নদীর কিনারে সারি সারি নৌকা, তারই একটিতে বসে আছেন ঝুমুর বেগম। ছোট্ট শিশু মুন্নি নায়ের নৌকার বৈঠায় হাত রেখে আনমনা চোখে তাকিয়ে রয়েছে। চোখের সামনে শান্ত নদী। কিন্তু বুকের ভেতর কষ্ট।
ঝলমলে আকাশে খাঁ খাঁ রোদ্দুর। বাজারে ঈদের আমেজ। কিন্তু তাদের ভাসমান এই জীবনে সেই আমেজের ছিটেফোঁটাও নেই।
‘গাঙে মাছ নাই, হাতে টাহা (টাকা) নাই।
গরিবগো (গরিব) আবার কিয়ের (কিসের) ঈদ—এই কথাই আক্ষেপের সুরে বেড়িয়ে এলো ঝুমুর বেগমের মুখ থেকে। তার স্বামী শহীদ হাওলাদার চুপচাপ নৌকার ছইয়ে শুয়ে আছেন। নদীতে মাছ ধরে সংসার চলত, এখন নদী যেন অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। নদীতে তেমন মাছ নেই, যা পাওয়া যায় তা দিয়ে কোনো মতে সংসার চলাই দায়।
আরো পড়ুন
বাসে উঠে যাত্রীদের খোঁজখবর নিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ ইউনিয়ন ঘেঁষা বুড়াগৌরাঙ্গ নদীর তীরে মান্তা পল্লীতে থাকেন ঝুমুর-শহীদ দম্পতি। ঝুমুর বেগমের পাশের নৌকাটি সোহেল ভূঁইয়ার। তার নৌকায় তাকাতেই আরেক দৃশ্য। ছোট্ট মেয়ে জমেলা নৌকার সামনেই বসা। তীরের শিশুদের দিকে তাকিয়ে আছে।
আরেক বোন মিমিলা নৌকার পেছনের দিকে বসা। নৌকার কাছে যেতেই সোহেল বললেন, ‘নদীতে মাছ নাই। অনেক কষ্টে ধারদেনা করে বাচ্চার পোশাক কিনেছি। নিজেরা অহনও (এখনও) লই নাই। বাজারে গেছিলাম দুই জনার কাপর চোপর কিনতে, দাম কইল দুই হাজার টাকার বেশি। এত টাকা কই পাব?’ হতাশ কণ্ঠে বলেন তিনি।
এই হতাশার গল্প শুধু এই দুই পরিবারেরই নয়। ঈদকে সামনে রেখে মান্তা পল্লীর অধিকাংশ পরিবারের উৎসবের গল্পে এমন করুণ সুর বাজছে। মান্তা সম্প্রদায়ের লোকজনের ভাষ্য মতে, গাঙে (নদীতে) তেমন মাছ নেই, ঈদের আনন্দ নেই। ঈদ মানেই তাদের কাছে শুধুই বিলাসিতা। নদীই মান্তা সম্প্রদায়ের জীবন। কিন্তু এবার ঈদের আগে সেই নদীর বুকে নৌকাগুলোতে কেবল হতাশা আর দারিদ্র্যের ছাপ।
আরো পড়ুন
জাতিসংঘ পার্ক থেকে বোমাসদৃশ তিনটি বস্তু উদ্ধার
ঝুমুর বেগমের মতো মায়েরা সন্তানদের নতুন জামা দিতে পারেননি, পুরনো কাপড় ধুয়ে ঈদের দিন কাটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সোহেল মাঝির মতো বাবারা ঈদের বাজারে গিয়ে সন্তানের জন্য কিছু কিনলেও নিজেদের জন্য কিনতে পারেননি। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে ফিরে এসেছেন শূন্য হাতে। শহীদ হাওলাদারের মতো জেলেরা কাজ হারিয়ে নৌকার ছইয়ে শুয়ে থাকেন। দিন পার করেন দুশ্চিন্তায়। গ্রামের বাজারে ঈদের বাজার জমজমাট। কিন্তু মান্তা পল্লীতে নেই কোনো খুশির ঝলকানি। নেই ভালো খাবার, নেই নতুন পোশাকের তেমন আয়োজন। ঈদের চাঁদ উঠলেও হয়তো তাদের ঘরে আলো আসবে।
মান্তা সম্প্রদায়ের লোকজন জানান, তাদের ঈদ নির্ভর করে নদীতে ভাসা মাছের ওপর। শেষ মুহূর্তে যদি ভাল মাছ ধরা পরে তবেই হবে ঈদ। আর মাছ না পেলে এবারের ঈদের আনন্দ আধরাই থেকে যাবে তাদের জীবনে। এ বিষয়ে কথা হয় মান্তা শিশুদের পড়াশোনা করানো শিশু বাগান স্কুলের শিক্ষক আইয়ুব খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে নতুন দিনের স্বপ্ন। কিন্তু মান্তা সম্প্রদায়ের কাছে ঈদ মানে শুধুই আরেকটি দিন, যেখানে নতুন পোশাক বা ভালো খাবারের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাগ্যের সহায়তা।’
ভাগ্যের এই খেলায় তারা বড্ড অসহায়, তবুও আশায় বুক বাঁধে—হয়তো এবার ঈদের দিনটি একটু আলাদা হবে মান্তা সম্প্রদায়ের জীবনে। শেষ মুহূর্তে ভাল মাছ মিললেই শিশুদের জন্য আসতে পারে নতুন জামা, পরিবারগুলোর পাতে উঠতে পারে একটু ভাল খাবার। ঈদের দিনে নদীর জলেও প্রতিফলিত হতে পারে তাদের হাসির ঝিলিক।
মান্তা শিশুদের শিশুদের শিশুবাগান বিদ্যালয়ের শিক্ষক আইয়ুব খান বলেন- মান্তা সম্প্রদায় শতভাগ মুসলমান হওয়া সত্তে¡ও তাদের ঈদ একটা বিলাসিতা মাত্র। আসলে এই সম্প্রদায়ের যারা ঢাঙ্গা এবং জলে ভাসমান অবস্থায় যারা রয়েছেন তারা স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে ইচ্ছে হয়। তবে যারা জলে ভাসমান রয়েছে তারা ঈদের নামাজ শেষে আবার নৌকায় ফিরে যায়। আসলে তাদের যাওয়ার তেমন কোন জায়গা নেই। চলতি সময়ে নদীতে তেমন মাছ ধরা পড়ছে না । ফলে তাদের অধিকাংশ পরিবার ঈদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
আরো পড়ুন
ভয়াবহ ভূমিকম্পের সময় রাস্তায় সন্তানের জন্ম : ভিডিও
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইকবাল হাসান বলেন, ‘মান্তা সম্প্রদায়ের জীবনসংগ্রাম সম্পর্কে আমরা সচেতন। সরকার ও প্রশাসন তাদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে। ঈদ যেন সবার জন্য আনন্দ নিয়ে আসে, সে জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। মান্তা পল্লীর জেলেদের জন্য বিশেষ সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করব।
তিনি আরো বলেন, ‘নদীই তাদের জীবন, তাই টেকসই সমাধানের জন্য নদী ও জলজ সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করছি। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয়ে ওই সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। তাদের শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাও আমাদের লক্ষ্য। ঈদের আনন্দ সবার কাছে পৌঁছে দিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা যথাযথ উদ্যোগ নিচ্ছি, ভবিষ্যতেও নেব।’