<p>ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে খুশি করতেই ওই আসনের বিভিন্ন স্থাপনার নাম পরিবর্তন করতেন তার ঘনিষ্ঠজনরা। এর থেকে বাদ যায়নি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মসজিদও।</p> <p>শুরুর দিকে কসবায় সাবেক আইনমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল কায়সা ভূঁইয়া জীবন। অবশ্য কয়েক বছর ধরে মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) শফিকুল আলম সোহাগ ও পিএ মো. আলাউদ্দিন বাবু কসবার সব কিছুতে নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন। এর মধ্যে আলাউদ্দিন বাবুর প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। আখাউড়াতে ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন সাবেক পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. তাকজিল খলিফা কাজল। মূলত আখাউড়ার সব কিছুতে একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করেন কাজল। ওই ঘনিষ্ঠজনরাই আনিসুল হককে খুশি করতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম তার পরিবারের সদস্যদের নামে পরিবর্তন করতে শুরু করেন।</p> <p>আখাউড়ায় ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি মসজিদের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় আনিসুল হকের প্রয়াত স্ত্রী নুর আমাতুল্লাহ হকের নামে। এ নিয়ে মুসল্লিদের ঘোর আপত্তি থাকলেও পাত্তা দেননি মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন মো. তাকজিল খলিফা কাজল। বরং মসজিদটিকে পৌরসভার অধীন উল্লেখ করে মন্ত্রীর কাজল নিজেই বনে যান পরিচালনা কমিটির সভাপতি। পুরনো মসজিদ ভেঙে শুরু করেন নতুন মসজিদের নির্মাণকাজ। </p> <p>৫ আগস্টে সরকার পতনের পরপরই মুসল্লিরা পরিকল্পনা করতে থাকেন মসজিদটিকে আগের নামে ফিরিয়ে আনার। সেই পরিপ্রেক্ষিতে মসজিদ নাম পরিবর্তন করে ‘বায়তুল আমান কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ’ নামে ব্যানার সাঁটিয়ে দেন তারা। যার পূর্বে নাম ছিল ‘নুর আমাতুল্লাহ হক পৌর মসজিদ।’ </p> <p>এলাকাবাসীর অভিযোগ, সাবেক আইনমন্ত্রীর প্রয়াত স্ত্রীর নাম নুর আমাতুল্লাহ হক। মূলত আনিসুল হককে খুশি করতেই তার স্ত্রীর নামে মসজিদের নাম করা হয়। এতে মুসল্লি বা এলাকার মানুষের কোনো ধরনের মতামত নেওয়া হয়নি। </p> <p>মসজিদ কমিটির নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘এটি পৌর এলাকার প্রধান মসজিদ হিসেবেই বিবেচিত। নাম পরিবর্তন থেকে শুরু করে মসজিদের কাজের ধীরগতি নিয়ে সবার মাঝেই ক্ষোভ ছিল। মুসল্লিদের সম্মতি নিয়ে এখন মসজিদটির নাম পরিবর্তন করে আগের নামে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। মসজিদের উন্নয়নে অনেকেই আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এসেছেন।’</p> <p>কসবা উপজেলার পানিয়ারূপ গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘পানিয়ারূপ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়’। ১৯৪৭ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাবা বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতাদের মধ্যে অন্যতম একজন সিরাজুল হক। প্রথম থেকেই বিদ্যালয়টি এই নামেই চলে আসছিল। কিন্তু ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে বিদ্যালয়টির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় সিরাজুল হকের নামে। পরিবর্তিত নাম হয় ‘সিরাজুল হক উচ্চ বিদ্যালয়’। পরে ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানটি ‘সিরাজুল হক স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ নামে কার্যকর হয়। যদিও সিরাজুল হক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার সময় নিজের নামে করেননি। এমনকি তার জীবদ্দশায়ও সেটি করতে চেষ্টা করেননি।</p> <p>শুধু এ বিদ্যালয়ই নয়, সাবেক আইনমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য আনিসুল হকের ১০ বছরের শাসনামলে নামের খড়গে পড়েছে আরো অনেক প্রতিষ্ঠান। মন্ত্রীকে খুশি করতে গিয়ে এসব স্থাপনার নাম পরিবর্তন করায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছিল। কিন্তু আনিসুল হকের ঘনিষ্ঠজনরা বিষয়টি তাকে ভিন্নভাবে বোঝাতেন। বলা হতো, এলাকার মানুষই চাচ্ছে উনার পরিবারের মানুষের নামে যেন কিছু স্মৃতি থাকে। </p> <p>নাম পরিবর্তনে তালিকায় যুক্ত হয়েছিল কসবা পৌর এলাকার প্রধান সড়কে অবস্থিত ‘দানবীর মহেশ চন্দ্র সেতু’। একটি বেসরকারি ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় সেতুটিকে আধুনিকায়ন করে এটির নাম রাখা হয় সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হকের বাবা সিরাজুল হকের নামে।</p> <p>আখাউড়া পৌর এলাকায় অবস্থিত নাছরীন নবী পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়কে ২০১১ সালে স্কুল অ্যান্ড কলেজে রূপান্তরিত করা হয়। ২০১৮ সালে বিদ্যালয় থেকে কলেজ শাখা আলাদা করে নাম দেওয়া হয় জাহানারা হক মহিলা কলেজ। জাহানারা হক হলেন সাবেক আইনমন্ত্রীর প্রয়াত মা। কলেজ শাখার জন্য বিদ্যালয় থেকে জমি ও টাকা নেওয়া হয়। </p> <p>এদিকে ওই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা বনে যান তাকজিল খলিফা কাজল এবং যোগ্যতা না থাকা সত্বেও তার স্ত্রীকে বানিয়ে দেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। আনিসুল হককে করা হয় কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি। যদিও বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে তাদের কারো কর্তৃত্ব নেই। সরকারি নির্দেশনা মতে আনিসুল হক আর সভাপতি নন। কাজলের স্ত্রী তার পদ থেকে ইতিমধ্যেই সরে দাঁড়িয়েছেন। </p> <p>বিতর্ক আছে আনিসুল হকের বাবার নামে আখাউড়া পৌর এলাকার রাধানগর কলেজ পাড়ায় প্রতিষ্ঠিত সিরাজুল হক উচ্চ বিদ্যালয় নিয়েও। অভিযোগ রয়েছে, যে জায়গাটিতে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয় সেটি মূলত গরুর বাজার। এ ছাড়া সেখানে কিছু ব্যক্তিমালিকানা জায়গাও রয়েছে। পৌরসভা প্রতিষ্ঠার আগে এটি ছিল দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের আওতাধীন। পরিষদের ক্রয়কৃত জায়গা বিধায় এটি পৌরসভাকে দিতে চাচ্ছিল না কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় সেখানে জোর করেই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়।</p> <p>কসবা উপজেলার বায়েক ইউনিয়নেও রয়েছে মন্ত্রীর বাবার নামে বিদ্যালয়। যেটির নাম সোনার বাংলা সিরাজুল হক উচ্চ বিদ্যালয়। তবে প্রায় দুই যুগ আগে প্রতিষ্ঠার সময় এটির নাম ছিল সোনার বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়। দ্রুত এমপিওভুক্তির প্রলোভন দেখি নাম পরিবর্তন করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। </p> <p>সরকারের পতনের গ্রেপ্তার হন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ থাকা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার সময় গ্রেপ্তার হন তিনি। বিভিন্ন মামলায় সাবেক আইনমন্ত্রীকে রিমান্ডে নেওয়া হয়। এখনো তিনি ঢাকায় কারাগারে আছেন।</p>