বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা বরগুনা, যেখানে প্রকৃতি তার অপার সৌন্দর্যের হাতছানি দিয়ে ডাকছে ভ্রমণপিপাসুদের। অপার সম্ভাবনাময় এ জেলার পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে ছড়িয়ে আছে সমুদ্রের গর্জন, সবুজ বনানীর শীতল পরশ, আর বন্যপ্রাণীর দুরন্তপনা।
বরগুনার তালতলীর আশারচর, সোনাকাটা, টেংরাগিরি সংরক্ষিত বনাঞ্চল, শুভ সন্ধ্যা কিংবা পাথরঘাটার লালদিয়ারচর, হরিণঘাটা, বিহঙ্গ দ্বীপ প্রতিটি স্থানেই প্রকৃতি তার নিজস্ব রূপে ধরা দিয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় বরগুনার এই পর্যটন স্পটগুলোতে বাড়ছে আগ্রহ।
তবে এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে পর্যটন শিল্পকে আরো সমৃদ্ধ করতে প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ।
এসব পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে পরখ করা যাবে বঙ্গোপসাগরের শোঁ শোঁ গর্জন। শ্যামল ছায়ার কোমল পরশ, মায়াবী চিত্রল হরিণের দুরন্তপনা, রাখাইন নৃগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনচিত্র, চরাঞ্চলের মানুষের জীবনযুদ্ধ যে কাউকে মুগ্ধ করে তুলবে। একই স্থানে প্রকৃতির এমন বাহারি সৌন্দর্যের সমাহার খুব কম জায়গায়ই মেলে।
বরগুনায় এমন কিছু স্থান রয়েছে, যেখানে এলে প্রকৃতির এমন নিবিড় সান্নিধ্য পাওয়া যায়।
টেংরাগিরি বনাঞ্চল
বঙ্গোপসাগরের কোলে ঘেঁষে গড়ে ওঠা তালতলী উপজেলার ফকিরহাটে অবস্থিত টেংরাগিরি এক সময় সুন্দরবনের অংশ ছিল। প্রাকৃতিক এই বনকে স্থানীয় লোকজন ‘ফাতরা বন’ হিসেবে চেনে। সুন্দরবনের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় টেংরাগিরি বনাঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি পায় ১৯৬৭ সালে।
.jpg)
তালতলী থেকে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা পর্যন্ত বিস্তৃত এই বনের আয়তন ১৩ হাজার ৬৪৪ একর। ২০১০ সালের ২৪ অক্টোবর ৪ হাজার ৪৮ দশমিক ৫৮ হেক্টর জমি নিয়ে গঠিত হয় টেংরাগিরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। এই বনাঞ্চলের তিন দিকে বঙ্গোপসাগর। বনাঞ্চলের সখিনা বিটে ২০১১ সালে ইকোপার্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়। টেংরাগিরি বনাঞ্চলের অভয়ারণ্যে হরিণ, শূকর, চিতাবাঘ, অজগর, কুমির, বানর, সজারুসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী রয়েছে।
সারি সারি গেওয়া, জাম, ধুন্দল, কেওড়া, সুন্দরী, বাইন, করমচা, বলই কেওয়া, তাল, কাঁকড়া, হেতাল, তাম্বুলকাটা গাছের মধ্যে এখানে ঘুরে বেড়ায় কাঠবিড়ালি, বানর, ডোরাকাটা বাঘসহ হাজার প্রজাতির জীবজন্তু। তালতলীর ২৩টি পল্লীতে বসবাস করছে কয়েক শ বছরের পুরোনো রাখাইন সম্প্রদায়। তাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন, প্রাচীন উপাসনালয়, বুদ্ধমূর্তিগুলো পর্যটকদের ভিন্ন মাত্রার আনন্দ দিবে।
সোনাকাটা ও আশারচর
টেংরাগিরি বনের খুব কাছেই আরেক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাকেন্দ্র সোনাকাটা ও আশারচর চরাঞ্চল। তালতলী সদর থেকে খুব কাছেই বঙ্গোপসাগরের কোলে সোনাকাটা। এর একদিকে টেংরাগিরি বনের সবুজ নৈসর্গ আর অন্যদিকে বিশাল সৈকতের বুকে কান পাতলে শোনা যাবে বঙ্গোপসাগরের কুল কুল ধ্বনি। সোনাকাটায় দেখা যাবে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সৌন্দর্য। বালিহাঁস, গাঙচিল, পানকৌড়িসহ হরেক পাখির কুজনে সব সময় মুখর থাকে আশারচর। তালতলী সদর থেকে আট কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত আশারচরে আছে শুঁটকির সাম্রাজ্য। রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে দূর সাগরের বুকে মাছ ধরতে নামা ছোট ছোট ডিঙিনৌকার টিপটিপ আলোর মিছিল দূর থেকে দেখলে মনে হবে ভাসমান কোনো শহর।
শুভ সন্ধ্যা সি বিচ
টেংরাগিরি বনের খুব কাছেই আরেক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের স্থান শুভ সন্ধ্যা সি বিচ। তালতলী সদর থেকে খুব কাছেই বঙ্গোপসাগরের কোলে শুভ সন্ধ্যা সি বিচ। এর একদিকে টেংরাগিরি বনের সবুজ নৈসর্গ আর অন্যদিকে বিশাল সৈকতের বুকে কান পাতলে শোনা যাবে বঙ্গোপসাগরের গর্জন। এখান থেকে দেখা যাবে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত।
হরিণঘাটা বনাঞ্চল
মায়াবী হরিণের দল বেঁধে ছুটে চলা, চঞ্চল বানর আর বুনো শূকরের অবাধ বিচরণ, পাখির কলরবে সারাক্ষণ মুখর থাকে হরিণঘাটা বনাঞ্চল। পাথরঘাটা উপজেলায় বঙ্গোপসাগরের মোহনায় পায়রা-বিষখালী-বলেশ্বর তিন নদ-নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত হরিণঘাটা। সৃজিত এই বনে হরিণ, বানর, শূকর, কাঠবিড়ালি, মেছো বাঘ, ডোরাকাটা বাঘ, সজারু, উদ, শৃগালসহ অসংখ্য বুনো প্রাণীর বিচরণ। সুন্দরবনের চেয়ে আকৃতিতে বড় প্রজাতির মায়াবী চিত্রল হরিণের বিচরণস্থল হওয়ায় এই বনের নামকরণ হয়েছে হরিণঘাটা। দৃষ্টিনন্দন ঘন বন আর সবুজে ছাওয়া হরিণঘাটা বনের সৌন্দর্যকে আরো আকর্ষণীয় করেছে পাশাপাশি সুবিশাল তিনটি সৈকত লালদিয়া, পদ্মা, লাঠিমারা। এই বনাঞ্চল ৫ হাজার ৬০০ একর আয়তন নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে। ‘লালদিয়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ইকো ট্যুরিজম সুযোগ বৃদ্ধি প্রকল্পের’ আওতায় ৯৫০ মিটার ফুটট্রেল (পায়ে হাঁটার কাঠের ব্রিজ) স্থাপন করা হয়েছে। রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার বেঞ্চ, ঘাটলা ও ইটের রাস্তা। মিঠাপানির জন্য খনন করা হয়েছে পুকুর।
.jpeg)
গোড়া পদ্মা ইকো ফরেস্ট-মোহনা পর্যটন কেন্দ্র
বিষখালী-পায়রা-বলেশ্বর বঙ্গোপসাগরে মিলেছে সোনাতলা এলাকায়। তিন নদনদীর সঙ্গমস্থলে গড়ে উঠেছে প্রাকৃতিক নৈসর্গের আরেক লীলাভূমি গোড়া পদ্মা ইকো ফরেস্ট-মোহনা পর্যটন কেন্দ্র। সৃজিত এই বনভূমির আয়তন ৪ হাজার ৬০০ একর।
সারি সারি কেওড়া, গেওয়া গাছে ছাওয়া এই বনে শূকর, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, মেছো বাঘসহ বিভিন্ন বন্য প্রাণি রয়েছে। রয়েছে একটি পিকনিক স্পট, কয়েকটি গোলঘর, একটি ডাকবাংলো ও পুকুর।
বরগুনা পর্যটন উদ্যোক্তা আরিফুর রহমান বলেন, সাগর, নদী ও সবুজ বনানীর মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা বরগুনা জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর। তবে বরগুনার এই সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে প্রয়োজন যথাযথ পরিকল্পনা ও সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ।
বরগুনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, বরগুনার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পর্যটন সম্ভাবনা উন্নয়নে জেলা প্রশাসন বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে, যা পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় পরিবেশ তৈরি করবে।