তার পাশ থেকে কিছু বরই কিনে আনি। বরইগুলো খুবই সুন্দর এবং মনোলোভা ছিল। কিন্তু বাসায় আনার পর আমরা বুঝতে পারি এগুলো আসল বরই নয়। রং মেশানো বরই মাত্র।

পণ্যের মাননিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) আছে। কোনো পণ্য বাজারে ছাড়ার আগে এই প্রতিষ্ঠান থেকে ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হয়। আর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রয়েছে। তারা মাঝে মাঝে বাজারে অভিযান চালিয়ে ভেজাল পণ্য বিপণনকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু লোকবল স্বল্পতা এবং অন্যান্য সীমাবদ্ধতার কারণে তারা ভেজাল প্রতিরোধে খুব একটা সফল হচ্ছে না। আজ দুর্নীতি যেমন রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থাকে গ্রাস করেছে, ঠিক তেমনি ভেজাল পুরো দেশবাসীকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। মেধাবী ও কর্মক্ষম জাতি গঠনে ভেজাল নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই। পৃথিবীর আর কোনো দেশে বাংলাদেশের মতো খাদ্যপণ্যে এত ভেজাল মেশানো হয় বলে আমাদের জানা নেই। ভেজাল খাদ্য গ্রহণ করলে একজন শিশু কখনোই মেধাবী হয়ে গড়ে উঠতে পারবে না।

ভেজাল নিয়ন্ত্রণের জন্য সবার আগে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। যাঁরা বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করেন তাঁদের বোঝাতে হবে সামান্য মুনাফার আশায় তাঁরা জাতির কতটা ক্ষতি করছেন। ভোক্তাদের তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। কোনো পণ্যে ভেজাল মেশানো হয়েছে এটা সন্দেহ হলেই সেই পণ্য কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে। দামে কম হলেও ভেজাল পণ্য ক্রয় করা যাবে না। ভেজাল প্রতিরোধে যে আইন প্রচলিত আছে তা পর্যাপ্ত নয়। সময়োপযোগী করে ভেজাল প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন করতে হবে। ভেজালকারী দেশ ও জাতির শত্রু। তাই তাদের কঠোর শাস্তি বিধান করতে হবে। বড় অপরাধীকে আইনের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা করতে হবে। ভেজালকারীকে কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া যাবে না। খাদ্য বা অন্যান্য পণ্যে যেসব ভেজাল মেশানো হয় তার ব্যবহার সীমিত করতে হবে। পণ্য ভেজালকারীর কাছে ফরমালিন বা এজাতীয় কেমিক্যাল বিক্রি বন্ধ করতে হবে।

রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে যে তারা যদি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়, তাহলে ভেজালের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বর্তমানে বাংলাদেশ একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে পরিচালিত হচ্ছে। সব কলুষতা মুছে ফেলে সুন্দরের পথে যাত্রা শুরুর এখনই শ্রেষ্ঠ সময়। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। ভেজালকারীদের কোনো ছাড় নেই। জেনেশুনে ভেজালকারীদের সঙ্গে আত্মীয়তা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ঘৃণা ছড়িয়ে দিতে হবে সমাজের সর্বত্র। বর্তমান মুক্ত পরিবেশে দেশ হোক ভেজালমুক্ত। জাতি হোক কলঙ্কমুক্তএই আমাদের অঙ্গীকার। 

 

লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত

 

মন্তব্য

জাতি ও শ্রেণির প্রশ্নে বিভক্ত সমাজ

    সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
শেয়ার
জাতি ও শ্রেণির প্রশ্নে বিভক্ত সমাজ

জাতি ও শ্রেণির প্রশ্নে উপমহাদেশে এবং বাংলাদেশেও আমরা চার ধরনের চিন্তা ও দুশ্চিন্তার তৎপরতা দেখি। প্রথমটি জাতীয়তাবাদী, দ্বিতীয়টি উদারনৈতিক, তৃতীয়টি ধর্মীয় মৌলবাদী এবং ৪ নম্বরটি সমাজতান্ত্রিক। এদের ভেতর বিরোধ আছে, কিন্তু স্বল্প সন্ধানেই ধরা পড়বে যে মস্ত মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও প্রথম তিনটি একই ধারার এবং চতুর্থটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকারের। জাতীয়তাবাদী, উদারনৈতিক ও ধর্মীয় মৌলবাদীরা একে অপরের থেকে দূরেই থাকে, মৌলবাদীরা তো অপর দুই পক্ষ থেকে খুবই দূরের, কিন্তু তবু অন্তর্গতভাবে তিন ধারাই এক ধারা এই অর্থে যে তিনটিই পুঁজিবাদে বিশ্বাসী।

পুঁজিবাদের ভেতরের খবরটি হলো সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানায় বিশ্বাস। সমাজতন্ত্র নানা রকমের হয় বলে প্রচার করা হয়ে থাকে, কিন্তু ওই মতবাদের কেন্দ্রে আছে ব্যক্তিমালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। সমাজতান্ত্রিক ধারাটি তাই অন্য তিন ধারার কেবল প্রতিপক্ষই নয়, শত্রুপক্ষও বটে। অন্যরা চায় শ্রেণিব্যবস্থাকে কোনো না কোনোভাবে রেখে দিতে, সমাজতন্ত্রীরা চায় সেটিকে ভেঙে ফেলতে।
মিলনের কোনো সুযোগই নেই।

জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন প্রকাশ ঘটে। তবে প্রধান প্রকাশ দুই রকমেরএকটি আগ্রাসনের, অপরটি আত্মরক্ষার। ব্রিটিশ ভারতে ব্রিটিশের জাতীয়তাবাদ ছিল আগ্রাসনের, লক্ষ্য ছিল লুণ্ঠন; আর যে ভারতবর্ষীয়রা ব্রিটিশকে বিতাড়িত করে স্বাধীন হতে চাইছিল, তাদের জাতীয়তাবাদটি ছিল আত্মরক্ষার।

পার্থক্যটি স্পষ্ট, কিন্তু মিলটি এখানে যে দুই পক্ষের কোনোটিই পুঁজিবাদে অবিশ্বাসী ছিল না, শত্রু-মিত্র উভয় পক্ষই ছিল পুঁজিবাদী। ব্রিটিশরা এসেছিল সম্পদ লুণ্ঠন করে নিজেদের দেশে নিয়ে যাবে এই ইচ্ছায়, এখানে তারা ছিল আগ্রাসী জাতীয়তাবাদী। আর স্বাধীনতার জন্য যে জাতীয়তাবাদীরা লড়ছিল, তারা চাইছিল দেশের সম্পদ দেশে রাখবে। তবে সে সম্পদ যে সবার সমান অধিকারে থাকবে, তা নয়। তাদের দ্বারা যে জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হবে, তাতে শ্রেণিব্যবস্থা অক্ষুণ্ন থাকবে; যার অর্থ হলো যারা ধনী, তারা সুযোগ পাবে আরো ধনী হওয়ার।
আর যারা দরিদ্র, তারা যদি দরিদ্রতর হতে থাকে। তবে সেটি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ চলবে, তবে ব্যবস্থাটিকে ভাঙা চলবে না। মূল লড়াইটি আসলে ছিল দখলদার বিদেশি পুঁজিবাদীদের সঙ্গে উঠতি দেশি পুঁজিপন্থীদের।

জাতি ও শ্রেণির প্রশ্নে বিভক্ত সমাজদেশীয় জাতীয়তাবাদীদের ভেতরে সশস্ত্র বিপ্লবীরা ছিল। বিপ্লবী তারা এই অর্থে যে অহিংস নয়, সশস্ত্র; নইলে অহিংস গান্ধীবাদীদের সঙ্গে তাদের মৌলিক কোনো বিরোধ নেই। কারণ গান্ধীবাদীদের মতো তারাও ব্যক্তিগত সম্পত্তির পবিত্রতায় আস্থা রাখত। গান্ধী নিজে বিলাসিতাকে ঘৃণা করতেন, বস্তিতে থাকতে তাঁর অসুবিধা হতো না, কিন্তু তাঁর কাঙ্ক্ষিত রামরাজ্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকবে না এমন অলক্ষুনে চিন্তাকে তিনি কখনো প্রশ্রয় দেননি। তিনি কংগ্রেসেরই নেতা। কংগ্রেসকে তিনি জনগণের কাছে নিয়ে গেছেন, কিন্তু জনগণের স্বার্থে নয়। কংগ্রেস ছিল বিত্তবানদের দল, তিনি তাদের স্বার্থই দেখতেন। শ্রমিক ও কৃষকরা রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হোক, এটিও তাঁর কাম্য ছিল না। সমাজতন্ত্রীরা তখনো প্রবল হননি, কিন্তু ওই উঠতি সমাজতন্ত্রীরাও তাঁকে প্রীত করেনি, বিরক্তই করেছে। ওদিকে সহিংস বিপ্লবীরাও সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন চায়নি, তারা সনাতন ধর্মের পুনরুজ্জীবনে বিশ্বাস করত। এই বিপ্লবীদের অনেকেই আন্দামানে নির্বাসিত হয়েছিল। ১৯৩৭ সালে মুক্তি পেয়ে তাদের কেউ কেউ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিল। তাদের কথা আলাদা। বলা যায়, তারা একটি সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিল, যে কাজটি অন্যরা করতে পারেনি।

জওয়াহেরলাল নেহরু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে একসময় তিনি প্রায় কমিউনিস্টই হয়ে যাচ্ছিলেন, হতে পারলেন না। কারণ টের পেয়ে গেলেন যে কমিউনিস্টরা যথেষ্ট ভারতীয় নয়। দেখা যাচ্ছে, জাতীয়তাবাদ কতটা প্রভাব ফেলেছিল তাঁর ওপর; আর ওই জাতীয়তাবাদের কারণেই তিনি বাপুজির সঙ্গেই রয়ে গেলেন, যে বাপুজি আবার তাঁর নিজের পাশে রাখতেন বড় শিল্পপতি ঘনশ্যামদাস বিড়লাকেও। কমিউনিস্টদের শ্রেণিসংগ্রাম বাপুজির অনুসারী নেহরুর পছন্দ হওয়ার কথা নয়। নেহরু বছরের পর বছর কারাযন্ত্রণা ভোগ করতে পেরেছেন, তাই বলে শ্রেণিচ্যুত হয়ে যাবেন এবং সামাজিক বিপ্লবের পক্ষে লড়বেনএমনটি তাঁর পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। তাঁর রাজনীতি বুর্জোয়া গণতন্ত্রীরই। তাঁর শাসনামলে কমিউনিস্টরা যে সুবিধায় ছিল তা নয়, খুব অসুবিধায়ই ছিল।

স্বাধীনতার প্রশ্নে নেহরুর তুলনায় সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন অনেক বেশি অনমনীয়। গান্ধীর নেতৃত্বকে আপসকামী মনে করে সেটিকে পরিত্যাগ করে তিনি চলে গিয়েছিলেন সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ আধিপত্যের অবসান ঘটানোর পথে। সুভাষ বসু সমাজতন্ত্রের কথা ভাবতেন এবং ভারতবর্ষের সমস্যার পথ যে সমাজতান্ত্রিক, সেটিও মানতেন। কিন্তু তিনিও জাতীয়তাবাদীই ছিলেন; নেহরুর চেয়ে কম নয়, বরং বেশিই। তাই দেখি তিনি কংগ্রেস ছেড়ে ফরওয়ার্ড ব্লক গড়ছেন ঠিকই, কিন্তু ফরওয়ার্ড ব্লক কংগ্রেসের ভেতরই থেকে যাচ্ছে। গান্ধীকে জাতির পিতা উপাধি তাঁরই দেওয়া। সে জন্য এটি অস্বাভাবিক ছিল না যে সমাজতন্ত্রকে তিনি ভারতবর্ষীয় রূপ দিতে চাইবেন। তাঁর মতে, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের সমাজতান্ত্রিক পথটিই ছিল সঠিক, মার্ক্স-এঙ্গেলসের পথের তুলনায়। অর্থাত্ সমাজতন্ত্র থাকবে আবার ব্যক্তিমালিকানারও অবসান ঘটবে না। মালিকের সঙ্গে শ্রমিকের যে বিরোধ অনিবার্য ছিল, সেখানে তাঁর প্রবণতা মালিকের দিকেই ঝোঁকার। ঝুঁকেছেন যে তার দৃষ্টান্তও রয়েছে।

এটির উল্লেখ আছে মণি সিংহের আত্মজীবনীতে। ১৯২৮ সালের কথা। মণি সিংহ তখনো কমিউনিস্ট হননি, তবে শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। কলকাতার উপকণ্ঠে মেটিয়াবুরুজে বিড়লাদের পাটকলে শ্রমিকরা ধর্মঘট করেছে। পুলিশ ও মালিকের পোষা বাহিনীর যৌথ আক্রমণে শ্রমিকরা বিধ্বস্ত। এরই মধ্যে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের এক সভা ডেকেছে; বিড়লারা যে মহত্, তাঁরা যে শ্রমিকের মা-বাবা এসব কথা বলার জন্য। মণি সিংহ তখন যুবক, বয়স ২৮; তিনি ধর্মঘটি শ্রমিকদের সঙ্গে ছিলেন। শোনা গেল মালিকপক্ষের সভায় সুভাষ বসু আসবেন, ধর্মঘটের বিরুদ্ধে বলার জন্য। শুনে মণি সিংহ ঘাবড়ে গেছেন। শ্রমিকরা তাঁকে সাহস দিয়েছে, বলেছে আপনাকে কিছু করতে হবে না, সুভাষ বসুর বক্তব্যের পর দাঁড়িয়ে শ্রমিকদের মত কী, তা জানতে চাইবেন। সুভাষ বসু ঠিকই এসেছিলেন। ধর্মঘট তুলে নেওয়ার পক্ষেই বলেছেন তিনি। শ্রমিকরা শুনেছে। শুনে চুপ হয়ে গেছে। শ্রমিক নেতারা চায়ের দোকান থেকে একটি টুল নিয়ে এসেছিল। মণি সিংহ সেটির ওপর দাঁড়িয়ে তাঁর জীবনে প্রথম এবং সংক্ষিপ্ততম বক্তব্যটি দিয়েছিলেন। ধর্মঘটের পক্ষে শ্রমিকদের শিখিয়ে দেওয়া কথা কয়টিই শুধু বলেছিলেন। এতেই কাজ হয়েছে। স্তব্ধতা ভেঙে শ্রমিকরা চিৎকার করে বলে উঠেছে, হরতাল চালু রহেগা। সভা পণ্ড হয়ে গেছে। হরতাল চালু থেকেছে। বিড়লারা সমঝোতায় এসেছেন।

সুভাষ বসু পুরোপুরি বাঙালি ছিলেন। রাজনীতিতে তাঁর প্রবেশ চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে। চিত্তরঞ্জনের চেষ্টা ছিল বাংলার রাজনীতিকে ভারতীয় রাজনীতি থেকে পৃথক রাখার; চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু অকালমৃত্যুর দরুন কাজটা খুব একটা এগোতে পারেনি। বাংলার রাজনীতি যদি ভারতের রাজনীতি থেকে আলাদা থাকতে পারত, তাহলে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের জন্য অবশ্যই সুবিধা হতো এবং কংগ্রেস যে এক জাতিতত্ত্বের সাম্প্রদায়িকতাকে পুষ্ট করার কাজটা করছিল, সে কাজে কিছুটা হলেও বিঘ্ন ঘটত। সুভাষ বসুর বাঙালিত্ব কিন্তু বাংলার রাজনীতিকে সর্বভারতীয় রাজনীতির আওতামুক্ত করার কাজে উৎসাহের সঞ্চার করতে পারেনি, তিনি রয়ে গেছেন ভারতীয় রাজনীতিতেই। ১৯৪৬-৪৭-এ তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শরত্চন্দ্র বসু সর্বভারতীয় ওই রাজনীতি যে বাংলাকে খণ্ডিত করতে তৎপর হয়ে উঠেছিল, সেটা চোখের সামনে দেখতে পেয়েছেন। বাংলার অখণ্ডতা রক্ষার জন্য তিনি আবুল হাশিম ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে যুক্ত উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কাজটায় সুভাষ বসু সময়মতো যদি হাত দিতেন, তবে সেটা উপমহাদেশের জন্য মঙ্গলজনক হতো বলেই আমাদের ধারণা।

পরাধীন ভারতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা যে জাতীয়তাবাদী রূপ নেবে, সেটা ছিল অনিবার্য; তবে জনগণের মুক্তির আন্দোলন শক্তিশালী হতো, যদি তাতে সমাজতান্ত্রিক উপাদান কার্যকর থাকত। কিন্তু জাতীয়তাবাদী সংগ্রামটা সংগঠিতরূপে শুরুই হয়েছিল সমাজ বিপ্লবের সম্ভাবনাকে ঠেকানোর জন্য। ওই সূচনাটা ঘটে ১৮৮৫ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে। উদ্যোগটা এসেছিল একজন ব্রিটিশ আইসিএস অফিসারের দিক থেকে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন উঠতি ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিনিধিরা। ব্রিটিশ শাসকরা খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিল, ১৮৫৭ সালের সিপাহি অভ্যুত্থান দেখে। তাদের দুশ্চিন্তা ছিল যে পরবর্তী কোনো অভ্যুত্থানে সাধারণ মানুষের সঙ্গে যদি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যুক্ত হয়ে যায়, তবে ফরাসি বিপ্লবের মতো ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবে। মধ্যবিত্তকে তারা তাই কাছে টেনে নিতে চেয়েছে, মধ্যবিত্তের জন্য সুযোগ করে দিতে চেয়েছে অভাব-অভিযোগের দরখাস্ত নিয়ে হাজির হতে। বলা বাহুল্য, শ্রেণিগত কারণেই এই মধ্যবিত্ত ওপরের দিকে উঠতে চেয়েছে, তারা ভীষণ ভয় পেয়েছে নিচের দিকে নামতে। তারা ইংরেজকে ভয় করত, কিন্তু আতঙ্কিত হতো সমাজ বিপ্লবের আশঙ্কায়। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সর্বভারতীয় জাতীয়তাকে প্রধান রাজনৈতিক সত্য করে তুলল। বলা বাহুল্য, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য প্রধান সমস্যাটা জাতিগত ছিল না, ছিল শ্রেণিগত; কৃষক শোষিত হচ্ছিল জমিদার ও মহাজনের হাতে, শ্রমিকদের শোষক ছিলেন পুঁজির মালিকরা, কিন্তু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি শ্রেণিবাস্তবতাকে আড়ালে ঠেলে দিয়ে জাতীয় ঐক্যকে প্রধান করে তোলে; আমরা সবাই ভাই ভাই আওয়াজের নিচে চাপা পড়ে যায় ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই-এর নিষ্ঠুর বাস্তবতা।

ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ প্রচার করল, বলল ঐক্যের কথা, কিন্তু সে ঐক্যের ভেতরে চাপা রইল না সাম্প্রদায়িকতা এবং ক্রমান্বয়ে ঐক্যের ভৌগোলিক দিকটাকে ছাপিয়ে উঠল ধর্মের দিকটা। সে ধর্ম সনাতন ধর্ম। রণধ্বনি উঠল বন্দেমাতরমের, যার ফলে নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবারের পাল্টা আওয়াজ ওঠার পটভূমিটা তৈরি হয়ে গেল। যে শাসকরা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস গঠনে উৎসাহ জুগিয়েছিল, তারাই আবার উৎসাহ দিল অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ গঠনের। চেষ্টা শুরু হলো সম্প্রদায়কে জাতিতে পরিণত করার। শুরুতে ভোট ছিল শতকরা মাত্র দুজনের; তারই মধ্যে বিভাজন দাঁড় করানো হলো হিন্দু-মুসলমানের পৃথক নির্বাচনের। পরিণামে কী ঘটেছে, সেটা তো আমরা জানি। সমাজতন্ত্রীরা সংগঠিত হচ্ছিল, তাদের আওয়াজ ছিল ইনকিলাব জিন্দাবাদ, বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। হিন্দু-মুসলমানকে তারা নিয়ে আসতে চেয়েছে বিপ্লবের পক্ষে, কিন্তু তাদের আওয়াজটা জোরদার হয়নি। কারণ ছিল। প্রধান কারণ জাতীয়তাবাদীদের গলার জোর। তারা বিত্তবান, নেতারা উচ্চশিক্ষিত, সংবাদপত্র তাদের পক্ষে। ব্রিটিশ শাসকরাও তাদের উৎসাহ দিয়েছে। উঠতি জাতীয়তাবাদীরা ব্রিটিশকে ভয় পায়, কিন্তু আরো বড় ভয় তাদের কৃষককে, কারণ জমিদারি ব্যবস্থার সুবিধাগুলো তারা ভোগ করে। তারাই আবার পেশাজীবী, ব্যবসা-বাণিজ্যও তারাই করে। এর মধ্যে কৃষক যদি খেপে ওঠে, তাহলে তো সর্বনাশ। সে জন্য শ্রেণি হিসেবে সমাজ বিপ্লবের অনুমোদন তারা তো দেয়ইনি, উল্টো যতভাবে পারা যায় ওই ধরনের বিপ্লবের বিরোধিতা করেছে। অন্য ব্যাপারে প্রবল শত্রুতা থাকলেও বিপ্লববিরোধিতার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ স্বার্থ আর ভারতীয় বিত্তবানদের স্বার্থ এক হয়ে গেছে; যেন বড় ভাই ছোট ভাইয়ের মিলন, অভিন্ন এক শত্রুর বিরুদ্ধে।

 

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ