পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় বাস্তুকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন

  • বিধান চন্দ্র দাস
শেয়ার
পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় বাস্তুকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন

উত্তর-মধ্য/পশ্চিম চীনের বিখ্যাত মালভূমির নাম লোয়েস মালভূমি। চীনা ভাষায় জায়গাটির নাম হোয়াংচু গোয়ান। এর আয়তন প্রায় সাড়ে ছয় লাখ বর্গকিলোমিটার। দূর অতীতে অরণ্য, তৃণভূমি, জলাশয়যুক্ত লোয়েস মালভূমি ছিল বাস্তুতাত্ত্বিক ভারসাম্যে পরিপূর্ণ একটি অঞ্চল।

চৈনিক সভ্যতার ইতিহাসে লোয়েস মালভূমিকে ফসলের জন্য অন্যতম উর্বর অঞ্চল বলে অভিহিত করা হয়েছে। একসময় প্রচুর ফসল হতো এই অঞ্চলে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এই মালভূমির অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। ক্রমাগতভাবে এখানকার অরণ্য, তৃণভূমি, জলাশয় তথা বাস্তুতত্ত্ব ধ্বংস করে ফসলের এলাকা বৃদ্ধি করা হয়।
ফলে পৃথিবীর অন্য অনেক জায়গার মতো এখানেও বাস্তুতাত্ত্বিক ভারসাম্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এই বিশৃঙ্খলা আরো চরম ও তীব্র আকার ধারণ করে যখন মাও জেদং তাঁর মহান উল্লম্ফন নীতির (গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড : ১৯৫৮-১৯৬২) আওতায় দেশে শিল্প ও কৃষি বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিলেন। এই কর্মসূচির আওতায় চীনের লোয়েস মালভূমির অবশিষ্ট গাছপালা উজাড় করে সেখানে সবুজ ফসলের ক্ষেত আরো বিস্তৃত করা হয়। ধারণা করা হয়েছিল যে এর দ্বারা সেখানকার ক্ষয়িষ্ণু মাটি রক্ষা করা সম্ভব হবে, কিন্তু তা হয়নি।
একসময় অবস্থা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে সেখানকার প্রতি বর্গকিলোমিটার জায়গায় বার্ষিক মাটি ক্ষয়ের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় চার হাজার টন। ফলে অঞ্চলটি পরিণত হতে থাকে এক ঊষর অনুর্বর ভূমিতে। ঘন ঘন বন্যায়ও আক্রান্ত হয় এখানকার কিছু এলাকা। এমতাবস্থায় সেখানে মহান উল্লম্ফন নীতি গ্রহণের কয়েক বছর পরে সেখানকার ব্যবস্থাপনায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে এই মালভূমিতে মানবকেন্দ্রিক ব্যবস্থাপনা থেকে কিছুটা সরে গিয়ে বাস্তুকেন্দ্রিক (ইকোসেন্ট্রিক) ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ বাস্তুতত্ত্ব পুনরুদ্ধার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে কিছু ভালো ফল লাভ করায় চলতি শতকের শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত লোয়েস মালভূমি অঞ্চলে অনেক বেশি জমিতে বাস্তুতত্ত্ব পুনরুদ্ধার কার্যক্রম অর্থাৎ বাস্তুকেন্দ্রিক ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় বাস্তুকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজনবাস্তুকেন্দ্রিক ব্যবস্থাপনা বলতে সেই ব্যবস্থাপনা বোঝায়, যে ব্যবস্থাপনায় পরিবেশের সামগ্রিক জীব ও জড় উপাদানের অন্তর্নিহিত মূল্যকে (ইনট্রিন্সিক ভ্যালু : নিজস্ব, স্বাধীন ও স্বতন্ত্র মূল্য, যা মানুষের প্রয়োজন বা উপযোগিতার ওপর নির্ভর করে না) বিবেচনায় নিয়ে তাদের স্থায়িত্বের বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এই ব্যবস্থাপনায় পরিবেশের জীব ও জড় উপাদানের যান্ত্রিক মূল্যকে (ইনস্ট্রুমেন্টাল ভ্যালু : মানুষের প্রয়োজনকেন্দ্রিক মূল্য) পেছনে রেখে তাদের অন্তর্নিহিত মূল্যকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। এর বিপরীতে যে ব্যবস্থাপনায় পরিবেশের জীব ও জড় উপাদানের শুধু যান্ত্রিক মূল্য বিবেচনায় নেওয়া হয়, সেই ব্যবস্থাপনাকে মানবকেন্দ্রিক (অ্যানথ্রোপোসেন্ট্রিক) ব্যবস্থাপনা বলা হয়। ওপরে বর্ণিত লোয়েস মালভূমির উদাহরণে সবুজ ফসলের ক্ষেত বিস্তারের যে কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছিল, সেটি ছিল মানবকেন্দ্রিক ব্যবস্থাপনা। এই ব্যবস্থাপনায় সেখানকার অসংখ্য জীব ও জড়ের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা বাস্তুতন্ত্রকে অস্বীকার করেসেখানকার শুধু অল্প কয়েকটি উদ্ভিদ (ফসল) থেকে মানুষের লাভ অর্থাৎ তাদের যান্ত্রিক মূল্যকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল। ফলে লোয়েস মালভূমির পরিবেশ উন্নত না হয়ে তার অবনতি ঘটে চলেছিল। পরবর্তী সময়ে যখন এই অঞ্চলের সামগ্রিক জীব ও জড় উপাদানের অন্তর্নিহিত মূল্যকে (ইনট্রিন্সিক ভ্যালু) বিবেচনায় নিয়ে তাদের স্থায়িত্বের জন্য কার্যক্রম (ফসলের ক্ষেতের পরিমাণ কমিয়ে বৈচিত্র্যময় বৃক্ষরোপণ, বৈচিত্র্যময় বন সৃজন, জলাশয় উদ্ধার, চারণভূমি সীমিতকরণ, দূষণ হ্রাস ইত্যাদি) পরিচালনা করা হলো, তখন এই মালভূমির সার্বিক পরিবেশ উন্নতির ধারায় ফিরে এলো। এ ধরনের ব্যবস্থাপনাকে বাস্তুকেন্দ্রিক ব্যবস্থাপনা বলা হয়ে থাকে।

শুধু লোয়েস মালভূমি নয়, পৃথিবীর অন্য কয়েকটি জায়গায়ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় বাস্তুকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে পরিবেশ পুনরুদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে বা হচ্ছে। যেমনশাহেল-সাহারা অঞ্চলে আফ্রিকান ইউনিয়নের গ্রেট গ্রিন ওয়াল ইনিশিয়েটিভ; যুক্তরাষ্ট্রের এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সির সিএডিডিআইএস (ক্যাজুয়াল আনালিসিস/ডায়াগনসিস ডিসিশন ইনফরমেশন সিস্টেম); ভুটানের বনভূমি ব্যবস্থাপনা; মাসাইমারা কনজারভেশন, কেনিয়া; ভিক্টোরিয়া লেক, পূর্ব আফ্রিকা ইত্যাদি। কিছু চ্যালেঞ্জ থেকে যাওয়া সত্ত্বেও এর কোনো কোনোটির সফলতা সন্তোষজনক বলে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় বাস্তুকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ বা তৈরি করার জন্য প্রয়োজন পরিবেশ এথিকস সম্পর্কে সম্যক ধারণা। পরিবেশ এথিকস হচ্ছে মানুষ ও তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যকার নৈতিক সম্পর্কের একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ বিবরণ। নৈতিক নিয়মই প্রাকৃতিক জগতের সঙ্গে মানুষের আচরণ পরিচালনা করতে পারে বলে পরিবেশ নীতিবিদরা মনে করেন। নৈতিক এই নিয়মগুলো কী কী, কার জন্য ও সেখানে মানুষের দায়িত্ব কী এবং সেই দায়িত্ব কিভাবে ন্যায়সংগতভাবে পালন করা যায়পরিবেশ এথিকসের তত্ত্ব সেগুলো ব্যাখ্যা করে। পরিবেশগত চরম সংকট থেকে মুক্তির জন্য আমাদের প্রয়োজন নৈতিক আচরণের পরিবর্তন। পরিবেশ এথিকস সেই সম্পর্কে সুসংবদ্ধ আলোচনা করে। পরিবেশ এথিকসের জনক প্রফেসর হোমস রলস্টন তৃতীয় (১৯৩২-২০২৫) পরিবেশ এথিকসকে একদিকে তাত্ত্বিক বিষয় আবার অন্যদিকে এটিকে ব্যাবহারিক বিষয় বলে উল্লেখ করেছেন।

পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় মানবকেন্দ্রিকতাবাদ (অ্যানথ্রোপোসেন্ট্রিজম) মানুষের জন্যই বিপদ ডেকে এনেছে। শুধু মানুষের জন্য নয়, গোটা জীবজগতের জন্যও এই দৃষ্টিভঙ্গি বিপর্যয়

সৃষ্টি করেছে। উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব থেকে শুরু করে জলাশয়, মাটি, পাহাড়, উন্মুক্ত প্রান্তর সব কিছুকে মানুষ যান্ত্রিক মূল্যে (ইনস্ট্রুমেন্টাল ভ্যালু) বিচার করতে চায়। ফলে সেগুলো যত খুশি আহরণ ও দখল করে নিজের সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি করার সর্বনাশা প্রতিযোগিতায় মানুষ লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতির এসব উপাদানের যান্ত্রিক মূল্য ছাড়াও যে তাদের অন্তর্নিহিত মূল্য (ইনট্রিন্সিক ভ্যালু) আছে, সে ব্যাপারটি খুব কম মানুষই বিবেচনা করে। মানুষের বিবেচনায় প্রকৃতির এসব উপাদানের অন্তর্নিহিত মূল্য নিতে পারলে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধার মনোভাব তৈরি হলেমানুষ প্রকৃতি বিধ্বংসী তৎপরতা থেকে সরে যাবে বলে বিশ্বাস করা হয়। পরিবেশ এথিকস মানুষকে প্রকৃতির এসব উপাদানের অন্তর্নিহিত মূল্য অনুধাবনে সাহায্য করে।

বাংলাদেশে পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় বাস্তুকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অনুপস্থিতি চোখে পড়ে। উদাহরণ হিসেবে সুন্দরবন ব্যবস্থাপনার কথা উল্লেখ করা যায়। অপ্রিয় হলেও সত্যি যে এই বন ব্যবস্থাপনায় কখনোই বাস্তুকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সেভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। সুন্দরবন ব্যবস্থাপনায় কেউ কেউ বলেন যে বাঘ বাঁচলে, সুন্দরবন বাঁচবে। বিভাময় (ক্যারিজমেটিক) প্রজাতিনির্ভর এই দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তুকেন্দ্রিক ব্যবস্থাপনা সমর্থন করে না। আমাদের বুঝতে হবে যে অসংখ্য জীব (প্রাণী, উদ্ভিদ, অণুজীব প্রজাতি) আর জড় উপাদানের পারস্পরিক জটিল ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ায় সুন্দরবন তথা ম্যানগ্রোভ বাস্তুতন্ত্র প্রবহমান। কাজেই সেখানকার একটি-দুটি কিংবা কয়েকটি প্রজাতিকে বাঁচানোর প্রচেষ্টায় গোটা সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। বাস্তবতা হচ্ছে, হাতে গোনা কয়েকটি প্রজাতি ছাড়া সুন্দরবনের অসংখ্য জীব প্রজাতির কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। এই তথ্য ছাড়া সুন্দরবনের বাস্তুকেন্দ্রিক ব্যবস্থাপনা সম্ভব নয়। আমাদের মনে রাখা দরকার, সুন্দরবন বাঁচলেই, বাঘ বাঁচবে। আর সুন্দরবন বাঁচাতে গেলে বাস্তুকেন্দ্রিক ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। শুধু সুন্দরবন নয়, প্রকৃতপক্ষে বাস্তুকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা ছাড়া বাংলাদেশের কোনো জায়গার পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় সফল হওয়া সম্ভব নয়।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের শাটল ডিপ্লোমেসি

    ড. ফরিদুল আলম
শেয়ার
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের শাটল ডিপ্লোমেসি

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ‘শাটল ডিপ্লোমেসি’ বলে একটি ধারণা প্রচলিত আছে। দুই পক্ষের মধ্যে যখন সংঘাত চলে এবং নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে এই সংঘাত নিরসনের কোনো সম্ভাবনা থাকে না কিংবা দুই পক্ষের কেউ কাউকে একবিন্দু ছাড় দিতে রাজি নয়, এমন অবস্থায় তৃতীয় এবং শক্তিশালী একটি রাষ্ট্রের প্রচেষ্টায় এই সংঘাত বন্ধের জন্য যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, সংক্ষেপে একেই শাটল ডিপ্লোমেসি বলা যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারকে শাটল ডিপ্লোমেসির উদ্যোক্তা বলা হয়। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘাত এবং পরবর্তী সময়ে একে কেন্দ্র করে আরব রাষ্ট্রগুলোর তেল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞাকে নিয়ে এক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।

সে সময়কার দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন এই সংঘাত নিরসনের উদ্যোগের কথা ভাবছিল, যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বিষয়টি আগে থেকেই অনুধাবন করে নিজে উদ্যোগী হন। তিনি সে সময়কার দ্বন্দ্বগুলো এক পাশে সরিয়ে রেখে বিদ্যমান সংকট সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে অসংখ্যবার তেল আবিব, কায়রোসহ আরব রাষ্ট্রগুলোর রাজধানী সফর করে বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যকার বার্তাগুলো আদান-প্রদান করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যার ফলে সে সময় মিসর ও ইসরায়েলের মধ্যকার ‘ক্যাম্প ডেভিড’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যদিও বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তবে সংকটের একটি আপাত সমাধানে এই উদ্যোগের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। ব্যাডমিন্টন খেলায় শাটল যেমন দ্রুত স্থান বদল করে, এই শাটল ডিপ্লোমেসিতেও মধ্যস্থতাকারী দ্রুত এক পক্ষের বার্তা অন্য পক্ষের কাছে পৌঁছে দিয়ে সংকটের ‘নিরপেক্ষ’ সমাধানে প্রয়াসী হন। তবে এখানে আবারও উল্লেখ করতে হয় যে এই মধ্যস্থতাকারীকে অবশ্যই হতে হবে একটি শক্তিশালী তৃতীয় পক্ষ।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের শাটল ডিপ্লোমেসিওপরের এই ভূমিকাটি দেওয়ার কারণ হচ্ছে বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বড় দুটি সংকটের মধ্যে একটি হচ্ছে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ এবং অপরটি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এর মধ্যে তিন বছরাধিক কাল ধরে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, ১০ লক্ষাধিক মানুষ শরণার্থী হিসেবে অন্যত্র চলে গেছে এবং অসংখ্য মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে স্থানচ্যুত হয়েছে। এরই মধ্যে শক্তিশালী রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে ইউক্রেন তার ২০ শতাংশ ভূমির দখল হারিয়েছে এবং যেকোনো সময় রাশিয়ার পক্ষ থেকে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ঝুঁকি রয়েছে। পশ্চিমাদের সুস্পষ্ট সমর্থন থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর এ নিয়ে খোদ পশ্চিমাদের মধ্যেই বিভাজিত অবস্থা তৈরি হয়েছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই যুদ্ধে সামরিক ও আর্থিকভাবে সমর্থনের জন্য তার পূর্ববর্তী বাইডেন প্রশাসনের ভুল নীতিকে দায়ী করে তাঁর প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আর কোনো ধরনের সহযোগিতা চালিয়ে যেতে অপারগতা প্রকাশের পর ইউক্রেনের বিপক্ষে রাশিয়া সুস্পষ্টভাবে বিজয়ী অবস্থানে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইউক্রেনসহ গোটা ইউরোপের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তাজনিত হুমকির বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এবং এই সংকটের একটি যৌক্তিক সমাধানের জন্য তিনি নিজ থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তাঁর এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে তিনি সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনার নিরপেক্ষ স্থান হিসেবে সৌদি আরবের রিয়াদকে বেছে নিয়েছেন এবং রাশিয়া-ইউক্রেনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিজের প্রতিনিধি পাঠিয়ে আলোচনা করছেন। কয়েক দফা এই আলোচনার এক পর্যায়ে গত ১৮ মার্চ তিনি সরাসরি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী টেলিফোনে কথা বলেন। এর ঠিক পরদিনই তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা ফোনালাপ করেন।
উভয় নেতার সঙ্গে ফোনালাপ শেষে তিনি তাঁর সন্তুষ্টি ব্যক্ত করে বলেন, ‘আলোচনা ভালোভাবেই এগোচ্ছে এবং শিগগির এই যুদ্ধবিরতি নিয়ে একটি ভালো সংবাদ আসতে যাচ্ছে।’ এর সুফল হিসেবে এরই মধ্যে রাশিয়ার তরফ থেকে ইউক্রেনের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা না চালাতে ট্রাম্পের অনুরোধে সম্মতি দিয়েছেন পুতিন। এরপর রিয়াদের পরবর্তী ধাপের আলোচনায় দুই পক্ষের মধ্যে আরো কিছু সমঝোতা হয়েছে, যা দ্রুতই একটি যুদ্ধবিরতির জোর সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।

গত ২৫ মার্চ রাশিয়ার ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে এক মাসের  জন্য (ট্রাম্প-পুতিন আলোচনার পর গত ১৮ মার্চ থেকে) ইউক্রেনের কিছু নির্দিষ্ট স্থানে যুদ্ধবিরতির কথা বলা হয়েছে, যার মধ্যে পারমাণবিক স্থাপনার বাইরেও রয়েছে তেল ও গ্যাস ক্ষেত্র, বৈদ্যুতিক স্থাপনা এবং খাদ্য মজুদ ব্যবস্থায় হামলা না করা। মোটাদাগে দুই পক্ষই একে অপরের এনার্জি ব্যবস্থাপনা ও খাদ্য মজুদ ব্যবস্থার ওপর হামলা থেকে বিরত থাকবে এবং কোনো এক পক্ষ এটি ভঙ্গ করলে অপর পক্ষও আর এটি মেনে চলতে বাধ্য নয়। এখানে উল্লেখ্য, রাশিয়ার তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে যে তারা এটি মেনে চললেও ইউক্রেন এরই মধ্যে রাশিয়ার সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে বেশ কিছু ক্যামিকাজ ড্রোন নিক্ষেপ করেছে, যা রাশিয়া ভূপাতিত করেছে। তারা বলছে, ইউক্রেনের তরফ থেকে ট্রাম্পের প্রস্তাব মেনে চলা হচ্ছে না। এর ফলে রাশিয়ার পক্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন পাল্টা হামলায় নতুন করে ইউক্রেনের কিছু বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তবে আশার কথা যে মার্কিন মধ্যস্থতায় দুই পক্ষের মধ্যে রিয়াদ আলোচনা এখনো চলমান এবং একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষরের পথে অনেকটাই ইতিবাচক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।

রাশিয়ার এ ক্ষেত্রে দাবি স্পষ্ট। ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য হওয়ার স্বপ্ন পরিত্যাগ করতে হবে, রুশ বাহিনী কর্তৃক দখলকৃত ইউক্রেনের ভূমি রাশিয়ার বলে স্বীকার করে নিতে হবে, ইউরোপীয় দেশগুলো কর্তৃক ইউক্রেনে শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে হবে এবং ২০২২ সালের বসন্তে ইস্তাম্বুল-রাশিয়া-ইউক্রেন চুক্তির বাস্তবায়ন করতে হবে। কী ছিল ইস্তাম্বুল-রাশিয়া-ইউক্রেন চুক্তিতে? ইউক্রেনের সামরিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা, সেনাবাহিনীর আকার সীমিত করা এবং ইউক্রেনে বসবাসরত রুশ ভাষাভাষীদের সুরক্ষা দেওয়া। এসব বিষয়ও আলোচনা হয়েছে ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে। এত কিছুর পর ট্রাম্পের পক্ষ থেকে আশাবাদ ব্যক্ত করার মধ্য দিয়ে এটিই স্পষ্ট যে ট্রাম্প যেকোনো শর্তেই এই যুদ্ধ বন্ধ করতে চান এবং এর মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী ইউক্রেনের বিরল খনিজ পদার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশ নিশ্চিত করতে চান। এ ক্ষেত্রেও অবশ্য নিরপেক্ষতার একটি বড় ধরনের ব্যত্যয় থেকে যায়।

আপাতদৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্র দুই পক্ষের মধ্যকার যুদ্ধ বন্ধের মধ্য দিয়ে নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হলেও কূটনৈতিক বিবেচনায় কিন্তু রাশিয়াই শতভাগ এই যুদ্ধের ফলাফল নিজেদের করে নিতে যাচ্ছে। ২০০৮ সালের বুখারেস্ট সম্মেলনে ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করে নিতে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ইউরোপীয় নেতাদের চাপ দেন। আজ ১৭ বছর পর এসে আনুষ্ঠানিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের দেওয়া চাপ থেকে সরে আসতে হচ্ছে। এটি এক বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে রাশিয়ার এক বড় ধরনের বিজয় অর্জন।

ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যকার আলোচনায় পুতিনের পক্ষ থেকে উপরোক্ত দাবিগুলো মেনে না নিলে যুদ্ধবিরতির প্রশ্নে অনীহা প্রকাশ করা হয়েছিল। দুই নেতার মধ্যে ফোনালাপের আগে এবং পরে রিয়াদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেনের প্রতিনিধিদের কয়েক দফা আলোচনার মাঝেও দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ চলছিল, যেখানে রাশিয়া একের পর এক ইউক্রেনের ওপর তাদের আক্রমণ অব্যাহত রাখছিল। এর বিপরীতে মার্কিন সমর্থন হারিয়ে ইউক্রেন ধুঁকছিল।

সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে জানানো হয়েছে যে রাশিয়া ট্রাম্পের প্রস্তাব অনুসারে কেবল ইউক্রেনের জ্বালানি স্থাপনাগুলোতে ৩০ দিনের জন্য যুদ্ধবিরতি মেনে নেবে এবং এই সময়ের মধ্যে আলোচনার ফলাফল তাদের অনুকূলে গেলে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতিতে তারা সম্মত হবে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে মনে হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার হয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র নিজ থেকেই। আর এর কারণ একটিই, দীর্ঘ মেয়াদে ইউক্রেনের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখা। তবে এর বিনিময়ে রাশিয়াকে ভবিষ্যতে ইউক্রেনের নিরাপত্তার জন্য শঙ্কা হওয়া থেকে বিরত রাখতে হলে তাদের দাবিগুলো মেনে নিতেই হবে। একই সঙ্গে এটিও ধারণা করা হচ্ছে যে দুই নেতার মধ্যে ফোনালাপে রাশিয়ার ওপর থেকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি প্রত্যাহার করা না হলেও যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে এটি প্রত্যাহারের বিষয়ে ট্রাম্পের সম্মতি থাকতে পারে। আর এমনটি হলে এটি ইউরোপের জন্যও একটি বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে।

আপাতত যুদ্ধ বন্ধ এবং একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও দীর্ঘ মেয়াদে এই যুদ্ধবিরতি চুক্তি কেবল ইউরোপ নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও স্বার্থের প্রতিকূলে যেতে পারে। একদা ১৯৯০-এর দশকে রাশিয়ার গণতান্ত্রিক উত্থানকে গ্রহণ না করে পশ্চিমা দেশগুলো নিজেদের শক্তি দিয়ে তা মোকাবেলা করার চেষ্টা করেছে, যা থেকে রাশিয়া ক্রমেই নিজেদের নিরাপত্তা উদ্বেগ থেকে আগ্রাসী হয়েছে। সময়ের ধারাবাহিকতায় পুতিনের একনায়কতান্ত্রিক নেতৃত্বে রাশিয়া কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিশ্বের শক্তির প্রতিযোগিতায় নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করেছে।

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

mfulka@yahoo.com   

 

 

 

মন্তব্য
সেলাই করা খোলা মুখ

সবার আগে জাতীয় ঐক্য

    মোফাজ্জল করিম
শেয়ার
সবার আগে জাতীয় ঐক্য

জাতীয় পর্যায়ে ছোট-বড় যেকোনো আন্দোলন বা কর্মসূচির সাফল্যের জন্য সর্বাগ্রে যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে জাতীয় ঐক্য। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ একাত্তরের আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। তখন আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, তাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ওই সময় মুষ্টিমেয় দু-একটি জনসমর্থনশূন্য রাজনৈতিক দল ব্যতীত বাকি সবাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক। তবে হ্যাঁ, যে ভয়াবহ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে তখন সারা দেশ যাচ্ছিল, তাতে হয়তো মুখ ফুটে বেশির ভাগ মানুষই স্বাধীনতার সপক্ষে কথা বলতে পারত না।

২৫ মার্চের পর পাক বাহিনী যেভাবে বাঙালি নিধন শুরু করেছিল, তাতে প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ উচ্চারণের আগে ১০ বার ভেবেচিন্তে নিজে নিজেই ওটাকে সেন্সর করতে হতো। তবে তখন যদি গোপন ব্যালটের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মতামত জরিপ করা হতো, তাহলে শতকরা ৯৮টি ভোট যে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষে পড়ত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাকি দুই ভোট ছিল পাকিদের নুন-নিমক মালাই-মাখনের উচ্ছিষ্টভোগীদের, যারা যুদ্ধের পুরো ৯ মাস মনে করত তাদের প্রভু পাকিরা জিতবে, তারা অজেয় অমর। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর যখন গণেশ উল্টে গেল, তখন গুরু সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় বলা যায় : হায়রে বিধির লেখা, হায়রে কিসমত, জহর হইয়া গেল যা ছিল শরবত।

সবার আগে জাতীয় ঐক্যস্বাধীন বাংলাদেশের গত দেড় দশকের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে পাক আমলের সঙ্গে কোথায় যেন কিছুটা হলেও মিল পাওয়া যায়। এখানেও মানুষের মনে যতই কষ্ট, যতই প্রতিবাদ জমা হোক না কেন, তা প্রকাশ করতে গেলেই ছিল বিপদ। গুম খুন ক্রসফায়ার মামলা হামলা ইত্যাদির ডেমোক্লিসের তরবারি সব সময় মাথার ওপর ঝুলত। স্বৈরাচারী শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হলেও সাহস করে কেউ প্রতিবাদ করতে পারত না।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের অভাবে কোনো আন্দোলন বা সরকারবিরোধী কর্মসূচি নিয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি।

অবশেষে এলো জুলাই চব্বিশের তারুণ্যনির্ভর আন্দোলন। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের কিছু অন্যায্য নীতিমালার বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা গড়ে তুলল ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত একটি আন্দোলন, যাকে বলা হলো কোটাবিরোধী আন্দোলন। এর পাশাপাশি সাধারণ মানুষ কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রকাশ্য সমর্থন ছাড়াই রাজপথে নামল বিপুল জনসমর্থন নিয়ে। শিক্ষার্থীরা যখন একাত্মতা ঘোষণা করে ওই নাম-গোত্রহীন মানুষের সঙ্গে এককাতারে দাঁড়াল, তখন ছাত্র-জনতার এই অভূতপূর্ব সম্মিলন শাসকগোষ্ঠীর ভিত দিল কাঁপিয়ে।

তারা ভাবল, এহিয়া-আইউব কিংবা তাঁদের পূর্বপুরুষ হিটলারের ফেলে যাওয়া বন্দুক মেরে এই গণ-আন্দোলন দমন করবে। ফলে চালাও গুলি, মারো নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা। ব্যস, ওটাই ছিল লাস্ট স্ট্র অন দ্য ক্যামেলস ব্যাক। মনে হলো ঐক্যবদ্ধ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যেন ঘৃতাহুতি পড়ল। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পর গণজাগরণ দেখল বাংলার মানুষ। এখানে পাদটীকায় আমাদের বক্তব্য হচ্ছে : সবই সম্ভব হয়েছে ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কারণে। ছাত্ররা যদি তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে একা একাই অগ্রসর হতোশুরুতে যেমনটি তারা করেছিলকিংবা জনগণ তাদের সরকারবিরোধী আন্দোলন অন্য কোনো পক্ষকে সঙ্গে না নিয়ে চালিয়ে যেত, তাহলে দ্বিতীয় স্বাধীনতা অভিধায় অভিহিত বিশাল গণজাগরণ আমরা দেখতে পেতাম না।

নিবন্ধের গোড়াতেই আমরা বলেছি, এই ভূখণ্ডে ঐক্যের সবচেয়ে বড় উদাহরণ একাত্তরে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ। শুরুতে যা ছিল রাজনৈতিক আন্দোলন, দাবিদাওয়া আদায়ের কৌশল, স্বাধীনতার জন্য মুক্তিসংগ্রামে সারা দেশের আপামর জনগণকে সম্পৃক্ত করে তা-ই রূপ নেয় এক জাতি এক দেশ বাংলাদেশ-এর স্লোগানে, তথা মুক্তিযুদ্ধে। ১৯৪৭ থেকে ২৪ বছরের লাঞ্ছনা-বঞ্চনার ইতিহাস বাঙালিকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল, পাকিদের সঙ্গে আর এক দিনও থাকা চলবে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও আমরা ছিলাম সুবিধাবঞ্চিত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। পাকিরা মুষ্টিমেয় কিছু সুবিধাভোগীকে সঙ্গে নিয়ে রীতিমতো শাসন-শোষণ করছিল পূর্ব বাংলাকে। অনেক জেল-জুলুম, হত্যা-নির্যাতন-নিপীড়নের পর একাত্তরে যখন একটি অসম যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয় বাংলার মানুষের ওপর, তখন হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, বাঙালি-পাহাড়ি, ধনী-গরিব সবাই উপলব্ধি করল, এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। এবং তা হতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে। একাত্তরে প্রকাশ্যে হয়তো সবাই মুক্তির কথা, স্বাধীনতার কথা বলতে সাহস পেত না, কিন্তু এ দেশের সব মানুষের অন্তরে স্বাধীনতার দীপশিখাটি প্রজ্বলিত ছিল। ফলে রণক্ষেত্রে অস্ত্রহাতে হয়তো যুদ্ধ করেছে দুই লক্ষ তরুণ মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতার জন্য অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিতে গেছে তারা, আর সারা দেশের ঘরে ঘরে কোটি কোটি মানুষ ছিল তাদের সপক্ষে। এমন জাতীয় ঐক্য বিদ্যমান ছিল বলেই একটি সম্পূর্ণ অসম যুদ্ধে একটি দানবীয় শক্তিকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ। সেই ঐক্য ছিল ইস্পাতকঠিন। কোনো লোভ-লালসা, কোনো প্রাপ্তির হাতছানি ফাটল ধরাতে পারেনি সেই ঐক্যে।

কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ বিজয় অর্জনের পর যে কলুষিত অধ্যায় সূচিত হলো এ দেশের ইতিহাসে, তা-ই গ্রাস করতে লাগল সব স্বর্ণোজ্জ্বল অর্জনকে। কোথায় রইল জাতীয় ঐক্য, কোথায় উবে গেল একটি নির্যাতন-নিষ্পেষণমুক্ত সাম্য-সম্প্রীতির বাংলাদেশের স্বপ্ন। ক্ষুধার্ত শ্বাপদের মতো এক শ্রেণির ক্ষমতাশালী মানুষ এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া দেশটাকে খামচে-খুবলে-কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে ছাড়ল। এই অন্যায় অবিচার নির্যাতনের মাশুল জাতিকে দীর্ঘ অর্ধশতাব্দী যাবৎ শোধ করতে হলো।

এর পরেই এলো ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টের ঘুরে দাঁড়ানোর সফল আন্দোলন। স্বল্পমেয়াদি সেই আন্দোলন সাফল্যের মুখ দেখল ছাত্র-জনতার ঐক্যের কারণে। দীর্ঘদিনের অত্যাচারী স্বৈরশাসক য পলায়তি স জীবতি’—এই আপ্তবাক্য জপতে জপতে হেলিকপ্টারে চড়ে পালালেন। এই দেশেরই এক রাজা একদা খিড়কি দুয়ার দিয়ে প্রাণ নিয়ে যেভাবে পালিয়েছিলেন সেভাবে। আর দীর্ঘদিন চেপে থাকা এই সিন্দবাদের ভূতকে নামানো সম্ভব হয়েছে ওই জাতীয় ঐক্যের কারণে। জেল-জুলুম, খুন-গুম ও আয়নাঘরের ভয়ে মুখে না বললেও ভেতরে ভেতরে কিন্তু জাতি ঐক্যবদ্ধ ছিল এমন একটি পরিণতি দেখার জন্য।

এখন সবার একটাই প্রত্যাশা, সিন্দবাদের ভূতকে তো নামানো গেল, এরপর কী? নিশ্চয়ই স্বপ্নের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরে পাওয়া, যার জন্য জাতি গত দেড় যুগ অনেক মূল্য দিয়েছে। আর সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য নানাজনের নানা মত ও পথের ঠিকানা থাকতে পারে। তবে এক জায়গায় তো সংশ্লিষ্ট সবাইকে একমত হতে হবে : যে  করে হোক একটি সুন্দর সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এবং তা যত দ্রুত সম্ভব, ততই মঙ্গল। নইলে আবার সুযোগসন্ধানীরা জল ঘোলা করে ফেলবে। এত দিনের দুঃখ-কষ্টে, ত্যাগ-তিতিক্ষায় যা কিছু অর্জন, তা যাবে হারিয়ে। শেষ কথা তাই, জাতীয় স্বার্থে চাই জাতীয় ঐক্য, যার কোনো বিকল্প নেই।

 

লেখক : সাবেক সচিব, কবি

mkarim06@yahoo.com

মন্তব্য

ফিরে দেখা উত্তাল মার্চ

    মযহারুল ইসলাম বাবলা
শেয়ার
ফিরে দেখা উত্তাল মার্চ

জালালাবাদের পাহাড়েতে রক্তে লিখেছি কত নাম, চট্টগ্রাম, বীর চট্টগ্রাম। ব্রিটিশবিরোধী লড়াই-সংগ্রামের অগ্নিযুগের বীর পুরুষ মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের বীর সন্তানরা পরাক্রমশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল ১৯৩০ সালে। দেশপ্রেমের বীরত্বপূর্ণ সেই আত্মত্যাগের নজির দেশ ও জাতির জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল বীর চট্টলা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামে থাকা সেনা-জনতা সম্মিলিতভাবে ঘটিয়েছিল প্রায় একই রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি।

১৯৩০ সালের ১৮ থেকে ২১ এপ্রিল তিন দিন চট্টগ্রাম ছিল স্বাধীন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত। চট্টগ্রামে ওই তিন দিন ব্রিটিশের পতাকার পরিবর্তে উড়েছিল স্বাধীন ভারতবর্ষের পতাকা। একইভাবে একাত্তরের ২৫ মার্চ-পরবর্তী তিন দিন হানাদার পাকিস্তানি জান্তামুক্ত ছিল চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের সর্বত্র উড়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রসংবলিত জাতীয় পতাকা।

একাত্তরের মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে পাহাড়তলীস্থ ওয়্যারলেস কলোনি, শেরশাহ কলোনি ও ফিরোজশাহ কলোনির অবাঙালিদের বাঙালিবিরোধী নির্মম তাণ্ডবে স্থানীয় বাঙালিরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা-সমর্থনে, এমনকি অস্ত্র জোগানের মাধ্যমে অবাঙালি বিহারিদের দৌরাত্ম্যের সীমা-পরিসীমা ছিল না। কৈবল্যধাম মন্দিরসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বেপরোয়া হামলা-লুণ্ঠন চালায় তারা। ২ ও ৩ মার্চ রেলওয়ে কলোনি, ওয়্যারলেস কলোনি ও শেরশাহ কলোনি এলাকায় চট্টগ্রামের সামরিক প্রশাসক কর্নেল ফাতেমির নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনারা এবং বিহারিরা যৌথভাবে বাঙালিদের আবাসে, স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে।

চট্টগ্রামে মার্চের শুরু থেকেই ঘটতে থাকে এমনই নানা অঘটন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে সেনানিবাস, ইপিআর, পুলিশ লাইনসহ দেশজুড়ে পাকিস্তানি হানাদাররা শুরু করে নারকীয় গণহত্যা। ঘুমন্ত বাঙালি সেনা, ইপিআর ও পুলিশের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। চট্টগ্রাম সেনানিবাসেও চালিয়েছিল একই কায়দায় গণহত্যা। প্রকৃতপক্ষে মার্চের শুরুতেই চট্টগ্রামে এমভি সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র নামানোকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল সর্বস্তরের ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ।

২ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত সর্বস্তরের মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধে এমভি সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করা সম্ভব হয়নি।

ফিরে দেখা উত্তাল মার্চ২৫ মার্চ রাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ঘুমন্ত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণে হতবিহ্বল বাঙালি সেনারা ঝাঁকে ঝাঁকে গুলির মুখে আত্মরক্ষার্থে ক্রলিং করে কেউ অস্ত্র নিয়ে, কেউ বা অস্ত্র ছাড়াই রাতের অন্ধকারে পশ্চিমের পাহাড়-জঙ্গল ডিঙিয়ে বহু কষ্টে মিরসরাই-সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন লোকালয়ে আশ্রয় নেন এবং স্থানীয় জনগণের কাছে ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করেন। স্থানীয় মানুষ তাঁদের আশ্রয়, খাবার ও বিশ্রামের বন্দোবস্তে পূর্ণ সহায়তা করে।

জাতীয়-প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অংশগ্রহণে তখন চট্টগ্রাম ছিল সম্পূর্ণরূপে হানাদারমুক্ত। চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানি হানাদাররা নিতে পারেনি। সেনানিবাসে অবরুদ্ধ থেকেছে। একইভাবে অবরুদ্ধ থেকেছে বিহারি অধ্যুষিত ফিরোজশাহ কলোনি, শেরশাহ কলোনি ও ওয়্যারলেস কলোনিতে বসবাসকারী অবাঙালি বিহারিরাও। কালুরঘাট বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা বিপন্ন দেশ-জাতিকে উজ্জীবিত ও নতুন পথের দিশা দিয়েছিল।

২৬ থেকে ২৮ মার্চ দুপুর পর্যন্ত সারা চট্টগ্রাম ছিল হানাদার পাকিস্তানি নিয়ন্ত্রণমুক্ত। চারদিকে চলছিল প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি। ২৮ মার্চ ঢাকা ট্রাংক রোড ধরে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে আসে বিশাল সাঁজোয়া বহর। শুভপুর ব্রিজ থেকে মিরসরাইয়ের বিভিন্ন স্থানে এবং সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া, কুমিরা, জোড়া আমতল, মাদাম বিবির হাট, ভাটিয়ারী, ফৌজদারহাট, নিউ পতেঙ্গা, পাকিস্তান বাজার, দক্ষিণ সলিমপুরের ঢাকা ট্রাংক রোডের পূর্ব ও পশ্চিম পাশের সুবিধাজনক স্থানে সেনা ও ইপিআর জওয়ানরা প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন। বিশাল সাঁজোয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্র কয়েক ঘণ্টার বেশি তাঁরা টিকতে পারেননি, পারা সম্ভবও ছিল না। হানাদার বাহিনী যেসব স্থানে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে, সেসব এলাকা নির্বিচারে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছিল। প্রতিরোধ যুদ্ধের বাধা অতিক্রম করে কুমিল্লা থেকে আসা সাঁজোয়া যানগুলো সন্ধ্যার আগেই চট্টগ্রাম শহরে ঢুকে পড়ে এবং ওই দিনই তিন দিনের পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত স্বাধীন চট্টগ্রামের পতন ঘটে।

পাকিস্তানি হানাদারদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় স্বাধীন চট্টগ্রাম। ভীতসন্ত্রস্ত শহরের মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে সমুদ্রের তীর-গ্রামের মেঠোপথ ধরে হেঁটে আত্মরক্ষার্থে শহর ছেড়ে শহরতলি ও গ্রাম অভিমুখে কাফেলার মতো ছুটে আসে। গ্রামগুলো অপরিচিত লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন যে যার সাধ্যানুযায়ী তাদের সাহায্য-সহযোগিতাসহ আশ্রয় প্রদান করে। সে বছর টমেটো ও কহির মাত্রাতিরিক্ত ফলনের কারণে মানুষের প্রাণ রক্ষা সহজ হয়েছিল। ভাতের সঙ্গে টমেটোর ঝোল এবং কহির ভাজি-নিরামিষ দুর্গত মানুষের খাদ্যতালিকায় ছিল একমাত্র বস্তু। চট্টগ্রাম শহরের নিয়ন্ত্রণের পরই হানাদার বাহিনী নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। পথঘাট, পাকিস্তানি বিরোধীদের এবং সংখ্যালঘুদের খুঁজে খুঁজে চিনিয়ে দেওয়ার ঘৃণিত কাজে যুক্ত হয় মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম দলের নানা স্তরের নেতাকর্মীসহ বিহারিদের একটি বড় অংশ। বাঙালি কারো জীবনই নিরাপদ ছিল না। নির্মম হত্যাযজ্ঞে কত মানুষের প্রাণ গেছে সেই সংখ্যা নিরূপণ আজও সম্ভব হয়নি এবং হওয়ারও নয়।

চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক সেনার কাছে জেনেছিলাম, ২৫ মার্চ দিনে তাঁদের দীর্ঘ সময় মাত্রাতিরিক্ত পিটি, প্যারেড করানো হয়। অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রমে এমনিতেই তাঁরা ছিলেন ক্লান্ত এবং বিছানায় গিয়েই ঘুমিয়ে পড়েন। সেই সুযোগে ঘুমিয়ে থাকা বাঙালি সেনাদের হানাদাররা ব্রাশফায়ারে, ট্যাংকের গোলা নিক্ষেপে হত্যা করে এবং অনেকে গুলির শব্দে দিশাহারা হয়ে এদিক-সেদিক ছোটাছুটিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। তিনি নিজে এবং অনেকে ক্রলিং করে বহু কষ্টে সেনানিবাস ছেড়ে রাতের অন্ধকারে পাহাড়-জঙ্গল অতিক্রম করে এখানে এসেছেন।

পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতির আশঙ্কা সবাই করছিল। সেই সেনা সদস্য নিজেও বুঝেছিলেন। বেশ কয়েকজন সেনা আমাদের ফৌজদারহাটের বাড়িতে সেদিন আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিতে তাঁরা ২৮ তারিখ সকালে সেই যে চলে গিয়েছিলেন আর ফেরেননি।

 

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

মন্তব্য

স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও দেশ নির্মাণের খোঁজ

    শায়রুল কবির খান
শেয়ার
স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও দেশ নির্মাণের খোঁজ

দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। দেশটির প্রধান সত্তা গণতন্ত্রএই গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। লাখো শহীদের রক্ত ও মা-বোনের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অর্জিত হয়েছিল, তা স্বাধীনতার উষালগ্নেই তার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে।

তবে স্বাধীনতার হিরণ্ময় ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর-উত্তম পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্রের নেতৃত্বে আসার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হতে শুরু করে।

তিনি একদলীয় শাসনের অবসান ঘটিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেন। মাত্র সাড়ে চার বছরের মাথায় বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ির বদনাম গুছিয়ে আধুনিক স্বনির্ভর রাষ্ট্র হিসেবে সামনে আসে।

আমাদের কাছে একাত্তর শুধু মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলন ও সংগ্রাম নয়, আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়এটি আমাদের জাতীয় সত্তার কেন্দ্রবিন্দু। দেশের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা এবং দেশপ্রেমের চেয়ে বড় প্রেম হতে পারে না।

কিন্তু আজ ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও একাত্তর নিয়ে দেশ এক অমোঘ বাস্তবতার মুখোমুখি। কতটা অপরিপক্বতা থাকলে কেউ কেউ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের তুল্য করে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ বলতে পারেন!

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত আওয়ামী ফ্যাসিবাদ স্বাধীনতার সেই আকাঙ্ক্ষাকে চেতনার নামে লুণ্ঠিত করে জাতির সঙ্গে প্রতারণা করেছে। একই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ব্যক্তি স্বার্থপরতাও। এর রেশ ধরে সৃষ্টি হয় দলীয় বিভক্তি, যার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় সামাজিক বিভক্তি।

ছিল ক্ষমতার অপব্যবহার ও লাগামহীন লুটপাট। এ নিয়ে আলোচনা বা বিতর্কের চেয়ে অতীতকে হাতের তালুয় রেখে গণতন্ত্র উত্তরণে সবার ঐক্য ও একনিষ্ঠ লক্ষ্য স্থির করার বাইরে কোনো বিকল্প নেই।

যে কারণে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর-উত্তমের দেখানো পথ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ দর্শন এবং ১৯ দফা কর্মসূচিই আমাদের সামনে অন্যতম প্রধান মুক্তির উপায়, যার ওপর ভিত্তি করে গণতন্ত্রের মাতা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ভিশন ২০৩০ ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৩১ দফা রূপরেখা বাস্তবায়নই হবে প্রধান পদক্ষেপ।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুধু অস্ত্রের লড়াই ছিল না। এটি ছিল আমাদের জাতীয় পরিচয়, ভাষা এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের জন্য লড়াই।

একজন কৃষক, একজন ছাত্র, একজন গৃহিণী, প্রত্যেকেই এ যুদ্ধে ভূমিকা রেখেছিলেন। দেশমাতৃকার জন্য এই ত্যাগ কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়, বরং সমষ্টিগত মুক্তির লক্ষ্যে ছিল।

বর্তমান প্রজন্মের সামনে একাত্তরের আকাঙ্ক্ষাকে চেতনার নামে ইতিহাসের পাতায় শুধু স্মৃতিসৌধ এবং তাদের দলীয় ও পারিবারিক কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ করেছিল আওয়ামী ফ্যাসিবাদ। তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল একটি শোষণমুক্ত, উন্নত ও সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ক্ষমতার স্বার্থ রক্ষা করে চলা। কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষরা কল্পনা করেছিলেন এমন একটি বাংলাদেশ, যেখানে মানুষে-মানুষে বৈষম্য থাকবে না, যেখানে স্বাধীনতার সুফল সবার কাছে পৌঁছাবে। তৈরি হবে সাম্য, মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ।

মুক্তিযুদ্ধের আকাঙক্ষা ও স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে রাজনৈতিকভাবে যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ, তার মধ্যে অন্যতম হলো মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষাকে চেতনার নামে বিকৃত করে প্রথাগত স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা। একাত্তরের প্রত্যাশাকে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে। এই বিভ্রান্তিকর প্রক্রিয়া দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বস্তুত স্বাধীনতার অর্জন ধরে রাখা এবং সঠিক পথে পরিচালিত করা এখন ততটাই চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের জন্য।

 দলীয় স্বার্থের ফ্যাসিবাদী প্রবণতা শুধু রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নয়, এটি সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে দেশের সম্পদ অপব্যবহারের নজির প্রতিনিয়তই বাড়ছে। অথচ একাত্তরের আকাঙ্ক্ষা ছিল এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এটি ছিল ঐক্যের, ত্যাগের এবং সাধারণ মানুষের অধিকারের। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে একাত্তরের গল্প শুধু আমাদের অতীত নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে একাত্তরের আকাঙ্ক্ষাকে জাগ্রত করা আজ অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তরুণরা এই আকাঙ্ক্ষা কিভাবে ধারণ করবে? 

স্বাধীনতার ইতিহাসকে রাজনৈতিক মতাদর্শের আলোকে না দেখে এই বিভাজনকে দূর করতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং পরিবারকেন্দ্রিক শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। একাত্তরের সত্য ঘটনাগুলো তুলে ধরে তাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। শুধু ইতিহাস জানালেই কি হবে? তরুণদের মধ্যে ত্যাগ, দায়িত্ববোধ এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের চেতনাও গড়ে উঠতে হবে। কেবল বই পড়ে বা বক্তৃতা শুনে নয়, তরুণদের বাস্তব জীবনে এসব মূল্যবোধের চর্চার ক্ষেত্র তৈরি করে দেবেন জাতীয় নেতারা। দেশ পরিচালনার প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করতে পারলে এই তরুণ প্রজন্ম গঠনমূলক লক্ষ্য নিয়ে গড়ে উঠবে এবং গোড়ায় যা ছিল, তা হয়তো কিছুটা হলেও খুঁজে নিতে সক্ষম হবে আজকের ও আগামীর প্রজন্ম।

লেখক : রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ