সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষায় কর্মরত একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বলছে, সুন্দরবনের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। তবে সেটি সুন্দরবনের ক্ষতি করে নয়। সাম্প্রতিক সময়ে বন কর্মকর্তা-রক্ষীদের ঘুষ আদায়ে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে সুন্দরবনের বনজসম্পদ আহরণ। গোলপাতা আহরণ মৌসুমে সুন্দরবনের গোলঝাড় থেকে পাতা কাটার সময় মাঝপাতার (মাঝের কচি পাতা) পাশে ঝাড় রক্ষায় একটি পূর্ণাঙ্গ পাতা (ঠ্যাকপাতা) রেখে আহরণের নিয়ম রয়েছে) কিন্তু সেই ঠ্যাকপাতা না রেখে ঝাড়ের সব পাতা কাটা হয়েছে। পাশাপাশি বাওয়ালিরা নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে অতিরিক্ত গোলপাতা নৌকায় করে আনছেন।
সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী সাংবাদিক শুভ্র শচীন বলেন, ‘উপকূলের প্রান্তিক মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস সুন্দরবন। এই বনকে ঘিরে কোনও না কোনওভাবে প্রায় দেড় লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন। নিয়ম মেনে সম্পদ আহরণ করা না হলে বনের ইকোসিস্টেমের ক্ষতি হবে।’
সাংবাদিক শুভ্র শচীন বলেন, ‘গোলপাতা আহরণ মৌসুমে নানা অপরাধের ঘটনা ঘটছে সুন্দরবনে। ৫০০ মণ ধারণক্ষমতার একেকটি নৌকায় বর্ধিত অংশ জোড়া দিয়ে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার মণ গোলপাতা বোঝাই করে আনা হচ্ছে। গোলপাতার আড়ালে বন থেকে আনা হচ্ছে বিভিন্ন গাছের খণ্ড। এভাবে ঝাড় ধ্বংস করে পাতা কাটার ফলে হুমকির মুখে পড়েছে গোলবন। এতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়ছে সুন্দরবন।’
তবে সুন্দরবনের বাওয়ালি-মহাজনরা বলছেন, সুন্দরবনের বনজসম্পদ আহরণে পদে পদে ঘুষ লাগায় ক্ষতি পোষাতে নৌকায় তারা বেশি করে গোলপাতা ও কাঠ বোঝাই করতে বাধ্য হন। বন কর্মকর্তা-রক্ষীদের টাকা না দিলে বন্যপ্রাণী হত্যা ও পাচার মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। এসবের পরও জীবিকার তাগিদে পুরানো পেশা টিকিয়ে রেখেছেন কেউ কেউ।
উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, অবস্থানগত কারণে খুলনার নয়টি উপজেলার মধ্যে সর্বদক্ষিণের সুন্দরবনঘেরা সমুদ্র উপকূলবর্তী উপজেলা কয়রার বেশিরভাগ মানুষই সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। এ জেলার সুন্দরবন প্রভাবিত অন্য উপজেলাটি হলো দাকোপ। এ উপজেলা দুটির সুন্দরবন-লাগোয়া গ্রামগুলোর মানুষরা মাছ-কাঁকড়া ধরা, গোলপাতা কাটা ও মধু আহরণের কাজ করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইতোমধ্যে গোলপাতা ভর্তি নৌকা সুন্দরবনের লোকালয়ে আসতে শুরু করেছে। মৌসুমের প্রথম দফায় গোলপাতা কেটে লোকালয়ে ফিরেছেন তারা।
সরেজমিনে সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রার শাকবাড়িয়া ও কয়রা নদীর পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, নদীর পাড়ে বাঁধা রয়েছে গোলপাতাবোঝাই বড় বড় নৌকা। বাওয়ালিরা নদীর বেড়িবাঁধের গা ঘেঁষে স্তুপ আকারে কেটে আনা গোলপাতা সাজিয়ে রাখছেন। এসব নৌকায় ৫০০ মণ গোলপাতা বোঝাইয়ের মাত্রা বেঁধে দেওয়া হলেও একেকটি নৌকায় ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার মণ পাতা বোঝাই করা। নৌকার চারপাশে গাছের বড় বড় গুঁড়ি ঝুলিয়ে রাখা। গোলপাতার নিচে রয়েছে সুন্দরী, পশুরসহ মূল্যবান গাছের খণ্ড।
নৌকা থেকে গোলপাতা নামানোর ফাঁকে কয়েকজন বাওয়ালি বলেন, এখন আর আগের মতো গোলপাতায় ভালো ব্যবসা নেই। বনদস্যুদের চাঁদা আর সরকারি রাজস্বের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টাকা দিতে হয় বন বিভাগের কর্মকর্তাদের।
নিয়মবর্হিভূতভাবে গোলপাতা আহরণের সুযোগ দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন সুন্দরবনের বেশ কয়েকজন স্টেশন কর্মকর্তা, কূপ কর্মকর্তা, সহযোগী কূপ কর্মকর্তা ও বনরক্ষী। চলতি গোলপাতা কাটার মৌসুমে বাওয়ালিদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধার জন্য এসব কর্মকর্তা নৌকাপ্রতি আদায় করেছেন ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এতে লোকসানে পড়ছেন তারা।
পাশাপাশি রয়েছে জীবনের ঝুঁকি। গোলপাতার ঝাড়ের মধ্যে বাঘ লুকিয়ে থাকার আশঙ্কা থাকে। এরপরও জীবিকার তাগিদে বনে এ পাতা কাটতে যেতে হয় জানিয়ে তারা বলেন, লোকালয়ে আনার পর এক কাউন (১৬৮০টিতে এক কাউন) ভালো গোলপাতা ৩২০০ টাকা বিক্রি হয়। আবদুস সালাম নামে কয়রা এলাকার একজন বাওয়ালি বলেন, ৫০০ মণ ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি গোলপাতার নৌকায় সাকল্যে সরকারি রাজস্ব আসে ১২ হাজার টাকার মতো।
বন অফিস থেকে অনুমতি নেওয়ার সময় বন কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত টাকা বখশিশ, এরপর কুপে তল্লাশি, ঘের দেওয়া, ঘাটে তল্লাশি, সিটি কাটানোসহ (পারমিট হস্তান্তর) বিভিন্ন অজুহাতে সবমিলিয়ে আরও ৩০-৪০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। তারপরে রয়েছে বনদস্যুদের চাঁদা। সুন্দরবনজুড়ে বেড়েছে বনদস্যুদের উৎপাত। সালাম বলেন, এসব টাকা দিতে গিয়ে ব্যাপক লোকসানে পড়ছেন তারা। এ কারণে নৌকায় তারা বেশি করে গোলপাতা ও কাঠ বোঝাই করতে বাধ্য হয়েছেন। সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রার মহেশ্বরীপুর এলাকার এলাকার বাওয়ালি-মহাজন মনছুর আলী বলেন, এমনিতেই গোলপাতার চাহিদা কমে গেছে। তারপর পদে পদে এত টাকা দিয়ে ব্যবসা করা যায় না। অনেক বনজীবী লোকসানে পড়ে গোলপাতার ব্যবসা বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন। আমিও আগামী মৌসুমে আর গোলপাতা কাটতে সুন্দরবনে নৌকা ঢুকাব না।
কয়েকজন কূপ কর্মকর্তা, ও বনরক্ষী গোলপাতা আহরণ মৌসুমে বাওয়ালি-মহাজনদের সামান্য সুযোগ করে দিয়ে টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করে বলেছেন, এ টাকা বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন থেকে শুরু করে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ-বাটোয়ারা হয়।
খুলনা রেঞ্জের গোলপাতা কুপ কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন এ বিষয়ে বলেন,‘ বাওয়ালিদের কাছে আমার কোনো দাবিদাওয়া নেই। তারা কিছু দিলে ভালো কথা, না দিলেও কোনো দাবি নেই।’
গোলপাতার আড়ালে গাছ কাটার বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রতিটি গোলপাতা নৌকা পাহারা দেওয়া তো আমার একার পক্ষে সম্ভব হয় না।’
তবে নির্ধারিত রাজস্বের বাইরে বাওয়ালীদের কাছ থেকে ঘুষ আদায়ের বিষয় জানা নেই বলে জানিয়েছেন খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ।
বন সংরক্ষক বলেন, ‘সুন্দরবনকেন্দ্রিক সব ধরনের অপরাধ দমনে সচেষ্ট রয়েছেন বন কর্মকর্তা ও রক্ষীরা। এ ধরনের কাজে বন বিভাগের কারও জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
গোলপাতার সঙ্গে বন থেকে গাছ কাটা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গোলপাতার সঙ্গে বন থেকে কোনো গাছ কাটতে পারবেন না বাওয়ালিরা। এমনকি নৌকায় ঝুল হিসেবেও কাঠ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি।’
বনদস্যুদের তৎপরতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ভুক্তভোগী এমন কোনো বনজীবী এ ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ করেনি। তবে বিভিন্ন জনের মাধ্যমে বনদস্যুদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের কথা শুনেছি।’
এ বিষয়ে কোস্ট গার্ডের পশ্চিম জোনের জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন মেহেদী হাসান বলেন, ‘৫ আগস্টের পর সুন্দরবনসহ সংলগ্ন এলাকা থেকে ২২টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। হান্নান বাহিনীর প্রধান হান্নানকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। পুলিশ-র্যাবসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সহায়তায় তালিকাভুক্ত ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’