<p style="text-align:justify">বনের এদিকটা একদম নির্জন। এতটাই যে পাখির কিচিরমিচিরও শোনা যায় না। এমন না যে গাছপালা নেই, বিশাল বিশাল গাছ, ডালপালাও বেশ ছড়ানো অনেক জায়গাজুড়ে, তবে এ সময় গাছের ডালপালায় পাতা খুব একটা থাকে না। </p> <p style="text-align:justify">শীত এসে পড়েছে, তাই পাতা ঝরে পড়ছে ডাল থেকে। পাতা ঝরার দিনগুলোতে কী যে আনন্দ নিয়ে পাতা কুড়ায় ছোট মেয়েটা! পরনে একটা কালো ময়লা ফুলহাতা গেঞ্জি আর হাঁটু পর্যন্ত গোটানো লাল পাজামা। কতকাল মেয়েটার চুলে তেল পড়েনি, কে জানে! আপনমনে পাতা কুড়িয়ে যাচ্ছে সে। সারা দিন পাতা কুড়িয়ে বিকেলে বাড়ি ফেরে।</p> <p style="text-align:justify">বনের মাঝখান দিয়ে সোজা পিচঢালা রাস্তাটা চলে গেছে নদীর পারে। অনেকেই ওখানে এ সময় পিকনিক করতে আসে। বড় বড় বাস নিয়ে যেমন আসে কিছু মানুষ, তেমনি ছোট মাইক্রোবাসে পারিবারিক পিকনিকেও আসে অনেকেই। তেমনি এক পরিবার আজ এসেছে। তাদের দুজন সদস্য হেঁটে হেঁটে আসে বনের এই শেষ সীমান্তে, যেখানে আপনমনে পাতা কুড়িয়ে যাচ্ছে ছোট মেয়েটা। দুজনের মধ্যে একজন বিশ-একুশ বছরের তরুণী, অন্যজন আট-নয় বছরের ছেলে। সম্পর্কে ওরা ফুপি আর ভাতিজা। দুজনেই দূর থেকে পাতা কুড়ানো মেয়েটাকে দেখছে। কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই মেয়েটার।</p> <p style="text-align:justify">শীত শীত এই সময়টায় পাতা একদম বিছিয়ে থাকে বনের ভেতর। খস খস শব্দ করে পাতা মাড়িয়ে দুজন মেয়েটার কাছে চলে আসে। মেয়েটা কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে খানিকক্ষণ। পরে আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।</p> <p style="text-align:justify">তোমার কী নাম? ফুপি একসময় বলল মেয়েটাকে। মেয়েটা পাতা কুড়ানো বাদ দিয়ে তাকিয়ে থাকে দুজনের দিকে।</p> <p style="text-align:justify">কী নাম তোমার? ফুপি দ্বিতীয়বার বলল।</p> <p style="text-align:justify">পাতা। ছোট করে উত্তর দিল মেয়েটা।</p> <p style="text-align:justify">ছেলেটা বলল, ফুপি পাতা বলল কেন? তুমি ওকে তো নাম জিজ্ঞেস করেছ। কী করছে সেটা জানতে চাওনি।</p> <p style="text-align:justify">ওর নাম পাতা বলেই তো ওটা বলল।</p> <p style="text-align:justify">ও আচ্ছা। ফুপির উত্তর শুনে বেশ বিজ্ঞের মতো বলল।</p> <p style="text-align:justify">ওরা কোথায় থাকে ফুপি? প্রশ্নটা এই নিয়ে দ্বিতীয়বার করল টুকু।</p> <p style="text-align:justify">তুমি জিজ্ঞেস করো পাতাকে।</p> <p style="text-align:justify">এবার কিছুটা যেন লজ্জা পেল ছেলেটা। ফুপির কাছে এসে আস্তে করে বলল, তুমি বলো না ওকে, কোথায় থাকে।</p> <p style="text-align:justify">এই পাতা, তুমি কোথায় থাকো? আমার ভাতিজা টুকু জানতে চাচ্ছে, ফুপি বলল।</p> <p style="text-align:justify">টুকু যেন এবার লজ্জায় একেবারে গলেই যাবে। ফুপির পেছনে গিয়ে দাঁড়াল, যেন পাতা ওকে দেখতে না পায়।</p> <p style="text-align:justify">বুঝতে পেরে ফুপি বলল, ঠিক আছে আমিই জিজ্ঞেস করছি। টুকু তবু কিছুতেই সামনে আসতে চাচ্ছে না। বিষয়টায় বেশ মজাই পাচ্ছে পাতা। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে ফুপি-ভাতিজার দিকে।</p> <p style="text-align:justify">পাতা আমার কাছে আসো তো। ফুপি একসময় বলল।</p> <p style="text-align:justify">পাতা ওর ছালার ব্যাগ দূরে রেখে ফুপির কাছে এলো।</p> <p style="text-align:justify">তোমরা কোথায় থাকো? ফুপি বলল।</p> <p style="text-align:justify">ওই দূরে। পাতা বলল।</p> <p style="text-align:justify">বনের ভেতরেই?</p> <p style="text-align:justify">পাতা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে।</p> <p style="text-align:justify">বাড়িতে কে আছে?</p> <p style="text-align:justify">বাবা-মায়।</p> <p style="text-align:justify">আর কেউ নেই?</p> <p style="text-align:justify">না।</p> <p style="text-align:justify">বাবা কী করে?</p> <p style="text-align:justify">মাছ ধরে।</p> <p style="text-align:justify">মা কিছু করে?</p> <p style="text-align:justify">বনের সাবে গো বাসায় কাম করে।</p> <p style="text-align:justify">এই পাতা কেন কুড়াও?</p> <p style="text-align:justify">পাতা দিয়া মায় চুলায় ভাত রান্না করে।</p> <p style="text-align:justify">ফুপি যা বোঝার বুঝে ফেলে। আর কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করল না।</p> <p style="text-align:justify">আজকে কতগুলো পাতা কুড়িয়েছ, ছালা ভরেছে?</p> <p style="text-align:justify">না, ভরে নাই।</p> <p style="text-align:justify">কতক্ষণ কুড়াবা?</p> <p style="text-align:justify">ছালা ভরলে যামু গা।</p> <p style="text-align:justify">চলো তুমি আজ আমাদের মেহমান। আমাদের সঙ্গে পিকনিক খাবা, ঠিক আছে?</p> <p style="text-align:justify">ছালা ভরে নাই তো। পাতা আস্তে করে বলল।</p> <p style="text-align:justify">ফুপির বুকটা কেমন যেন হু হু করে উঠল। বনের ভেতর যেমন হু হু করে হাওয়া বইতে থাকে, পাতা ঝরে পড়ে, তেমন করে হু হু করে উঠল এই ছোট্ট মেয়েটার কথা শুনে। ছালা না ভরলে চুলায় আগুন জ্বালাতে পারবে না ওর মা। রান্না হবে না। না খেয়ে থাকতে হবে—এত সব ভাবনা এসে জড়ো হতে থাকে ফুপির মনে। তাই বলে ফেলল, তোমাদের আজ রান্না করা লাগবে না। দুপুর আর রাতের খাবার দিয়ে দেব। চলো আমাদের সঙ্গে। পাতার হাত ধরে হাঁটা শুরু করল ফুপি। পেছন পেছন বেশ আনন্দ নিয়ে টুকু হাঁটতে থাকে।</p> <p style="text-align:justify">প্রথমে একটা চিকেন বার্গার দিল। মেয়েটা বেশ গোগ্রাসেই খেল। খাওয়া শেষ হতেই ফুপি বলল, আরেকটা দিই?</p> <p style="text-align:justify">পাতা বলল, মায়রে দিমু।</p> <p style="text-align:justify">তোমার মাকে আলাদা দেব। তুমি আরেকটা খাও?</p> <p style="text-align:justify">না, খিদা নাই।</p> <p style="text-align:justify">এরপর টুকু ওদের গাড়ির ভেতর থেকে অনেকগুলো চকোলেট আর চিপসের প্যাকেট দিল পাতাকে।</p> <p style="text-align:justify">দুপুর পর্যন্ত পাতা ওদের সঙ্গে থাকল। বিরিয়ানি, জুস খেল। খাবার শেষ করে চলে যেতে চাইলে টুকুর ফুপি তিন প্যাকেট বিরিয়ানি, তিনটা জুস আর কয়েকটা বার্গার দিল পাতাকে; বাড়িতে নেওয়ার জন্য। পাতা দুই হাতে খাবারগুলো নিয়ে নদীর পার থেকে ছোট ছোট পা ফেলে বনের দিকে হাঁটা শুরু করে।</p> <p style="text-align:justify">শেষ বিকেলের মিষ্টি রোদের বিদায় মুহূর্তে টুকুরা যখন ফিরছিল, তখন দেখতে পায় পাতাকে। দুপুরের সেই জায়গায় পাতা কুড়াচ্ছে। পাশে খাবারের প্যাকেটগুলো রাখা। গাড়ি থামিয়ে টুকুর ফুপি জিজ্ঞেস করে, তুমি বাড়ি যাবা না?</p> <p style="text-align:justify">ছালা ভরে নাই। ছোট করে উত্তর।</p> <p style="text-align:justify">টুকুর বাবা গাড়ি থেকে নেমে পাঁচ শ টাকার দুইটা নোট দিল, সোয়েটার কেনার জন্য। পাতা কিছুতেই নেবে না। ফুপি শেষে জোর করে পাতার হাতে নোট দুইটা গুঁজে দেয়। ঠিক তখনই পাতা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। টুকুর মা বুঝতে পারল ওকে মায়া করে কেউ কখনো এত কিছু দেয়নি হয়তো।</p> <p style="text-align:justify">টুকু অবাক হয়ে একবার বাবার দিকে, একবার মায়ের দিকে, আরেকবার ফুপির দিকে তাকায়। সবার চোখ ছলছল করছে। পরে গাড়িতে উঠে পড়ে সবাই। গাড়িটা বনের মাঝখানের পিচঢালা পথ দিয়ে চলতে থাকে, বনকে পেছনে ফেলে।</p> <p style="text-align:justify">কালো ফুলহাতা ময়লা গেঞ্জি আর হাঁটু পর্যন্ত গোটানো লাল পাজামা পরা পাতা দাঁড়িয়ে থাকে অপলক।</p> <p style="text-align:justify">দূরে তখনো হয়তো সন্ধ্যার আগমনী নির্জনতা ভেঙে ডালপালা থেকে টুপ করে খসে পড়ছে দু-একটা পাতা।</p>