সামাজিক গণমাধ্যম

  • হানিফ সংকেত
শেয়ার
সামাজিক গণমাধ্যম
অঙ্কন : আমজাদ হোসেন মানিক

একসময় টেলিভিশন যন্ত্রটির প্রতি মানুষের প্রচণ্ড আকর্ষণ ছিল। কারণ একসময় এই যন্ত্রটি ছিল অত্যন্ত ক্ষমতাবান। বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে এর প্রভাব ছিল ভয়ংকর। গণমানুষের চেয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনের মানুষ এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের কাছে এর কদর ও আদর ছিল বেশি; বিশেষ করে যাদের চেহারা দেখে বোঝা যায় না কে সোজা কে সরল, কে কঠিন-কে গরল।

আমাদের সমাজে একেকজন মানুষ একেক উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে। কারো উদ্দেশ্য সুন্দরভাবে, সত্ভাবে জীবন যাপন করা, ছেলেমেয়ে মানুষ করা। আর কারো কারো উদ্দেশ্য সংসারের পাশাপাশি গাড়ি-বাড়ি করা। আর কারো বা দেশে-বিদেশে সামাজিক গণমাধ্যমবাড়ি আর কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা করা, যার সীমা শত নয়, হাজার পেরিয়ে কয়েক হাজার কোটি।
এসব অর্থ অসৎ উপায়ে অর্জিত, দুর্নীতির মাধ্যমে প্রাপ্ত। আর যারা এসব করেছে, তাদের আগে না চিনলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সবারই মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। সবাইকেই এখন চেনা যায়, অনেকেই এই চুরির দায় নিয়ে জেলে যায়। একসময় অফিস-আদালতে দুর্নীতি দেখলে বলতাম ‘পুকুর চুরি’, এখন দেখছি পুকুর নয়, সাগরও নয়; এ যেন ‘মহাসাগর চুরি’।

এসব খবরই জানা যায় টেলিভিশন বা মিডিয়ার কল্যাণে। এখন দেশে মিডিয়ার জোয়ার চলছে। অগণন গণমাধ্যম। নেটনির্ভর মাধ্যমগুলো এখন বেশি সোচ্চার। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর চেহারায় বেশ পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে।

অভ্যুত্থানের আগের চেহারা আর এখনকার চেহারার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। তখন ছিল তৎকালীন সরকারকে খুশি করার প্রতিযোগিতা আর এখন এই সরকার এবং অভ্যুত্থানের সঙ্গে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র-জনতাকে খুশি করার প্রতিযোগিতা। নানা ব্যক্তির নানা অপকর্ম উদঘাটনে তৎপর। কিন্তু এই কাজগুলোই যদি তখন করত তাহলে দেশের অর্থনীতির অবস্থা এত খারাপ হতো না। শোনা যায়, কেউ কেউ নাকি লক্ষ কোটি টাকাও পাচার করেছে। অনলাইনে এখন এসব সংবাদের ছড়াছড়ি। পড়ার জন্য হুড়াহুড়ি। তাজা খবর যেমন আছে, মজার খবরও তেমনি আছে। আছে সুনীতির খবর এবং দুর্নীতির খবর। নিজেরা সত্যবাদী ও নিরপেক্ষতার দাবিদার অনেক ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার দিকে তাকালে কষ্ট হয়। কারণ এরা অনেক খবর জেনেও জানায়নি।

আগে অনেকেই বলতেন, পত্রিকার কলাম লেখক বা চ্যানেলের টক শোর টকারদের দেখলেই বোঝা যায় কে কী লিখবেন আর কে কী বলবেন। আবার টক শোগুলোতে উপস্থাপক আলোচনার জন্য যে বিষয়ই নির্ধারণ করুক, বক্তাকে দেখলেই বোঝা যায় তিনি নির্ধারিত বিষয়ে কী বলবেন, কোন দিকে যাবেন। আর রাজনীতির আলাপ হলে তো কথাই নেই। যে যার পক্ষ নিয়ে ভাঙা রেকর্ড বাজাতেই থাকে। বলা বাহুল্য, এরা সবাই নাকি সত্য বলে। তাদের এসব তথ্যে কী সত্য, আর কী অসত্য তা দর্শকরা বোঝেন। কারণ তাঁরা সবকিছুরই সাক্ষী। সুতরাং এ নিয়ে বলে লাভ নেই। লেখার বেলায়ও ঠিক তা-ই। গণমাধ্যমে এইসব লেখা ও বলার ক্ষেত্রেও চাটুকারের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরা ক্ষণে ক্ষণে চরিত্র বদলাতে অভ্যস্ত। শুধু বক্তা বা লেখকের চরিত্রই নয়, এখন নাকি চ্যানেলের নাম শুনলেই বোঝা যায় কোন চ্যানেল কী বলবে। তবে সময়ের পরিবর্তনে অনেক টক শোর উপস্থাপকের প্রশ্নের ধরন, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এবং নিজের মতের অমত হলে বক্তাকে ধমক দেওয়ার পরিবর্তে বিনয়ের সুর পরিলক্ষিত হয়। এসব চিত্র দেখে অভ্যস্ত দর্শকরাও এদের প্রতি বিশ্বাস হারাচ্ছে। গণমাধ্যম হারাচ্ছে আস্থা। চ্যানেলগুলোতে দর্শকদের প্রত্যাশিত প্রত্যাশার প্রাপ্তি কতটুকু তা আমরা খতিয়ে দেখি না। অর্থাৎ দর্শকরা কী চান আর কী পান সেটা বুঝি না। আর বোঝার চেষ্টাও করি না। ফলে নির্দিষ্ট একটা ফরম্যাটে চলছে চ্যানেলের অনুষ্ঠানমালা, যা অনেক সময় শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। মানের প্রশ্ন তুললেও কিছু কিছু চ্যানেলে কোন মানদণ্ডে মানহীন অনুষ্ঠান চলে তা-ও অনুমান করা কঠিন। কিছুদিন তো নানা নামের প্রতিযোগিতার প্রতিযোগিতা চলেছে চ্যানেলে চ্যানেলে। দেখে মনে হয়েছে, নতুন নতুন প্রতিভায় ভরপুর হয়ে যাবে পুরো মিডিয়া। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। এতগুলো চ্যানেলের সিরিজ প্রতিযোগিতায় দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কাঙ্ক্ষিত মানের কোনো শিল্পী পাওয়া যায়নি। আলোচনা অনুষ্ঠানের কথা না হয় বাদই দিলাম। গান-বাজনার কথাই বা কী বলব। একসময় নাচ-গান ছিল টেলিভিশনের প্রাণ। কিন্তু পরে গান যখন মধ্যরাতে চ্যানেলগুলোর প্রধান সংগীতানুষ্ঠান হয়ে উঠল, সরাসরির ছড়াছড়ি শুরু হয়ে গেল, তখন থেকেই কমতে শুরু করল গানের মান ও গানের প্রতি দর্শকদের আকর্ষণ। অনেকেরই ধারণা ছিল, নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে বোধ হয় এসব গান খুবই জনপ্রিয়তা পাবে। চ্যানেল হিট হবে। কিন্তু তা কি হয়েছে? আসলে আজকালকার ছেলেমেয়েরা এখন হিন্দি গানও কম শোনে। এসব গান এখন গায়েহলুদ, বিয়ের অনুষ্ঠানে স্থান করে নিয়েছে। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এখন শোনে বিশ্বখ্যাত কোরিয়ান কে পপ-এর গান। অর্থাৎ দক্ষিণ কোরিয়ার পপ ঘরানার মিউজিক। শুধু বাংলাদেশেই নয়, দুনিয়াজোড়া জনপ্রিয় এই কে পপ। ভক্তরা শুধু তাদের গানই নয়, এই ব্যান্ডতারকাদের বিভিন্ন ছবি, ব্যবহৃত জিনিসপত্রের শোপিস, শার্ট, টি-শার্ট, অ্যালবামসহ নানা জিনিস সংগ্রহ করে থাকে। আমাদের দেশে অবশ্য এখন মধ্যরাত থেকে ভোররাত পর্যন্ত টানা গানের এইসব লাইভ শো কিছুটা কমেছে। এখন শুরু হয়েছে ইউটিউবে ‘গান ভাইরাল প্রতিযোগিতা’। কিন্তু শুধু ভিউ বা ভাইরাল হলেই যে শিল্পী জনপ্রিয় হয় না, কিংবা তাদের গান বেশিদিন টেকে না তার ভূরি ভূরি প্রমাণ আমরা অনেক ‘ভাইরাল’ গানেই পেয়েছি। বিষয়টি অনেকটা ঝড়ের মতো, ঘূর্ণি দিয়ে এলো আর গেল—থাকল না। টেবিল চাপড়ে গান গেয়েও অনেকে ভাইরাল হয়েছে। পরে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। গানের এই অবস্থা দেখে এক শ্রেণির শিল্পী এখন লাখ লাখ টাকা খরচ করে মিউজিক ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবসহ বিভিন্ন চ্যানেলে ছাড়ছেন। প্রচুর ভিউ হচ্ছে। কিন্তু ইউটিউবে গান থাকলেও সব গান অন্তরে থাকছে না। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ভাইরাল বা কোটি ভিউয়ের গান কেন দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে? কেন দর্শকদের মনে স্থায়ী আসন করে নিতে পারছে না? আমার অনুষ্ঠানের অনেক গান দর্শক পছন্দের শীর্ষে থাকে। আমি সেটাকে বলি গানটা ছড়িয়ে যায়। কখনো ‘ভাইরাল’ বলি না। কারণ ‘ভাইরাল’ শব্দটি আমার অপছন্দের। ভাইরাল কোনো মানদণ্ড নয়। আজকাল অনেক অশ্লীল বিষয় ও অশ্রাব্য কথার গান, দৃশ্য তথাকথিত এই ‘ভাইরাল’ হয়। আমরা সেই সারিতে যেতে চাই না। এ ব্যাপারে খ্যাতিমান গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান তাঁর ফেসবুকে বেশ আক্ষেপের সঙ্গে লিখেছেন, “মাঝে মাঝে মনে হয়, বাংলাদেশের তথাকথিত ‘হিট’ গানগুলো নিয়ে একটা বিশ্লেষণমূলক বই লিখি। তাতে ভুল শব্দ, শব্দ ব্যবহারের ভুল, অর্থহীন শব্দ, বাক্য গঠনের ভুল, অসমাপ্ত বাক্য, ক্রিয়ার অপব্যবহার, ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ড পারসনে সম্বোধনের গোঁজামিল, বিশেষ্য-বিশেষণের তালগোল পাকিয়ে ফেলা, ছন্দ ও অন্ত্যমিলের ধারণাহীনতা,   উপমা-রূপকের ভুল প্রয়োগ, রুচিহীন শব্দ ব্যবহার এবং সম্পূর্ণটা মিলে অর্থহীনতা নিয়ে আলোচনা থাকবে।” পরিশেষে তিনি লিখেছেন, ‘এত বিশাল পরিমাণ বাজে কিছু ঘাঁটা হয়তো আমার আয়ুষ্কালে কুলাবে না।’ এ থেকেই বোঝা যায়, গান-বাজনার অবস্থা এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

শুধু সংগীতই নয়, নাটক-সিনেমার কথাই ধরি না কেন। বলতে গেলে দর্শকরা এখন টেলিভিশনে অনুষ্ঠান দেখা ছেড়েই দিয়েছেন। বেশির ভাগই ইউটিউবনির্ভর। এর দুটি কারণ। এক. কর্মব্যস্ততার কারণে কোনো বেঁধে দেওয়া সময়ে অনুষ্ঠান দেখতে দর্শকরা ইচ্ছুক নন। দুই. সময় থাকলেও অনেক নাটক সপরিবারে দেখার মতো নয়। কারণ নাটক থেকে এখন পারিবারিক পরিবেশ পরিত্যক্ত হয়েছে। কোন নাটকে কোন সংলাপ বা কোন দৃশ্য সন্তানের সামনে মা-বাবাকে কিংবা মা-বাবার সামনে সন্তানকে বিব্রত করবে কে জানে? তাই রিমোট টিপে দর্শকদের এই অন্যত্র বিচরণ। ওয়েব সিরিজের অবস্থাও এমনই ভয়াবহ। কোনো পারিবারিক বা সমাজসংস্কারমূলক ওয়েব ফিল্ম নেই বললেই চলে। খুন, হত্যা, লাশ, কারাগার, অশ্লীলতা, গুম, ভৌতিক বিষয়—এসবই ওয়েব ফিল্মের মূল বিষয়। যা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। সিনেমার অবস্থাও করুণ। সিনেমার সংখ্যা কমতে কমতে এমন পর্যায়ে এসেছে যে কেউ নতুন নতুন সিনেমা বানানোর ঘোষণা দিলেও দর্শকদের তেমন প্রতিক্রিয়া হয় না। তবে অনেকের জন্য আনন্দের সংবাদ হচ্ছে, এখন সিনেমায় অভিনয় করতে পারলেই পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। কারণ এখন যে হারে সিনেমা কমতে শুরু করছে, তাতে ভবিষ্যতে সিনেমায় অভিনয়ের জন্য পুরস্কার দেওয়ার শিল্পী খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনাও কম। তা ছাড়া ইদানীং বেশির ভাগ সিনেমাই সব শ্রেণির দর্শকরা দেখতে পারেন না। কারণ সাধারণ মানুষের মাল্টিপ্লেক্স বা সিনেপ্লেক্সে গিয়ে সিনেমা দেখার সামর্থ্য নেই। এখন অনেক সিনেমা বানানো হয় পুরস্কারের জন্য। কে দেখল, কে দেখল না তাতে কিছু যায়-আসে না। সিনেমার বাজেটও থাকে সে রকম। চ্যানেলে ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হলেই হলো। তবে ছবি সম্পর্কে প্রচলিত অভিযোগটি এখনো রয়েছে, হলে গিয়ে সপরিবারে ছবি দেখা যায় না। আর ‘হলসংকট’ তো রয়েছেই। রয়েছে অর্থসংকটও। সব মিলিয়ে বিনোদনজগতের করুণ অবস্থা। এরপর আবার গত কয়েক বছরে আমরা হারিয়েছি অনেক গুণী শিল্পীকে, যাঁদের অভাব কখনোই পূরণ হওয়ার নয়। তাই বিনোদনজগতে শিল্পীশূন্যতা বাড়ছেই।

আমরা একটি কথা জানি, হুজুগে বাঙালি। ইদানীং আবার কিছু কিছু মিডিয়া হুজুগে চলে। তাদের বলা হয় হুজুগে মিডিয়া। নতুন কোনো খবর পেলে একেকটি মিডিয়া সেটাকে একেকভাবে দেখায় এবং ছাপায়। ইন্টারনেট আসার কারণে অনলাইনে এখন লেখার সঙ্গে দেখাও যায়। এসব ভিডিও যাঁরা ধারণ করেন, অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা পেশাদার নয়। তাই বুঝতে পারেন না কোন দৃশ্য প্রচারযোগ্য কিংবা কোনটি অযোগ্য। তাই তাঁদের মাধ্যমে যখন কারো চিত্র ধারণ করা হয় এবং অনলাইনে ছেড়ে দেওয়া হয়, তখন তিনি বিব্রত হন। কণ্ঠশিল্পী আকবরের কথাই ধরা যাক। হাসপাতালে অসুস্থ অবস্থায় তাঁর খালি গায়ে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, যা ছিল দৃষ্টিকটু।

এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রসঙ্গ, যাকে অসামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বললেও অত্যুক্তি হবে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি শক্তি আছে। অনেক সময় মূলধারার গণমাধ্যমের আগেই সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অনেক তথ্যের সাহায্যে গণমাধ্যমে খবর বের হয়। এমন বহু খবর আমরা দেখেছিও। ফেসবুক বা সামাজিক মাধ্যম আপনাকে দ্রুত তারকা বানাতে পারে। এই মাধ্যম যেমন আমাদের পারস্পরিক যোগাযোগকে সহজ করেছে, তেমনি অনেকের কান্নারও কারণ হয়েছে। গুণীজনদের অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে মৃত্যুসংবাদ প্রচার করে ভাইরাল হতে চেষ্টা করেছে। এটাকে ‘ভাইরাল’ না বলে ‘ভাইরাল প্রতারণা’ বলাই শ্রেয়। গত বছর প্রয়াত কয়েকজন গুণী মানুষ—এন্ড্রু কিশোর, আবদুল কাদের, এ টি এম শামসুজ্জামানসহ অনেক খ্যাতিমান শিল্পীর অসুস্থতার সময় কিছু মানুষ নামের অমানুষ তাঁদের জীবিত অবস্থায়ই ফেসবুকে মৃত্যুসংবাদের গুজব রটিয়ে বিকৃত আনন্দ উপভোগ করেছে, আর এই মানুষগুলোর পরিবার ও স্বজনরা দেশে-বিদেশে অঝোরে কেঁদেছেন। এসব মিথ্যা তথ্য বা খবর মানুষকে যেমন কষ্ট দেয়, তেমনি মিথ্যা তথ্য, ভুল তথ্য, গুজব সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। যেকোনো পোস্ট বা খবরে লাইক, শেয়ার, কমেন্টের চাহিদা থাকতেই পারে, কিন্তু অবশ্যই তা যেন ভুল বা ভুয়া তথ্যনির্ভর না হয়।

আসলে আমাদের দেশে আগে সীমিতসংখ্যক পত্রিকা ও রেডিও-টেলিভিশন ছিল। এখন শুধু টেলিভিশন চ্যানেলই না, রয়েছে অগণিত সামাজিক গণমাধ্যম। ইন্টারনেটের কারণে এখন হাতে হাতে মোবাইল। আর মোবাইল মানেই প্রতি হাতে একটি চ্যানেল। সুতরাং যে যাঁর মতো বলে যাচ্ছেন। যেখানে তথ্যের সত্য-অসত্য নির্ধারণের কোনো উপায় নেই। তাই এসব ব্যাপারে প্রয়োজন আরো বেশি দায়িত্ববোধ ও সচেতনতা—অনলাইনে, অফলাইনে—সব লাইনে। সঙ্গে এখন ফেসবুক, ইউটিউবসহ নানা সামাজিক মাধ্যমের কারণে টেলিভিশন যন্ত্রটি ধীরে ধীরে তার জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। এখন টিভির চেয়ে অনলাইনের গুরুত্ব বেশি। আগে বিভিন্ন চ্যানেলে বেশ উচ্চমূল্যে নাটক কেনা হতো। চ্যানেলে প্রচারের পর ইউটিউবে প্রচারিত হতো। এখন বিষয়টি উল্টো। এখন ইউটিউবে প্রচারের জন্যই মূলত বেশি নাটক নির্মাণ করা হয়। সেটাকে টিভিতে শুধু একবার প্রচারের জন্য অল্প টাকার বিনিময়ে স্বত্ব দেওয়া হয়। মূল স্বত্ব থাকে প্রযোজক বা নির্মাতার।

কারণ এখন ইউটিউবের ভিউয়ের ওপরে নির্ধারিত হয় নাটকের মূল্যমান। যেসব তারকার বা নির্মাতার নাটকের ভিউ বেশি তার চাহিদা তত বেশি। এই ভিউয়ের ওপর নির্ভর করে শিল্পী-নির্মাতার বাজারমূল্য। এসব ক্ষেত্রে বিষয় কিংবা নাটকের মান সব সময় গুরুত্ব বহন করে না। ভালো বিষয়ের পরিচ্ছন্ন বক্তব্যধর্মী নাটকও যেমন ভিউ হয়, তেমনি অত্যন্ত নিম্নমানের অশোভন দৃশ্য ও অশ্লীল সংলাপনির্ভর নাটকও বেশি ভিউ হয়। আর বেশি ভিউ মানেই বেশি আয়, যেটা টেলিভিশনে অর্থাৎ চ্যানেলে পাওয়া যায় না। সেখানে প্রতিটি নাটক বাবদ কর্তৃপক্ষ নির্মাতাভেদে বিশেষ মূল্য নির্ধারণ করেন। নাটক ভালো হোক বা খারাপ হোক, এতে মূল্যের হেরফের হয় না। কিন্তু অনলাইনে নাটক যদি বেশি ভিউ হয়, তখন সেটি চলে যায় ট্রেন্ডিংয়ে আর উঠতে থাকে ডলারের মিটার। টিভিতে যে নাটক কেনা হতো তিন-চার লাখ টাকায়, সেই নাটক ভিউয়ের কারণে ১৪-১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করে।

শুধু নাটক, সিনেমা বা ওয়েব সিরিজই নয়, এখন টক শো থেকে শুরু করে ট্রাভেল শো, রান্নার অনুষ্ঠান, গানের অনুষ্ঠান, কমেডি অনুষ্ঠান, সংগীত প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে নানা ধরনের অনুষ্ঠান হচ্ছে। অনেকে ইউটিউব টেলিভিশনও খুলে বসেছেন। কেউ কেউ একা একাই কথা বলছেন। কথার মান বিচারে অনেকেরই মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ হচ্ছে। অর্থাৎ সামাজিক মাধ্যমে ভিউ যত বাড়ছে, টেলিভিশনের ভিউ তত কমছে। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো একসময় কেউ টেলিভিশনই দেখবে না। নির্ভরশীল হয়ে পড়বে অনলাইন মাধ্যমে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে যাবে সামাজিক গণমাধ্যম। নতুন নামে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে এই সামাজিক গণমাধ্যম।

 

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

শীত বিকেল

    শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
শেয়ার
শীত বিকেল
অঙ্কন : বিপ্লব চক্রবর্ত্তী

বাইরে কা কা করছে একটা কাক। নাজুকে শোনাতে পারলে খুশি হতো। সেদিন বলছিল, ‘ভোরে এখন আর কাকের ডাক শুনি না। কাক কি হারিয়ে যাচ্ছে? কাকের শহর ঢাকায় সাতসকালে একটা কাক ডাকবে না—এ কেমন কথা!’

কাক নিয়ে অবশ্য মাথাব্যথা নেই মাশুকের।

যে শহরে তার নিজেরই ঠিকানার ঠিক নেই, সেখানে আবার কাক!

মাশুকের ভাবনায় বাদ সাধে এক খদ্দের। দিনের প্রথম কাস্টমার।

‘অরিজিনাল লেদার শু আছে?’

প্রশ্নটা বিরক্তিকর! সমিতির মার্কেটে এসেছে লেদার শু কিনতে? মাশুক কুশলী জবাব দেয়, ‘পিওর লেদার পাবেন না, মিক্সড হবে। তবে এগুলা লেদারের চেয়ে কম না।

‘দেখান তো ভাই।’

র্যাক ভর্তি বিভিন্ন ধরনের জুতা সাজানো। এক দিকে আঙুল তুলে মাশুক বলল, ‘ওইখানে নতুন কিছু শু আছে। দেখেন কোনটা পছন্দ হয়।

লোকটা এগিয়ে গেল র্যাকের দিকে। মাশুক এই জুতার দোকানে ক্যাশ আগলায়। জুতা দেখানো বা খদ্দেরের পায়ে গলিয়ে মাপ ঠিক করা তার কাজ নয়। অল্পবয়সী দুই তরুণ কাজটা করে। কিন্তু সকাল সাড়ে দশটায়ও কারো আসার নাম নেই।

দুজনই মোবাইল নিয়ে রাতভর পড়ে থাকে। ফেসবুক, টিকটক—আরো কত কী দেখে! ফাঁক পেলেই এসব নিয়ে কথা বলে দুজন। ফেসবুক অবশ্য মাশুকও দেখে। রাতে ঘুম না এলে ফেসবুকের ভিডিওগুলো দেখে।

অঙ্কন : বিপ্লব চক্রবর্ত্তী

‘ভাই, এই জোড়া নামান। নিয়া আসেন, দেখি।’

নরম কুশনের টুলে গিয়ে বসল ক্রেতা। ছোকরা দুটো আসছে না কেন? মাশুকের মাঝেমধ্যে এমন রাগ হয়, দুজনের নামে মালিকের কাছে নালিশ দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু দমে যায়। ওরা দুজনই ছেলের বয়সী। মায়া লাগে।

মাশুক বাধ্য হয়ে লেগে গেল খুবই অপ্রিয় একটা কাজে। লোকটা ধুলোমলিন পুরনো জুতা থেকে পা দুটি বের করতেই ছুটে পালাতে ইচ্ছা করল তার। মোজায় এমন গন্ধ, কেনার পর চিজ দুখানায় কখনো পানি পড়েছে কি না সন্দেহ!

লোকটা নতুন জুতা পায়ে গলিয়ে মচমচ করে কয়েক কদম হেঁটে দেখল। তারপর মুখ বাঁকা করে বলল, ‘নাহ, জুত নাই। রাইখ্যা দেন।’

লোকটার ধুলোমলিন পুরনো জুতা ডাকঘরের সিলমোহরের মতো একটা ছাপ রেখে যায় মাশুকের মনে। পরিবার থেকে দলছুট এই দেহটা এখনো বয়ে বেড়ানো যাচ্ছে। যখন আরো বয়স হবে, কর্মক্ষম থাকবে না, ঠিক ওই ধুলোমলিন জুতা বনে যাবে সে। হায় জীবন!

তাড়াহুড়া করে আসায় সকালের নাশতাটাও সারা হয়নি আজ। পেটে সারিন্দা বাজাচ্ছে ক্ষুধা। কিছু মুখে দেওয়া দরকার। কিন্তু ওরা না এলে বাইরে যাবে কী করে?

পরিষ্কার থাকার একটু বাতিক আছে মাশুকের। লোকটার নোংরা মোজা হাতড়ে গা ঘিনঘিন করছে। হাত না ধুলেই নয়। এ সময় সুরেলা আওয়াজ তোলে মোবাইলের রিংটোন। কল দিয়েছে নাবিলা। হাত ধোয়ার কথা ভুলে কল রিসিভ করে মাশুক।

‘কী করছ, বাবা?’

‘এইতো—দোকানে বসছি।’

‘আজ দুপুরে আসতে পারবা?’

‘কেন?’

‘তোমার এই একটা বিশ্রী স্বভাব, একটা প্রশ্ন করলে জবাব না দিয়া পাল্টা প্রশ্ন করো। আসতে পারবা কি না?’

‘খুব দরকার?’

‘উহু রে, আবার প্রশ্ন! আইসো।’

‘দেখি।’

‘দেখি আবার কী? দেখার কী আছে? আসবা, ব্যস।’

লাইন কেটে দেয় নাবিলা। মাশুকের হৃদয়গভীরে একটা কুলুকুলু স্রোত বয়ে যায়। ওদের কাছে যাওয়ার সুযোগ হলে এমন অনুভূতি হয়। আজব এক পরিস্থিতি। পরিবার নিজের, কিন্তু বাসা ওদের।

মাস কয়েক আগে মিরপুরের রুফটপ ওই ফ্ল্যাটে উঠেছে ওরা। নাজু, নাবিলা আর নাহিদ। বড় একটা রুম দুই ভাগ করে দুটি বানানো হয়েছে। একটায় রান্নাবান্না চলে। সেখানেই এক কোণে খাট পেতে থাকে নাজু আর নাবিলা। বাথরুম একটাই। সেটা ছাদের আরেক প্রান্তে। আরেকটা রুম নাহিদের। সেখানে জায়গা হয়নি মাশুকের। মা-মেয়ে যত স্বচ্ছন্দে একসঙ্গে থাকা যায়, বাপ-ছেলের এক রুমে থাকাটা সহজ নয়। বিশেষ করে ছেলে যদি তরুণ হয় আর মুখের ওপর বলে, ‘কী করলা জীবনে? মায়ের জীবন তো তামা করছই, আমাদের জন্যও তো কিছু করতে পারলা না!’

বাধ্য হয়ে মেসে উঠেছে মাশুক।

এর মধ্যে দোকানের ছেলে দুটি এসেছে। সমিতির মার্কেটের দোকানগুলোতে ক্রেতার ভিড় জমছে। এখানে বেশির ভাগই নিম্নমধ্যবিত্ত। তারা দেখে বেশি, কেনে কম। কিনলেও দোনামনা থাকে—ঠকলাম কি না। এর পরও জুতার দোকানে বিক্রি মন্দ না। দিনে সাত-আট জোড়া বিক্রি করতে পারলে ভালো লাভ থাকে।

দুপুরের দিকে ফোনে মালিকের কাছ থেকে ঘণ্টা তিনেকের জন্য ছুটি নেয় মাশুক। বলে, বাসায় জরুরি কাজ। ছেলে দুটির ওপর দোকানের ভার বুঝিয়ে দিয়ে মিরপুরের বাস ধরে সে। মাথায় এলোমেলো চিন্তা। হঠাৎ এই জরুরি তলব কেন? টাকার দরকার, না অন্য কোনো সমস্যা? নাজু আজকাল নিজে ফোন করে না, মেয়েকে দিয়ে করায়। এখন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ চলছে। এই মুহূর্তে টাকা দেওয়া সম্ভব না, যা দেওয়ার তা তো দিয়েছেই।

মিরপুর-১০ গোলচত্বরে বাস থেকে নেমে যায় মাশুক। এখান থেকে বাসায় যেতে রিকশায় ৫০ টাকার মতো লাগে। মাশুক হেঁটেই যায়। গলির মাথায় সবজির ভ্যান। বাসায় কিছু সবজি নেওয়া যায়। খুশি হবে ওরা। কিন্তু দাম শুনে দমে যায় মাশুক। নতুন আলু ৭০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, বেগুন ১০০ টাকা। সবজির দামের কাছে জীবনের দাম পানি। সস্তার সবজি অবশ্য আছে। মুলা। বিশ টাকা কেজি। মাশুক নেয় কেজিখানেক।

এ বাসায় লিফট নেই। সিঁড়ি ভেঙে ছয়তলায় ওঠা কষ্ট। প্রবল ইচ্ছাশক্তি মাশুককে টেনে তোলে। টুকটুক করে মৃদু টোকা দেয়। নাজু দরজা খোলে।

‘তুমি!’

যেন তিরিশ বছরের জীবনসঙ্গীকে চিনতে অনেক কষ্ট। মাশুক গা করে না। সয়ে গেছে। তবে নাজুর জন্য মাশুকের এখনো অনেক মায়া।

মাশুক বিরস মুখে বলে, ‘নাবু ফোন দিয়া আসতে বলল। ভাবলাম জরুরি।’

‘আসো।’

দরজা থেকে সরে জায়গা করে দেয় নাজু। পেছনে নাবিলা এসে দাঁড়িয়েছে। মাকে তীক্ষ কণ্ঠে বলে, ‘বাবাকে দেইখা চমকানোর কী আছে, মা? নয় দিন পর আসল বেচারা!’

নাজু বলে, ‘আমাকে তো বললি না?’

‘তোমাকে বইলা কী হইব? তিতা কথা ছাড়া কিছু জানো?’

‘তিতা কথা তো এমনিই বাইর হয় না। তোর বাপের চুল পাইকা সাদা হইয়া যাইতেছে, তবু আক্কেল-বুদ্ধি পাকল না! দেখ, মুলা নিয়া আসছে! এইসব বলে কোনো বাসায় নেওয়ার জিনিস!’

‘মাসের কয় তারিখ আইজ? তুমি আমার পকেটের অবস্থা দেখবা না?’

‘টাকা না থাকলে আনবা না। তাই বইলা গ্যাসের ফ্যাক্টরি নিয়া আসবা?’

নাবিলা ফিক করে হেসে ফেলে। নাজুও যোগ দেয়।

মাশুক বিরক্ত হয়ে বলে, ‘এই জন্যই তোদের কাছে আসতে ইচ্ছা করে না। ভালো কিছু করলেও মরণ! মুলা দিয়া পাতা শুঁটকির চচ্চড়ি তুমি পছন্দ করো না? এই জন্যই তো...। এখন বলো কী হইছে?’

নাবিলা বলে, ‘কিছু হয় নাই, বাবা। বাসায় আজ ভালো কিছু রান্না হইছে। আমরা পোলাও-মাংস খাব, আর তুমি বাদ থাকবা, সেইটা কি হয়?’

মাশুক এতক্ষণে খেয়াল করে, রান্নাঘর প্লাস থাকার ঘরটায় দারুণ সুবাস! কয়েক দিনের না-খাওয়া অভাগার মতো হাসি ফোটে তার। বলে ফেলে, ‘পোলাওয়ের সঙ্গে কী করছ তোমরা? গরু, না মুরগি?’

নাবিলাও হাসে, ‘দুইটাই।’

‘কী উপলক্ষে এত কিছু?’

নাজু বলে, ‘আরে, নাহিদ ওর এক বন্ধুরে খাওয়াইব। সেও রাইড শেয়ার করে।’

এখন দুপুর দুইটা। এত বেলা পর্যন্ত না-খাওয়া মাশুকের আর তর সয় না। বলে, ‘কী দিবা দাও। খুব ক্ষুধা লাগছে।’

নাজু ভেতরে ভেতরে টেনশনে অস্থির। আজকের দাওয়াতের বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। নাহিদ যে বন্ধুকে নিয়ে আসবে, সেও পড়াশোনা ছেড়ে রাইড শেয়ার করে। নাহিদ বলেছে, ওর জানা মতে ছেলেটির বাজে কোনো নেশা নেই। কোনো মেয়ের সঙ্গেও নেই, তবে খুঁজছে। পছন্দমতো পেলে বিয়ে করবে। নাবিলাকে দেখে সে রকম আগ্রহ দেখালে বিয়ের কথা পাড়বে নাহিদ।

নাবিলা দেখতে-শুনতে মন্দ না। মেধাবীও। এসএসসিতে সায়েন্স থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। মেডিক্যালে পড়ার ইচ্ছা। না হলে পাবলিক ভার্সিটি। কিন্তু নাহিদ বলে, বাবার যে অবস্থা, কলেজে থাকতে থাকতে নাবিলাকে পার করতে হবে। আইবুড়ো হলে তখন ছেলে পাওয়া মুশকিল।

নাজু একটু আপত্তি তুলেছিল, অমনি রেগে গেল ছেলেটা। বলল, ‘আমি এত বিয়ার করতে পারব না, মা। বোঝা হালকা করতে হইব। আমারও তো ভবিষ্যৎ আছে। বি প্র্যাকটিক্যাল!’

নাজু আর কিছু বলেনি। টাকা-পয়সা না থাকলে এ বয়সে অনেক অধিকার বেদখল হয়ে যায়। নাহিদ পইপই করে বলেছে, ‘বাবা যেন কিছুতেই জানতে না পারে। পরে জানাইলেই হইব।’

এ জন্যই নাজু কিছু জানায়নি মাশুককে। নাবিলাও জানে না এই দাওয়াতের আসল কারণ। মেয়েটা হুট করে বাবাকে নিয়ে আসায় এখন ভারি বিপদ হয়েছে। কখন যে ওরা এসে পড়ে! বাবাকে দেখলে নাহিদ এখন হয়তো কিছু বলবে না, পরে ঠিকই ঝাল ওঠাবে।

নাজু বলে, ‘তাড়াতাড়ি খাইয়া চইলা যাও। দেরি করলে দোকানের মালিক আবার কী বলে!’

হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় বসে পড়ে মাশুক। নাবিলা ঘরে রাখা  মোটা কাগজের একটা শপিং ব্যাগ ছিঁড়ে বিছিয়ে দেয় বাবার সামনে। বলে, ‘সকালে কী দিয়ে নাশতা করছ, বাবা?’

মাশুক এড়িয়ে যায়, ‘সকালের কথা এখন জানার দরকার আছে?’

‘রোজ সকালে নাশতা করার সময় তোমার কথা মনে পড়ে, বাবা। মা দুধ-চা দিত, তুমি তেল ছাড়া পরোটা ভিজাইয়া খাইতা। মা বলে আর কাঁদে।’

‘তুইও এখন কাঁদবি নাকি?’

নাবিলা ওদিক ফিরে মুখ আড়াল করে। মাশুকের বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে। করোনার আগে ভালোই ছিল ওরা। তখন এত লোয়ার লেভেলে না, বেশ ভালো একটা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানে হিসাব বিভাগে ছিল। দুই কামরার একটা ছিমছাম বাসায় ছিল। আলাদা কিচেন, দুটি বাথরুম। নাহিদ তখন ঢাকা কলেজে অনার্সে পড়ে। নাবিলা স্কুলে। হুট করে করোনা এলো, ভোজবাজির মতো উধাও হলো চাকরিটা। তারপর কয়েকটা মাস একদম বেহদ্দ বেকার। করোনা গেলে ব্যাংকে যা ছিল, তা দিয়ে শেষরক্ষা হিসেবে একটা ফাস্ট ফুডের দোকান দিয়েছিল। জমল না। পুরো ১০ লাখ টাকা গচ্চা। নাহিদের পড়াশোনা ওখানেই শেষ। তবু ভাগ্যিস, ধারদেনা করে ওকে একটা মোটরবাইক কিনে দিতে পেরেছে। চারটা বছর ছোট-বড় নানা ঢেউ সামলে শেষে এই জুতার দোকানে ঢুকেছে মাশুক। বেতন যা পায়, তা দিয়ে কোনোমতে টেকা যায়, কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না।

বাবাকে পোলাও-মাংস বেড়ে দেয় নাবিলা। অনেক দিন এমন ভালো খাবার খায় না মাশুক। রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সব শেষে দই খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে মাশুক। নাবিলা বলে, ‘তোমার বেতন কি আর বাড়বে না, বাবা?’

‘বাড়বে কিভাবে? বাড়ানোর কথা বলারই তো সাহস হয় না।’

‘তোমার সাহস নাই দেইখাই তো আমাদের এই অবস্থা। ভাইয়া ঠিকই বলে। মালিককে বলবা যে জিনিসপত্রের দাম বেশি, চলা যায় না।’

মাশুক কিছু বলে না। হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ে। নাজুর ফোনে রিংটোন। কল দিচ্ছে নাহিদ। বুকটা ধড়াস করে ওঠে। এসে গেছে নিশ্চয়ই! ভয়ে ভয়ে ফোন ধরে। কিন্তু না, জরুরি কি একটা কাজ পড়েছে। এখন না, রাতে আসবে ওরা। হাঁপ ছাড়ে নাজু। যাক, এ যাত্রা বাঁচা গেছে!

নাজু এবার বলে, ‘খেয়ে একটু আরাম করেই যাও। একদিন একটু লেট হইলে কী আর বলবে?’

মাশুকেরও ভরপেট খেয়ে নড়তে ইচ্ছা করে না। ওই বিছানায়ই চিত হয়ে শুয়ে পড়ে। নাবিলা মাথার কাছে বসে। বাবার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘আর কয়েকটা মাস কষ্ট করো, বাবা। আমি এইচএসসি দিয়া টিউশনি করব। তোমাকে আর মেসে থাকবে হইব না। তখন আরেকটা ভালো বাসায় উঠব।’

নাবিলা বলেই চলে, ‘আর যদি ভার্সিটিতে ভর্তি হই, হলে উঠতে পারি...’

নাবিলার সব কথা কানে যায় না মাশুকের। আবেশে চোখ বুজে আসে। ঘোরলাগা চোখে স্বপ্ন দেখে সে। সবাই একসঙ্গে নতুন একটা বাসায় উঠেছে। বারান্দায় আসা নরম রোদে গা পেতে বসে আছে সে। ভেতরে চায়ের কাপে টুং টাং। এখনই আসবে ভাপ ওঠা চা। কিন্তু শীত বিকেলটা বড্ড ক্ষণস্থায়ী। কখন যে মিষ্টি বিকেল অস্তাচলে বিলীন হয়, টের পায় না মাশুক।

 

 

 

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

একটি পুরনো গল্প

    ইউসুফ শরীফ
শেয়ার
একটি পুরনো গল্প
অঙ্কন : শতাব্দী জাহিদ

পুরনো হলেও এখনো চাপা রিনঝিন হাসি ঢেউ খেলে যায় ছ’ফুটি এই গলিতে—বাঁ দিকে সালেহা মঞ্জিলের উঁচু দেয়াল, ডান দিকে আম-কাঁঠালগাছের নিরিবিলি ছায়ায় পর পর দুটি টিনশেড বাংলোবাড়ি। সামনে গলি গিয়ে পড়েছে দু’পায়া পথে আর পেছনে এল সাইজ টিনশেড এই এলাকার থেকে যাওয়া একমাত্র মেস—ইঞ্জিনিয়ার্স মেস। যে ইঞ্জিনিয়াররা গাছপালায় ছাওয়া শান্ত পরিবেশে এই মেসবাড়িটার প্রথম বাসিন্দা ছিলেন, এখন নিশ্চিত কোনো না কোনো অভিজাত পাড়ায় তাঁরা বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন।

ইলিয়াস ঢুকতে গিয়ে পুরনো ভাঙাপ্রায় টিনের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে যায়।

বেশ ক’দিন ধরে এই রিনঝিন চাপা সুবাস ছড়ানো হাসির ঢেউ ঠিক এখানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই তার ওপর আছড়ে পড়ে।

সুবাসটা চেনা চেনা, অথচ মোটেই চেনা নয়। হাসিটাও এই রকম—পুরনো হাসির ধরন, যা চেনা যায় যায় না। চকিতে মনে পড়ে ইলিয়াসের মানুষকে চেনার আগেই বোধ হয় তার হাসি চেনা যায়।

হাসি মানবীয় সম্পর্কের এক আদি নির্ভরযোগ্য সেতু। এটা আদৌ যদি তত্ত্বকথা হয়, তাহলে ভাবতে পেরে ইলিয়াস মুচকি হাসল—অতৃপ্ত মানুষের তৃপ্তির হাসি।

স্কুলে হেডমাস্টার সাব আজ বলে দিয়েছেন—আমি দুঃখিত ইলিয়াস সাব, আপনার জন্য বোধ হয় কিছু করতে পারলাম না। কিভাবে করব বলুন, একজন মন্ত্রী যদি সামান্য একটা স্কুল শিক্ষকের চাকরির জন্য রিকমেন্ড পাঠিয়ে আবার টেলিফোনে রিকোয়েস্ট করেন, তাহলে কী করা যাবে! আপনি সাময়িক নিযুক্তি নিয়ে কাজ করেছেন—আপনার একটা দাবি আছে, কিন্তু আমার করার নেই কিছুই।

তবে আমি কথা দিচ্ছি, দু-একটা ভালো টিউশনি আপনাকে জোগাড় করে দেওয়ার চেষ্টা করব।

অঙ্কন : শতাব্দী জাহিদ

মন্ত্রীদের হাত কত দীর্ঘ! একটা মানুষের হাত কত দীর্ঘ হতে পারে? কোনো কোনো বংশের লোকদের হাত নাকি তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ হয়—এ রকম কথা বলা হয়ে থাকে। সেটাও তো আর শরীর ছাড়িয়ে যায় না। তবে মন্ত্রীর হাত শরীরের তোয়াক্কাই করে না, অশ্বখুরের দাগের পরিমাণ ফাঁকফোকরে ননি-মাখনের খানিকটা আভাসও জিহ্বাগত হওয়ার বাইরে থাকে না!

হাত নিয়ে ভাবতে ভাবতে ইলিয়াস মেসে ঢুকছিল। টিনের ভাঙা গেটে হাত রাখার সঙ্গে সঙ্গে ওই হাসি আজও দুরন্ত তরঙ্গের মতো আছড়ে পড়ল।

তার হাত যদি তেমন হতো তাহলে হয়তো এই হাসির খনিকটা উপড়ে নিয়ে আসতে পারত! তবু হাসিটাকে সে ঠিক চিনে ফেলেছে—এই হাসি অদৃশ্য হাতের আঙুল হয়ে হৃদয়ের গোপন দরজায় টুকটুক করে কড়া নাড়ে।

গোপন কড়া নাড়ার এই শব্দ ঝরনার মতো বইছে এখন তার বুকের ভেতর। অবাক কাণ্ড, দীর্ঘ হাতের ছোবল যে ক্ষত তৈরি করেছে, তার ওপর ঝরনার পানি পড়তেই বেদনা ধোঁয়ার মতো উড়তে থাকল—আসলে উড়তে থাকল কী! পুরনো অভ্যাস তো থাকে!

মুচকি হাসিটা ধরে রেখেই রুমে ঢুকল। রুমমেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডেপুটি অ্যাকাউন্টস অফিসার রফিক মাড়ির গোড়ায় গুল ঠেসে দিয়ে পুরনো অভ্যাসে অস্বাভাবিক জোরে হাত ঝাড়ছিল।

ইলিয়াস ঢোকামাত্র তার মুখে দৃষ্টি স্থির করে হাতঝাড়া ভুলে উৎসাহিত হয়ে উঠল, কী কাম হইয়া গ্যাচে! হবে না ভাই, আপনের কপাল ভালো। কইছিলাম না—চিন্তা কইরেন না। আরে ভাই—আপনে আপনের কপাল দেখতে না পাইলে কী হইব—আমরা তো দেখতে পাই। আপনের কপালের গড়ন আলাদা—এই রকম গড়নপদের কপাল দেখলেই চিনবার পারি—হেই ইস্ট পাকিস্তান ওয়াপদার আমলে ক্লার্ক হইয়া ঢুকছি—কত কপাল দেখছি। অহন একনজর দেখলেই কইয়া দিতে পারি কী আছে কপালে। না, কপালতত্ত্ব নিয়া পড়াশোনা করি নাই, এইডা অভিজ্ঞতা। বুঝলেন ভাই, অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নাই।

রফিক গুলের ক্রিয়ায় মুখে জমে ওঠা পানি দরজা দিয়ে বাইরে পিক করে ছুড়ে দিয়ে আত্মতৃপ্তির হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।

ইলিয়াসের হাসি মিলিয়ে গেছে—জামার বোতাম খুলতে খুলতে বলল, কাম হয় নাই, রফিক ভাই!

রফিক বিছানা থেকে উঠে ইলিয়াসের সামনে এসে দাঁড়াল, কন কী, হয় নাই! হয় নাই ক্যান? আপনে তিন মাস কাজ করছেন—অহন আপনে, ডিপার্টমেন্টাল ক্যান্ডিডেট রুলে আছে আপনের প্রিফারেন্স।

ইলিয়াস বলল, কলোনিতে পাঁচ বছর আগে আপনার নামে বাসা অ্যালট হয়েছে—তার পরও বাসায় উঠতে পারছেন না কেন?

রফিক হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়ে বলল, আরে ভাই, এই কিচ্ছা না কত দিন কইছি। গত পাঁচ বছরে আমি যত কথা কইছি—তার বেশি অর্ধেক খরচ হইছে এই কিচ্ছা কইতেই। তো আর কওয়া যাইব না, পরশু দিন অফিসে হুমকি দিয়া গ্যাছে।

ইলিয়াস বলল, কন কী! হুমকি দেওয়ার জন্য অফিসে গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়েছে?

রফিক হাত-পা ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল, আরে ভাই, গুণ্ডা হইলে বুঝতাম—গুণ্ডায় হুমকি দিব না তো কী করব, হুমকি দিয়া গ্যাছে ওই মেয়েটা। কই নাই যারা জবরদখল কইর্যা রাখছে বাসা ওদের ওই মেয়েটা। কয় গান গায়—শিল্পী। এ যে কোন শিল্প সে কি আর বুঝি না! জানেন, ছোটবেলায় গেরামে দেহতত্ত্বের গান শুনছি, আর অহন এই সময়ে ঢাকার শহরে দেখছি দেহশিল্পের দাপট!

ইলিয়াস বলল, গোটা দেশটাই এখন মাসলম্যানদের হাতে জিম্মি—এদের হাত থেকে উদ্ধার না পেলে দেশ চলবে না!

রফিক বলল, আরে দূর সাব, আপনে কী কন! এই যে মেয়েটা আমারে রীতিমতো হুমকি দিয়া গ্যাল—সে কি মাসলম্যান? এ হলো সফট মাসল ওম্যান। এখন এদের যুগ, এদের হাতে জিম্মি এখন সমাজ। হার্ডওয়্যারের যুগ শেষ, এখন সফটওয়্যারের যুগ!

ইলিয়াস বিছানায় বসে পড়ে বলল, বুঝলাম না ভাই কী কইলেন সাংকেতিক ভাষায়।

রফিক বলল, আরে ভাই, আপনেরে আর কত বুঝাইবাম। সাংকেতিক ভাষা হইল এই যুগের ভাষা। আপনে তো ম্যালা নভেলটভেল পড়েন। দেখেন না আজকাল মডার্ন জনপ্রিয় লেখকরা কেমন শর্টহ্যান্ডের মতো সংকেত দিয়া দিয়া তরতর কইর্যা লেইখ্যা যায়। মনে হয় চিন্তা নাই ভাবনা নাই—কাগজ-কলম নিয়া বসে আর ফরফরায়্যা লেখা শেষ কইর্যা ফালায়। এই কথা কইছে এক মহাজনপ্রিয় লেখক এক সাপ্তাহিকে সাক্ষাৎকারে। কথা বেঠিক না—চিন্তা-ভাবনা যদি কিছু করতে হয় তো করব পাঠকরা।

ইলিয়াস বলল, এটা আপনার অন্যায়, রফিক ভাই—আপনি জানেন সারা বিশ্বের সাহিত্যে পরিবর্তন এসেছে। আমাদের লেখকরাও—

রফিক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, রাত কয়টা দেখছেন? অহন হাতমুখ ধুইয়া খাইতে বসেন।

লোকটার মেজাজ এই বাসা নিয়ে ইদানীং খিটখিটে হয়ে উঠেছে। তবে সময়মতো খাওয়া আর ঘুমানোর ব্যাপারে ইলিয়াসকে প্রতিদিন তাগিদ দিতে ভোলে না।

খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে বাতি নিভিয়ে দিল ইলিয়াস। অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে সেই রিনঝিন হাসিটা তার মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল—সে এখন থইথই হাসির ঢেউয়ে নিমজ্জিত। এমন তো হতে পারে, কাল খুব ভোরে এই গলির বাসিন্দারা জেগে ওঠার আগে ভাঙা গেট দিয়ে বের হতেই দেখবে—কী দেখবে! কোনো ছবি স্পষ্ট হয় না। সাদা কাগজের মতো একটা ভোর ওত পেতে রয়েছে—এ রকম সাদার মুখোমুখি হতে ভয় পায় সে, দম আটকে আসে তার।

ইলিয়াস উঠে বসে বিছানায়। মশারি গুটিয়ে টেবিলের ওপর থেকে হাতড়ে পানির গ্লাসটা তুলে নেয়—ঢকঢক করে খানিকটা পানি পান করে।

তারপর ডাকে, রফিক ভাই ঘুমিয়েছেন?

রফিক জিজ্ঞেস করল, ঘুম আসছে না? ঘুমান, ঘুম হইল শরীরের বিশ্রাম। চিন্তা কইর্যা কিছু হয় না—যা হওয়ার এমনিই হয়। ঢাকার শহরটা একটা সমুদ্র—এইখানে রুই-কাতলার পাশাপাশি মলা-পুঁটিও থাকে। তবে থাকার একটা ফরম্যাট আছে—আয়ত্ত না হওয়া পর্যন্ত অস্থির অস্থির লাগে, হইয়্যা গ্যালে দেখবেন একেবারে নিশ্চিন্ত পানির মতো জীবন। নেন ঘুমান।

ইলিয়াস বলল, আপনি সজাগ ছিলেন—ঘুমান নাই?

রফিক বলল, আরে কইয়েন না, হঠাৎ আপনের ভাবিরে দেখলাম—

ইলিয়াসের কণ্ঠে বিস্ময়, ভাবিরে দেখলেন! কী স্বপ্ন দেখছেন?

রফিক হেসে ওঠে, আরে না—ঘুমাই নাই তো স্বপ্ন দেখব ক্যামনে!

ইলিয়াস বলল, তাহলে ভাবিরে দেখলেন কেমনে?

রফিক বলল, মশারির পাশে আইস্যা দাঁড়াইল। আপনে যখন পানি খাইলেন তখন কইল—যাইগা, ইলিয়াস ভাইয়ে দেখলে কী কইব? শত হউক এইডা মেস তো!

ইলিয়াস থ—লোকটা বলে কী—মাথায় গোলমাল দেখা দেয়নি তো! সে চুপ হয়ে যায়—মুখ থেকে কোনো শব্দ বের করে না।

অনেকক্ষণ পর রফিক কথা বলে ওঠে—কী, ঘুমাইলেন?

ইলিয়াস সাড়া দেয়, না।

রফিক বলল, ইলিয়াস সাব, আপনে আমার ছোট ভাইয়ের মতন, কী কই আপনেরে। জানেন, বিয়া করলাম—দু’টা ছেয়েমেয়েও হইল, কিন্তু সংসার করতে পারলাম না। একজন ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর একজন ঢাকায়। সংসার বলতে যা বোঝায়, প্রতিদিনের সংসার, তা হয়!

রফিকের দীর্ঘশ্বাস ঘরের বাতাস ভারী করে তোলে—এত ভারী যে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

ইলিয়াস জিজ্ঞেস করল, রফিক ভাই, আমি যখন এলাম, তখন বাইরে কোনো হাসির শব্দ শুনেছিলেন?

রফিকের কণ্ঠে বিস্ময়, হাসি! কার হাসি?

ইলিয়াস বলল, এই—এই কোনো মহিলার!

রফিক আপন মনে আওড়াল—মেয়েমানুষের হাসি! না তো—কন কী! শুনছেন আপনে?

ইলিয়াস বলল, হ্যাঁ। গত কয় দিন যাবৎই শুনি—ভাঙা গেটটায় হাত রাখতেই রিনঝিন হাসি...

রফিক হেসে ওঠে, দূর কী কন! আপনে শোনেন আর আমি শুনি না, কেউ শুনে না—এইটা হয় নাকি? এইটা আপনের ভেতরে লুকাইয়া আছে—ফাঁক পাইলেই বাইর হয়!

ইলিয়াস বলল, এটা কী কন রফিক ভাই? আমি স্পষ্ট শুনেছি, একদিন-দুইদিন না, গত এক সপ্তাহ ধরে শুনছি—মিষ্টি সুরেলা হাসি, ঠিক ঝরনা থেকে পানি গড়ায় যেমন শব্দ করে!

রফিক ওকে থামিয়ে দেয়—ব্যস, হইয়া গ্যাছে, আর কইতে হইব না। এই যে আপনের ভাবি আইস্যা দাঁড়াইল—এইটা ক্যামনে? আরে ভাই, ভেতরে লুকাইয়া থাকলে ফাঁক পাইলেই বাইর হইয়া আসে। ভেতরটা যখন অসহ্য হইয়া ওঠে, তখনই বাইর হয়।

ইলিয়াসের গা ছমছম করে ওঠে—সে বুকে হাত দেয়—অনুভব করার চেষ্টা করে সত্যই রিনঝিন হাসিটা ভেতরে আছে কি না! 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

ঈদে অভিজাত সাজ

    ঈদে গরম থাকবে, তাই স্টাইলের সঙ্গে সাজে আরামের দিকটাও খেয়াল রাখুন। ঈদের সাজ নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন রেড বিউটি স্যালনের রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন। লিখেছেন মোনালিসা মেহরিন
শেয়ার
ঈদে অভিজাত সাজ

ঈদের দিনের অনুভূতিই অন্য রকম। এদিন সাজে সুন্দর ও সাবলীল থাকা চাই। ঈদ সকালটা শুরু হয় কাজের ব্যস্ততা দিয়ে। দুপুরে অতিথি আপ্যায়নে সময় কাটে।

বিকেল আর রাতে নিজের জন্য একটু বেশি সময় পাওয়া যায়। প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরাঘুরি, আড্ডা কিংবা দাওয়াতে যাওয়া হয়। এ জন্য তিন বেলায় চাই তিন রকম সাজ।

সকালে হালকা সাজ

সকালে হালকা ও আরামদায়ক পোশাক পরা উচিত কারণ এসময় ছিমছাম, স্নিগ্ধ সাজই সুন্দর লাগে।

সকালে যেহেতু কাজের ব্যস্ততা থাকে তাই সাজ-পোশাক আরামদায়ক হওয়া চাই। শোভন মেকওভারের স্বত্বাধিকারী শোভন সাহা বললেন, ‘ঈদের দিন ব্যস্ততায় তিনবার লুক বদলানো বেশ ঝামেলার কাজ। সকালের সাজ দিয়েই দুপুর ও রাতের সাজটা সেরে ফেলতে পারেন। সকালে হালকা ফাউন্ডেশন দিন।
ঠোঁটে এ সময় ন্যুড রঙের লিপস্টিক দিতে পারেন। চোখ সাজাতে হালকা আইশ্যাডো দিলে সুন্দর লাগবে।’

সকালের পরিবেশে হালকা যেকোনো কিছুই ভালো মানায়। মেকআপ, কনট্যুরিং, ব্লাশ ও মাশাকারায় হালকা ভাব ধরে রাখতে পারেন। সকালে চুলের সাজে পনিটেল করে নিন।

কম বয়সীরা কপালের দুই পাশে একটু স্টাইলিশ বেণি করে নিলে সুন্দর দেখাবে।

 

ঈদে অভিজাত সাজ

দুপুরে চাই আরাম

গরম আবহাওয়া এখন। রেড বিউটি স্যালনের স্বত্বাধিকারী ও রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন বললেন, ‘ঈদের দিন দুপুরে ভারী মেকআপ না করাই ভালো। বেইস মেকআপ ম্যাট রাখুন। গরমে ত্বক বেশি ঘামলে বা তেলতেলে হলে ভালো করে মুখ ধুয়ে টোনার লাগিয়ে নিন। চেষ্টা করুন মেকআপের সব উপাদান যেন ম্যাট হয়। এতে গরমে ঘামলেও মেকআপ নষ্ট হবে না। চোখে ঘন মাশকারা ও আইলাইনার দিতে পারেন। চোখের সাজে স্মোকি ভাবও এই সময় সুন্দর লাগবে। পোশাকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে লিপস্টিক দিন ঠোঁটে। ন্যুড কালার লিপস্টিকও রাখতে পারেন। কানে দুল আর গলায় হালকা লকেট বেছে নিতে পারেন। দুপুরের সাজে চুল বেঁধে রাখাই বেশি আরামদায়ক হবে।’

 

ঈদে অভিজাত সাজ

রাতে জমকালো

রাতের বেইস মেকআপ মানায় ভালো। সাজও জমকালো হয়। রাতে জমকালো কাজ করা পোশাকের সঙ্গে ভারী মেকআপ, ভারী গয়না, চোখের সাজে রঙের বাহার, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক রাতে আরো বেশি সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলবে। বিন্দিয়া এক্সক্লুসিভ কেয়ারের স্বত্বাধিকারী শারমিন কচি বললেন, ‘রাতের সাজে মানানসই হাইলাইটার ব্যবহার করুন। গাঢ় ব্লাশ অন বেছে নিন। ঠোঁটেও থাকবে উজ্জ্বল রং। চোখে রঙিন সাজ বা স্মোকি আই রাতে ভালো দেখাবে। চুলের সাজে লম্বা বেণি সুন্দর মানাবে। চাইলে চুল ছেড়েও রাখতে পারেন।’

যখন যেমনই সাজুন, সবার আগে নিজের ব্যক্তিত্ব ও আরামদের দিকটা প্রাধান্য দিন। গরমে সাজবেন তো অবশ্যই, তবে তা যেন নিজের সৌন্দর্য আর সুস্থতায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটায়। মনে রাখবেন, সবার আগে নিজেকে সুস্থ রাখা সবচেয়ে জরুরি। তবেই তো ঈদের আনন্দ সবার সঙ্গে মিলেমিশে উপভোগ করবেন।

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য
ফ্যাশন

ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

    ঈদের দিন পাঞ্জাবি না পরলে ছেলেদের ফ্যাশন যেন অপূর্ণ থেকে যায়। প্রতিবছর নতুন নকশা, থিম ও প্যাটার্নের পাঞ্জাবি নিয়ে আসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ডিজাইনারদের সঙ্গে কথা বলে এবারকার ঈদের পাঞ্জাবির খোঁজ জানাচ্ছেন আতিফ আতাউর
শেয়ার
ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

পাঞ্জাবি পরতে ভালোবাসেন না এমন পুরুষ কমই। ঈদের দিন তো নতুন পাঞ্জাবি ছাড়া জমেই না। এ জন্য ঈদ ঘিরে নতুন নতুন পাঞ্জাবির পসরা সাজিয়ে বসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ফ্যাশন হাউস কে ক্রাফটে এসেছে বর্ণিল নকশার পাঞ্জাবি।

লাল, নীল, সাদা, কালো, খয়েরিসহ বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রণ ঘটেছে পাঞ্জাবিতে। গলা ও হাতায় রয়েছে আলাদা নকশা ও কাজ। ঐতিহ্যবাহী কাঁথা স্টিচ, মোগল শৈলী, উইভিং মোটিফের অনুপ্রেরণা ছাড়াও গুজরাটি, ইক্কত, কলকা আর্ট, জামদানি, ফ্লোরাল, ট্র্যাডিশনাল, টার্কিশ আর্ট ও ইসলামিক মোটিফ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রয়েছে আরামদায়ক কাপড়ের ব্যবহার।
প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার খালিদ মাহমুদ খান বলেন, ‘পাঞ্জাবির গলা, বুক ও হাতার পাশাপাশি কাঁধেও নতুন নকশা করা হয়েছে। কটন, ডিজাইন কটন, হ্যান্ডলুম কটন, লিনেন, জর্জেট, সিল্ক, হাফসিল্ক, টিস্যু ও সাটিনের মতো আরামদায়ক কাপড় বেছে নেওয়া হয়েছে। যেন গরমে স্বস্তি পাওয়া যায়। হাতের কাজ, এমব্রয়ডারি, স্ক্রিন ও ব্লক প্রিন্ট, কারচুপি ও টাইডাইয়ের সাহায্যে পাঞ্জাবির নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

বিশ্বরঙের শোরুমে ম্যানিকুইনগুলোর বেশির ভাগই ঈদের পাঞ্জাবি পরা। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ডিজাইনার বিপ্লব সাহা বলেন, ‘এবার নকশা ও থিমের চেয়ে আরামই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে পাঞ্জাবির কাপড়ে। কারণ গরমের মধ্যে। সে জন্যই আরামকে বেছে নেওয়া। সুতি, কটন, সেমিকটন, লিনেন ও পাতলা তাঁতের কাপড়ে তৈরি হয়েছে এবারকার ঈদ পোশাক।

একই সঙ্গে মোটিফেও থাকছে ইসলামিক, ফ্লোরাল, ফুল, লতাপাতা ও মোগল কারুকার্য।’

 

ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

প্রিন্টে পরিপাটি

প্রিন্টের পাঞ্জাবির প্রতি ছেলেদের আকর্ষণ সব সময়ই। এবারও প্রিন্টের পাঞ্জাবির জয়জয়কার। ফ্যাশন হাউস ওটু, জেন্টল পার্ক, লা রিভ, টুয়েলভ, অঞ্জন’স, লুবনান, রিচম্যান থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠান ঈদ উপলক্ষে প্রিন্টের নতুন পাঞ্জাবি এনেছে। লালচে সুতি পাঞ্জাবিতে কালো প্রিন্টের নকশা, হাতায় কালো রঙের পাইপিংয়ের প্রিন্ট যেমন দারুণ সাড়া ফেলেছে, তেমনি গাঢ় সবুজ শেডের জমিনে হালকা সবুজ প্রিন্ট, তার সঙ্গে এমব্রয়ডারির নকশা যুক্ত করে অভিজাত ভাব আনা হয়েছে। এসব পাঞ্জাবির বোতামের আলাদা নকশা ও ম্যাটেরিয়ালেও পাওয়া যাবে ভিন্নতা। এ ছাড়া ফুল, ফল, পাখি, লতাপাতা ও প্রকৃতির নানা মোটিফ যুক্ত হয়েছে এবারকার প্রিন্টের পাঞ্জাবিতে।

 

কাটছাঁটে নতুন কী

গলা, বুক, হাতা ও কাঁধের কাটছাঁটে রয়েছে আলাদা বৈচিত্র্য। সারা লাইফস্টাইলের ডিজাইনার শামীম রহমান বলেন, ‘কম বয়সীদের জন্য জমকালো ও ভিন্ন ধাঁচের প্যাটার্নের পাঞ্জাবি এনেছি। আলাদা কাপড় জুড়ে দেওয়া, বোতামের পরিবর্তন, বুকের কাটে ভিন্নতা, এমব্রয়ডারি ও সুই-সুতার কাজের সাহায্যে নতুনত্ব যোগ করা হয়েছে। কখনো বুকের এক পাশ খালি রেখে আরেক পাশে নকশা, কখনো কাঁধের কাছে ভিন্ন কাপড় জুড়ে দিয়ে ভিন্নতা আনা হয়েছে।’

একেকজনের একেক রকম চাহিদার কথা মাথায় রেখে পাওয়া যাবে তিন ধরনের পাঞ্জাবি—রেগুলার ফিট, স্লিম ফিট ও স্লিম শর্ট। এখনকার ট্রেন্ড লম্বা কাটের লুজ ফিট পাঞ্জাবি। অভিজাত লুকেরও পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসে। সিল্ক, মসলিনের মতো দামি কাপড়ে তৈরি এসব পাঞ্জাবিতে অভিজাত ভাব তুলে ধরতে অতিরিক্ত ভ্যালু অ্যাড করতে ব্যবহার করা হয়েছে নানা রকম ম্যাটেরিয়ালের অলংকার।

 

কখন কেমন পাঞ্জাবি

ঈদের সকালে হালকা রঙের পাঞ্জাবি বেশি মানানসই। ঈদের জামাতে বেশি উজ্জ্বল রং বেমানান মনে হবে। হালকা রঙের পাঞ্জাবি সকালের আবহে স্নিগ্ধ ভাব এনে দেবে। ঈদ বিকেলে ও রাতে উজ্জ্বল রঙের পাঞ্জাবি বেছে নিন। কমলা, হালকা সোনালি, হলুদ ও গাঢ় নীল রঙের পাঞ্জাবি পরা যাবে। বিকেলের সূর্যের সোনালি রং কিংবা রাতের আলো-আঁধারি পরিবেশে দারুণ মানিয়ে যাবে এমন পাঞ্জাবি। বেছে নিতে পারেন ম্যাচিং পাঞ্জাবিও। কয়েক বছর ধরেই ট্রেন্ডে রয়েছে ম্যাচিং পোশাক। সব বয়সী সদস্যদের জন্য পাওয়া যাবে একই নকশার পাঞ্জাবি।

 

কোথায় পাবেন, কেমন দাম

বসুন্ধরা সিটি শপিং মল, যমুনা ফিউচার পার্ক, সুবাস্তু আর্কেড, রাপা প্লাজা, পুলিশ প্লাজার মতো বড় বড় মার্কেটের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শোরুমগুলোতে পাওয়া যাবে ঈদের নতুন পাঞ্জাবি। একটু কম দামে ভালো মানের পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে নিউমার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেট, বেইলি রোড, মিরপুর শাহ আলী মার্কেটসহ ছোট-বড় মার্কেটগুলোতে। মিরপুর, নিউমার্কেট, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, বঙ্গবাজারে আলাদা পাঞ্জাবির মার্কেট রয়েছে। ব্র্যান্ডের পাঞ্জাবি পাবেন এক হাজার ৩০০ টাকা থেকে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। ব্র্যান্ডের বাইরের পাঞ্জাবির দাম পড়বে ৩০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে।

 

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ