<p>‘হোয়াই হ্যাভ ইউ কাম হোয়েন ইভেন ক্রোওস আর অ্যাফরেইড টু ফ্লাই ওভার আওয়ার হাউস।’</p> <p>মওদুদ আহমদের  ‘বাংলাদেশ : কনস্টিটিউশনাল কোয়েস্ট ফর অটোনমি ১৯৫০-১৯৭১’ বইটিতে বঙ্গমাতা বেগম মুজিবের উপরোক্ত উদ্ধৃতি পাওয়া যায়, মওদুদ আহমদের সঙ্গে বেগম মুজিবের প্রথম সাক্ষাতের সময়কার বর্ণনায়। সময় : জানুয়ারি ১৯৬৮ সালের শেষের দিক। পাকিস্তান আর্মির হাতে বঙ্গবন্ধু আটক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়। বলা বাহুল্য, কথাটি বলা হয়েছিল মওদুদ আহমদকে উদ্দেশ করে। যদিও বইটিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ঘটনা বর্ণনায় যা লেখা রয়েছে, তাতে কোনো পাঠক যদি বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী যে আক্ষেপ নিয়ে কথাটি বলেছিলেন তার অন্য মানে খোঁজে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।</p> <p>বইটির লেখক মওদুদ আহমদকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে তাঁর অবদান প্রশ্নসাপেক্ষ। তাঁর দাবি মতে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালে বঙ্গবন্ধু তাঁকে পিএস হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন, বইটি প্রকাশিত হওয়ার পরে জিয়াউর রহমানের বিএনপি আমলে তিনি ছিলেন (বইটির প্রকাশকাল ১৯৭৬—হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটির সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট এবং ১৯৭৯ ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, বাংলাদেশ) ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী, এরশাদ সরকারের জাতীয় পার্টির আমলে তিনি প্রধানমন্ত্রী, পরবর্তী সময়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট আবার ২০০১-এর খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকারে তিনি ছিলেন আইনমন্ত্রী, বর্তমানে বিএনপির সর্বোচ্চ ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্য, তুখোড় আইনজীবী, ভালো লেখক, পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের মেয়ের স্বামী, দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান, চমৎকার ইংরেজি এবং শুদ্ধ বাংলায় কথা বলেন। লেখক মওদুদ আহমদের এই বইটির ৬ ও ৭ নম্বর অধ্যায়ে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ এবং উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের ইতিহাস বিবৃত রয়েছে। বইটিতে বিবৃত আছে, পাকিস্তান সরকার ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি প্রেস নোটের মাধ্যমে প্রথম স্বীকার করে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রের কথা এবং তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্য রয়েছে যে শেখ মুজিবুর রহমান এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত।</p> <p>উল্লেখ্য, ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে লাহোরে বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি পেশ করেন। অতঃপর তিনি ছয় দফার প্রতি জনমত তৈরির জন্য পূর্ব বাংলায় সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করেন এবং জনগণ তাতে অভাবনীয় সাড়া প্রদান করলে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী তাঁকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, ময়মনসিংহ, সিলেট, খুলনা, পাবনা, ফরিদপুরে বারবার গ্রেপ্তার করে এবং তিনি প্রতিবার জামিনে বের হয়ে আসেন। এই ঘটনাগুলো ঘটে ছয় দফা দাবি করার মাত্র তিন মাসের মধ্যে। সর্বশেষ ৮ মে ১৯৬৬ সালে নারায়ণগঞ্জে পাটকল শ্রমিকদের জনসভায় বক্তৃতা শেষে গভীর রাতে দেশ রক্ষা আইনে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়, তারপর ১৭ জানুয়ারি ১৯৬৭ সালে তাঁকে মুক্তি দিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আর্মির হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরবর্তী সময়ে তাঁকেসহ ৩৫ জনকে আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক দেখানো হয়। তবে বঙ্গবন্ধু তাঁকে এ রকম কোনো দুরভিসন্ধিমূলক মামলায় জড়ানো হতে পারে, তা বুঝতে পেরেছিলেন। (সূত্র : কারাগারের রোজনামচা—শেখ মুজিবুর রহমান এবং ডিক্লাসিফাইড ডকুমেন্টস ১৯৫৩-১৯৭৩ ইউএস স্টেটস ডিপার্টমেন্ট)। বইটিতে আরো পাওয়া যায়, সে সময়কার সুপ্রিম কোর্ট বারের পরিস্থিতি, তাঁর বিবৃত মতে আওয়ামী লীগ এর সঙ্গে জড়িত বা বঙ্গবন্ধুকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন এমন আইনজীবীরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছিলেন না আর তাই যখন পাকিস্তান সরকার স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করে, তখন বঙ্গবন্ধুকে আইনি সহায়তা দেওয়ার মতো আইনজীবীও পাওয়া যাচ্ছিল না। সর্বপ্রথম তিনজন তরুণ আইনজীবী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য। তাঁদের একজন লেখক স্বয়ং, অন্য দুজন কে জেড আলম ও সাখাওয়াত হোসেন, যদিও তাঁদের কথা বইয়ের ফুট নোট ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না। যা হোক, তিনি বারবার অধ্যায় দুটিতে বঙ্গবন্ধুকে একজন আপসকামী নেতা হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি লিখেছেন, ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বর থেকে তিনি, আমীর-উল ইসলাম ও ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু প্রতিনিয়ত দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করতেন এবং তিনি যেকোনো মূল্যে আটকাবস্থা থেকে বের হতে চাচ্ছিলেন। কেননা তিনি আতঙ্কিত ছিলেন তাঁর অবর্তমানে পার্টির নেতৃত্ব অন্য কারো হাতে চলে যায় কি না এই ভেবে। অথচ তিনি একবারও লেখেননি সরকারের চরম দমন-পীড়ন, মামলা-হামলা উপেক্ষা করে অক্টোবর ১৯৬৮ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধুকে সর্বসম্মতভাবে পরবর্তী দুই বছরের জন্য আবার পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। আর সেই কাউন্সিলের প্রধান সিদ্ধান্ত ছিল আটক সব বন্দির নিঃশর্ত মুক্তি, যা সে সময়ের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তাই ভাবনার অবকাশ থাকে। কেননা লেখকের স্মৃতিকথার আলোকে বইটি রচিত নয়, তিনি সে সময়ের পত্রিকার রেফারেন্স প্রায়ই নিয়েছেন। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুসহ আরো চারজন আটক নেতাও ছিলেন সেই কমিটিতে। এর মধ্যে একজন তাজউদ্দীন আহমদ, যিনি ছিলেন সেই কমিটির নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। (তথ্য সূত্র : ডিক্লাসিফাইড ডকুমেন্টস ১৯৫৩-১৯৭৩ ইউএস স্টেটস ডিপার্টমেন্ট)</p> <p>১৯৬৮ সালের ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশে যখন আন্দোলন তুঙ্গে; ছাত্র, জনতা, শ্রমিক কারফিউ, ১৪৪ ধারা, হত্যা, বুলেট, গ্রেপ্তার, নির্যাতন উপেক্ষা করে ‘জয় বাংলা’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘জেলের তালা ভাঙ্গবো শেখ মুজিবকে আনবো’, ‘ঢাকা না পিন্ডি, ঢাকা ঢাকা’, ‘পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা বাংলা’, ‘আমার দেশ তোমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত রাজপথ। মৃত্যুর পরোয়া করছে না জনগণ—এ রকম একটি পরিস্থিতিতে মহাপ্রতাপশালী স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ‘স্বাধীনতার অযোগ্য, ক্ষুদ্র অন্তঃকরণের বাঙালি’র মার খেয়ে গোলটেবিল বৈঠকের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দিতে চাইলেন। তবে ১০ বছরের দাম্ভিক স্বৈরশাসক জালিম আইয়ুব কূট চাল দিতে ভুললেন না। তিনি বললেন, ১৯৬৬ সাল থেকে বন্দি-নির্যাতিত বাঙালি নেতা শেখ মুজিবকে তিনি প্যারোলে মুক্তি দেবেন গোলটেবিল বৈঠকে তাঁর উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তার জন্য (তথ্য সূত্র : সিরাজুল আলম খান, স্বাধীনতা, সশস্ত্র সংগ্রাম এবং আগামীর বাংলাদেশ, মাহফুজা খানমের ডায়েরি দ্বিতীয় খণ্ড, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর—আবুল মনসুর আহমদ, ডায়ারিজ অব ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান ১৯৬৬-১৯৭২, বাংলাদেশ কোয়েস্ট ফর ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস—কামাল হোসেন)। লেখক মওদুদ আহমদ সেই প্রস্তাবের পরবর্তী ঘটনা বর্ণনা করছেন এভাবে, ‘মুজিব রিকোয়েস্টেড অ্যাস টু অ্যারেঞ্জ আ প্যারোল ফর হিম অ্যাস হি বিকেইম ইমপ্যাসেন্ট টু জয়েন দ্য কনফারেন্স’ এবং তাঁর ভাষ্য মতে, ১৯৬৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিলেন আইয়ুবের সঙ্গে আপস করে জামিন বা প্যারোল নিয়ে বের হয়ে গোলটেবিল বৈঠকে বসবেন, যদিও এরই মধ্যে একই মামলায় আটক সার্জেন্ট জহুরুল হক খুন হয়েছেন ১৫ তারিখ ক্যান্টনমেন্টে, মওলানা ভাসানী ডাক দিয়েছেন ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে মুজিবকে ছিনিয়ে আনার, রাজশাহী ভার্সিটির প্রক্টর শামসুজ্জোহাকে বেয়নেটে খুঁচিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে, বুকের দুধ পান করানো অবস্থায় গুলিতে মারা গিয়েছেন মা, রক্তে মাখামাখি হয়ে তাঁর পাশে পড়ে আছে শিশু, সরকারি মূল কৌঁসুলি আর ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতি পালিয়ে গিয়েছেন পশ্চিম পাকিস্তান আর ফিরবেন না বলে দিয়েছেন, ট্রাইব্যুনালের বাঙালি বিচারপতিদের বাসা আক্রান্ত হয়েছে, মামলার নথি পর্যন্ত পুড়িয়ে দিয়েছে ক্রুদ্ধ জনতা, প্রাদেশিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের বাসা তছনছ, খান এ সবুরের খুলনার বাসায় আগুন, ভুট্টো, তাজউদ্দীন আহমদকে মুক্তি দিয়েও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না আইয়ুব সরকার। পাকিস্তানি ইতিহাসবিদ পাঞ্জাব ভার্সিটির শিক্ষক মাহবুব হোসেন তাঁর লেখা ‘বেঙ্গলি ন্যাশনালিজম অ্যান্ড অ্যান্টি আইয়ুব মুভমেন্ট’ নামক গবেষণাপত্রে (ভলিউম ৭, নম্বর ২, ডিসেম্বর ২০০৬, পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি, লাহোর) যে হিসাব দিয়েছেন তাতে দেখা যায়, সরকারবিরোধী আন্দোলনে ডিসেম্বরে মৃত্যুর সংখ্যা ১১, এক হাজার ৩৫০ জন গ্রেপ্তার, জানুয়ারিতে মৃত ৫৭ জন, চার হাজার ৭৭০ জন গ্রেপ্তার, আহতের সংখ্যা এক হাজার ৪২৪, ফেব্রুয়ারি ২০ তারিখের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা ৫৭, আহত অগণিত আর লেখকের ভাষ্য মতে, তিনি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশক্রমে জামিন বা প্যারোলের দরখাস্ত লিখছেন। শুধু তা-ই নয়, ২০ তারিখ সন্ধ্যায় তিনি এয়ারপোর্টে অপেক্ষায় ছিলেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি চার্টার্ড বিমানে করে পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তাঁর পরামর্শে বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুকে পরিস্থিতি বোঝাতে সক্ষম হওয়ায় ২০ তারিখে তিনি সব রাজবন্দির মুক্তি ব্যতিরেকে গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেবেন না বলে জানান, যার পরিপ্রেক্ষিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে সরকার বাধ্য হয়, বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দি মুক্তি পান ২২ তারিখে।</p> <p>অথচ ১৫ ফেব্রুয়ারির ব্রিটিশদের তারবার্তায় (সূত্র : ডিক্লাসিফাইড ডকুমেন্টস ১৯৬২-১৯৭১ ইউকে ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিস রিপোর্ট) পাওয়া যায়, বঙ্গবন্ধু প্যারোলের মুক্তির প্রস্তাব বাতিল করেছেন। ড. কামাল হোসেন তাঁর প্রবন্ধ ‘শেখ মুজিব কোয়ালিটি অব লিডারশিপ’ প্রবন্ধে পরিষ্কারভাবে লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর প্রধান কৌঁসুলি আব্দুস সালাম খান যখন আইয়ুবের প্রস্তাবের কথা কোর্টরুমে তাঁকে জানান, তখন বঙ্গবন্ধু ড. কামাল হোসেনকে বলেছিলেন, তিনি তখনই গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেবেন, যখন তিনি এবং আসামির ডকে দাঁড়ানো সবাই মুক্ত হবেন।</p> <p>মওদুদ আহমদের লিখিত বক্তব্য মতে, ব্রিটিশ তারবার্তা ভুল সাক্ষ্য দেয়, বাঙালি/পাকিস্তানি লেখক, ইতিহাসবিদ-গবেষকদের গবেষণা সত্য নয়, ড. কামাল হোসেন মিথ্যা কথা বলেছেন, আমেরিকান তারবার্তা ভুয়া, আইয়ুব খান তাঁর ডায়েরিতে ভুল লিখেছেন, তৎকালীন সংবাদপত্রের সংবাদ সত্য নয়। বইটি পড়ে বিভ্রান্ত পাঠকদের স্মরণে রাখা উচিত মওদুদ আহমদকে প্রথম দেখে বঙ্গমাতার প্রশ্নটি ‘হোয়াই হ্যাভ ইউ কাম হোয়েন ইভেন ক্রোওস আর অ্যাফরেইড টু ফ্লাই ওভার আওয়ার হাউস।’</p> <p>লেখক : ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল, বাংলাদেশ এবং কলামিস্ট</p>